আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ দশম সংখ্যা ● ১৬-৩১ মে, ২০২৩ ● ১-১৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০

প্রবন্ধ

চার্লস ডারউইন এবং তাঁর অদৃশ্য প্রতিদ্বন্দ্বীরা

স্বপন ভট্টাচার্য


যেভাবেই দেখা যাক না কেন ডারঊইনের বিবর্তনবাদের মত ‘গ্রেট লেভেলার’ আজকের এই বিশ্বায়িত জগতে সত্যিই বিরল। ১৮৫৯-এ ‘অরিজিন অফ স্পিসিস’ প্রকাশিত হবার পর থেকেই বিতর্ক তাঁর পাশ ছাড়েনি কিন্তু আর কোনো মতবাদ এভাবে খ্রিস্টান, মুসলমান, ইহুদী এবং হিন্দু পরমেশ্বরবাদীদের এক প্ল্যাটফর্মে দাঁড় করাতে পারেনি যা তিনি পেরেছেন। শুনতে যতই অবাক লাগুক না কেন একথা সত্য যে বিবর্তনবাদকে এখনো পর্যন্ত প্রাসঙ্গিকতার পরীক্ষা দিতে হচ্ছে কোনো বিকল্প বিজ্ঞানসূত্রের সঙ্গে নয়, সৃষ্টিবাদ বা ‘ক্রিয়েশিনজম’-এর সঙ্গে। এদের মধ্যে একটা দৃশ্যজগতের থেকে উপাদান সংগ্রহ করে একটা প্রকল্পকে দাঁড় করাতে চায় আর অপরটির ভিত্তি বিশ্বাস, দৃশ্যমান হবার কোন দায় নেই তার।

একথা ঠিক, একটা বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব বিতর্ক ছাড়া মেনে নেবার দায় নেই কারও ! বিবর্তনবাদও বিনা তর্কে আজও মেনে নেয় না বিজ্ঞানজগত। ভুলে গেলে চলবে না, জোহান গ্রেগর মেন্ডেল নামের একজন পাদ্রী চার্চের নিরীক্ষণের আওতায় থেকেই মটর গাছ নিয়ে কৌতুহলজনিত কারণে যেসব পরীক্ষা চালাতে পেরেছিলেন এবং যার ফলশ্রুতি জিনতত্ত্বের প্রথম পাঠ, তা ডারউইন প্রবর্তিত বিবর্তনবাদকে শুরু থেকেই পরিবর্তিত প্রেক্ষিতে দেখতে বাধ্য করছিল, কিন্তু পরিমার্জন-পরিবর্ধন এগুলো সেই বিজ্ঞানপ্রকল্পেরই অংশ যার একটা ভাবিয়ে তোলার মত ভিত্তি আছে। পাদ্রী মেন্ডেল প্রবর্তিত বংশগতির সূত্র, প্রস্তাবনার ছাব্বিশ বছর পরে, ম্যুনিখের ডিপোজিটরি থেকে ধুলো ঝেড়ে বার করার পর থেকে জেনেটিক্স এগিয়ে গিয়েছে ঝড়ের গতিতে। পরমেশ্বরবাদী চিন্তকরা এর ব্যখ্যা নিজেদের মত করে দিতে চাননি তা নয় বরং ইউজেনিক্স বা সদ-জিন এবং অসদ-জিনের মত সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রস্তাবনাকে দু’হাতে গ্রহণ করে গায়ের রঙ, মেধা, সাফল্যকে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন তাঁরা। সে চেষ্টা যে এখনো জারি নেই তা বলা যাবে না। ডিএনএ-এর গঠন বর্ণনা করে যে জেমস ওয়াটসন জীবনসূত্র তুলে দিয়েছিলেন বিজ্ঞানবিশ্বের হাতে, তিনি পর্যন্ত কিনা ২০০৭ সালে বলে বসলেন আফ্রিকার ভবিষ্যৎ ‘ইনহেরেন্টলি গ্লুমি’ (অর্থাৎ এই যে জিনগতভাবে সফল হইবার উপাদান তাহাদের মধ্যে কিছু কম রহিয়াছে)!



