আরেক রকম ● দশম বর্ষ সপ্তম সংখ্যা ● ১-১৫ এপ্রিল, ২০২২ ● ১৬-৩০ চৈত্র, ১৪২৮

প্রবন্ধ

কি মন্তরে হেমন্ত হন হেমন্ত্‌ কুমার!

ভাস্কর দাশগুপ্ত


হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আজো অনেকের কাছেই একটি অমীমাংসিত ব্যক্তিগত সমস্যা। কোন্‌ হেমন্ত প্রাণের বেশি কাছাকাছি? গায়ক হেমন্ত না কি সুরস্রষ্টা হেমন্ত? তারপরও প্রশ্ন থাকে, কি প্রকারে তিনি বোম্বের সেই ভরন্ত পেশাদারী চিত্রজগতে ব্যস্ততম সংগীতকার হয়ে গেলেন?

আমাদের বিনীত অনুমান - এ শুধু সুর-তাল-লয়ের সঙ্গম নয়; নয় শুধু সুযোগ পাওয়ার কপাল। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জীবন-চর্যা সমাজেতিহাসের অঙ্গ যেখানে আমরা সন্ধান পেতে পারি ব্যক্তির সঙ্গে সমষ্টির এবং সময়ের নির্মাণ আর সংঘর্ষে রচিত এক অভাবনীয় ফেনোমেননের খতিয়ান।

বিস্তৃত পরিসরে স্মরণীয় তাঁর সময়ের জলবায়ু, যে আবহাওয়া তাঁর পুষ্টিসাধন করেছে। এমনটা ভাবা কি কষ্টকল্পনা যে তিন অভিন্নহৃদয় বন্ধু সুভাষ মুখোপাধ্যায়, রমাকৃষ্ণ মৈত্র এবং হেমন্ত তাঁদের কথালাপে, সদ্য কমিউনিস্ট সুভাষ কিম্বা ‘রমা’ পরস্পরের মধ্যে জারিত করেননি একরোখামি যা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের সামনে অকুতোভয় কিম্বা বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র জগতে পেশাদারী দক্ষতায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী?

তাঁর আত্মজীবনী ‘আনন্দধারা’তে মিতবাক হেমন্ত মুখোপাধ্যায় স্বভাবের বাইরে গিয়ে অনেক কথা বলেছেন। তবুও তাঁর মেজাজ, তাঁর প্রত্যয় এবং জীবনের প্রতি দৃষ্টিপাতের সুলুক-সন্ধান পাওয়া যায় তাঁর রচিত গল্পগুলি পাঠ করলে। আটান্ন সাল নাগাদ ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘একটি দিন’ আজ ফিরে পড়লে বিস্ময়ে হতবাক হতে হয়। কাহিনীর বিষয়-বিন্যাস, শব্দ-সন্নিবেশ, সংলাপের স্বাভাবিক বিশেষত্ব যে কোন আধুনিক লেখকের কাছে আজো ঈর্ষণীয়। ভাবালুতাহীন, সেন্টিমেন্ট বিবর্জিত একটি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের অতি সাধারণ একটি বর্ণনা। মনে আসে ম্যাক্সিম গোর্কির ‘নীচের মহল’। অনন্বিত বর্ণনায় বিধৃত জীবনের একটি খণ্ড। ১৯৮৮-তে প্রকাশিত ‘শতাব্দীর আর্তনাদ’ গল্প পাঠের পর আকৈশোর হরিহর-আত্মা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। “...হ্যাঁ (হেমন্ত) একদা গল্পই লিখত। কিন্তু ওর গলার গান শোনার পর আমরা দুই পরম বন্ধু রমাকৃষ্ণ মিত্র আর আমি ওঁর নৌকাটাকে ঠেলে আমরাও গল্পের ঘাট থেকে কায়দা করে গানের ঘাটের দিকে ভিড়িয়ে দিয়েছিলাম। আমাদের মধ্যে সাহিত্যে জ্ঞানগম্যি একমাত্র রমাকৃষ্ণেরই ছিল। ও ছিল পাকা জহুরি। ও বুঝত কার কতটা হবে না-হবে। ও-ই আমাকে পা থেকে ফুটবল ছাড়িয়ে শেষ পর্যন্ত হাতে কলম ধরিয়ে দিয়েছিল। ...রমার কথা মনে পড়ল হেমন্তর লেখা গল্পের প্রসঙ্গে। ...হাতের কাছে রমা থাকলে আবার গল্প লেখার দায়ে হেমন্তকে তুড়ুং ঠুকে দেওয়া যেত। ...ভয়ে ভয়ে হেমন্তর গল্পটা হাতে নিলাম। ভাগ্যিস, বাংলায় টাইপ করা। নইলে হাতের লেখা কাগের-ঠ্যাং-বগের-ঠ্যাং দেখলেই তো আমার পিত্তি জ্বলে যেত। ...গোড়ার বাক্যটাতে এসে একটু নড়ে বসতে হল। নাঃ, ছোকরা গল্প জমাতে জানে। ...শেষ করেছি এক নিঃশ্বাসে। ...ব্যর্থ শিল্পীর এ-গল্প আর কোন সার্থক শিল্পীর কলম দিয়ে তো বেরোলো না। ...করুণা নয়। ভালবাসা। অন্যের ব্যথার সুর নিজের প্রাণের তারে বাজিয়ে তোলা। ...তার মানে, প্রত্যাবর্তন কি? গান থেকে গল্পে? ...অনায়াসে গল্প থেকে গানে, গান থেকে গল্পে - নাঃ, হেমন্ত দেখছি বুড়ো হবে না। কপালও ওর পাতাচাপা। সব কিছুই ওর উতরে যায়...”।

