আরেক রকম ● দশম বর্ষ সপ্তম সংখ্যা ● ১-১৫ এপ্রিল, ২০২২ ● ১৬-৩০ চৈত্র, ১৪২৮

প্রবন্ধ

কয়লা শ্রমিকদের লড়াই

অভিজ্ঞান সরকার


রাণিগঞ্জ আসানসোলের ইস্টার্ণ কোলফিল্ডস লিমিটেডের ঠিকা শ্রমিক চন্দ্রশেখর পাল হাহুতাশ করছিলেন, বিএ পাস শেষ করে কোদাল ধরতে হয়েছে তাকে। তাতেও তার আপত্তি ছিল না, যদি ঠিকা শ্রমের মজুরিটা ঠিকঠাক সময়ে পেতেন! গত পুজোর তিন মাস আগে থেকে বেতন পাননি, বোনাস দূর অস্ত। ২০২১ বছর ঠিকামজুরদের জন্য বোনাস ঘোষণা করা হয়েছে আট দশমিক তিন তিন শতাংশ - সাত হাজার দুইশত টাকা দিতেই হবে। কোলিয়ারির বেশির ভাগ ঠিকা শ্রমিক সেটা পাননি । চন্দ্রশেখর যখন বেতন পেলেন, মুদির দোকান আনাজের দোকানের বাকির খাতা অনেকটা ভরে গেছে, কয়েক মাসের ধার শোধ করতে করতেই ফুরুত করে টাকা ফুরিয়ে গেল। চন্দ্রশেখর বলছিলেন তিনি হতাশাগ্রস্ত, শ্রমার্জিত ন্যায্য মজুরি পেতে তাদের ঠিকাদার, ম্যানেজার, স্থানীয় তৃণমূল নেতার কাছে ক্রমান্বয়ে ঠোক্কর খেতে হয় - ইসিএল বলছে তারা টাকা ছেড়ে দিয়েছে, ঠিকাদার বলছে তাদের চেক ফিনান্স থেকে ছাড়ছে না, কর্তাব্যক্তিদের চেক ছাড়ানোর জন্য ঘুষ দিতে হচ্ছে, নেতা আশ্বাস দিচ্ছে সব পাওয়া যাবে - বেতন প্রলম্বিত হচ্ছে মাসের পর মাস, এবং কয়েকটি কোলিয়ারিতে সেটিই নিয়মে পরিণত হয়েছে।

কোল ইন্ডিয়ার হাই পাওয়ার কমিটির সুপারিশ অনুসারে চন্দ্রশেখরদাদের মজুরি হওয়ার কথা ছিল সর্বনিম্ন নয়শো চল্লিশ টাকা দৈনিক, চন্দ্রশেখর পান চারশ পঞ্চাশ টাকা, ওনাদের কোলিয়ারিতে গত দুই বছর ধরে আন্দোলনের ফলে তারা এই মজুরি পাচ্ছেন। গত বছর পেয়েছিলেন তিনশ পঞ্চাশ টাকা রোজ, তার আগের পেতেন বছর দুইশত আশি টাকা। অর্থাৎ বছর বছর আন্দোলন করে তারা কিছু মজুরি বাড়াতে সক্ষম হয়েছেন, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সরকার নির্ধারিত নয়শো চল্লিশ টাকা মজুরি শ্রমিকরা কিছুতেই পাবেন না। সমগ্র ইসিএল জুড়ে এক চিত্র, কোলিয়ারির ঠিকা শ্রমিকের মজুরি লুঠ হয়ে যাচ্ছে ইসিএল অফিসার, ঠিকাদার আর তৃণমূলের ট্রেড ইউনিয়নের নেতাদের যোগসাজশে। চন্দ্রশেখরদের অবস্থা কিঞ্চিৎ ভালো, অধিকাংশ খনিতে মজুরি ঘোরাফেরা করে আড়াইশো থেকে চারশোর মধ্যে।