ডারউইনকে নিয়ে সমস্যা হল বিবর্তনকে অবাঙমানসগোচরীয় আশীর্বাদরূপে মোচড়ানোর অনেক সুযোগ থাকলেও তাঁর প্রস্তাবনার দৃশ্য-প্রমাণ প্রচুর, ফলে ওই মোচড়ের চেষ্টা হয়নি তা নয়, কিন্তু সুবিধে হয়নি। বিজ্ঞান আর অপবিজ্ঞানের আর কোন লড়াই এত দীর্ঘদিন ধরে জারি নেই। ভূকেন্দ্রিক ব্রহ্মাণ্ডের ধারণা নস্যাৎ হয়ে যাবার পর প্রকৃতিবিজ্ঞানের আর কোন ব্যাখ্যাকেই অতিজাগতিক বাসনার সঙ্গে রাজ বা রাষ্ট্রনীতিক স্তরে এতটা মোকাবিলা করতে হয়নি যা হয়ে চলেছে ডারউইনের তত্ত্বকে নিয়ে। তবে বিজ্ঞানের কোনো প্রস্তাবনা যদি এতটাই বিতর্কিত হয় যে সেটাকে দেড়শ বছর পরেও চেতনা ও অতিচেতনা উভয় স্তরেই ক্রমবর্ধিষ্ণু আক্রমণের মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাহলে ভরসা জাগে এই ভেবে যে বিষয়টার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি সুদৃঢ়!

এটা ঠিক, প্রাণের উদ্ভব ঠিক কীভাবে ঘটেছিল তা অন্তত আজ পর্যন্ত ল্যাবরেটারিতে প্রমাণ করা যায়নি, কিন্তু সে তো অতি প্রাচীনকালে ‘স্রষ্টা’ কিভাবে করে বসলেন, তাও প্রমাণিত হয়নি। কিন্তু সৃষ্টির পর জীবনের অভূতপূর্ব বহুধা বিন্যাস জীবিত প্রাণ এবং বিলুপ্ত প্রাণের ফসিল যার সাক্ষ্য বহন করছে, ভ্রূণের বিকাশ যার সাক্ষ্য বহন করে, বাঁচবার পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার নিদর্শনগুলি যে সাক্ষ্য বহন করে, প্রকৃতি দ্বারা নির্বাচত হয়ে টিকে থাকা বা পরিত্যাজ্য বিবেচনায় হারিয়ে যাওয়ার এত প্রামাণ্য নজির রয়ে গেছে আমাদের দৃশ্য-জগতে যে সেটাকে অস্বীকার করলে নীহারিকামন্ডলীকে, সৌরজগতকে, কন্টিনেন্টাল ড্রিফটকে, অনু-পরমাণুকে, জীনতত্ত্বকে এবং যে কোনো তত্ত্বের নিরিখেই গোটা বিবর্তনবাদ বিষয়টিকেই অস্বীকার করতে হয়। ডারউইনের বিবর্তনবাদকে বিজ্ঞানজগত প্রকল্পটির প্রস্তাবনার সময় থেকে আজ পর্যন্ত অবিসংবাদিতভাবে স্বতঃসিদ্ধ বলে মেনে নেয়নি। এখনো তা অতি জীবন্ত বৈজ্ঞানিক গবেষণার বিষয় এবং আজও এটির পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন এবং ব্যাখ্যা নিয়ে অগণিত গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়ে চলেছে, কিন্তু কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতেই বিবর্তনকে, তার গতিময়তাকে এবং উৎসপ্রাণ থেকে বহুধা বিভক্ত প্রাণের ধারণাকে উড়িয়ে দেওয়া যায়নি।

