আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ দ্বাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ জুন, ২০২৩ ● ১-১৫ আষাঢ়, ১৪৩০

প্রবন্ধ

সাভারকরের ‘হিন্দুত্ব’ এবং ইতিহাস চর্চা (প্রথম পর্ব)

রঞ্জন রায়


প্রস্তাবনা

ইতিহাসের পরিহাসে আজ ভারতের মধ্যবিত্ত এবং শিক্ষিত জনতার একটি বড় অংশ ‘হিন্দু রাষ্ট্রের’ শ্লোগানে মুগ্ধ এবং তাঁদের স্বপ্ন এক প্রাচীন অখণ্ড ভারতের নির্মাণ। তাই নতুন সংসদ ভবনের উন্মোচনের দিন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রহ্লাদ জোশী এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের সর-সংঘচালক মোহন ভাগবত জোর গলায় বলেন যে অখণ্ড ভারতের নির্মাণ হবেই এবং খুব বেশি হলে আর ২০-২৫ বছর লাগবে।[1] নতুন সংসদ ভবনের ম্যুরালে অখণ্ড ভারতের যে ম্যাপ দেখানো হয়েছে তাতে বর্তমান পাকিস্তানের সিন্ধু, পেশোয়ার, তক্ষশিলা এবং নেপালের বিরাটনগর সবই অখন্ড ভারতের অংশ হিসেবে দেখানো হয়েছে। এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র জানিয়েছেন ওটা অশোকের সাম্রাজ্যের ম্যাপ।[2]

আমাদের প্রশ্ন দুটিঃ
এক, সত্যিই কি 'অখণ্ড ভারত' বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব ছিল? ইতিহাসে বা পুরাণকথায়?

দুই, ভারতের সংস্কৃতি বা ঐতিহ্য মানে কি কেবল হিন্দু ঐতিহ্য? 'হিন্দু' শব্দের উৎপত্তিস্থল কী?

এই স্বপ্নের প্রণেতা এবং মূল তাত্ত্বিক হলেন বিনায়ক দামোদর সাভারকর। ইনি বলছেন ভারতবাসী অর্থে 'হিন্দু' শব্দের ব্যবহারের প্রমাণ আমাদের পুরাণকথায় তথা ঐতিহ্যে রয়েছে। কাজেই উপরোক্ত দুটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের খুঁটিয়ে দেখতে হবে সাভারকর তাঁর বিখ্যাত 'হিন্দুত্ব' বইয়ে এবং অন্যত্র কী করে ‘হিন্দুত্ব’ শব্দের সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছেন এবং তার যাথার্থ নির্মাণে কী ধরনের সাক্ষ্য প্রস্তুত করেছেন।

সাভারকরের মানসভুবন

সাভারকরের জীবনীলেখক বৈভব পুরন্দরে বলছেনঃ
সাভারকর যখন আন্দামানের সেলুলার জেলে ঢুকেছিলেন তখন তিনি ছিলেন হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের একনিষ্ঠ প্রবক্তা, এমনকি ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের মুসলিম নায়কদের, যেমন অওধের নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ্, রোহিলাখণ্ডের বিদ্রোহীদের নেতা খান বাহাদুর খান, প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কিন্তু তিনি যখন আন্দামান থেকে ফিরে এলেন তখন তিনি ভারতকে হিন্দু ন্যাশনালিজমের ছাঁচে ঢেলে সাজাতে বদ্ধপরিকর।[3]

মনে পড়ে, তাঁর লণ্ডন প্রবাসের সময় লেখা সিপাহী বিদ্রোহের ইতিহাসে ইংরেজদের দেশ থেকে তাড়াতে পূর্বশর্ত হিসেবে হিন্দু ও মুসলমানের একতার উপর বারবার জোর দেওয়া হয়েছিল। বইটি শেষ হয়েছিল দিল্লির গদিচ্যুত মুঘল বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফরের বয়েৎ দিয়ে।

কিন্তু ওঁর চিন্তা এবং আবেগের এমন পরিবর্তনের কারণ?