হ্যাঁ। এই উতরে যাওয়া হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্বভাব। আর তাঁর সহজাত সম্পদ - আত্মমূল্যায়নের ক্ষমতা।

১৯৪৩-এই হেমন্তর নিজের সুরে গানের রেকর্ড দারুণ জনপ্রিয়। ‘কথা কয়ো না-কো’ সুরের স্বাতন্ত্র্য বিস্ময়কর। কণ্ঠে ভর করে সুর লয়, যেন শল্য-চিকিৎসকের মত চুলচেরা অস্ত্রোপচার। কিন্তু উচ্চারণে যুগ-অনুমত শৈলীগত বদ-অভ্যাস। নাসিক্য ধ্বনি-প্রাবল্য, অকারণ প্লুত উচ্চারণ, এমনকি গায়কীতে পঙ্কজ কুমার মল্লিকের প্রচ্ছন্ন প্রভাব (তাঁর শুরুর দিকে গায়ক হেমন্তকে শ্রোতারা ‘ছোট পঙ্কজ’ নামে অভিহিত করতেন)। কিন্তু কি দ্রুত তিনি নিজের মৌলিকতা উদ্ভাবন করে নিলেন, কণ্ঠ-সম্পদের মিত ব্যবহারে, গানের ভাষায় যাকে ‘ক্রুনিং’ বলে সেই পাথরকোঁদা মূর্তির মত অতিরেকহীন সুর-প্রক্ষেপণে।