যেহেতু ঠিকা শ্রমিকের পে স্লিপ নেই, ইসিএল পরিচয়পত্র দেয় না (ঠিকাদার একটি জেরক্স করা পরিচয়পত্র ইস্যু করে যার কোনো আইনি স্বীকৃতি নেই), অধিকাংশ মজুরের বেতন ব্যাঙ্ক ট্রান্সফার হয় না, ফলে সরকারি তথ্য থেকে আন্দাজ করা কঠিন কত ঠিকা শ্রমিক কাজ করেন - পিট, ওসিপি ও প্রোজেক্ট মিলিয়ে। তবে অনুমান করা যায় দশ থেকে বারো হাজার ঠিকা শ্রমিক রয়েছেন। দৈনিক ঠিকা শ্রমিকের সংখ্যা যদি পাঁচ হাজার ধরেও হিসাব করি, এবং যদি ধরে নিই সাড়ে চারশ টাকা করে তারা মজুরি পাচ্ছেন, তাহলে দৈনিক মজুরি চুরির পরিমাণ হয় পঁচিশ লক্ষ টাকা, ছাব্বিশ দিন ধরে মাসিক সাড়ে ছয় কোটি টাকা, বছরে আশি কোটি। ঠিকাদার শ্রমিক সাপ্লাই দেওয়ার জন্য বিপুল কমিশন পায়, ইসিএল অফিসার মাসিক লক্ষাধিক টাকার বেতন পায় - এসব সত্ত্বেও রাবণের চিতার মত তাদের খাঁই। তৃণমূলের ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্ব অবশ্য পরজীবী, এই মজুরি চুরির ব্যবসা তারা ত্যাগ করতে পারবে না।

কোলিয়ারি ভেদে ঠিকাদারদের মজুরি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক। সাধারণতঃ স্থানীয় মানুষদের কাজে নেওয়া হয় না, স্থানীয়দের লোকজন জুটিয়ে ঝামেলা করার সম্ভাবনা এড়াতে দূর গাঁয়ের লোক নেওয়া হয়। কোথাও স্থানীয় শ্রমিক নিযুক্ত করলে তাদের ঠান্ডা রাখতে একটু বেশি মজুরি দেওয়া হয়। খোট্টাডি কোলিয়ারিতে স্থানীয় মজুরদের বেতন চারশ কুড়ি টাকা, আর অজয় নদী পেরিয়ে বীরভূম থেকে কাজে আসা ঠিকা শ্রমিকের মজুরি তিনশ পঞ্চাশ টাকা। এই নিয়ে বীরভূমের শ্রমিক ট্যাঁফোঁ করলে পত্রপাঠ পরের দিন থেকে কাজে আসতে বারণ করে দেওয়া হবে। আবার খোট্টাডির স্থানীয় ঠিকা মজুরটি যদি তার ন্যায্য বেতন অর্থাৎ নয়শত চল্লিশ টাকা দাবী করেন তাহলে তারও কাজে আসা বন্ধ করে দেওয়া হবে। অতও চাইতে হবে না, ছয়শ টাকা দাবী করলেই কাজ থেকে বিদায়।

চন্দ্রশেখর জানালেন গত বছরের আন্দোলনের পর ম্যানেজার, ঠিকাদার, স্থানীয় তৃণমূল নেতা ও শ্রমিকদের মিটিং-এ ঠিক হয়েছিল মজুরি হবে ছয়শত টাকা, তার মধ্যে দেড়শ টাকা পিএফ ফান্ডে যাবে। সেই টাকা গত একবছর ধরে ঠিকাদার কেটে নিচ্ছে, কোথায় জমছে সেটা শত জিজ্ঞাসাবাদ করেও তারা জানতে পারেননি। কাঞ্চন বাউরি পনের বছর ইসিএলের ঠিকা শ্রমিক, বিষাদের সঙ্গে বললেন তার পিএফ জমেছে পঁচিশ হাজার টাকা। মাঝে এক ঠিকাদার কাঞ্চনের পিএফের হাজার চল্লিশ টাকা হজম করে ফেলেছিল, কাঞ্চন বাউরি মেনে নিয়েছেন চুপচাপ - ‘একই পাড়ায় থাকি, কি আর বলব!’ খেদোক্তি করছিলেন উনি।

পুন্য বাদ্যকর বলছিলেন ঠিকা কাজের কোনো গ্যারেন্টি নেই, মাসে কখনো কুড়ি দিন কাজ পেলেন তো কখনো দশদিন, সব মিলিয়ে বছরে হয়ত দেড়শ দিন। অনিশ্চয় শ্রমজীবনের নিরাপত্তাহীনতায় তিনি চাষের কাজ করতে বাধ্য হন। অন্যান্যদের অনেকে রাজমিস্ত্রির কাজ করেন, টিউশনি করেন, বাড়িতে গো-পালন করেন, একশ দিনের কাজ খোঁজেন, এটা-সেটা করেন। চন্দ্রশেখরদা অস্তিত্বজনিত সমস্যায় ভোগেন। বলছিলেন ‘সোজার মাথায় বোঝা’- সৎভাবে ডিউটি করারপর ন্যায্য মজুরির জন্য আদায় করতে তাদের চপ্পলের শুকতলা খইয়ে ফেলতে হয়, এই লাঞ্ছনার পেশা আর তিনি চান না।