অনেকে বলেন, সেলুলার জেলে মুসলিম ওয়ার্ডারদের হিন্দু কয়েদিদের উপর অত্যাচার এবং ভয় দেখিয়ে ধর্মান্তরণ তাঁকে ক্ষুব্ধ করেছিল। কিন্তু সাভারকর নিজেই লিপিবদ্ধ করেছেন যে পাঠান, বালুচ ও সিন্ধি মুসলমানরা ছিল সবচেয়ে গোঁড়া, তারপর পাঞ্জাবি মুসলমানেরা। তবে কারাগারে তামিল, মারাঠি এবং বাঙালি মুসলমানেরা ‘neither cruel, nor anti-Hindu’.[4]

সাত সকালে মুয়াজ্জিনদের আজানের ডাক সাভারকরের ঘুম ভাঙিয়ে বিরক্তির কারণ হয়েছিল। এর পালটা হিসেবে তিনি ওই সময় হিন্দু বন্দীদের শঙ্খ বাজাতে বললেন। এতে দু’পক্ষের হল্লাগোল্লা মিলে এমন উপদ্রব শুরু হল যে জেল কর্তৃপক্ষ তিতিবিরক্ত হয়ে দুটোই বন্ধ করিয়ে দিলেন। সাভারকরের কৌশলের জয় হল।[5]

এটা সাভারকর বলছেন, কিন্তু এমন একটা ঘটনার বিবরণ অন্য বন্দীদের স্মৃতিকথায় নেই!

আগেই দেখিয়েছি যে বারীন্দ্র এবং উপেন্দ্রের স্মৃতিকথায় মুসলমান ওয়ার্ডারদের হিন্দু বন্দীদের উপর অত্যাচার এবং মুসলমান বন্দীদের উপর হিন্দু ওয়ার্ডারদের অত্যাচার দুটোরই বর্ণনা রয়েছে, এবং রয়েছে ‘ধর্মান্তরণ’ করার প্রয়াস আর পালটা আর্যসমাজীদের ফিরিয়ে আনার প্রয়াস। ওয়ার্ডারদের যৌন অত্যাচারের কথাও এঁরা বলেছেন। কিন্তু এঁরা কেউ আন্দামান থেকে ফিরে এসে মুসলমান বিদ্বেষী হয়ে যাননি।

আবার ডঃ রমেশ চন্দ্র মজুমদারের আন্দামানের পেনাল সেটলমেন্ট নিয়ে গবেষণায় দেখা যাচ্ছে কালাপানির শেষ বছরে বিনায়ক সাভারকর তেলঘানির ফোরম্যান হয়েছিলেন।[6]

এছাড়া, ওঁর নিজের মারাঠি এবং ইংরেজিতে লেখা আন্দামানের স্মৃতিকথায় দেখা যাচ্ছে তিনিও ক্ষমতা পেয়ে কিছু মুসলমান বন্দীদের শিক্ষা দিতে কসুর করেননি।

পুরন্দরে লক্ষ্য করেছেন যে সাভারকরের আগে স্বামী বিবেকানন্দ, দয়ানন্দ সরস্বতীর মত সন্ন্যাসী এবং লোকমান্য তিলকের মত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও হিন্দু-পুনরুত্থানের আহ্বান করেছিলেন। কিন্তু সাভারকরের সঙ্গে এঁদের মৌলিক তফাৎ হল সাভারকরের হিন্দুত্ব বা হিন্দু সংহতির অবধারণাটি রাজনৈতিক, ওঁদের মত ধার্মিক বা ধর্মভিত্তিক নয়।[7]

হিন্দুত্ব এবং হিন্দুধর্মঃ শব্দের উৎপত্তি নিয়ে সাভারকর

সাভারকরের মতে হিন্দুধর্ম ও হিন্দুত্ব এক নয়। হিন্দুত্ব একটি জাতির আচার ব্যবহার, তার সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতার ইতিহাস, এবং ওই ইতিহাস শৌর্যে ও বীরগাথায় ভরপুর।

