আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ দশম সংখ্যা ● ১৬-৩১ মে, ২০২৩ ● ১-১৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০

প্রবন্ধ

হ্যারি বেলাফ্যন্টেঃ প্রেম ও বিদ্রোহে

দেবজ্যোতি মিশ্র




দারিদ্র্য, সারা শরীর জুড়ে, দারিদ্র্যের মধ্যেই জন্ম তাঁর। নিজের জীবন কথায় অকপটে তিনি বললেন আমি দারিদ্র্যের মধ্যেই জন্মেছি, বেড়ে উঠেছি, জীবনের অনেকটা সময় পর্যন্ত শুধু দারিদ্র্যকেই চিনতাম, ওই দারিদ্র্যই আমায় সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করে। তবে আমরা, যাঁরা তার গান শুনে শৈশব থেকে কৈশোর যৌবন পেরিয়ে এসেছি, জানি এটা শুধু তাঁর চরিত্রকেই নয় তাঁর গানকেও নির্ধারিত করে দিয়েছে। হ্যারি বেলাফন্টে - বহু নামজাদা গায়কদের নক্ষত্রখচিত আকাশে সাধারণ, অতি সাধারণ মানুষের পয়গম্বর হয়ে এলেন তিনি। কিন্তু দারিদ্র্য যাঁর নিত্যসঙ্গী ছিল তাঁকে গান শেখালো কে? ভেবেছি আমরা কখনো?

তাঁকে গান শেখালো ক্যারিবিয়ান সাগরের জলে ঠিকরে পড়া ভোরের সূর্য আর… আর? আর অন্ধকারও। মা ছিলেন জামাইকার মেয়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন অভিবাসী হিসেবে। বাবার নাম হ্যারল্ড। রোজগারের জন্য আরও অন্যান্য অনেক মেয়েদের সঙ্গে রাস্তায় দাঁড়াতে হতো মা’কে। সেখান থেকে সাফাইকর্মী, কলকারখানায় কাজ ইত্যাদি বিভিন্ন কাজের জন্য ধনীরা আসতেন গাড়ি করে কাজের লোক খুঁজতে। তাদের কারোর প্রয়োজনের যোগ্য হয়ে উঠতে পারলে হ্যারির মা তাদের জিজ্ঞেস করতেন ছোট্ট হ্যারি-কে সঙ্গে রাখতে পারেন কিনা, তারা রাজী হলে হ্যারি সঙ্গে থাকত নয়তো সেখানকারই কোনো মহিলার কাছে হ্যারিকে রেখে মা যেতেন কাজে। এই ঘটনা হ্যারির মনে ভীষণভাবে দাগ কেটেছিল। তবে দাগ কেটেছিল ভালটূকু। হ্যারি বুঝেছিলেন এই যে দুঃখ ভাগ করে নেওয়া, এই যে বাড়িয়ে দেওয়া সাহায্যের হাত, সেটা আর একজন দরিদ্রেরই হাত। কোনও ধনী মানুষ কোনও দিনও বুঝতে পারবে না এই আবেগ, এই নিঃশর্ত নিঃস্বার্থ বন্ধনকে। এই ভাবনাই পরবর্তী জীবনে তাঁর গানের রূপ পেয়েছে।

মঞ্চে আসতেন এমন একটা পোষাক পরে যাতে তাঁর শ্যামলা শরীরের অনেকটা দেখা যায়, এই পোষাক দিয়ে যেন বুঝিয়ে দিতে চাইতেন কালো মানুষের দমটা আসলে ঠিক কোথায়। গানের মঞ্চকে উনি বরাবর ব্যবহার করেছেন এক থিয়েটারের মত। এবং মঞ্চে তাঁর সঙ্গে দর্শক শ্রোতাদের একটা গল্প তৈরি হতো এবং সেই গল্প হতো একেক দিন একেক রকম, প্রতিদিন নতুন করে। এ এক বিস্ময়ের জায়গা! হ্যারির সঙ্গে দর্শকের যোগাযোগও ঘটত থিয়েটারের মতই সরাসরি, সোজাসুজি।

