আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ দশম সংখ্যা ● ১৬-৩১ মে, ২০২৩ ● ১-১৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০

প্রবন্ধ

বঙ্গাব্দ কি আসলে ভাস্করাব্দ?

সুখবিলাস বর্মা


বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ প্রকাশিত ‘ভারতকোষ (প্রথম খণ্ড)’ গ্রন্থে নির্মল চন্দ্র লাহিড়ির আলোচনায় পাই - অব্দ-বৎসর; কালবোধার্থে বর্ষনির্ণায়ক সংখ্যা। যেমন, শকাব্দ, বঙ্গাব্দ, খ্রিস্টাব্দ ইত্যাদি। দীর্ঘ কালান্তরের দুইটি ঘটনার অন্তর্গত সময় নির্ণয়ে বা ঐতিহাসিক ঘটনাসমূহের পারম্পর্য এবং উহাদের সঠিক কাল নিরূপণের উদ্দেশ্যেই অব্দ গণনার প্রচলন হইয়াছে।

উল্লিখিত ভারতকোষ মতে -
দাক্ষিণাত্য হইতে আগত সেন রাজবংশ বঙ্গদেশে শকাব্দ প্রচলিত করেন। পরে মুসলমানদের আগমনের পর এদেশে রাজকার্যে হিজরা অব্দ ব্যবহৃত হইতে থাকে, যদিও শিক্ষিত সম্প্রদায় শকাব্দ ব্যবহার করিতেন। কিন্তু হিজরা অব্দ ৩৫৪ দিনে পূর্ণ হয় বলিয়া উহার বর্ষারম্ভ বৎসরের যে কোনো সময়েই হইতে পারে। ইহাতে রাজস্ব আদায় সংক্রান্ত রাজকার্যের অসুবিধা হয়। এইজন্য সম্রাট আকবরের সময়ে হিজরাকেই ৩৬৫ দিন গণনা করিবার ব্যবস্থা করা হয়। ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দর হিজরা সংখ্যা ৯৬৩-র সহিত তৎপরবর্তী সৌর বৎসর সংখ্যা যোগ করিলে বর্তমানকালের বঙ্গাব্দ পাওয়া যায়।

১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ কি করে ৯৬৩ হিজরি সন? হিসাবটা নিম্নরূপঃ
পৃথিবীর উপগ্রহ চাঁদ পৃথিবীর চারপাশে একবার ঘুরে আসতে সময় নেয় ২৯.৫৩০৫৮৮ অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ঊনত্রিশ সৌরদিন। এই সময় পরিমাণকে বলা হয় 'এক চান্দ্রমাস'। অতএব 'এক চান্দ্র বৎসর' হয় সাড়ে ঊনত্রিশ গুণিতক ১২ অর্থাৎ ৩৫৪ দিন, যা সৌর বৎসর থেকে ১১ দিন কম। এই চান্দ্র বৎসর অনুসারে ৬২২ খ্রিস্টাব্দর ১৬ই জুলাই শুক্রবার ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হজরত মহম্মদের মক্কা থেকে মদিনায় প্রস্থানের ‘হিজরৎ’ দিনটিকে ধরে নিয়ে শুরু হয়েছিল ‘হিজরি’ অব্দ। হিজরির শুরু ৬২২ থেকে ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ হল ৯৩৪ খ্রিস্ট বৎসর। আবার যেহেতু প্রতি সাড়ে বত্রিশ খ্রিস্ট সনে এক বৎসর হিজরি সন বৃদ্ধি পায়, তাই ৯৩৪ খ্রিস্ট বৎসরে অতিরিক্ত হিজরি বৎসরের সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৩৪/৩২.৫= ২৮.৭৩ অর্থাৎ ২৯। এইভাবে ৯৩৪ খ্রিস্ট বৎসর মানে ৯৩৪+২৯=৯৬৩ হিজরি বৎসর।