বোঝাই যাচ্ছে, কেন আজকাল নতুন করে কিছু লোকগাথা ও চারণদের গীতকে ইতিহাস বলে চালানোর হিড়িক পড়েছে। লিখতে হবে যে রাণা প্রতাপ হলদিঘাটির যুদ্ধে পরাজিত নয়, বিজয়ী হয়েছিলেন।

সাভারকরের মতে হিন্দুধর্ম হল হিন্দুত্বের বিশাল অবধারণার একটি সাবসেট মাত্র। অতএব, লোকমান্য তিলকের দেওয়া সংজ্ঞাটি হিন্দুধর্মের অনুসারীদের জন্যে যথেষ্ট হলেও ‘হিন্দুত্ব’-এর জন্যে একেবারেই উপযুক্ত নয়। এই কারণেই তিলকের নীচে উল্লিখিত সংজ্ঞাটি, সাভারকরের মতে, হিন্দুধর্মের জন্যে সবচেয়ে কার্যকরী হলেও ‘হিন্দুত্ব’-এর জন্য সংকীর্ণ।

প্রামাণ্যবুদ্ধির্বেদেষু সাধনানামনেকতা,
উপাস্যানামনিয়ম এতদ্ধর্মস্য লক্ষণম্।

বেদে আস্থা, পূজার্চনার বিবিধতা এবং কোনো এক বাঁধাধরা নিয়মের অভাব - এই হল হিন্দুধর্মের বৈশিষ্ট্য।[8]

হিন্দু কে? খালি সনাতন বৈদিক ধর্মের অনুযায়ীদের হিন্দু বলা, সাভারকরের মতে, মস্ত ভুল।[9]

তাহলে হিন্দু কে?

সাভারকরের নিজস্ব সংজ্ঞাঃ
আসিন্ধু সিন্ধু-পর্যন্তা যস্য ভারত-ভূমিকা,
পিতৃভূঃ পূণ্যভূশ্চৈব স বৈ হিন্দুরিতি স্মৃতঃ।[10]

সাভারকরের খ্যাতনামা জীবনীকার বিক্রম সম্পত এর অনুবাদ করেছেন - তারাই হিন্দু, যাদের পিতৃভূমি এবং পুণ্যভূমি হল এক বিশাল স্থলভাগ - from the Sindhu to the Sindhu (Indus to the seas)।[11]

কিন্তু 'হিন্দুত্ব' গ্রন্থের হিন্দি অনুবাদকেরা এর অর্থ করেছেনঃ
সিন্ধুনদ (ব্রহ্মপুত্র এবং তার উপনদী সমেত এলাকাকেও 'সিন্ধু' বলা হত) থেকে সিন্ধু (সাগর) পর্যন্ত বিস্তৃত এই ভারতভূমি, যার পিতৃভূমি (পূর্বপুরুষের ভিটে), এবং পূণ্যভূমি (সাংস্কৃতিক ভূমি), সেই হিন্দু। (প্রকাশকের হিন্দি থেকে অক্ষরশঃ আমার বাংলা)।

বন্ধনীর মধ্যের অংশটুকু হিন্দি সংস্করণে ইদানীংকালের প্রকাশকেরা জুড়ে দিয়েছেন।

মনে হয়, হিন্দি অনুবাদকেরা খেয়াল করেছেন যে হিন্দুদের আদি বাসভূমি সিন্ধুনদ থেকে সমুদ্র ধরলে উত্তর-পূর্ব ভারত বাদ পড়ে যায়, তাই ব্রহ্মপুত্রকে টানাটানি। সাভারকর কিন্তু তাঁর মূল লেখায় সিন্ধু ও পঞ্চনদের কথাই বলেছেন।

