আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ দশম সংখ্যা ● ১৬-৩১ মে, ২০২৩ ● ১-১৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০

সমসাময়িক

সোনার মেয়েরা আজ রাস্তায়


দেশের হয়ে অলিম্পিক ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পদকজয়ী মহিলা ও পুরুষ কুস্তিগীররা ১৯ দিন ধরে দ্বিতীয় দফায় দিল্লীর যন্তর মন্তর চত্বরে ধর্ণায় বসে রয়েছেন। এর আগেও তারা জানুয়ারি মাসে ধর্ণায় বসেছিলেন। ইতিমধ্যেই তাদের এই প্রতিবাদী ধর্ণায় দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব গিয়ে সংহতি জানিয়েছেন। এমনকি সংযুক্ত কৃষক মহাসভার নেতৃত্বও কুস্তিগীরদের এই আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে সেখানে যোগ দিয়েছেন। অন্যদিকে দেশের শাসকদল বিজেপি ও তার অনুগামীরা মৃদুস্বরে এই আন্দোলনকে সুবিধাবাদী আন্দোলন বলে ইতিউতি বলে বেড়াচ্ছেন।

খোদ লেখক যেমন 'বিশ্বাসঘাতক' উপন্যাস শুরু করেছিলেন 'what a fine list of suspected traitors', সেকথাই ধার করে বলা যায়, 'what a fine list of protestors'। এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ জয়ী কুস্তিগীর সাক্ষী মালিক, আরেক অলিম্পিক ব্রোঞ্জ বিজেতা বজরং পুনিয়া, কমনওয়েলথ-এ সোনাজয়ী বিনেশ ফোগত, সঙ্গীতা ফোগত সহ ২৩ জন কুস্তিগীর। মজার বিষয় হল বিজেপি ও তার অনুচরেরা যাই প্রচার করুক না কেন, এ তথ্য পরিষ্কার যে এই প্রতিবাদী কুস্তিগীরদের সবাই বিজেপি বিরোধী রাজনীতির শিবিরের দ্বারা অনুপ্রাণিত নন। হয়ত অনেকেরই মনে থাকবে এই খ্যাতনামা ফোগত পরিবার থেকে এক কন্যা বিজেপির হয়েই গত লোকসভা নির্বাচনে লড়েছেন এবং জিতেছেন। এমনকি রাজধানীর উপকন্ঠে যখন কৃষকরা আন্দোলন করছিলেন গত বছর তখন এদেরই কেউ কেউ 'amecable solution' চেয়ে টুইটও করেছেন। সুতরাং এই প্রতিবাদ আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র নয়। বরং এটা যে দেশের হয়ে খ্যাতি অর্জন করে আসা মহিলা কুস্তিগীরদের, সর্বোপরি দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের মহিলা ক্রীড়াবিদদের একটি সাধারণ সমস্যাকেই নির্দেশ করছে।

কুস্তিগীরদের এই প্রতিবাদ কেন? তারা মূল যে অভিযোগ তুলেছেন তা হল দেশের কুস্তি নিয়ামক সংস্থার সভাপতি, বিজেপি সাংসদ ব্রিজভূষণ সরন সিং সহ জাতীয় শিবিরের একাধিক কোচেরা মিলে মহিলা কুস্তিগীরদের সন্মানহানী করেছেন, শারীরিক হেনস্থা করেছেন। এই অভিযোগ তারা আজ নয়, বিগত জানুয়ারি মাস থেকেই করেছেন। তখন আন্দোলন শুরু হওয়ার পর কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর, যিনি আবার দিল্লী দাঙ্গায় নাকি যুক্ত, এবং কেন্দ্র সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব আশ্বাস দেন যে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে এবং সেই কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অলিম্পিক সোনাজয়ী বক্সার মেরি কম-কে মাথায় রেখে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। কিন্তু আজ অবধি সেই কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়নি। ফলে দেশের প্রথিতযশা কুস্তিগীররা আবার রাস্তায় নেমেছেন। তাঁরা একথাই বলছেন যে সরকার তাদের সাথে প্রতারণা করেছে। জানুয়ারি মাসে আন্দোলন তুলে নিয়ে তারা ভুল করেছেন। সরকার অভিযুক্ত নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া তো দূর, দিল্লী পুলিশ কোনো এফআইআর অবধি দায়ের করতে চায়নি। অবশেষে আন্দোলনের চাপে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে মামলা দায়ের হয় এবং আদালতের নির্দেশে দিল্লী পুলিশ অভিযোগ গ্রহণ করেছে এবং নির্যাতিতদের বয়ান জেলাশাসকের কাছে নথিভুক্ত করা হয়েছে।