ভারী কণ্ঠ-প্রয়োগ, শ্রোতাকে গাম্ভীর্যে বিহ্বল করে দিতে পারে অনায়াসে, কিন্তু সে আয়ুধ হেমন্ত যত্রতত্র প্রয়োগ করেননি। ‘তোমার ভুবনে মাগো এত পাপ’ গানে ‘নাই প্রতিকার’ যখন উচ্চারণ করেন মনে হয় সে জলদমন্দ্র স্বরধ্বনি বুঝি ঈশ্বর বিরাজ করলে তাঁর কানে গিয়ে স্পর্শ করলো। কিন্তু কি আশ্চর্য! ‘তোমার কঠিন হাতে বজ্র কি নাই’ স্তবকে ‘বজ্র’ শব্দটিতে যে মুনশিয়ানায় সুর লাগান, তখন সেই নরম স্বল্প স্বরের স্পর্শে পাখির ওম যেন কানের ভেতর দিয়ে মরমে প্রবেশ করে। তিনি অকপটে বলেছেন, মার্গ সংগীতে তাঁর তেমন তালিম নেই। সুর-রচনায় তাঁর খোলসা কবুলতি - তাঁর পথপ্রদর্শক আধুনিক গানের অতুলনীয় বৈপ্লবিক শ্রুতকীর্তি রত্নাকর রবীন্দ্র, যিনি মার্গ সংগীতের খাঁচাকে বাসায় পরিণত করতে জানেন। সংগীতজ্ঞ পণ্ডিতম্মন্য মানুষেরা রবীন্দ্রের রাগাশ্রয়ী গান নিয়ে নানা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে জেরবার। ‘রাগরাগিণীর এলাকায় রবীন্দ্রসংগীত’ গ্রন্থে অনন্য সংগীতবেত্তা প্রফুল্ল চক্রবর্তীর মহাশয় যখন সংশয়ে আবিষ্কার করেন - “...পুরনো দিনে তোড়ি ও ভৈরবী প্রায় একই একই আকারের ছিল। তার আভাস রবীন্দ্রনাথের শুদ্ধ মধ্যম ও কোমল নিষাদযুক্ত ও শুদ্ধ নিষাদযুক্ত ভৈরবীতে গান আছে। ...ভীমপলশ্রী আর মূলতান ছিল কাছাকাছি। পূরবীর ‘চঢ়ি কোমল’ ধৈবত তখন কোন ঘরানায় গিয়ে কোমল দ, কোথাও শুদ্ধ ধ-তে রূপ নিচ্ছিল।...”। এই সঙ্গত সমস্যার বিপ্রতীপে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ খেলা ভাঙার খেলা খেলে বলেন - “...আজ গান শুনিলেই সকলে দেখিতে চান, জয়জয়ন্তী, বেহাগ বা কনেড়া বজায় আছে কিনা; আছে মহাশয়, জয়জয়ন্তীর কাছে আমরা এমন কি ঋণে বদ্ধ যে, তাহার নিকটে অমনতর অন্ধ দাস্যবৃত্তি করিতে হইবে? যদি মধ্যমের স্থানে পঞ্চম দিলে ভাল শুনায়, আর তাহাতে বর্ণনীয় ভাবের সহায়তা করে, তবে জয়জয়ন্তী বাঁচুন বা মরুন, আমি পঞ্চমকেই বাহাল রাখিব না কেন - আমি জয়জয়ন্তীর কাছে এমনি কি ঘুষ খাইয়াছি যে, তাহার জন্য এত প্রাণপণ করিব?”

উঠতি শিল্পী হিসেবে সে আমলে, তিনজন সঙ্গী শলা করে নিয়ম করেছিলেন, জলসায় কোন একজনকে আমন্ত্রণ জানালে অনন্য দুজনকেও গাইতে দিতে হবে। তিন তরুণ, বলা বাহুল্য, সত্য চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং সুধীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়। স্মৃতি রোমন্থনে তাঁর পুত্র কবীর সুমনের কাছে সুধীন্দ্র জানিয়েছেন, সে আমলে হেমন্ত নিমেষে শ্রোতাদের মনোহরণ করতেন মঞ্চে উঠে ‘ঝপাঝপ রবীন্দ্রনাথের পালার গান’ গেয়ে। মোদ্দা কথা; যে গায়ক পর্যায়ক্রমে নৃত্যনাট্যের বিচিত্র তাল-লয়-ছন্দের গান অবলীলায় গেয়ে যান তিনি আসলে সংগীতের রেওয়াজ করছেন এক অভিনব স্ব-আবিষ্কৃত পদ্ধতিতে। এই রবীন্দ্র-অনুবর্তনের ফলশ্রুতি; হেমন্তর সুরারোপিত গানে বিহ্বল আমরা সাধারণ-জন,ধরতেও চাই না যে, ‘এ যদি আকাশ হয়, তোমায় কি বলে আমি ডাকব বল’ ইমন রাগে আধৃত অথবা সারং রাগে ‘এই বালুকাবেলায় আমি লিখেছিনু’ কিম্বা কীর্তনাঙ্গে ‘তুমি কখন যে এসে চলে গেছ ওগো জানিতে পারিনি।