১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দর হিজরা সংখ্যা ৯৬৩-এর সহিত তৎপরবর্তী সৌর বৎসর সংখ্যা যোগ করিলে বর্তমানকালের বঙ্গাব্দ পাওয়া যায়’, সেই হিসাবে ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ হল ২০২৩-১৫৫৬ = ৪৬৭+৯৬৩ = ১৪৩০ বঙ্গাব্দ। স্পষ্টতই, বঙ্গাব্দের প্রাক্ ১৫৫৬ অংশ চান্দ্রমতে এবং পরবর্তী অংশ সৌরমতে গণিত। বঙ্গাব্দে সূর্য ও চন্দ্র দুই ঘড়িবাবুরই ভূমিকা।

‘বঙ্গাব্দ’ নিয়ে ভারতকোষ তত্ত্বটি কেমন গোলমেলে/গোঁজামিল মনে হয় না? আমরা জানি, বিশেষ বিশেষ অব্দ শুরু হয়েছে কোনো রাজা-বাদশা-সম্রাটের সিংহাসন আরোহণ তারিখ বা কোনো মহাপুরুষের জন্ম তারিখ থেকে। যীশুখ্রিস্টের জন্মকাল স্মরণ করে সারা পৃথিবীতে যে 'খ্রিস্টাব্দ' শুরু হয়েছিল গ্রেগরীয় ক্যালেণ্ডার রূপে ৩৬৫ বা ৩৬৬ দিনের সৌরবৎসর ধরে নিয়ে, তার সঙ্গেই সম্পর্কযুক্ত করা হয়েছে সব অব্দকে। ‘শকাব্দ’ শুরু হয়েছিল ৭৮ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট কণিস্কের সিংহাসন আরোহণের বর্ষ থেকে। দক্ষিণ ভারতে এই শকাব্দ শকাদিত্য শালিবাহনের শাসনকালে প্রবর্তিত হয়েছিল বলে তা 'শালিবাহনাব্দ' নামে পরিচিত। ‘হর্ষাব্দ’ প্রচলিত হয় ৬০৬ খ্রিস্টাব্দে কান্যকুব্জরাজ হর্ষবর্ধনের সিংহাসন আরোহনের বর্ষ থেকে। সেই সময়ে পূর্বভারতে প্রতাপশালী রাজা ছিলেন কামরূপাধিপতি ভাস্করবর্মা বা ভাস্কর বর্মণ। বহু প্রাচীন কামরূপ দেশটির উল্লেখ রয়েছে তন্ত্র ও পুরাণাদিতে। কামরূপ অধিপতি ভগদত্ত মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে কৌরব পক্ষকে হাতি দিয়ে সাহায্য করেছিলেন বলে বিশ্বাস। ভাস্কর বর্মার সাহায্যেই হর্ষবর্ধন তাঁর ভগ্নীপতি গ্রহবর্মা ও দাদা রাজ্যবর্ধনের হত্যাকারী গৌররাজ শশাঙ্ককে শায়েস্তা করেছিলেন। হিউয়েন সাঙের বিবরণ মতে শশাঙ্কের মৃত্যুর পরে সমস্ত পশ্চিমবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গের অধিপতি হয়েছিলেন ভাস্কর বর্মা। তিনি কামরূপ সিংহাসন আরোহণ করেন ৫৯৩ খ্রিস্টাব্দে এবং সেই উপলক্ষে কামরূপ রাজ্যে চালু হয় ‘ভাস্করাব্দ’ বা কামরূপী সন। অনেকের ধারণা এই ভাস্করাব্দই হোল বঙ্গাব্দ-এর ভিত্তি। ২০২৩ থেকে ৫৯৩ বাদ দিলেই ১৪৩০। আসাম ও বাংলা পঞ্জিকায় ভাস্করাব্দের উল্লেখ ও গণনা এহেন বিশ্বাসকে দৃঢ় করে।