এই আন্দোলন কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং দেশের ক্রীড়াক্ষেত্রে যে চরম অব্যবস্থা ও নিয়মনীতিহীন পরিচালন ব্যবস্থা বিদ্যমান তারই প্রতিফলন। একে তো এদেশে ক্রিকেট বাদ দিয়ে আর কোন খেলার জন্যই পর্যাপ্ত অর্থ সরকারি খাত থেকে ব্যয় করা হয় না। একমাত্র বিপুল ধনশালী ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডকে একাধিক কর ছাড় দেওয়া হয়। তার ফল হল, আজ দেশের অন্য ক্রীড়াবিদরা আন্দোলনকারীদের পক্ষে দাঁড়ালেও কপিলদেব বাদে দেশের বাকি সব ক্রিকেটাররা, ছোট থেকে বড় মুখে তালা মেরে বসে আছেন। অন্য ক্ষেত্রের ক্রীড়াবিদদের প্রায় সর্বদাই অনুশীলন থেকে শুরু করে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের খরচ অবধি নিজেদের বহন করতে হয়। তারপর এই ক্রীড়াসংস্থাগুলির পরিচালন কোনো পেশাদার প্রশাসক বা খেলোয়াড় দিয়ে হয় না। প্রায় সবক্ষেত্রেই কেন্দ্রের শাসকদলের নেতা বা বিধায়ক বা সাংসদ অথবা তাদের আত্মীয়দের পরিচালন সংস্থার শীর্ষকর্তা হিসাবে নিয়োগ করা হয়। যার ফলে তৈরী হয় স্বজনপোষণের এক চূড়ান্ত দুষ্টচক্র। ফলে দেশের হয়ে প্রতিযোগিতায় কোনো ক্রীড়াবিদ অংশ নিতে পারবেন কি না, তা যোগ্যতার বদলে কর্তার ইচ্ছা দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়। যার ফলে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় ভারতীয় ক্রীড়াবিদদের পদক জয়ের সংখ্যা হাতে গোনা যায়। এক আদ্যন্ত অপেশাদার ব্যবস্থায় মহিলা ক্রীড়াবিদদের যন্ত্রনা আরও বেশী। আর্থিক উৎকোচ থেকে শুরু করে সম্ভাব্য সমস্ত রকম অন্যায় দাবি তাদের করা হয়। যার ফলে প্রশিক্ষকদের দ্বারা যৌন নির্যাতন ভোগ করা মহিলা ক্রীড়াবিদের সংখ্যা এদেশে ব্যাপক। ফলে আজ দেশের মহিলা কুস্তিগীররা যে দাবি নিয়ে রাস্তায় বসেছেন তা অত্যন্ত বাস্তব এবং অন্যান্য কর্মক্ষেত্রের মত দেশের ক্রীড়াক্ষেত্রেও তারা একই রকম নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েই থাকেন।

কিন্তু এই গোটা ঘটনা পরম্পরায় দেশের সরকার বা প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা আরই বিতৃষ্ণার। একথা তো প্রায় স্বতঃসিদ্ধ যে বিজেপি ঘোষিতভাবেই ধর্ষকদের প্রতি দুর্বল। তাই বিলকিস বানোর ধর্ষকরা আগাম মুক্তি পেয়ে যায়, কাঠুয়া কাণ্ডে অভিযুক্তকে নিয়ে মিছিল পর্যন্ত বের হয়ে যায়, দেশে দলিত আদিবাসী মেয়েরা প্রায় রোজ ধর্ষিত হয় বিজেপি শাষিত উত্তমপ্রদেশে অথচ সরকার বা প্রশাসন নির্বিকার বসে থাকে। সেই পরম্পরা বজায় রেখে আজকেও তারা অভিযুক্ত সাংসদকে আড়াল করার চেষ্টা করে চলেছে। মহিলা ক্রীড়াবিদরা পদক জয়ের পর প্রধানমন্ত্রী তাদের ডেকে ঘটা করে ছবি তোলেন, প্রায় ওঁনার কৃতিত্বেই যেন পদকগুলি আসছে এরকম প্রচার আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে চলতে থাকে অথচ আজকে যখন সেই পদকজয়ীরা ২০ দিন ধরে রাস্তায় তখন ঢিলছোঁড়া দূরত্বে থেকেও প্রধানমন্ত্রীর সেখানে যাওয়ার বা তাদের নিজের বাসভবনে ডেকে কথা বলার সময় হয় না। অন্তত সরকার যে তাদের অভিযোগকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছে এমন আশ্বাস দেওয়ার প্রয়োজনও বোধ হয় না। 'বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও' স্লোগান তাই কেবল নির্বাচনী স্লোগান হয়েই থেকে যায়। ক্ষমতার স্বাদ পাওয়ার সুযোগ থাকলে এই বিজেপি নামক দলের নেতা কর্মীরা নারী নির্যাতন নিয়ে গলা ফাটান, কিন্তু আদতে মনে মনে তারা মনুবাদী, নারী-স্বাধীনতা বিরোধী। তাই দেশের সোনার মেয়েরা ক্ষোভে ফেটে পড়লেও, রাস্তায় দিনের পর দিন বসে থাকলেও এই দলটির শীর্ষ থেকে তৃণমূল স্তরের কোনো নেতারই বিবেকে টান পড়ে না। আসলে সুযোগ পেলে তারাও যে মেয়েদের ছেড়ে কথা বলবেন না। আজ ব্রিজভূষণ সিং তো গতকাল কুলদীপ সেঙ্গার। নারী নির্যাতনের দায়ে বিজেপির একাধিক নেতা অভিযুক্ত। কিন্তু তারা না দল থেকে না পদ থেকে বহিষ্কৃত হন। আসলে এটাই বিজেপি। কুস্তিগীরদের এই আন্দোলন আবারও চোখে আঙুল দিয়ে তা প্রমাণ করে দিচ্ছে। দেশের মানুষ কি সত্যকে গ্রহণে প্রস্তুত?