আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ চতুর্দশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ জুলাই, ২০২৩ ● ১-১৫ শ্রাবণ, ১৪৩০

সম্পাদকীয়

পঞ্চায়েত নির্বাচন প্রসঙ্গে


২০২৩ সালের পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যেই পরিমাণ অরাজকতা, রিগিং, হিংসা এবং মৃত্যুমিছিল দেখা গেল, তার দায় সম্পূর্ণভাবে তৃণমূল কংগ্রেস এবং রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে নিতে হবে। ৮ই জুন, ২০২৩ রাজ্য নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয় প্রাক্তন মুখ্যসচিব রাজীব সিনহার হাতে। তিনি চেয়ারে বসেই পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিন ঘোষণা করে দেন - ৮ই জুলাই, গোটা রাজ্যে একটি পর্যায়েই এই নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা করা হয়। দায়িত্ব নিয়েই, কোনো পর্যালোচনা না করে, কোনো প্রস্তুতি ছাড়া এই নির্ঘন্ট ঘোষণা করার প্রধান কারণ হল নির্বাচন কমিশনারের মনিব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও শাসকদলের ইচ্ছা অনুযায়ী ভোটপর্ব পরিচালনা করা।

এরপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। লাগাতার হিংসার ঘটনা ঘটেছে। ৫০ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন রাজ্যের গণতান্ত্রিক উৎসব(!) তথা নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে। শুধুমাত্র নির্বাচনের দিন ১৮ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। হাইকোর্টের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ভোটের দিন কার্যত দেখা যায়নি। বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের আধিকারিক প্রেস কনফারেন্স করে জানিয়েছেন যে তাদেরকে স্পর্শকাতর বুথ সম্পর্কিত কোনো তালিকা বা নির্দেশ রাজ্য নির্বাচন কমিশনের তরফে দেওয়া হয়নি। অর্থাৎ সরাসরি মাননীয় হাইকোর্টের নির্দেশকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশন তৃণমূলের হয়ে নির্বাচন করাতে সচেষ্ট ছিল।

সেই চেষ্টার ফল কি হয়েছে তা গোটা দেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছেন ৮ই জুলাই, নির্বাচনের দিনে। ব্যাপক রিগিং, বুথ দখল, বোমা-গুলি, ব্যালট পেপার রাস্তায় ফেলে দেওয়া, ব্যালট বাক্স নিয়ে পালানো ইত্যাদি যাবতীয় অনৈতিক বেআইনি কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে গোটা রাজ্যজুড়ে। একের পর এক মানুষের হত্যা হয়েছে। কিন্তু মাননীয় নির্বাচন কমিশনার কোনো ব্যবস্থা নেননি। কেন্দ্রীয় বাহিনী নামেনি। রাজ্য পুলিশ যেখানে পেরেছ তৃণমূলের হয়ে কাজ করেছে নয়ত নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে।

একবিংশ শতাব্দীর প্রায় এক-চতুর্থাংশ বিগত। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে এখনও ভোটের নামে হানাহানি বন্ধ হল না। লাশের উপর লাশ তার উপরে ক্ষমতার পতাকা পতপত করে উড়ছে। যারা মৃত হলেন, তাদের নামগুলির দিকে তাকালে দেখা যাবে যে তারা অধিকাংশই মুসলমান, তফশিলী জাতি অথবা অন্যান্য প্রান্তিক শ্রেণির মানুষ। কিছু টাকার আশায়, কোনো সরকারী সুবিধার লোভে তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বোড়েতে পরিণত হয়ে তাদেরই সমতুল্য গরীব মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছেন। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলির উপরের নেতৃত্বে সমাজের এই পিছিয়ে পড়া অংশের দেখা নেই। কিন্তু মৃত্যুমিছিলে শুধুই তাদের নাম! এই বাস্তবতা কোনো রাজনৈতিক দলই স্বীকার করতে চায় না। তবু, রাজ্যের রাজনীতিতে উচ্চবর্ণের আধিপত্য যুগযুগ ধরে চলে এলেও তা নিয়ে বিতর্কের পরিসর সীমিত, আলোচনা প্রায় নেই।