আমরা জানি, সিন্ধুর উপ এবং শাখা নদীগুলোর নাম সিন্ধু, চন্দ্রভাগা (চেনাব), ঐরাবতী (রাভী), বিতস্তা (ঝিলম), শতদ্রু (সতলেজ), বিপাশা (বিয়াস) এবং অধুনা বিলুপ্ত সরস্বতী - এই হল সপ্তসিন্ধু।

কিন্তু সাভারকরের সপ্তসিন্ধু বর্ণনায় পাচ্ছি সিন্ধু, শতদ্রু, চেনাব, বিতস্তা, গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী![12] এখানে রাভী এবং বিপাশাকে বাদ দিয়ে গঙ্গা-যমুনা কীভাবে জায়গা পেল বুঝতে পারছি না। আমরা দেখব ঐতিহাসিক সত্যের অকাট্য প্রমাণ হিসেবে যেসব কথা এবং রাজনৈতিক স্বার্থে তথ্যবিকৃতি আজ সোশ্যাল মিডিয়ার আকছার দেখা যায়, যেমন জোর গলায় এবং সঠিক তথ্যসূত্রের উল্লেখ ছাড়াই কোনো ভেজাল বক্তব্যকে নির্ভেজাল সত্য বলে দাবি করা, তার শুরু হয়েছে অনেক আগেই।

খেয়াল করার বিষয় - এই শ্লোকটি কোনো শাস্ত্রগ্রন্থে নেই, সাভারকরের নিজস্ব রচনা। কিন্তু দ্বিতীয় সংস্করণে (১৯৪২) প্রকাশক বলছেন - এই শ্লোকটি এখন ধার্মিক গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতির সমান মান্যতা পেয়েছে।[13]

সেই প্রকাশক কে? প্রকাশন সংস্থা - বীর সাভারকর প্রকাশন, সাভারকর সদন, বোম্বাই।

প্রকাশকের নাম এস. এস. সাভারকর। তিনি কে - কোথাও বলা নেই।

সংস্কৃত সাহিত্যের কোনো কোনো মনোযোগী পাঠকের মনে হয়েছে যে শ্লোকটি কোনো মৌলিক রচনা নয়, এটি মনুস্মৃতির শ্লোক ২.২২-কে একটু পালটে দেওয়া মাত্র।

মনু ওই শ্লোকে কোন দেশে বা এলাকায় তাঁর 'মনুস্মৃতি' মান্য সেটা বোঝাতে গিয়ে বলেছেন আর্যাবর্ত কোথায় বা কতদূর বিস্তৃত।

আ সমুদ্রাৎ তু বৈ পূর্বাদা সমুদ্রাচ্চ পশ্চিমাৎ।
তয়োরেবান্তরং গিয়োর আর্যাবর্তং বিদুর্বুধাঃ।।
(মনুস্মৃতি ২/২২)

‘পূর্ব এবং পশ্চিম সাগরের অন্তর্বতী যে ভূমি দুই পর্বতের মধ্যে অবস্থিত, তাহাকেই বিদ্বদজ্জনেরা আর্যাবর্ত বলিয়া থাকেন। (মহামহোপাধ্যায় গঙ্গানাথ ঝা’র ইংরেজি অনুবাদ থেকে আমার বাংলা)।

সাভারকরের ‘হিন্দুত্ব’ নামের চটি বইটিতে 'ভবিষ্যপুরাণ' গ্রন্থটির বিশেষ ভূমিকা। হিন্দুত্বের শব্দ এবং ধারণাটিকে শাস্ত্রসম্মত সিদ্ধ করতে উনি অনেকবার 'ভবিষ্যপুরাণ'কে অথরিটির মর্যাদা দিয়ে উদ্ধৃত করেছেন। সবচেয়ে বেশি আশ্রয় নিয়েছেন 'ভবিষ্যপুরাণ'-এর তৃতীয় ভাগ প্রতিসর্গ পর্বের।