এই অজেয় আয়ুধে সুসজ্জিত হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রবেশ করলেন বম্বের চিত্রজগতের চক্রব্যূহে। সেখানে প্রকাশ পেল ব্যক্তি হেমন্তর তিতিক্ষা। পেশাদারী অভিজ্ঞতা বলতে, তখন ইস্ট ইন্ডিয়া ফিল্ম কোম্পানির ‘নিমাই সন্ন্যাস’-এ সংগীত পরিচালক হরিপ্রসন্ন দাসের সহকারী এবং তার অব্যবহিত পর সংগীত পরিচালক হিসেবে অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘পূর্বরাগ’ এবং জ্যোতির্ময় রায়ের হেমেন গুপ্ত পরিচালিত ‘অভিযাত্রী’ এবং আরও দু'একটি ছবি। বম্বে থেকে প্রথম ডাক পেলেন ভি. শান্তারামের ‘শিবশক্তি’ ছবিতে সংগীত পরিচালনার। শান্তারাম হেমন্তকে যখন জিজ্ঞেস করেন - কি পারবে তো? হেমন্তর সপ্রতিভ উত্তর ছিল - “কিচ্ছু ভাববেন না...। আমার গানের গুরু হলেন রবীন্দ্রনাথ। যে বিষয়ে ছবি করুন না, সব পাওয়া যাবে রবীন্দ্রকোষ থেকে। অফুরন্ত ভাণ্ডার ওঁর”। এর পর সম্পূর্ণ ‘শ্যামা’ শুনিয়ে মোহিত করে দিয়েছিলেন হেমন্ত। শান্তারাম সত্যিই মুগ্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত ছবিটা হয়নি। তাই দু-তিন মাস পরে ফিরে আসতে হল কলকাতায়। এরপর পরিচালক হেমেন গুপ্তর ডাকে ফিল্মিস্তান-এর প্রযোজনায় হিন্দি ‘আনন্দমঠ’এর সংগীত নির্দেশনার দায়িত্ব পেয়ে ১৯৫১-র মার্চ মাসে আবার বম্বে। এ বাঁধা মাস মাইনের চাকরি। আপিসের মত এগারোটা থেকে পাঁচটা হাজিরা। এর মাঝে হেমন্ত সমঝে নিয়েছেন তাঁর ভবিতব্য। বাংলায় অজয় করের ‘জিঘাংসা’ ছবির আবহ সংগীত বাকি সে কাজ সম্পূর্ণ করতে ছুটি নেবেন। কঠোর কর্ণধার শশধর মুখার্জি ছুটি নামঞ্জুর করলে, সুভদ্র অথচ দৃঢ়ভাবে হেমন্ত জানালেন কথা দিয়ে তার খেলাপ তিনি করতে পারবেন না। শশধর মুখার্জি জাত জহুরি; অব্যাহতি পেলেন হেমন্ত। ভেবে অবাক হতে হয় মাত্র তিন দিনের ছুটি পেয়ে ছবির বাকি সুর সংযোজনা সারলেন কি করে। লড়াকু মানসিকতার হেমন্ত আদ্যন্ত পেশাদারী। শিল্পী বা স্রষ্টার ‘মুড’ আসা নিয়ে তাঁর মন্তব্য - “...এ(মুড)টা যে কি জিনিস আমি নিজেকে বুঝতে দিইনি কোনো দিন। দিলে এত কাজ করতে পারতাম না। আমি সব সময় চেষ্টা করেছি কাজগুলোকে অভ্যাসের আওতায় নিয়ে আসার।... প্রতিদিন ডায়রি খুলে আমি কাজে বসি। মুড থাকুক আর নাই থাকুক হারমোনিয়াম সামনে রেখে শুরু করে দিই কাজ। কিছুক্ষণের মধ্যে মুড আসতে বাধ্য। অনেকটা উপাসনার মত। এটাও তো নিয়মিত করতে হয়।... সংগীতের তপস্যায় নিয়মিত বসতে পারলে মুড-এর জন্য মাথা খুঁড়তে হবে না। ওটা আপনা থেকেই চলে আসবে...’।

