আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ দশম সংখ্যা ● ১৬-৩১ মে, ২০২৩ ● ১-১৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০

সম্পাদকীয়

বিজেপি মুক্ত দক্ষিণভারত


এখনও আশা আছে। ভারতীয় জনতা পার্টি তথা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বর্তমান ভারতে সাম্প্রদায়িকতা এবং হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে যেই আধিপত্যের রাজনীতি কায়েম করেছে, তার বিরুদ্ধে লড়াই নিরন্তর চললেও নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিজেপিকে পরাস্ত করার সম্ভাবনা অনেকের মনেই ক্ষীণতর হয়ে আসছিল হয়ত। কর্নাটকের সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল তাদের মনে পুনরায় আশার সঞ্চার করবে যে, বিজেপি যতই পরাক্রমী হোক না কেন তারা অপরাজেয় নয়। রাজনৈতিকভাবে তাদের মোকাবিলা করা সম্ভব, তাদের পরাস্ত করা সম্ভব যদি জনগণের মনের কথা বিরোধী রাজনৈতিক দলের ভাষ্যে পরিণত হতে পারে।

২০১৮ সালের নির্বাচনেও বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। তবু, টাকার প্রলোভন, কেন্দ্রীয় সংস্থাদের দ্বারা বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের হেনস্থা করা, জনতা দল (সেকুলার)-এর সুবিধাবাদী রাজনীতির সুযোগ নিয়ে বিজেপি ক্ষমতা দখল করে। কিন্তু বিগত পাঁচ বছর ধরে কর্নাটকে ‘ডবল ইঞ্জিন’ সরকার চললেও সেখানে জনগণের স্বার্থে কোনো কর্মসূচী বিজেপি নেয়নি। বরং বিপুল দুর্নীতির পাঁকে নিমজ্জিত থেকেছে সরকারের কার্যক্রম। ফলত, সাধারণ মানুষ সরকারের উপর বীতশ্রদ্ধ ছিল।

সিএসডিএস-এর নির্বাচন পরবর্তী সমীক্ষা জানাচ্ছে যে বেকারত্ব, দারিদ্র এবং অনুন্নয়ন এই নির্বাচনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ছিল। বিজেপি নেতৃত্ব তথা নরেন্দ্র মোদী যে এই কথা জানত না, তা নয়। তারা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিল যে যতই উন্নয়নের কথা বলা হোক না কেন, তাতে চিঁড়ে ভিজবে না কারণ মানুষ নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝতে পারছে যে কর্নাটকের সাধারণ মানুষের সমস্যা বিগত পাঁচ বছরে বেড়েছে। অতএব, আরএসএস-বিজেপি-র যেই অস্ত্র তারা প্রত্যেকটি নির্বাচনে ব্যবহার করে সেই সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতিকেই তারা তাদের প্রচারের কেন্দ্রস্থলে রেখেছিল। 'জয় বজরঙ্গবলী' স্লোগান দিয়েছেন স্বয়ং দেশের প্রধানমন্ত্রী। সরাসরি সাম্প্রদায়িক বিভেদমূলক প্রচার করা হয়েছে। সরকারে থাকাকালীন হিজাব বিতর্ক, টিপু সুলতানকে কেন্দ্র করে নানা বিতর্ক উসকে দিয়ে বিজেপি ভেবেছিল যে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ সম্পূর্ণ হয়েছে। এবারে তাদের রোখে কে!

এই সমস্ত বিভেদমূলক ইস্যুর মাধ্যমে বিজেপি যে জনগণের রুটি-রুজির সমস্যাগুলিকে ধামাচাপা দিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চাইছিল, মানুষ তা বুঝেছে। এবং বিভেদের রাজনীতিতে না ভুলে তারা বিজেপিকে পরাস্ত করে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ-গণতান্ত্রিক মানুষের সামনে বার্তা দিয়েছে যে বিভেদ নয়, সাধারণ মানুষের রুটি-রুজির সমস্যা নিয়ে রাজনীতি করলে তার পাশে দাঁড়াতে হবে। কর্নাটকের মানুষের এই বিভেদের রাজনীতির বিরুদ্ধে অবস্থানের সবচেয়ে বড় উদাহরণ হল শিক্ষামন্ত্রী বি সি নাগেশ ৩৫% ভোট পেয়ে পরাজিত হয়েছেন কংগ্রেস প্রার্থীর কাছে। এই মন্ত্রী কর্নাটকে হিজাবের উপর নিষেধাজ্ঞা ও অন্যান্য নানান সাম্প্রদায়িক কার্যকলাপের জন্য প্রায় রোজ শিরোনামে ছিলেন। কিন্তু তাঁর নিজের বিধানসভার মানুষ এই বিভেদকামী রাজনীতি মেনে নেয়নি।