সেগুলো নিয়ে যথাসময়ে আলোচনা করা হবে।

বর্তমানে আমরা শুধু সপ্তসিন্ধুকে হপ্তসিন্ধু বলা, ‘স’-কে যাবনিক উচ্চারণে ‘হ’ করা নিয়ে তথ্যগুলো দেখব।

'ভবিষ্যপুরাণ' হচ্ছে প্রচলিত ১৮টি পুরাণের মধ্যে সবচেয়ে অর্বাচীন। কিন্তু এটি একমাত্র পুরাণ যা শুধু অতীত (পুরানো দিনের) কথাই নয়, ভবিষ্যতের কথাও বলে।

যদিও বলা হয় এই পুরাণটিও মহাভারতকার বেদব্যাস লিখেছিলেন কিন্তু এর প্রথম দুটো খণ্ডে 'মনুস্মৃতি'র থেকে সৃষ্টি রহস্য এবং তিনটে যুগের বর্ণনা রয়েছে। তাতে কলিতে মেয়েদের অবস্থা এবং চরিত্র নিয়ে একগাদা যা বলা হয়েছে সেসব এখানে লেখা সম্ভব নয়।

যেমন মেয়েদের জঙ্ঘায় লোম অথবা স্তনের বা তার বৃন্তের গঠন দেখে বোঝা যায় যে সে আজ্ঞাকারী বা কামুক বা পতিহন্তা!

চতুর্থ পর্বে প্রায় কয়েকশ’ ব্রত পালনের নিয়ম ও তজ্জনিত পুণ্যের সূচী রয়েছে।

কিন্তু মজার ব্যাপার হল তৃতীয় খণ্ড বা প্রতিসর্গ পর্ব। কারণ শুধু এতেই ভারত রাষ্ট্রের রাজাদের কথা ত্রেতা, দ্বাপর হয়ে কলিকালে মুসলমান এবং ইংরেজ শাসনের কথা বলা হয়েছে। এই পুরাণ অনুসারে রঘুবংশের সব রাজা (রাম এবং কুশ সমেত) দশ হাজার বছর ধরে রাজত্ব করেছেন।

তারপর মহমদ বলে এক ঘৃণ্য অসুরের সময় থেকে ভারতে ম্লেচ্ছদের রাজত্ব এবং যাবনী ভাষার প্রচলনের কথা বলা হয়েছে। এটাকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘মহম্মদ’ ধরে প্রচার করা হয়। আমার মনে হয় মহম্মদ ঘোরী। পৃথ্বীরাজ চৌহানের কথাও রয়েছে।

বর্ণনা করা হয়েছে কীভাবে বেদমন্ত্রের প্রভাবে হিন্দুবীর যজ্ঞ করে আক্রমণকারী শক, হুণ, যবন, রোমক এবং দ্বীপবাসী চিনাদের ভস্ম করে দিলেন। (প্রতিসর্গ পর্ব, পঞ্চম অধ্যায়, ৭ এবং ৮)।[14]

আমি এখানে উদ্ধৃত করব এই বইটির বাংলা প্রথম নবভারত সংস্করণ, ১৪২০ সন, থেকে।

ভূমিকায় সম্পাদক স্বামী পরমাত্মানাথ ভৈরব (গিরি) বলছেন, আধুনিক বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে মনে হতেই পারে ‘প্রতিসর্গ পর্ব’টি অত প্রাচীন নয়। যেমন এতে রবিবার অর্থে সানডে, ফাল্গুন অর্থে ফেব্রুয়ারি ইত্যাদি বলা আছে।

রবিবারে চ সন্ডে চ ফাল্গুনে চৈব ফর্বরী।
ষষ্টিশ্চ সিক্সটি জ্ঞেয়া তদুদাহারমীদৃশম্।।
( প্রতিসর্গ পর্ব, ৫ম ভাগ, ৩৭)।

অর্থাৎ ম্লেচ্ছদের ভাষায় রবিবার হয় ‘সানডে’, ফাল্গুন হয় ‘ফেব্রুয়ারি’ এবং ষষ্টি বা ষাট হয় ‘সিক্সটি’। এসব নাকি বেদব্যাস ৫০০০ বর্ষ আগে দিব্যদৃষ্টিতে দেখে লিখে গেছেন।