এই বাস্তবতার উপরে নতুন উপাদান নিয়ে এসেছে তৃণমূল কংগ্রেস। দলটি যে আপাদমস্তক দুর্বৃত্তদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এই নিয়ে মানুষের মনে কোনো সন্দেহ নেই। ২০১১ সাল থেকে গোটা রাজ্যে যেই পরিমাণ দুর্নীতি এবং সাধারণ মানুষের উপর অত্যাচার হয়েছে তার তুলনা রাজ্যের ইতিহাসে আর নেই বললেই চলে। বিশেষ করে পঞ্চায়েত এবং পুরসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তৃণমূল একটি ত্রিস্তরীয় রিগিং পদ্ধতি তৈরি করে, প্রশাসন এবং পুলিশের মদতে তা বাস্তবায়িত করে চলেছে। প্রথমে বিরোধী দলগুলিকে মনোনয়ন জমা করতে দেওয়া হবে না। জমা করলেও প্রবল অত্যাচার করে তা প্রত্যাহার করার চেষ্টা করা হবে। তা না করা গেলে ভোটের দিন রিগিং হবে, ভোটলুঠ হবে। সর্বশেষে গণনার দিন আবার কারচুপি করা হবে। বিরোধী দলের এজেন্টদের গণনা কেন্দ্রে ঢুকতে দেওয়া হবে না। এমনকি বিরোধী প্রার্থী জয়ী হলেও জোর করে জয়ের শংসাপত্র দেওয়া হবে তৃণমূলের প্রার্থীকে। ভাঙড় তথা অন্যান্য জায়গায় এইরকম জোর করে তৃণমূলকে জয়ী ঘোষণা করার ঘটনা ঘটেছে, যাকে কেন্দ্র করে গণ্ডগোলে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হয়েছে। গণনা কেন্দ্রের বাইরে ব্যালট পড়ে থেকেছে। এমনকি তৃণমূলের প্রার্থী ব্যালট পেপার খেয়ে নিয়েছে বিরোধী প্রার্থীকে হারাতে!

ভোট গণনাকে কেন্দ্র করে এই মারাত্মক অরাজকতা কোন পর্যায়ে পৌঁছিয়েছে তা বোঝার জন্য দুটি খবর যথেষ্ট। প্রথমত, এই সম্পাদকীয় কলাম লেখার সময় অবধি রাজ্য নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইট জানাচ্ছে যে ৯,০২৭টি পঞ্চায়েত আসনের ফলাফল এখনও ঘোষণা করা যায়নি। ১১ জুলাই থেকে ভোট গণনা শুরু হয়েছে। এখন ১৫ জুলাই। তবু ৯,০০০-এর বেশি পঞ্চায়েত আসনের ফলাফল কেউ জানে না। দ্বিতীয়ত, মাননীয় হাইকোর্ট একটি মামলার শুনানিতে বলেছেন যে পঞ্চায়েতের ফলাফল নির্ভর করবে হাইকোর্টের রায়ের উপর। এই মর্মে নির্বাচন কমিশন নোটিশ জারি করে ঘোষণা করেছে যে যারা জিতেছেন তারা যেন মনে রাখেন যে হাইকোর্টের রায়ের প্রেক্ষিতে তাদের ভাগ্য নির্ধারিত হবে। অর্থাৎ গোটা নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে নিয়ে একাধিক প্রশ্ন উঠছে যা রাজ্যের শাসন ব্যবস্থায় যেই একদলীয় অরাজকতা চলছে তার প্রতিফলন ছাড়া আর কিছু নয়।

হাইকোর্ট যেখানে বলছে যে সর্বশেষ নির্বাচনী ফলাফল তাদের রায়ের উপর নির্ভর করবে, সেখানে নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে আলাদা করে আলোচনার তাৎপর্য খুব বেশি নেই। তবু কিছু রাজনৈতিক প্রবণতা এই নির্বাচনী ফলাফলে দেখা যাচ্ছে যা নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। প্রথমত, মনোনয়ন পর্ব থেকেই এই কথা স্পষ্ট হয়েছে যে এইবারের নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতা আসনের সংখ্যা ২০১৮-র নির্বাচনের তুলনায় কম। অর্থাৎ বিরোধীরা আগেরবারের তুলনায় বেশি আসনে তৃণমূলের বিরুদ্ধে প্রার্থী দিতে সক্ষম হয়েছেন।