ফিল্মিস্তান-এ প্রত্যাবর্তন ও ‘আনন্দমঠ’এর কাজ শুরু। ‘বন্দে মাতরম’ গানটি লতা মঙ্গেশকারকে দিয়ে গাওয়াতে চান, কিন্তু মালিকপক্ষ জানালেন সুরকার সি. রামচন্দ্রন মনোমালিন্যের জন্য ‘ফিল্মিস্তান’ ছেড়ে দিয়েছেন অতএব লতা এই প্রতিষ্ঠানের জন্য গান গাইবেন না। অন্য শিল্পী ভাবুন। কিন্তু ব্যক্তি হেমন্ত তাঁর সুর ও কণ্ঠের মতই সুস্থির, অপ্রতিরোধ্য। লতার বাসায় গিয়ে সোজা-সাপটা উপরোধ। লতা এক কথায় রাজি। পারিশ্রমিকের কথা পাড়তে লতার জবাব - ‘শুধু আপনার জন্য গাইছি। পয়সার জন্য নয়। সুতরাং ফিল্মিস্তান-এর সঙ্গে এ বিষয়ে কোনো কথা বলবার দরকার নেই’। পরের ছবি ‘শর্ত’; এই পর্বে একটি গানের একুশ রকম মুখড়া শুনে মিস্টার মুখার্জি বেছে দিয়েছিলেন - ‘না ইয়ে চাঁদ হোগা’। যে গান আজো অমর। ততদিনে ‘আনন্দমঠ’ মুক্তি পেয়েছে। ছবি চলল না; অতএব গানেরও ভগ্নদশা। শর্ত-ও বক্স অফিসে মার খেল। হেমন্ত তখনো ভাবছেন কলকাতায় ফিরে আসার কথা। পরিবার নিয়ে বম্বে বসবাস ওই বেতনে কষ্টসাধ্য; তার ওপর প্রথম দুটি ছবির কাজ মাঠে মারা গেছে। কিন্তু শশধর মুখার্জি তাঁকে চাকরি থেকে রেহাই দেবেন না। তাঁর পছন্দ করা যুবকের সাফল্য প্রমাণ না করতে পারলে আত্মগরিমা বিফল হবে। আর হেমন্ত ততদিনে জীবনের সারকথা শিখে নিয়েছেন। বহু বছর পরে ‘জীবন জুয়ায় বীর জিতে গেলে, বোকার হদ্দ তুমি হেরে গেলে...’ সলিলের এই গানের কলির উল্লেখ করে হেমন্তর মন্তব্য - “কথাটা খুবই খাঁটি...”। অতএব হাল ছাড়লেন না হেমন্ত, চাকরিতে রয়ে গেলেন। এরই মধ্যে বাইরে দু-চারটে প্লে-ব্যাক যার মধ্যে শচীন দেব বর্মণের ‘ইয়ে রাত ইয়ে চাঁদনি ফির কাহাঁ’ জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। কিন্তু সুরকার হিসেবে তখনো খুঁড়িয়ে খুড়িয়ে চলা। এবার ‘ফিল্মিস্তান’ দুটো ছবির কাজ শুরু করল। ‘আনারকলি’ ও ‘নাগিন’। ‘আনারকলি’ সুরকার সি. রামচন্দ্রন আর ‘নাগিন’-এর দায়িত্বে হেমন্ত।
‘নাগপঞ্চমী’ ছবিতে কল্যানজি সাপুড়েদের বীণ-এর কাছাকাছি চরিত্রের একটি বিদেশী যন্ত্র বাজিয়েছেন - ক্ল্যাভিওলাইন। তাঁকে নিয়ে এলেন। শশধর এবং নাগিন-এর পরিচালক নন্দলালজী দুজনেই আবহ শুনে জানালেন - বড় একঘেয়ে। হেমন্ত কিন্তু এবার অনড়। মাটির মানুষদের তিনি বিলক্ষণ চেনেন তার গণনাট্য সঙ্ঘের আমল থেকে। এই একঘেয়ে সুরই জনতা নিবিষ্ট হয়ে শোনে হাটেবাজারে দাঁড়িয়ে। তাঁর সাফ কথা, ছবির ‘আবহ’ থেকে এই সুর তিনি বাদ দেবেন না। ১৯৫৪ সন; ‘নাগিন’-এর গান সুপারহিট। আর ‘নাগিন’ ছবির আবহ-সুর তো আজ সাপুড়েরা অনুকরণ করেন। ‘আনারকলি’ নিয়ে আবার মতবিরোধ। সি. রামচন্দ্রন আবার ‘ফিল্মিস্তান’ ছাড়লেন। শশধর হেমন্তকে দায়িত্ব দিলেন বাকি কাজ শেষ করতে। হেমন্ত কিন্তু পুনে থেকে সি. রামচন্দ্রনকে খুঁজেপেতে অনুনয় বিনয় করে বাকি কাজ দুজনে মিলে শেষ করলেন। এই হলেন বামনের দেশে গালিভার - হেমন্ত। কোন অসূয়া নয়, পরশ্রীকাতরতা নয়, কাজ শুধু কাজ এবং নিজের সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে সমভিব্যাহারীদের সঙ্গী করে নেওয়া। ঐতিহ্য ও প্রগতি মিলিয়ে হেমন্ত যেন এক শোয়াসে বলতে পারেন - পথে এবার নামো সাথী পথেই হবে এ পথ চেনা। ভবিতব্য আমাদের উভয়কে সমান রক্ষা করুন, সমতুল কলাবিদ করুন, আমরা যেন সমান সামর্থ্য অর্জন করতে পারি, আমাদের উভয়ের বিদ্যা সফল হোক, যাত্রাপথে আমরা যেন পরস্পরকে বিদ্বেষ না করি।