যাকগে, আমরা আগে প্রাচীন শাস্ত্রে (ভবিষ্যপুরাণে) ‘স’ কী করে ম্লেচ্ছদের হাতে ‘হ’ হয়ে গেল সে বিষয়ে সাভারকরের বক্তব্য শুনি। 

সংস্কৃতের সিন্ধু প্রাকৃতে হিন্দু হয়ে গেল (উপ-শিরোনাম)। যেমন ভবিষ্যপুরাণে আছে -
সংস্কৃতস্য বাণী তু ভারতবর্ষ মুঝ্যতাম।
অন্যে খণ্ডে গতা সৈব ম্লেচ্ছাহ্যা নন্দিনোভবত।।
পিতৃপৈতর ভ্রাতা চ ব্রাদর পতি রেবচ।
সেতি সা যাবনী ভাষা হাশ্চশ্চাস্যস্তথা পুনঃ।
জানুস্থানে জৈতু শব্দঃ সপ্তসিন্ধুস্তথৈব চ।
হপ্তহিন্দুর্যাবনী চ পুনর্জ্ঞেয়া গুরুণ্ডিকা।।
 (প্রতিভাস পর্ব, অধ্যায় ৫)। শ্লোক সংখ্যা বলা হয়নি।[15]

না, দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি ওরকম কোনো শ্লোক বইটিতে বা ওই অধ্যায়ে নেই। তাহলে সাভারকর কোত্থেকে উদ্ধৃতি দিলেন?

উনি আসলে চারটে শ্লোক থেকে মিলিয়ে এটির নির্মাণ করেছেন। সেগুলো হল ২১, ২২ এবং ৩৫, ৩৬। এজন্যেই স্পষ্ট শ্লোক সংখ্যার উল্লেখ করার দায়িত্ব এড়িয়ে গেছেন।

প্রসঙ্গ সমেত পর পর দিচ্ছি।

ভবিষ্যপুরাণ বলছেঃ ম্লেচ্ছগণের ভাষা সরস্বতীর অভিশাপ, মহা অধম ভাষা। (শ্লোক ১৯-২০)।

তেষাং বৃদ্ধিকলৌ চাসী সংক্ষেপেন প্রকীর্তিতা।
সংস্কৃতস্যৈব বাণী তু ভারতবর্ষ মুহ্যতাম্।
(২১)

সংস্কৃত হল এমন এক বাণী যাতে সমগ্র ভারত প্রফুল্লিত হয়।

অন্যখণ্ডে গতা সৈব ম্লেচ্ছা হ্যানন্দিনোঃ ভবন।
এবং তে কথিতং বিষ্ণুভক্তব্দিজৈসহ।।
(২২)

ম্লেচ্ছ ভাষার কথা আগেই বলেছি; এতে শুধু ম্লেচ্ছরা আনন্দ পায়।

ম্লেচ্ছভাষা চার প্রকার। ব্রজভাষা, মহারাষ্ট্র ভাষা, যাবনী ও গুরুণ্ডিকা। (৩১-৩২)

এই ভাষায় পানীয়কে বলে ‘পানি’, বুভুক্ষাকে ‘ভুখ’। (৩৩)

পিতৃপৈতর ভ্রাতা চ বাদরঃ পতিতেব চ।
সেতি সা যাবনী ভাষা হ্যশ্চশ্চাপেস্তথা পুনঃ।।
(৩৫)

এরা পিতাকে বলে ‘পিতর’ (পেটার?), ভ্রাতাকে বলে ‘বাদর’ (ব্রাদার?), অশ্বকে বলে ‘আস্য’ (হর্স?)।

জানুস্থানে জৈনু শব্দঃ সপ্তসিন্ধুস্তথৈবচ।
সপ্তহিন্দুর্যাবনী চ পুনর্জ্ঞেয়া গুরুন্ডিকা।।
(৩৬)

যবনী ভাষায় জানুকে বলে 'জৈনু', আর সপ্তসিন্ধুকে বলে ‘সপ্তহিন্দু’!