এর ফলে এই বছরের নির্বাচনে বিরোধীদের আসন সংখ্যা (নির্বাচনের সর্বশেষ হিসেব অনুযায়ী) আগেরবারের তুলনায় বেড়েছে। গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে বিজেপি জিতেছে ৯,৭৫৪টি আসন, বামফ্রন্ট জিতেছে ৩,০৯০টি আসন, কংগ্রেস জিতেছে ২,৫৫১টি আসন এবং অন্যান্যরা জিতেছে ২,০৭৫টি আসন। অন্যদিকে তৃণমূল জিতেছে ৩৫,০৫৩টি আসন। রাজ্যের রাজনৈতিক বিন্যাসে এখনও তৃণমূল প্রথম, বিজেপি দ্বিতীয় এবং বামফ্রন্ট-কংগ্রেস জোট তৃতীয় স্থানেই রয়েছে। এই প্রেক্ষিতে বিজেপি-র আসন সংখ্যা যথেষ্ট চিন্তাজনক। বিজেপি রাজ্যে মোট ৩৮,৪৭৫ আসনে প্রার্থী দিয়েছিল যার মধ্যে তারা জয়ী হয়েছে ৯,৭৫৪টি আসনে। অর্থাৎ তারা যেই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে তার মধ্যে ২৫ শতাংশ আসনে তারা জয়ী হয়েছে। বামফ্রন্ট প্রায় সমসংখ্যক আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৩,০৯০টি আসন জিতেছে এবং কংগ্রেস ১১,৭৭৪টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জিতেছে ২,৫৫১টি আসন। যেহেতু নির্বাচন কমিশন এখনও সম্পূর্ণ ফলাফল প্রকাশিত করেনি এবং পার্টিগতভাবে মোট ভোট সংক্রান্ত কোনো সরকারী তথ্য নেই, তাই ভোটের শতাংশের হিসেব পাওয়া যাচ্ছে না। তবু, উপরের হিসেবের দিকে তাকালে স্পষ্ট হবে যে রাজ্যের রাজনীতিতে বিজেপি এখনও বিরোধী পরিসরের প্রথম স্থানটি দখল করে আছে। আগামীদিনে, লোকসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিজেপি-র রাজনৈতিক গতিবিধি বাড়বে। তাই বিজেপিকে রাজ্য রাজনীতিতে দুর্বল শক্তি হিসেবে ভাবলে ভুল হবে।

বামফ্রন্ট এবং তাদের সহযোগীরা এই নির্বাচনে কয়েকটি জেলায় ভালো ফল করেছে। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেস তৃণমূলের হিংসার রাজনীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। কিছুটা রাজনৈতিক উপস্থিতি এই পঞ্চায়েত নির্বাচনে বামফ্রন্ট তথা কংগ্রেস বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু রাজ্যের সার্বিক রাজনৈতিক ভারসাম্যে পরিবর্তন আনার জন্য তা যথেষ্ট হয়নি। তৃণমূলের বিরুদ্ধে মানুষের মনে যে ক্রোধ এবং ক্ষোভের জন্ম হয়েছে তা বামপথে পরিচালিত করার জন্য বাম রাজনীতিকে আরো শক্তিশালী করার প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষ করে আগামী লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল এবং বিজেপি উভয়ের বিরুদ্ধেই শক্তিশালী এবং গ্রহণযোগ্য বিকল্প মানুষের সামনে হাজির করার কাজ করতে হবে বামপন্থীদের। পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রেক্ষিতে আত্মতুষ্টির কোনো জায়গা নেই বামপন্থীদের। এখনও অনেক পথ চলা বাকি রয়েছে। সাম্প্রদায়িক বিজেপি এবং স্বৈরতান্ত্রিক দুর্নীতিগ্রস্থ তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে রাজ্যের বৃহদাংশের মানুষের সমর্থন আদায় করার লক্ষ্যে এখন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। আগামী লোকসভা নির্বাচনে একদিকে বিজেপিকে গদিচ্যুত করতে হবে, অন্যদিকে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে লড়াই করে বৃহত্তর শক্তি হিসেবে উঠে আসতে হবে। এই রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করাই এখন বামপন্থীদের প্রধান কর্তব্য।