তাছাড়া, উল্লিখিত গোঁজামিল নিয়ে প্রাসঙ্গিক কিছু প্রশ্নও উঠে আসে। যেমন, আকবরের সাম্রাজ্য কেবলমাত্র বঙ্গদেশে সীমাবদ্ধ ছিল না। সারা ভারতের জন্য যদি তিনি একটি ‘অব্দ’ চালু করতে চাইতেন, তবে তাঁর নাম 'বঙ্গাব্দ' হবে কেন? সেই অব্দের নাম তো ভারতাব্দ বা মোগলাব্দ বা আকবরাব্দ হওয়া যুক্তিসঙ্গত। দ্বিতীয়ত, বঙ্গদেশ ছিল আকবরের সাম্রাজ্যের একটি ক্ষুদ্র অংশ। প্রবল প্রতাপাদিত্য মোগল সম্রাট তাঁর বিশাল সাম্রাজ্যের এক ক্ষুদ্র অংশের নামে একটি নতুন অব্দের নামকরণ করবেন, তাও আবার সৌর বৎসর ও চান্দ্র বৎসরের সমন্বয়ে এক জটিল প্রক্রিয়ায় প্রাপ্ত বর্ষের ধারণা থেকে, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য?

আসলে, মুসলমান শাসনের আগে পর্যন্ত সমগ্র কামরূপ অঞ্চলে যা চালু ছিল তার নাম ‘ভাস্করাব্দ’ বা কামরূপী সন। ভারতে মুসলমান শাসন প্রবর্তিত হওয়ার পর তাদের ধর্মীয় অব্দ হিজরি চালু হয়। কিন্তু তৎকালীন বঙ্গের বিস্তৃত অঞ্চল কামরূপে যেহেতু আগে থেকেই ভাস্করাব্দ প্রচলিত ছিল, তাই স্বাভাবিক কারণেই এখানে ভাস্করাব্দের শুরু ৫৯৩ খ্রিস্টাব্দকে বঙ্গাব্দ-এর সূচনা হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে। কামরূপের কেন্দ্রভূমি আসাম প্রদেশে তাই অব্দ হিসাবে অনুসরণ করা হয় ভাস্করাব্দকে।

হাতের কাছে পেলাম বাংলা ১৪২৩ সালের 'শ্রী মদন গুপ্তের ফুল পঞ্জিকা'। সেখানে অসমীয় সালকে ভাস্করাব্দের সঙ্গে যুক্ত করে বলা হয়েছে অসমীয়া (ভাস্করাব্দ) ১৪২৩। অর্থাৎ বাংলা গণনাকারক পণ্ডিতদের মতেও অসমে প্রচলিত অব্দের নাম ভাস্করাব্দ। আনিয়ে নিলাম অসমে প্রচলিত 'পূর্ণাঙ্গ প্রাগজ্যোতিষ পঞ্জিকা', ১৪২৩। এই পঞ্জিকায় ১লা বৈশাখ/বহাগ-এর উপরে বর্ষ শুরুতে লিখিত “১৪২৩ ভাস্করাব্দ দিন পঞ্জিকা আরম্ভ” এবং ৩১শে চৈত্র বর্ষ শেষে লিখিত “১৪২৩ ভাস্করাব্দর দিন পঞ্জিকা সমাপ্ত”। গণনাকারক পঞ্জিকাকারের মতানুসারে এই পঞ্জিকায় ‘ভাস্করাব্দ’কে অনুসরণ করা হয়েছে। তবে সেখানে সামান্য একটু ‘কিন্তু’ রয়েছে নববর্ষের দিন শুরুর দিক থেকে। ভাস্কর বর্মার সিংহাসন আরোহণের দিন থেকে শুরু অব্দ অনুসারে অসমের ১লা বহাগ হল ভাস্করাব্দ ২৫শে চৈত্র (১লা বৈশাখ নয়), ১৪ই এপ্রিল নয়, একুশে এপ্রিল। কিন্তু ভাস্করাব্দকে মেনে নিয়েও আসামের পণ্ডিতগণ বাংলার ১লা বৈশাখকে ভিত্তি করেই দিন-ক্ষণ-তিথি-নক্ষত্র গণনা করেছেন।