তাঁর বিখ্যাত 'জামাইকান ফেয়ারওয়েল'-এও আমরা দেখি মাত্র তিনটি কর্ডে যে একটা ওরকম হৃদয় দোলানো গান গাওয়া যায় এও অবিশ্বাস্য, শুধু সুরই নয় তার ভাষাও অত্যন্ত সোজা সরল। একজন মিউজিশিয়ান হিসেবে প্রচুর কর্ড, প্রচুর নোটেশন, হারমনি ইত্যাদির মধ্যে দাঁড়িয়ে অবাক বিস্ময়ে দেখি কীভাবে মাত্র তিনটি কর্ডে গাওয়া এই গান প্রতিটি মানুষকে তার সারল্যের সামনে নতজানু হতে বাধ্য করেছে। আমাদের প্রত্যেককেই কোনও না কোনও দিন কিছু না কিছুকে ফেলে আসতে হয় ছেড়ে আসতে হয়। কাউকে নিজের গ্রাম, কাউকে পরিবার, কারোর পেছনে পড়ে থাকে শৈশবের আনন্দ-স্মৃতি। এগোনোর সঙ্গেই থাকে সেই ফেলে আসা, ছেড়ে আসার কষ্ট, 'জামাইকা ফেয়ারওয়েল' সেই প্রতিটি কষ্টের ছবি আঁকে যেন। রঞ্জন প্রসাদ যখন এরই সুরে তৈরি করলেন ‘পথের প্রান্তে ওই সুদূর গাঁয়ে /যেথা সময় থমকে থামে বটের ছায়ে’ বাংলা তার বুকে খুঁজে পেল এক কিংসটন টাউনকে। কিংসটন আর বাংলা তাদের ভৌগোলিক দূরত্ব ঘুচিয়ে বাঁধা পড়ল এক সরল সোজাসাপটা সুরে, সরল উচ্চারণে। এতটাই সহজ সেটা যে সে একই সাথে উঠে এলো বাংলার প্রত্যন্ত গ্রাম বা মফস্বলের গলায় আবার একইভাবে খোদ কলকাতার পাকা গাইয়েরাও সুর মেলাল এতে।

ক্যারিবিয়ান সাগরের তীরে সার বাঁধা দ্বীপগুলোর গল্প বলতেন হ্যারি। ওই যে প্রথমেই বলেছিলাম কে তৈরি করল তাঁর গান? গান তৈরি হয়েছিল সমুদ্রের নোনা জলের সঙ্গে দ্বীপের লোকগুলোর ঘাম মিশে গিয়ে। সেই দ্বীপ ছিল তাদেরই। তাই গাইলেন -

‘দিস ইজ মাই আইল্যান্ড ইন দ্য সান
হোয়্যার মাই পিপল হ্যাভ টয়েলড সিন্স টাইম বিগান
আই মে সেল অর মে সী
দেয়ার শোরস উইল অলওয়েজ বি হোম ফর মি...’

বললেন আমি তীরে থাকি বা জলে আমি তোমার কথাই, তোমাদের কথাই বলব। সবসময়।

তাই-ই বলে গিয়েছেন হ্যারি। আজীবন। গানের মধ্যে দিয়ে ছবি এঁকেছেন তিনি। সে 'কোকোনাট ওম্যান'ই হোক বা 'জামাইকা ফেয়ারওয়েল' বা 'স্কারলেট রিবন'। অদ্ভুত এক ক্রিস্পি আওয়াজ ছিল তাঁর। তাঁর আওয়াজে, উচ্চারণে মঞ্চে দৃপ্ত সাবলীল আত্মবিশ্বাসী চলাফেরায় সেসব গান হয়ে উঠত পৃথিবীজোড়া সেইসব মানুষের গান যাদের কথা শুনতে চিরকাল অনীহা শাসকবর্গের। হ্যারি বললেন তাদের কথা।

হ্যারি বেলাফন্টে এক প্রতিবাদের নাম। হাজারো বৈষম্যের মাঝখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছেন বারবার। দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে বলেছেনঃ

‘অ্যাঞ্জেলিনা অ্যাঞ্জেলিনা
প্লিজ ব্রিং ডাউন ইয়োর কনসার্টিনা
অ্যান্ড প্লে আ ওয়েলকাম ফর মি
কজ আই উইল বি কামিং হোম ফ্রম সী...’

আমায় স্বাগত জানাও, আমি ফিরছি আমারই ঘরে আমারই দেশে। ক্যাপিটাল সর্বস্ব আমেরিকা কখনও শুনতে চায়নি যাদের গান, সেই গান গেয়ে বললেন আমেরিকা আমারও দেশ। সেই সময় ছিল না ‘ব্ল্যাক লাইভ ম্যটারস’-এর মতো কোন স্লোগান বা মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়া সোশ্যাল মিডিয়া বিপ্লব, সেই সময় দাঁড়িয়ে হ্যারি গেয়েছেন এই গান। যে গানে চিৎকার করে নিজের দাবি জানানো নেই কিন্তু অদ্ভুত এক প্রত্যয় আছে যাকে অগ্রাহ্য করা যায় না, করতে পারেনি তৎকালীন আমেরিকা। কেউই কি পেরেছি আমরা হ্যারিকে সরিয়ে রাখতে? সেই মার্টিন লুথার কিং থেকে জর্জ ফ্লয়েড, মানবাধিকারের জন্য এ লড়াই, বৈষম্যের বিরুদ্ধে অন্তহীন এ লড়াই চলেছেই। হ্যারি বেলাফ্যন্টেরা তো আসলে অমর।