মাইকেল রুস (Darwinism and Its Discontents. Michael Ruse. Cambridge University Press, 2006.) তাঁর ২০০৬-তে প্রকাশিত গ্রন্থে ক্রিয়েশনিস্টদের সঙ্গে এক পংক্তিতে বসিয়েছেন সেইসব সেকুলার বিজ্ঞানীদের যারা ‘পরম চেতনা’-কে না মানলেও ‘ন্যাচারাল সিলেকশন’ বা যোগ্যতমের উদবর্তন-কে হয় মেনে নিতে পারেননি নয়তো নিজেদের সমাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অ্যাজেন্ডা প্রচারের কাজে তা ব্যবহার করেছেন। রুস-এর মতে বিবর্তনবাদকে ঘিরে এত যে বিবাদ-বিসম্বাদ এর উৎস রয়েছে অষ্টাদশ শতাব্দীতে। এই সময়কার ‘এনলাইটেনমেন্ট থিংকার’ - যাদের মধ্যে পড়েন ডারউইনের নিজের পিতামহও - তাঁরা সৃষ্টির একটা অখ্রিস্টীয় ব্যাখ্যার খোঁজে ছিলেন বিবর্তনবাদ প্রস্তাবিত হবার প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে থেকেই। সে যুগের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রাগ্রসরতার ব্যাখ্যায় একটা বায়োলজিক্যাল ন্যারেটিভ-এর প্রয়োজন ছিল। ডারউইনের প্রস্তাবিত সে ব্যাখ্যা যে ক্রিয়েশনিজমের প্রতিস্পর্ধী হয়ে উঠেছে এ নেহাতই সমাপতন, কেন না ডারউইন কখনো 'ওল্ড টেস্টামেন্ট' বা ‘বুক অফ জেনেসিস’-কে খারিজ করতে ঢাল-তরোয়াল হাতে নেমে পড়েননি এবং ততোধিক উল্লেখযোগ্য হল সে যুগের রক্ষণশীল খ্রিস্টানরাও ডারউইনকে পড়ামাত্র খারিজ করার নিদান দেননি। বস্তুত সৃষ্টির একটা মেটাফিজিক্যাল ব্যাখ্যা দেওয়াই বরাবর ছিল বিজ্ঞান-দর্শনের মূল লক্ষ্য, সেখানে ডারউইন ব্যাখ্যা দিয়ে বসলেন প্রাকৃত বিশ্ব বা ফিজিক্যাল ওয়ার্ল্ডের রেগুলারিটি বা নিত্যতার। সৃষ্টিকে একটা বায়োলজিক্যাল দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যখ্যা করতে গেলে এই যে কোন মেটাফিজিক্যাল ওয়ার্ল্ডভিউ দরকার হচ্ছে না - সেটা একই সঙ্গে ডারউইনের সাফল্য এবং সেই সময়ের নিরিখে একটা আকস্মিকতাও বটে । তিনি না চাইলেও, বিতর্ক যে তাঁর সঙ্গ ছাড়লো না তার একটাই কারণ, যতই বিবর্তনবাদ বৈজ্ঞানিকভাবে প্রামাণ্য প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, ততই তাকে অবৈজ্ঞানিক পরিসরে ডুয়েল লড়তে আহ্বান করা হয়েছে।

বিবর্তনবাদের বিকল্প যদি আসে (আসতে যে পারে সেটা বিজ্ঞানের ভিত্তিভূমি থেকে অস্বীকার করা অসম্ভব) তাহলেও সেটা ডারউইনের নিরীক্ষণগুলিকে মনগড়া বলে উড়িয়ে দিতে পারবে না, এতটাই দৃঢ় ও দৃষ্টিগ্রাহ্য সেগুলি। অবিজ্ঞান অবশ্য যুক্তির ও প্রমাণের ধার ধারে না, কেন না দৃশ্যমাণ জগত থেকে কোনো বিকল্প তাস তার পক্ষে ফেলা অসম্ভব। সুতরাং সে চাপিয়ে দিতে চাইবে। প্রমাণরহিত বিষয়কে প্রামাণ্য বলে চালানো এমনকি শিশুমগজেও আবেদন রাখতে সক্ষম হবে না অনুমানে সে চাইবে রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার করে বিষয়ের আওতা থেকে মগজকে বিচ্ছিন্ন রাখতে। সুতরাং বিবর্তনবাদ সিলেবাসের বাইরে যাবে - এতে অবাক হওয়ার মত কিছু দেখি না।