এই মানসিকতায়ই সহকারী রবি-র হাজার আপত্তি সত্ত্বেও তাঁকে স্বাধীন সংগীত পরিচালনার দিকে ঠেলে দিয়েছেন। তখন বাংলা কাঁপাচ্ছে ‘শাপমোচন’, ‘হারানো সুর’। তিনিও বুঝে গেছেন তাঁর প্রাণ বাংলা। বম্বের পেশাদার জগৎ তাঁর চূড়ান্ত সাফল্যকে ব্যবহারে উদগ্রীব। তাই অনর্গল বম্বে-কলকাতা গতায়াত। ঘোর বাস্তববাদী হেমন্তর মিথ্যে মোহের আবরণে আচ্ছন্ন থাকা ছিল চিন্তাধারার বাইরে। ঘরের কুলদেবতা দধিবামনের প্রতি তাঁর নিখাদ সমর্পণ তাঁকে এমন প্রেরণা দিয়েছে যে দৈবের বিপ্রতীপে তিনি পুরুষকারকে গুরুত্ব দিয়েছেন বেশি।

ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের সক্রিয় সংগীত-কর্মী হিসেবে তিনি দেশের মাটির ঘ্রাণ প্রত্যক্ষ করেছিলেন; বড় কাছ থেকে পরিচিত হয়েছিলেন সেই বিশাল জনতার যারা তেভাগায় হাজির থাকেন, সিনেমা হাউজে গিয়ে গানেও মজে যেতে পারেন প্রাণের স্পন্দনে। সেই অভিজ্ঞতায় ভর করে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মননে এবং কার্যক্রমে এক আশ্চর্য সমন্বয় সম্ভব হয়েছিল। তাই আমাদের মত মধ্যমেধা শিক্ষিত বাঙালি শ্রেণীর কাছে তাঁর সাফল্য, জন্মের শতবর্ষ পরেও এক বিরাট বিস্ময়।


ঋণ স্বীকারঃ
১। আনন্দধারা - হেমন্ত মুখোপাধ্যায়; সপ্তর্ষি প্রকাশন; ২০১৩।
২। হেমন্তর গল্প।
৩। রাগরাগিণীর এলাকায় রবীন্দ্রসংগীত - প্রফুল্ল কুমার চক্রবর্তী; পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সংগীত আকাদেমি; ২০১১।
৪। কবীর সুমন।