জোয়ান বায়েজ়-এর মতো শিল্পী বলেছেন আমার ছোটবেলায় পিট সিগার, ওডেটা কিংবা কিংসটন ট্রায়োর আগে, আমার কাছে ছিলেন বেলাফন্টে। মা’র সঙ্গে বসে অ্যালবাম কভারে এই সুপুরুষ মানুষটির ছবি দেখতে দেখতে আমি তাঁর অদ্ভুত এক স্ক্র্যাচি আওয়াজে গাওয়া 'স্কারলেট রিবন' শুনতাম। তিনি বলছেন আমি সেই সময় বেলাফন্টে ছাড়া আর কিছু শুনতামই না। এমনকি প্রথমবার উকুলেলে ছেড়ে যখন গীটার ধরলাম এবং ভয়ে ভয়ে প্রথম রেকর্ডিং করলাম তখনও বারোটার মধ্যে ছ'টা গান বেলাফন্টেরই ছিল। এমনই ছিল তার ব্যাপ্তি তার জনপ্রিয়তা। বায়েজ় তখন ভাবতেও পারেননি আর মাত্র দশ বছর পরেই সেই ম্যাজিক স্ক্র্যাচি কন্ঠ এবং বাদামী ভেলভেট মুখের হ্যারির সঙ্গে আলাবামার মন্টগোমেরিতে তিনি পাশাপাশি হাঁটবেন! তখন বায়েজ এটাও জানতেন না যে অহিংসা আর মানবাধিকারের প্রতি হ্যারির দায়বদ্ধতা ছিল আন্তরিক এবং সেই বিশ্বাস থেকে আজীবন তাঁকে টলানো যায়নি। যে বিপ্লব থেকে তাঁর গানের জন্ম, হ্যারি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেই বিপ্লবের কথা বলে গেছেন, তার গানে তার কথায়। হ্যারির যখন জীবন প্রদীপ প্রায় নিভে এসেছে তখন বায়েজ় গিয়েছিলেন ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে তাঁকে দেখতে, বায়েজ বলছেন গায়ক হ্যারি তখন প্রায় অন্ধ, তাঁর স্ত্রী তাঁকে যা বলছিলেন তা বোধহয় তিনি শুনতেও পাচ্ছিলেন না কিন্তু তবু তাঁর চওড়া হাসিতে, তার মজার মন্তব্যে আমরা তাঁর রাজকীয় উপস্থিতি টের পাচ্ছিলাম প্রতি মুহুর্তে।

বায়েজ়ের কথার রেশ রেখেই বলি তার রাজকীয় উপস্থিতি টের পাই আমরাও। আসলে সেই সময়টাই ছিল উত্তাল ঢেউয়ের। সে এক অদ্ভুত সময়! ক্যারিবিয়নের তীরে মানুষের জন্য মানুষের গান গাইছেন বেলাফন্টে আর আরব সাগরের নোনা জলে উদ্দাম উচ্ছ্বাস শুনতে পাচ্ছি সলিল চৌধুরীর সুরে। বিস্ময়কর দুই সমকালীন প্রতিভা নিজের নিজের জায়গায় নিজের মত করে মানুষের কথা বলছেন। বেলাফন্টে গাইছেন -

‘ডে ও, ডে ও
ডে লাইট কাম অ্যান্ড উই ওয়ান্ট টু গো হোম...’

সলিল চৌধুরী তৈরি করছেন 'হেই সামালো ধান হো' - মাঝে যোজন যোজন দূরত্ব উধাও হয়ে যাচ্ছে মুহূর্তে। আমরা শুনতে পাচ্ছি দুটি ভাষায় দু'রকম বিপ্লবের গান। আমরা শুনতে পাচ্ছি সাগরের নোনা জলে, নারকেল পাতার আওয়াজে, সোনালী বালিতে মিশে যাচ্ছে প্রেমের সঙ্গে বিপ্লব আর বিপ্লবের মধ্যে প্রেমের সুর।

হ্যারি চলে গেলেন ছিয়ানব্বইয়ে, সলিল চৌধুরীর শতবর্ষ আগত প্রায়। পাঠক! যুগে যুগে বিস্ময় প্রতিভা কি শুধুই আশ্চর্য সমাপতন? না কি ইতিহাস লিখবে বলেই এই সুরের জাদুকরদের জন্ম? এ প্রশ্নের উত্তর তো আমিও খুঁজছি।