২০১৮-তে মানবসম্পদ বিকাশ দপ্তরের ছোট মন্ত্রী সত্যপাল সিং প্রথম ইঙ্গিত দেন কী রয়েছে তাঁদের ভাবনায়। ডারউইনের বিবর্তনবাদকে ‘অবিজ্ঞান’ লেবেলে দেগে দিয়ে তিনি একটা যুগান্তকারী ‘কোট’ দিয়েছিলেন এই মর্মে যে - বাঁদরকে মানুষে রূপান্তরিত হতে কেউ দেখেনি। অর্থাৎ এই যে, মানুষ মানুষ রূপেই ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছিল, তাকে কোন বিবর্তনের মাইলস্টোন পার হতে হয়নি। কথা হল এই যে, আজকেও মোটামুটিভাবে এই একই যুক্তিকে ব্যবহার করা হয় পরমেশ্বরবাদীদের দ্বারা বিজ্ঞানের কোটিং লাগিয়ে। প্রশ্ন তোলা হয় প্রাইমেট থেকে মানুষের বিবর্তনের সমর্থনে এখনও পর্যন্ত প্রত্নবিজ্ঞান কোন অবিসংবাদিত মিসিং লিংক সামনে আনতে পারেনি অর্থাৎ জেনাস ‘হোমো’ প্রায় স্বতঃউদ্ভুত, তাঁদের মতে। এমন ডারউইন বিরোধীদের মধ্যে একজন হলেন এ. এন. উইলসন (Charles Darwin: Victorian Mythmaker by A. N. Wilson; John Murray, 2017), যিনি ডারউইনকে ভন্ডামি, চৌর্যবৃত্তি, এমনকি নাৎসি মানসিকতার জনকরূপে দেগে দিয়েছেন। উইলসনের এই ‘exposé’ এবং তার আবেদন ইংরেজি ভাষাভাষী জগতে, যারা খোঁজ রাখেন জানেন, কিছু কম নয়। অথবা দেখে নেওয়া যেতে পারে নেটফ্লিক্স-এ প্রচারিত একটি ডকু সিনেমা - ‘A Matter of Faith’ যার শেষ দৃশ্যে এক কল্পিত বিজ্ঞানী রাবার চিকেন হাতে নিয়ে ভাবছেন কোনটা আগে - ডিম না মুরগি? বিবর্তন এত জীবন্ত ঘটমান বিষয় যে কেবল মিসিং লিংকের যুক্তিতে তাকে কাল্পনিক বলাটা মুশকিল এটা যারা ডারউইনের বিরোধিতা করে তারাও জানে। যে কোন মিউজিয়ামে বিবর্তনের পথে উদ্ভব ও অবলুপ্তির এত কাঁড়ি কাঁড়ি নজির রয়েছে এবং প্রত্ন-গবেষণা আজ জিনবিদ্যার সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে চলে মানুষের উদ্ভব, বিকাশ, মাইগ্রেশন এবং প্রাইমেটদের সঙ্গে আমাদের জিনসাম্য বা হোমোলজি’র এত নজির সামনে আনছে যে শুধু গালি দিয়ে ডারউইনকে ঠেকানো মুশকিল হয়ে যাচ্ছে।