১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রায়ত্বকরণের পর রাণিগঞ্জ কয়লাঞ্চলের সমস্ত ব্যক্তি মালিকাধীন কোলিয়ারিগুলি কোল ইন্ডিয়া লিমিডেটের সাবসিডিয়ারি ইস্টার্ণ কোলফিল্ডস লিমিটেডের আওতাধীন হয় ১৯৭৫-এ। সেসময় রাণিগঞ্জ কয়লাঞ্চলের কয়লা উৎপাদন সমস্তটাই হত ভূগর্ভস্ত খনি থেকে। রাষ্ট্রায়ত্বকরণে সময় থেকে নানা কায়দায়, লুকিয়ে চুরিয়ে ঠিকা শ্রমিক নিয়োগ করা হত ভারতের খনিগুলিতে, বিশেষত ছত্তিশগড়, মহারাষ্ট্র, উড়িষ্যায়, যেখানে খোলামুখ খনি চালু রয়েছে প্রথম থেকে।

ভূগর্ভস্ত খনি থেকে লাভ হচ্ছে না এই যুক্তি দেখিয়ে ইসিএল কর্তৃপক্ষ নব্বই দশকের সময় থেকে খোলা মুখ খনির স্বপক্ষে যুক্তি খাড়া করেন, এবং ১৯৯৩ সালে দুটি খোলামুখ খনির অনুমতি দেন প্রাইভেট কোম্পানিকে। সেই শুরু, তারপর থেকে একের পর এক খোলামুখ খনি দগদগে ঘায়ের মত ফুটে উঠছে রাণিগঞ্জ আসানসোল কয়লাখনি অঞ্চলে। ১৯৯৭-৯৮ সালে বিশ্বব্যাঙ্কের কাছে এক বিলিয়ন ডলার লোন নিয়ে নতুন ২৪টি খোলা মুখ খনি শুরু করে কোল ইন্ডিয়া যেগুলির যন্ত্রপাতি সরবারহ করে উন্নত বিশ্বের কারিগরি কোম্পানিগুলি। নব্বই দশকে খোলামুখ খনি ও প্রাইভেট কনট্রাকটরদের আগমনের সাথে সাথে হু হু করে বাড়তে থেকেছে ঠিকা শ্রমিকদের সংখ্যা, নয়াউদারিকরণের ঢেউ লাগে কয়লা ক্ষেত্রেও। পাল্লা দিয়ে কমেছে ইসিএলের স্থায়ী কর্মীর সংখ্যা। বর্তমানে খোলামুখ খনির সম্প্রসারণে জমি অধিগ্রহণের বিনিময়ে বা কর্মরত চাকুরিজীবীর মৃত্যু হলে পরিবারের কেউ স্থায়ী নিয়োগপত্র পান।

১৯৭২-৭৩ এর তথ্য অনুযায়ী কোল ইন্ডিয়াই স্থায়ী কর্মীর সংখ্যা ছিল প্রায় সাত লক্ষ, ২০০৩ সালে পাঁচ লক্ষ দশ হাজার সাতশো দশ, ২০২০ সালে দুই লক্ষ বাহাত্তর হাজার চারশ পঁয়তাল্লিশ জন। ২০০৩ সালে ঠিকা শ্রমিকের সংখ্যা ছিল পনের হাজার, 'লাইভমিন্ট'-এর তথ্য অনুযায়ী ২০২১ সালে ঠিকা শ্রমিক তিরাশি হাজার। বছর বছর কয়লার উৎপাদন বাড়ছে (গত দশ বছরে বেড়েছে ২৫০ মিলিয়ন টনের বেশি), কোল ইন্ডিয়ার লাভের ভাঁড়ারও পূর্ণ হচ্ছে। আবার আরেকটি তথ্য হল, ২০১৭-১৮ সালে পাঁচশ সাতষট্টি মিলিয়ন টনে উৎপাদিত কয়লার মধ্যে একষট্টি শতাংশ অর্থাৎ তিনশ পঁয়তাল্লিশ মিলিয়ন টন আউটসোর্সড হয়েছে অর্থাৎ প্রাইভেট কনট্রাকটরদের মাধ্যমে উত্তোলিত হয়েছে। অর্থাৎ এই বিপুল উৎপাদনের অবদান ঠিকা শ্রমিকদের। কিন্তু ভাগের মা গঙ্গা কি পায়? ডিরেকটরেট জেনারেল অফ মাইনিং সেফটির ২০১৬-১৭ সালের তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে ঠিকা শ্রমিকের খনি সংক্রান্ত দুর্ঘটনা ঘটার হার স্থায়ী শ্রমিকের চেয়ে দুই দশমিক সাত গুন বেশি। কাজ টিকিয়ে রাখাতে বেপরোয়া তো হতেই হবে ঠিকা শ্রমিককে, খনির ঝুরঝুরে মাটির অনিত্যতা নিয়ে সন্দিহান হলে তাদের চলবে না।