এবার ফিরে যান সাভারকরের ছ’লাইনের শ্লোকটিতে। প্রায় প্রতিটি শব্দ উপরোক্ত ২১-২২ এবং ৩৫-৩৬ থেকে তোলা। কিন্তু একটা তফাৎ রয়েছে।

শেষ লাইনে সাভারকর লিখছেনঃ হপ্তহিন্দুর্যাবনী চ পুনর্জ্ঞেয়া গুরুণ্ডিকা।।

অথচ ৩৬ নম্বর মূল শ্লোক বলছেঃ সপ্তহিন্দুর্যাবনী চ পুনর্জ্ঞেয়া গুরুন্ডিকা।।

অর্থাৎ মূলে আছে সপ্তহিন্দু, কোনমতেই হপ্তহিন্দু নয়। তাহলে এই যে জোর করে ‘স’ কে ‘হ’, এটা কি অনিচ্ছাকৃত?[16]

______________________________
* পরের কিস্তিতে সাভারকরের হিন্দুত্বের সংজ্ঞার বিস্তারিত আলোচনা এবং বর্তমান রাজনীতিতে তার প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা থাকবে।


তথ্যসূত্রঃ

1) 'দি হিন্দু', ২৯ মে, ২০২৩।
2) ঐ, ৩ জুন, ২০২৩।
3) Purandare, 'Savarkar, The True Story of the Father of Hindutva', Chapter 9, pp-174.
4) Ibid, page 175 and Savarkar, ‘Majhi Janmathep’, pp. 70-7, (in Marathi).
5) Ibid, page 177 and Savarkar, ‘Majhi Janmathep’, pp 228-71, (in Marathi).
6) আর. সি. মজুমদার, পেনাল সেটলমেন্টস ইন আন্দামান অ্যান্ড নিকোবর, চ্যাপ্টার থ্রি, ভারত সরকারের পাবলিকেশন, ১৯৭৫। 
7) পুরন্দরে, ‘সাভারকর’, পৃঃ ১৭৭।
8) সাভারকর, ‘হিন্দুত্ব’, পৃঃ ১০৮।
9) সাভারকর, ‘হিন্দুত্ব’, হিন্দি ডিজিটাল সংস্করণ, প্রভাত প্রকাশন, দিল্লি, পৃঃ ৭৮।
10) সাভারকর, ‘হিন্দুত্ব’, হিন্দি সংস্করণ, প্রভাত প্রকাশন, দিল্লি, পৃঃ ৮৬।
11) সম্পত, ‘সাভারকর’, ইকোজ ফ্রম দ্য ফরগটন পাস্ট’, ভল্যুম ১, পৃঃ ৪১৬।
12) সাভারকর, ‘হিন্দুত্ব’, হিন্দি সংস্করণ, প্রভাত প্রকাশন, দিল্লি, পৃঃ ১২।
13) হিন্দুত্ব বইয়ে দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকা, পৃঃ iv.
14) ভবিষ্যপুরাণম্ (মূল সংস্কৃত ও বঙ্গানুবাদ সমেত), (২০১৩ সাল), শ্রীমৎ স্বামী পরমাত্মানাথ ভৈরব (গিরি) কৃত অনুবাদ ও সম্পাদনা।
15) সাভারকর, হিন্দুত্ব, প্রভাত প্রকাশন, নিউ দিল্লী, ই-বুকে পৃঃ ১২।
16) ভবিষ্যপুরাণের শ্লোক নিয়ে সাভারকরের কারসাজির এবং যুক্তির ফাঁক ধরিয়ে দিয়েছেন প্রবাসী বাঙালি সংস্কৃতজ্ঞ প্রাবন্ধিক শুদ্ধব্রত সেনগুপ্ত। তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানাই।