আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুন, ২০২৩ ● ১৬-৩১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০

সমসাময়িক

নোট বাতিল ২.০


মোদী সরকার নয় বছর অতিক্রম করল। এই নয় বছরে সরকার কোন কাজটি জনগণের স্বার্থে করেছে আর কোন কাজটি তাদের নিজেদের সাম্প্রদায়িক এজেন্ডাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য করেছে, সেই বিতর্ক চলছে, এবং ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচন অবধি যে তা চলবে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বিগত নয় সালে জনগণের জীবন দুর্বিসহ করে দেওয়ার মতন বহু নীতি নেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে নিঃসন্দেহে নোট বাতিল একেবারে শিরোনামে থাকার দাবি রাখে।

একদিন সন্ধ্যা ৮টায় দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী টিভি-র পর্দায় এসে সটান ঘোষণা করে দিলেন যে ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট বাতিল করা হল, সেইদিন রাত থেকেই। সাধারণ মানুষ ত্রস্ত। দেশের ৮৬ শতাংশ নোট, এক লহমায় বাতিল বলে ঘোষণা করা হল। কেন? কালো-বাজারি রোখা হবে, দেশে নগদহীন লেনদেনের প্রচলন বাড়বে, নকল নোটের সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে এবং উগ্রপন্থী শক্তিগুলির অর্থের যোগান আটকে দেওয়া যাবে। এক ঢিলে পাঁচ-দশটি পাখি মারার নীতিটি যে প্রথম থেকেই ভ্রান্ত ছিল, তা এই পত্রিকায় ২০১৬ সাল থেকে বহুবার লেখা হয়েছে। নোট বাতিল সংক্রান্ত কোনো দাবিই যে পূরণ হয়নি, একথাও এখন সর্বজনবিদিত, এমনকি বিজেপিও আর নোট বাতিলকে তাদের গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য বলে দাবি করে না।

নোট বাতিল যে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ছিল, তার সর্বশেষ প্রমাণটি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক নিজেই আমাদের সামনে হাজির করেছে দিন কয়েক আগে। মনে রাখবেন, মোদীজির পরামর্শে কালো টাকা রোখার জন্য ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিল করে গোলাপী রঙের ২০০০ টাকার নোট ছাপিয়েছিল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। মোদীর স্নেহধন্য সাংবাদিককূল এই নোটে ন্যানো চিপ পর্যন্ত খুঁজে পেয়েছিল। এই গালগপ্পোগুলির প্রয়োজন ছিল, কারণ মানুষ নিজের কষ্টার্জিত টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তোলার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে প্রাণ হারাচ্ছিলেন। যত নগদ মানুষের দরকার ছিল, তা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পক্ষে সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই ২০০০ টাকার নোট ছাপানো হয়েছিল, যাতে কম সময়ে বেশি নগদ বাজারে সরবরাহ করা যায়।

অতএব, বলা যেতে পারে যে ২০০০ টাকার নোট ছাপানোর মূল কারণ হল নোট বাতিল। এই নোট ২০১৬ সাল থেকে বাজারে সচল থাকলেও, ২০১৮-১৯ সাল থেকেই দেখা যায় যে নোটটি আর খুব বেশি বাজারে ঘুরছে না। ২০০০ টাকার নোটের মুখ শেষ কবে আপনি দেখেছেন? প্রশ্নের উত্তর খোঁজা সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে সহজ নয়। অনেকেই মনে করেন যে ২০০০ টাকার নোট বাজার থেকে উবে যাওয়ার প্রধান কারণ মজুতদার এবং কালোবাজারিরা এই নোটের মাধ্যমে নিজেদের কালো ধন গচ্ছিত রেখেছেন। অন্যদিকে, বাজারের রোজের খরচ চালানোর জন্য ৫০০ টাকা, ২০০, টাকা, ১০০ টাকার নোট সাধারণ মানুষ ব্যবহার করে থাকেন। মোবাইল ফোনে সড়গড় যারা, তারা ব্যবহার করে ইউপিআই। অতএব ২০০০ টাকার নোটের প্রয়োজনীয়তা ২০১৬ সালের নভেম্বর পরবর্তী সময়ে মাস কয়েকের মধ্যেই ফুরিয়ে আসে। ২০১৮-১৯ সালেই রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ২০০০ টাকার নতুন নোট ছাপা বন্ধ করে দেয়। অবশেষে মে মাসের ১৯ তারিখে তারা বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানায় যে ২০০০ টাকার নোট আর চালু থাকবে না। ব্যাঙ্কে জমা করে অন্য নগদ টাকা নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু ২০১৬ সালের মতন এখন আর কোনো পরিচয়পত্র দেখানো বা অন্য কোনো কাগজ পূরণ করতে হবে না।