ইসিএলের ঠিকা শ্রমিকদের লাঞ্ছনা ও শোষণের বিরুদ্ধে যাদের লড়াই করার কথা ছিল সেই ট্রেড ইউনিয়নগুলির ভূমিকা অতি নিন্দনীয়। তৃণমূল শ্রমিক ইউনিয়নের কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, তারাই ঠিকাদার ও নিয়ন্ত্রক। ক্ষমতাসীন ট্রেড ইউনিয়নকে ডিঙ্গিয়ে একটি পদক্ষেপ নিতে গেলেই হুমকি, কাজ থেকে বহিষ্কার নিশ্চিত। কাজ পেতে গেলে তাদের ঝান্ডা ধরেই ঢুকতে হবে। ক্ষমতায় থাকাকালীন সিপিআই(এম)-এর সামাজিক নিয়ন্ত্রণের মডেলটি শাসকদল বর্তমানে রপ্ত করেছে। একটি নিশ্ছিদ্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যেখানে ঠিকাদারই শাসক, ট্রেড ইউনিয়নের সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত, চুরি করা কোটি কোটি টাকা মজুরির উপার্জনের চক্র চালাচ্ছে - ন্যায্য মজুরি পেতে গেলে এই ট্রেড ইউনিয়নের বিরুদ্ধেই আন্দোলন করতে হবে। অন্যদিকে শ্রমিকশ্রেনীর প্রতিনিধিত্বকারী বলে দাবী করা বামফ্রন্টের ট্রেড ইউনিয়নগুলি প্রায় অনুপস্থিত। ২০০২ সাল অব্ধি সিটু নেতৃত্ব কয়লা উৎপাদনে আউটসোর্সিংএর বিরুদ্ধে কাগজে কলমে বক্তব্য রেখেছিল, ওই বছর ছোট কয়লাখনিতে ঠিকা শ্রমিকের নিয়োগ মেনে নেয়। সিপিআই(এম)-এর সাংসদ, বরিষ্ঠ শ্রমিক নেতা হারাধন রায় খোলামুখ খনি, ঠিকাদারীকরণের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন, দল ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। ষষ্ঠ ও সপ্তম বামফ্রন্টের আমলে ঠিকাদাররা সেই সময় প্রশ্রয় পেয়েছিল, মজুরি চুরির একই ধারা বজায় ছিল। রাজ্যে ক্ষমতাবদলের পর ঠিকাদাররা শিবির পরিবর্তন করতে সময় নেয়নি। ঠিকা শ্রমিকরাও কাজ হারানোর ভয়ে বা ভক্তিতে পুরানো আঙ্গিকে নয়া শাসন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন।

ঠিকা শ্রমিকদের অবস্থা, তাদের বিপন্নতা বোঝার জন্য মজুরি চুরি উদাহরণ যথেষ্ট। ভাবুন, রাষ্ট্র আলাদা মজুরি কমিশন বানিয়ে শ্রমিকের একটা শ্রমমূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে, আর রাষ্ট্রের কার্যনির্বাহী অংশ সেই মজুরির অর্ধেকের বেশি আত্মসাৎ করছে দিনে দুপুরে। কিছু সংগ্রামী সংগঠন যেমন ইস্টার্ণ কোলফিল্ড লিমিটেড কন্ট্রাক্ট ওয়ার্কারস ইউনিয়ন বা আসানসোল ঠিকা শ্রমিক অধিকার রক্ষা সমিতি ঠিকা শ্রমিকের ন্যায্য মজুরির দাবীতে আন্দোলন করার চেষ্টা করছেন - মজুরি বৃদ্ধির দাবী নয়, রাষ্ট্র নির্ধারিত মজুরি পাওয়ার আন্দোলন।

