আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ চতুর্দশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ জুলাই, ২০২৩ ● ১-১৫ শ্রাবণ, ১৪৩০

প্রবন্ধ

ওষুধের যথেচ্ছ ব্যবহারে চিকিৎসা সমস্যা

প্রতীশ ভৌমিক


ওষুধ সম্পর্কিত প্রচলিত ধারণা এবং নিজে থেকে ওষুধের ব্যবহার বহুক্ষেত্রেই চিকিৎসা বিভ্রাটের সূচনা করে। অনেক সময়েই হোয়াটসঅ্যাপ মিডিয়ায় লেখা কিছু খবর ভয়ানক বিভ্রান্তি ছড়ায় কিছু ভুল ধারণা সৃষ্টি করে, যা অনুসরণ করে বাস্তব জীবনে বিপজ্জনক সমস্যা তৈরি হয়।

এই প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন যে, সাধারণ মানুষের ওষুধের সম্পর্কে ধারণা অত্যন্ত কম এবং সেইটাই স্বাভাবিক। বহুক্ষেত্রেই উচ্চ রক্তচাপ সংক্রান্ত বিভ্রাটের মূল কারণই হল নিজে থেকে ওষুধ বন্ধ করে দেওয়া। অনেকের ধারণা প্রেসার যখন নিয়ন্ত্রণে তখন ওষুধের আর প্রয়োজন নেই।

যে ব্যক্তির উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি বা ক্রনিক সমস্যায় ভুগছেন তিনি কী খাবেন আর কী খাবেন না তা ঠিক করবেন চিকিৎসকরা। খাওয়ার নুন একটি রাসায়নিক। এই নুন শরীরের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় পদার্থ আবার নিজ দায়িত্বে নুন বা নুনমিশ্রিত হজমিগুলি খাওয়াটাও অতি বিপজ্জনক। এই সমস্ত বিষয়ে বৈজ্ঞানিক ধ্যান ধারণা তৈরি করতে জনগণের মধ্যে ন্যূনতম প্রচার করে সরকার/জনস্বাস্থ্য কর্মীরা। এখন অবশ্য মিডিয়ার মাধ্যমেই আরও প্রচার সম্ভব, কিন্তু সেভাবে রুটিন করে করা হয়নি।

বহু আগে টিউবারকিউলোসিস বা টিবি রোগ নিয়ন্ত্রণে সরকার গ্রামেগঞ্জে ছায়াছবি পরিবেশন করতো। কেবলমাত্র সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য টিবি রোগ সংক্রান্ত প্রচার করে মানুষের মধ্যে সম্যক ধারণা তৈরি করতো। দেখা গেছে বহু সংখ্যক রোগী মাঝে মধ্যে একদিন দু'দিন করে টিবির ওষুধ খেতে ভুলে যাচ্ছিলেন অথচ নিয়মিত ভিটামিন খাচ্ছিলেন। তাতে রোগীর মাধ্যমে মাল্টি ড্রাগ রেজিস্টেন্ট টিবির জীবাণুর জন্ম হয়েছে, যা কিনা সাধারণ টিবির ওষুধে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তাই এখন বাড়ি বাড়ি গিয়ে রোজ টিবির ওষুধ খাওয়ানো শুরু হয়েছে।

আবার দেখা গেছে অনেকে সম্যক জ্ঞান না থাকায় মাথা ধরা, হাঁটু ব্যথা এবং ক্রনিক ব্যথায় নিজে নিজেই ব্যথার ওষুধ খেয়ে থাকেন, ফলত দীর্ঘদিন এই ওষুধ খেয়ে নিজের বিপদ ডেকে আনছেন। অনেকের ধারণা প্যারাসিটামল খেলে কোনো ক্ষতি নেই, তাই প্যারাসিটামল ট্যাবলেটটা বোধহয় প্রয়োজনে রোজই খাওয়া যায়। আসলে তা একদমই অনুচিত। তাই চিকিৎসকের কাছে পরামর্শ নিয়েই ওষুধ খাওয়া প্রয়োজন।

করোনাকালে অবশ্য আমাদের একটা ভালো অভ্যাস তৈরি হয়েছে, সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে খাওয়া তার মধ্যে একটি। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন এতে প্রায় চল্লিশ শতাংশ রোগ সংক্রমণ কমে যায়। এছাড়াও ডিহাইড্রেশন কমাতে ওআরএস খাওয়ার মাঝে খানিকটা করে শুধু জল খাবার প্রয়োজনীয়তা আছে।

অনেকের ধারণা রয়েছে ডেট এক্সপায়ার্ড ওষুধও খাওয়া যায়। একটু গুঁড়ো হয়ে যাওয়া, ভেজা বা রঙচটা ওষুধও খাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে অবশ্যই কিছু আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। একটি ওষুধের এক্সপায়ারি বলতে মূলত ঐ বিশেষ ওষুধটির (সেল্ফ লাইফ) নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত গুনমান ও সঠিক কার্যক্ষমতা বজায় রাখার ক্ষমতা বোঝায়। ফার্মাকোলজির কথায়, A product's “self life” generally means the length of time you can expect a product to look and act as expected and to stay safe for use.

এক একটি মলিকিউল বিশেষ ধর্মের এবং তার গঠন, পি.এইচ. সম্পূর্ণ আলাদা। সেই ওষুধের কার্যকারিতা কেমন থাকছে তার উপর নির্ভর করে অসুখ কমবে কিনা। পাশাপাশি সূর্যের আলোর বা জলীয় বায়ুর সংস্পর্শে ঐ মলিকিউলের বিশেষ কোনো পরিবর্তন যাতে না হয় তার জন্য ওষুধের উপর আবরন ও প্যাকিং অত্যন্ত জরুরি। সেই কারনেই রঙ চটা বা গুঁড়ো হয়ে যাওয়া ওষুধ দেখে সহজে বলা যাবে না যে ঐ ওষুধের গুনমান ও কার্যকারিতা সঠিক বজায় থাকছে কিনা। সঠিক অর্থাৎ Disintegration, Absorption, Metabolism, Distributions, Excretion সঠিক পদ্ধতিতে হচ্ছে কিনা। যদি না হয় তাহলে ওষুধটিতে কোনো কাজ তো হবেই না বরঞ্চ বড় কিছু ক্ষতিই হতে পারে।

প্রসঙ্গত এটাও বলা প্রয়োজন যে এক্সপায়ারি ডেটের পর ওষুধ কেন ব্যবহার করব না। তথ্য বলছে যে, ওষুধের কার্যকারিতার মূল্যায়ন এবং তার পরীক্ষিত ফলাফলের উপর নির্ভর করে জানানো হয় কতদিন পর্যন্ত ঐ ওষুধটি ব্যবহারযোগ্য থাকবে। ঐ সময়ের পর ওষুধের কার্যকারিতা নষ্ট হতে পারে, যথাযত কাজ নাও হতে পারে এমনকি শারীরিক ক্ষতি হতে পারে। পাশাপাশি ওষুধের এক্সপায়ারি ডেট ছাপার থাকে যাতে আইনত ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলো সরকারের কাছে দায়বদ্ধ থাকে। সেই কারণেই প্রস্ততকারী সংস্থা ওষুধের গ্যারান্টি দেয়।

কেউ কেউ বলেন যদি ফিজিক্যালি ওষুধটি ঠিক থাকে তাহলে এক্সপায়ারি ডেট-এর পনেরো বছর বাদেও ওষুধটি ব্যবহার করা যায়। এই প্রসঙ্গে ন্যাশনাল হেল্থ সার্ভিস (ইউ.কে.)-র তথ্য বলছে, ওষুধের এক্সপায়ারি ডেটের পরে ঐ ওষুধটি নিরাপদ বা এফেকটিভ না থাকলে তার জন্য জীবন সংকট হতে পারে। ঐ ওষুধ রোগীর সমস্যা বাড়িয়ে দিতে পারে, অন্যান্য নতুন সমস্যা বা রোগের সৃষ্টি করতে পারে বিশেষত কিডনি বা লিভারের সমস্যা তৈরি করতে পারে। সেই কারণেই বাড়িতে থাকা অব্যবহৃত ওষুধ এক্সপায়ারি ডেটের মধ্যে থাকলেও সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।