পৃথিবীর ইতিহাসে খুব কম দেশের উদাহরণ দেওয়া যায়, যেখানে ভারতের মতন হঠাৎ করে ৮৬ শতাংশ নোট বাতিল করা হয়েছে। মোদীজির কৃপায়, এই অনন্য কীর্তির অধিকারী একমাত্র ভারত। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন দেশও বিরল, যারা পাঁচ-সাত বছরের মধ্যে ঘনঘন নিজেদের নগদ ব্যবস্থা নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছে। যেমন ২০১৬ সালে ২০০০ টাকার নোটের প্রচলন এবং ২০২৩ সালে সেই নোট বাতিল ঘোষণা করা। আবারও মোদীজির কল্যাণে আমরা এটিও প্রত্যক্ষ করলাম। ভারতের মিডিয়া যেহেতু আপাতত মোদীর ভৃত্যে পরিণত হয়েছে, তারা গলা ফাটিয়ে বিরোধী পক্ষের উপর চেঁচালেও, এই প্রশ্নটি কেউ তুলছে না যে, ২০০০ টাকার নোট ছাপালেন কেন, আর কেনই বা তা বাতিল করলেন?

যেকোনো অর্থব্যবস্থায় মূদ্রার স্থিতিশীলতা আসলে নির্ভর করে বিশ্বাসের উপর। আপনি যখন কাউকে ১০০ টাকা দিচ্ছেন, সে বিশ্বাস করে যে সে এই ১০০ টাকা অন্য কাউকে দিলে তা প্রত্যাখ্যাত হবে না, এবং তার বিনিময়ে দ্বিতীয় ব্যক্তি কোনো পণ্য ক্রয় করতে পারবে। বারংবার মূদ্রাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনলে এই যে অলিখিত বিশ্বাস জনগণের মূদ্রাব্যবস্থার উপর রয়েছে তা দুর্বল হয়। যদি আপনাকে হঠাৎ বলা হয় যে কাল থেকে ১০০ টাকার নোট ব্যবহার করা যাবে না, অথবা আপনি যদি মনে করেন যে কাল ১০০ টাকার নোট বাতিল হয়ে যেতে পারে, তাহলে আপনি সেই নগদ নিজের কাছে রাখবেন না। আপনি অন্য কোনো পণ্যে আপনার সঞ্চয় গচ্ছিত রাখবেন। কিন্তু নগদ ছাড়া অর্থব্যবস্থায় লেনদেন হবে না। যতই ডিজিটাল ইন্ডিয়ার প্রচার চলুক, তথ্য বলছে যে ২০২০-২১ সালে দেশে মোট নগদের সরবরহ জিডিপি-র অনুপাতে ছিল ১৩ শতাংশের বেশি, যা নোট বাতিলের সময় ছিল ১২ শতাংশ। অর্থাৎ নোট বাতিলের যে অন্যতম প্রধান দাবি যে অর্থব্যবস্থায় নগদ নির্ভরতা কমবে, তা হয়নি। বরং তা বেড়েছে। এমতাবস্থায় আপনি যদি নগদের স্থিতিশীলতা নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েন তাহলে অর্থনীতি যে মৌলিক বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে পরিচালিত হয় তা ধাক্কা খায়। এর ফল মারাত্মক হতে পারে।

কিন্তু আমাদের দেশের শাসকদের কাছে এই সবকিছু গৌণ। এবং দেশের জনসাধারণ নোট বাতিলের মতন ভয়াবহ জনবিরোধী পদক্ষেপের পরেও মোদী সরকারকে ভোট দিয়েছে এই কথা অস্বীকার করা যাবে না। তবু জনমতের ঊর্ধ্বে সর্বদাই সত্য বিরাজমান। সমস্ত মানুষ যদি মনে করেন যে সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে, তা যেমন সত্য হয়ে যায় না, তেমনি মিডিয়া-রাজনীতিবিদ-জনগণ সবাই যদি মনে করে যে নোট বাতিল একটি অত্যন্ত ভালো নীতি ছিল, তা সত্য হয়ে যায় না। মানুষ কখনও কখনও সত্যকে উপলব্ধি করতে ভুল করে। কিন্তু সত্যের জয় নিশ্চিত। ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে যে নোট বাতিল মানুষের জীবনে সর্বনাশ ডেকে এনেছিল। ২০০০ টাকার নোটের অন্তর্জলি যাত্রা এই ইতিহাসের প্রথম পরিচ্ছেদ।