ভারতবর্ষ জুড়ে, তৃতীয় বিশ্ব জুড়ে কল-কারখানায়, উৎপাদনে শ্রমশক্তির প্রায় সবটাই ঠিকাদারী ব্যবস্থার অধীন। নিও-লিবারাল অর্থনৈতিক যুক্তিতে ঠিকা প্রথায় শ্রমিক নিয়োগ বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত। নব্বই দশকের প্রাথমিক পর্যায়ে যখন মুক্ত-বাণিজ্যের স্বার্থে ঠিকাপ্রথার জন্য ওকালতি করেছিল বিশ্বব্যাঙ্ক আইএমএফ এবং তাদের অর্থনীতিবিদেরা, তা ছিল শ্রমিকের শ্রমমূল্যের উপর সরাসরি কোপ বসানোর শুরু - দীর্ঘকালের সংগ্রামে অর্জিত ন্যায্য মজুরির থেকে পিছনের দিকে ঠেলার প্রক্রিয়া। ন্যায্য মজুরির থেকে বঞ্চিত করার মাধ্যমেই অতি মুনাফা, পুঁজির অতি কেন্দ্রীভবন ও ঘনীভবন সম্ভব, সেই সূত্রটি ধরিয়ে দিয়েছিলেন মার্ক্সসাহেব। বাস্তবে তা প্রয়োগ করে দেখিয়েছে পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, বিশ্বায়ন - বারে বারে, দশকের পর দশক। শেষ পর্যায়ের পুঁজিবাদ, তথা নিও-লিবারালিসিম আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করেছিল সংগঠিত শ্রমিকশ্রেণিকে - শ্রমিকশ্রেণির ক্ষমতার আধারগুলি অর্থাৎ ট্রেড-ইউনিয়ানের অধিকার, ধর্মঘটের অধিকার, স্থায়ীত্বের রক্ষাকবচ, মজুরির অসাম্য নিয়ে দরকষাকষির ক্ষমতাকে লঘু করে ‘হায়ার ও ফায়ার’ নীতিকে কেন্দ্রবিন্দুতে রাখা শুরু হয়, ইউনিয়ন করার অধিকার কেড়ে ম্যানেজার বসিয়ে শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ করার সওয়াল করা শুরু হয়, কন্ট্র্যাক্ট জব (ঠিকা কাজ)-কে শ্রমসংক্রান্ত কর্মসংস্থানের অক্ষ নির্ধারিত করা হয়। ‘মুক্ত বানিজ্যে’র স্বার্থে রাজ্য-কেন্দ্র সকল সরকারই এই নতুন ব্যবস্থার কাছে নতি স্বীকার করেছিল। সামাজিক উৎপাদনে কন্ট্র্যাক্টচুয়াল জব আজ নিয়মে পরিণত হয়েছে, একটা পাকাপোক্ত ব্যবস্থার রূপ নিয়েছে - সংগঠিত শ্রমিকশ্রেণিকে হঠিয়ে বিপুল অসংগঠিত, নড়বড়ে দুর্বল, ভাষ্যহীন, জীবনযুদ্ধে অসুরক্ষিত অংশে পরিণত করার প্রচেষ্টা আজ সফল। কোভিড লকডাউনে পরিযায়ী শ্রমিকদের দূরবস্থা, তাদের প্রতি সরকারী তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের উদাহরণ দিয়ে এই শ্রমিকদের সংগঠনহীনতার খানিক আন্দাজ পাওয়া যায়। পুঁজি এবং শ্রমের চিরন্তন দ্বন্দ্বের নবীনতম অবস্থা হল দুনিয়াজুড়ে ঠিকা কাজের ফিরে আসা। শ্রমিকশ্রেণির জন্য সমতা, লোকহিত, জনকল্যাণ রাষ্ট্র ইত্যাদি ধারণা দীর্ঘদিন আগে অন্তর্হিত হয়েছে। ঠিকাদারি ব্যবস্থার রমরমাকে সমসাময়িক পর্যায়ে শ্রম ও পুঁজির চূড়ান্ত রূপ হিসাবে দেখাটা খুব অপ্রাসঙ্গিক হবে না - এবং এই ব্যবস্থার পরিবর্তন নিয়মতান্ত্রিক আইনী পথে পরিবর্তন অসম্ভব। অতি মুনাফা তৈরির এই ব্যবস্থায় ইসিএলের কয়লার খাদ থেকে ঠিকা শ্রমিকদের উঠে আসার ঢালটি তাই খুবই পিচ্ছিল।