এমনকি ধর্মনিরপেক্ষভাবে দেখলেও দেখা যাবে যে, গড়পড়তা বিজ্ঞানশিক্ষার গোড়ায় একটা গলদ আছে। তা হল একান্তই মনুষ্যকেন্দ্রিক বীশ্ববীক্ষা। আমরা গোড়া থেকেই খুব সচেতন ব্রহ্মান্ডে আমাদের স্পেশাল স্টেটাস নিয়ে। এ আমাদের বহুদিনের অধীত এবং সংস্কৃতিলব্ধ বিশ্বাস। এই কারণেই সূর্যকেন্দ্রিক সৌরমণ্ডলের ধারণাকে মেনে নিতে এত কষ্ট হচ্ছিল চার্চের। লুই পাস্তুরের অতি সাধারণ পরীক্ষা যখন দেখালো জীবন আসে পূর্ববর্তী জীবন থেকেই তখন হাওয়া থেকে, জল থেকে, দৈবী কৃপা থেকে জীবনের উদ্ভবের নানা প্রকল্পের সঙ্গে দোন কিহোতের মত যুদ্ধ করতে হয়নি তাঁকে কেন না বিশ্বাস ও যুক্তির পথ ততদিনে আলাদা হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো আমাদের বিশ্বাস করানো হয় যে আমরা এ মহাবিশ্বের কেন্দ্রে থাকি না বটে, কিন্তু আমরা সৃষ্টি হিসেবে বিশেষ।

ডারউইনবাদ এই ধারণার গোড়ায় আঘাত। মানুষের এই ‘বিশেষ’ অবস্থানকে বিবর্তনবাদ মানলে হজম করা মুশকিল। যে জীবনধারার অংশ অ্যামিবা, ছত্রাক, গিরগিটি, মাছ বা বাঁদর - মানুষও সেই জীবনধারাতেই পুষ্ট হয়েছে এই সত্য আজকের জিনযুগে শিশুবোধের অন্তর্গত হওয়া উচিৎ কিন্তু তাতে রাষ্ট্রের, বোঝাই যাচ্ছে, কিছু সমস্যা থাকে যদি ধর্মীয় বিশ্বাসের পথে তা অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। অথচ বিবর্তনবাদকে বিপজ্জনক না ভেবে নিয়ে ধর্মচর্চায় কোনো বাধা থাকার কথা নয় যদি বিষয়টি গোঁড়ামি বর্জন করে দেখা যায় যদিও মহামতি পোপ ১৯৯৬-তে বিবর্তনবাদ মেনে নেবার কথা বলে ‘ইনসেন’ আখ্যা পেয়েছেন তাঁরই অনুগামীদের কাছে।

এদেশে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলি যে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালায় তাদের কখনো কোনদিন বিবর্তনবাদকে নিয়ে বড়সড় কোন সমস্যা হয়েছে বলে শুনিনি যা আমেরিকার দক্ষিণের বহু প্রদেশে এখনো জীবন্ত ইস্যু। সেখানে রিপাবলিকান জনভিত্তির অন্যতম গোড়ার কথাই হল ‘ক্রিয়েশনিজম’-এ অসংশয়ী আস্থা। বোঝা মুশকিল সমস্ত জীবের মধ্য দিয়ে সৃষ্টির যে ধারাটি প্রবাহিত হয়ে চলেছে তা ঈশ্বরের ধারণার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠল কীভাবে, আর উঠল যদিও বা, আজও এই একুশ শতকে তা পুষ্ট হচ্ছে কীভাবে? এর দু’টো কারণ রয়েছে বলে মনে হয় - দৃশ্যমান জগতে যার প্রমাণ নেই তাকে বিশ্বাসের আওতায় আনতে গেলে যে অন্ধত্ব লাগে বিজ্ঞান হাজার চেষ্টাতেও তার সঙ্গে সহাবস্থান করতে পারবে না, আর দুই - মানুষকে বিবর্তনের উচ্চতম অবস্থানে স্বীকার করতে বাধা না থাকলেও জীবনের বৃহত্তর পরিসরে তার অবস্থান অদ্বিতীয় নয় বরং বহুর মধ্যে এক, একথা বিজ্ঞান অস্বীকার করতে পারবে না। সুতরাং ব্যান করো, পাঠ্যসূচি থেকে বাদ দাও। সৌদি আরব, তিউনিসিয়া, মরক্কো, ওমান, আলজিরিয়াতে বিবর্তনবাদ পাঠ্যসূচির অন্তর্গতই নয়, লেবাননে, মিশরে তা পড়ানো হয় ধর্মীয় কাঠামোর মধ্যে এবং পাকিস্তানে এই বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ দিয়ে যে, উল্লিখিত প্রস্তাবনা ইসলাম-বিরোধিতায় দুষ্ট।