কর্নাটকের নির্বাচন কংগ্রেসকে নতুন করে উৎসাহ যোগাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। রাহুল গান্ধীর ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ দীর্ঘ সময় কর্নাটকের অভ্যন্তরে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু তার জন্য কংগ্রেসের এই জয় নিশ্চিত হল, নাকি কংগ্রেসের স্থানীয় দুই নেতা শিবকুমার এবং সীদ্দারামাইয়ার লাগাতার জমিতে পড়ে থেকে লড়াই এই জয়ের প্রধান কাণ্ডারী তা নিয়ে বিতর্ক থাকবেই। তবু বলতেই হবে যে কংগ্রেস এই রাজ্যে মানুষের সাধারণ সমস্যাগুলি নিয়ে লাগাতার প্রচার করেছে। বজরং দলের মতন সাম্প্রদায়িক শক্তিকে নিষিদ্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সব মিলিয়ে কংগ্রেস কর্নাটকে মানুষের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছে। তবু, আবারো সেই পুরোনো ছবি আমরা দেখতে পাচ্ছি। এই সম্পাদকীয় লেখার সময় অবধি কংগ্রেস তার মুখ্যমন্ত্রীর নাম স্থির করতে পারেনি। সীদ্দারামাইয়া এবং শিবকুমারের মধ্যে গদি নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে বলে সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে। জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে কংগ্রেসকে শীঘ্রই এই দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

এই জয়ের মধ্য দিয়ে যদি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে ২০২৪ নিয়ে আত্মসন্তুষ্টি তৈরি হয়, তাহলে তা অত্যন্ত বিপজ্জনক হবে। এই জয়, নিঃসন্দেহে দেশের বিরোধী শক্তিদের বাড়তি উৎসাহ যোগাবে। কিন্তু এই জয় ২০২৪ সালের নির্বাচনের পূর্বাভাস হিসেবে ধরে নিলে ভুল হবে। প্রথমত, কর্নাটকেও ২০১৮ সালের তুলনায় বিজেপির ভোট শতাংশ কিন্তু কমেনি। এখনও বিজেপি কর্নাটকে ৩৬ শতাংশ ভোট পেয়েছে। কংগ্রেসের ভোট বেড়েছে মূলত জনতা দল (সেকুলার)-এর ভোট কেটে। অর্থাৎ বলা যেতে পারে কংগ্রেস নির্বাচনে জয়লাভ করলেও বিজেপির যে মোট জনসমর্থন কর্নাটকে রয়েছে তাতে কোনো বড় ফাটল ধরাতে পারেনি। বিগত কয়েক বছরে এই প্রবণতাও দেখা গেছে যে বিধানসভা নির্বাচনে জনগণ বিজেপি-র বিরুদ্ধে ভোট দিলেও লোকসভা নির্বাচনে তারা আবার বিজেপিকেই বেছে নিয়েছেন। এই প্রবণতার বিরুদ্ধেও বিরোধীদের সজাগ থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, ভুলে গেলে চলবে না কর্ণাটক থেকে মোট ২৮ জন লোকসভা সদস্য নির্বাচিত হবেন। তাই সেখানকার ফলাফল গুরুত্বপূর্ণ হলেও নির্ণায়ক নয়।

বিজেপি-র মূল শক্তি কেন্দ্রীভূত রয়েছে হিন্দি বলয়ের রাজ্যগুলিতে। উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট, হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র, উত্তরাখণ্ড, বিহার ইত্যাদি রাজ্যে বিজেপি-র ২০১৯ সালে বিপুল জনসমর্থন ছিল। এই রাজ্যগুলিতে বিরোধীরা বিজেপির জনসমর্থনে কতটা ধ্বস নামাতে সক্ষম হচ্ছেন তার উপরে নির্ভর করবে ২০২৪ সালের বিধানসভা নির্বাচনের ফল। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগেই রাজস্থান, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা ইত্যাদি রাজ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। এই রাজ্যগুলিতে নির্বাচনী ফলাফল কী হবে তার উপরে অনেকটা নির্ভর করবে ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের প্রবণতা।

আপাতত তাই এক বছর ব্যাপী লড়াই গড়ে তুলতে হবে বিরোধীদের। এই লড়াইয়ের মাধ্যমেই ঐক্য স্থাপিত করতে হবে। দক্ষিণ ভারত বিজেপিমুক্ত হয়েছে যা নিঃসন্দেহে খুশীর খবর। কিন্তু গোটা ভারতকে বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষ থেকে মুক্ত করার সংকল্প গ্রহণ করতে হবে। আমরা আশা রাখব দেশের বিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক শক্তি সেই লড়াই লড়ার জন্য ক্ষুদ্রতার ঊর্ধ্বে উঠে সার্বিক দেশের মানুষের স্বার্থের কথা ভেবে নিজেদের নিয়োজিত করবেন।