কিছু এ্যান্টিবায়োটিক ড্রাইসিরাপ খুলে ফেলার পর বা জলে গুলে নেবার পরে বেশীদিন ব্যবহার করা যায়না এমনকি ওষুধের এক্সপায়ারি ডেটের মধ্যে থাকলেও যায় না। চোখের ওষুধের ক্ষেত্রেও তাই, ব্যবহার করে খুব বেশি দিন ফেলে রাখার পর (বিশেষত চোখের এ্যান্টিবায়োটিক) ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়। যেকোনো মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ ডিসপোস করার জন্য সরকারী নির্দেশ রয়েছে।

সরকারি নিয়মে ওষুধের নির্দিষ্ট এক্সপায়ারি ডেট ল্যাবে পরীক্ষা করে সরকারের ছাড়পত্র নিয়ে মানুষের শরীরে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে নিশ্চিত করা হয়। ওষুধের এক্সপায়ারি ডেট কত বছর হবে তা নির্ভর করবে ওষুধটি মানব/প্রাণী দেহের পক্ষে নিরাপদ কিনা এবং সম্পূর্ণ কার্যকর থাকবে কিনা তার ওপরে। ঐ সময়ের মধ্যে কোনোরকম জীবনের ঝুঁকি এড়াতেই পরীক্ষায় নিশ্চিত হয়ে এক্সপায়ারি ডেট নির্ধারণ করা হয়। অন্যথায় কোনো ক্ষতি হলে কোম্পানিকে আইনি কারণে কোটি কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হয়।

একটি ওষুধের এক্সপায়ারি ডেট ৩১ ডিসেম্বর, ২০২১ - অনেকের মনে হয় ৩১ ডিসেম্বর অবধি ওষুধটি ঠিকঠাক কাজ করবে, আর ঠিক পরের দিনই ঔষধটা হয়ে যাবে অকেজো? এমনকী রাসায়নিক পরিবর্তন ৩১ ডিসেম্বর রাত বারো'টা বেজে এক মিনিটে ঘটবে যাতে পয়লা জানুয়ারি রাত একটায় ওষুধটি শুধু অকেজো নয়, প্রাণঘাতী হয়ে উঠবে?

বলা যেতে পারে যে, ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলো সরাসরি সরকারের কাছে দায়বদ্ধতা পালনের জন্য একটি ওষুধের সমস্ত পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ওষুধগুলোর এক্সপায়ারি ডেট প্রিন্ট করে। ঐ সময়ের মধ্যে কোনোরকম জীবনের ঝুঁকি তৈরি হলে তারা সরকারের কাছে দায়বদ্ধ থাকার অঙ্গীকার করে। এক্সপায়ারি ডেটকে সুচতুরভাবে নিজেদের কাজে লাগিয়ে বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করে। আসলে তা নয়।

তথ্য অনুযায়ী ওষুধ এক্সপায়ার হলে আমাদের কি করা উচিত? FDA বলছে অব্যবহৃত ওষুধ নষ্ট করে দিতে হবে। তারা এই বিষয়ে নানা উপায়ও বাতলেছেন। ভারত সরকারের আইনি নিয়ম অনুযায়ী এই সব এক্সপায়ার্ড মেডিসিনগুলো সমস্ত কোম্পানির নিজস্ব ডিপোতে ফেরত পাঠানো হয় এবং সেখানে ঐ সমস্ত ওষুধ ইনসিওরেন্স কোম্পানির প্রতিনিধিদের সামনে নষ্ট করে দেওয়া হয়। কোম্পানি তারপরে তাদের প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ ফেরত পেয়ে যায়।

ওষুধের সংরক্ষণের জন্য তদারকি করতে হয় ড্রাগ কন্ট্রোল আর ড্রাগ ইন্সপেক্টরদের এভাবেই চেকিং বা নজরদারি করা হয়। সবশেষে একথা বলা অত্যন্ত প্রয়োজন যে প্রতিটি ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে, আবার ভিন্ন ভিন্ন রোগীর ক্ষেত্রে তার ডোজ কী হবে সেটাও চিকিৎসকেরা ঠিক করেন সেই রোগীর শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী। প্রতিটি ওষুধের এলোমেলো ব্যবহার বিষের সমতুল্য।

আমাদের মনে রাখতে হবে ওষুধ হল এমন একটি রাসায়নিক যার ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন করে দায়িত্ব গ্রহণ করেন একজন চিকিৎসক। তাই ওষুধের ব্যবহার চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া করা কখনোই বাঞ্ছনীয় নয়।