ভারতে, সত্যপাল মালিক যদিও আজ মন্ত্রী নন আর, কিন্তু তাঁর অ্যাজেন্ডা রূপায়নের পথে বিজেপি সরকার এগিয়ে গেল বিবর্তনবাদকে স্কুল সিলেবাসের আওতা থেকে বাদ দিয়ে। অর্থাৎ, যে কোনোদিন উচ্চশিক্ষায় জীবন বিজ্ঞান বিষয় হিসেবে নেবে না, সে বিবর্তনবাদ সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা না নিয়েই উচ্চশিক্ষিত হয়ে দাঁড়াবে, চলতি ভাষায় যাকে বলে ‘মানুষ’ হবে। এতে অবশ্য প্রকল্পটির দৃঢ় ভিত্তি সম্পর্কে আর একবার নিশ্চিন্ত হওয়ার অবকাশ থাকল, কেন না বোঝাই যাচ্ছে আর পাঁচটা বৈজ্ঞানিক প্রকল্পের মত ডারউইনবাদ কেবল বিজ্ঞানী বা দার্শনিকের মগজে ঝড় তোলেনি, তাকে নিয়ে চিন্তিত যারা তাদের হয়ত ন্যূনতম বায়োলজির ট্রেনিংটাও নেই। ডারউইন ভাবাতে পেরেছেন ধর্ম ও জিরাফের সব উপাদানকেই, সেটাই তাঁর বিরাট সাফল্য।

ডারউইনবাদ নিয়ে আজও চিন্তিত ধর্মগুরু ও রাষ্ট্রনায়ক, আইনজীবি ও আইনপ্রণেতা - এ বড় কম কথা নয়। বলছি না বিজ্ঞান কারোর জন্য ‘অফ-লিমিট’ হয়ে যাওয়া উচিৎ, কিন্তু বিবর্তনকে যত সহজে ছেঁটে ফেলতে চান তারা, তারা জন্মকে তেমনভাবে ছেঁটে ফেলার কথা ভাবেন? অভিকর্ষবল নিয়ে এত চিন্তিত হন কি তারা? সাব-এটমিক কণা যা চোখে দেখা যায় না, তাকে নিয়ে? যত গোল ডারউইনকে নিয়ে এবং গদি আঁটা চেয়ারে বসলেই এ সম্পর্কে মতামত দেবার এক্তিয়ার পাওয়া যায়? মনে হয় এর পেছনের কারণটি গূঢ় মনস্তত্ববাদের সঙ্গে সম্পর্কিত। দৃশ্যমান জগতে, সৃষ্টির মহাফেজখানায় মানুষের ‘বিশেষ’ আশির্বাদধন্য স্টেটাসটিকে তেমন আমল দেয় না বিবর্তনবাদ। নার্ভাসনেসের উৎস সেটাই কেন না ‘এলেম আমি কোথা হতে’ এই প্রশ্ন যে উত্তরের অবতারণা করবে তাতে বিশ্বাসে মুক্তি মেলানোর রাস্তা কিছু দুর্গম বিবেচিত হতে বাধ্য। তাই ছেঁটে ফেলার নিদান। শুরুতেই বলেছিলাম ডারউইনবাদ এক ‘গ্রেট লেভেলার’, ইসলামী বিশ্বের এক বড় অংশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আজ ভারতের শিক্ষাব্যবস্থাতেও তিনি ব্রাত্য হয়ে গেলেন।