আরেক রকম ● দশম বর্ষ সপ্তম সংখ্যা ● ১-১৫ এপ্রিল, ২০২২ ● ১৬-৩০ চৈত্র, ১৪২৮

প্রবন্ধ

২০২২-এর যুদ্ধ ও বিশ্ব অর্থনীতি

গৌতম সরকার


যুদ্ধ শুরুর কোনও শুভক্ষণ থাকতে পারে না, কারণ যুদ্ধ পূজো-পালা-পার্বন নয়, তবু রাশিয়া যে সময়টাকে ইউক্রেনে সামরিক আক্রমণের জন্য বেছে নিল, সেটা বিশ্বের সার্বিক কল্যাণের নিরিখে বড়ই অসময়। গত দু'বছর ধরে কোভিড অতিমারীর কারণে আপামর মানুষ একটা দ্রোহকালের মধ্যে দিয়ে চলেছে, তার উপর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ তাদের জীবনযন্ত্রণা আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। কোভিড-১৯ বিশ্বের উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থা প্রায় অচল করে দিয়েছে, অগণিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া ঘোষণা করায় বেকারত্মের হার ১৯৩০ সালের মহামন্দাকেও ছাড়িয়ে গেছে। সংকটের মধ্যেই বিশ্ব অর্থনীতি মন্থর গতিতে হলেও যখন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে, ঠিক সেই সময় এই যুদ্ধ সেই সাধু প্রচেষ্টার গোড়ায় কুঠারাঘাত করেছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর কয়েকদিনের মধ্যেই এই যুদ্ধ শুধুমাত্র সামরিক হিংসার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, সাথে অর্থনৈতিক যুদ্ধও শুরু হয়েছে। এর অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে প্রভাবিত হবে বিশ্ব অর্থনীতি। কোভিড-১৯ এর কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, সেটি এখনও পুরোপুরি কাটেনি। ২০২০ সালে পৃথিবীব্যাপী মন্দার পর ২০২১ সালে একটা সার্বিক উত্তরণের আভাস ছিল। কিন্তু ২০২২ সাল শুরুর তৃতীয় মাসেই এই সামরিক সংঘাত বিশ্ব অর্থনীতিকে একটা নতুন সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

ইউক্রেন ও রাশিয়ার দ্বন্দ্ব আজকের নয়। ১৯৯১ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ইউক্রেনের আত্মপ্রকাশকাল থেকেই দ্বন্দ্বের শুরু। প্রথম থেকেই রাশিয়া চায় ইউক্রেন তার ছত্রছায়ায় থাকুক। অন্যদিকে ইউক্রেন রাশিয়ার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব ছাড়িয়ে পশ্চিমা দেশগুলির ধাঁচে নিজেকে গড়তে চায়। এই পরিপ্রেক্ষিতে গত কয়েক বছর ধরে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদমির জেলেনস্কি ন্যাটোয় যোগ দিতে উঠেপড়ে লেগেছেন। রাশিয়ার এখানেই আপত্তি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরে সাম্যবাদী রাশিয়াকে প্রতিহত করতে আমেরিকার নেতৃত্বে এই জোট (নর্থ অ্যাটল্যান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন - ন্যাটো) তৈরি হয়েছিল। রাশিয়া স্বাভাবিকভাবেই চায়না ইউক্রেন সেই বিরুদ্ধ গোষ্ঠীতে যোগ দিক। এমনিতেই ন্যাটো সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আলাদা হওয়া অনেক রাষ্ট্রকে সদস্য করে নিয়েছে। এখন ইউক্রেনকেও দলে টেনে ন্যাটো চাইছে রাশিয়াকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরতে, যেটা পুতিন সরকারের মোটেই পছন্দের নয়। ন্যাটোর এই বাড়বাড়ন্ত রাশিয়ার জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত করবে। আন্তর্জাতিক মঞ্চে রাশিয়ার এই অভিযোগ বহুদিনের, সেই অভিযোগ বিন্দুমাত্র গুরুত্ব না দিয়ে ইউক্রেনকে নিয়ে ন্যাটোর তথা আমেরিকার কূটক্রীড়াই রাশিয়াকে এই যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করেছে।

সামরিক যুদ্ধের বিরুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলো একযোগে অর্থনৈতিক যুদ্ধ শুরু করেছে। নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি বিভাগের এমিরিটাস অধ্যাপক নুরিয়েল রুবিনি মনে করেন, "বিশ্ব অর্থনীতিতে এই যুদ্ধের প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। কোভিড পরিস্থিতি গত দুই বছরে সামগ্রিক সরবরাহ ব্যবস্থাকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। এই যুদ্ধ সেই সমস্যাকে আরও প্রকট করে তুলবে। এর ফলে বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতির চাপ আরও বেড়ে যাবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যে মুহূর্তে বিভিন্ন দেশের সরকার ঋণের সরবরাহ কমাতে সুদের হার বাড়িয়ে দেবে, ঠিক তখনই বিনিয়োগ ও উৎপাদন কমতে শুরু করবে। একই সাথে একদিকে দ্রব্যসমূহের সার্বিক দাম বাড়বে, অন্যদিকে মোট উৎপাদন ও প্রবৃদ্ধি কমবে, অর্থনীতির ভাষায় একে বলা হয় 'স্ট্যাগফ্লেশন'। এর ফলে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে, কিন্তু নতুন কোনও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না।"

বিশ্ব অর্থনীতিতে যুদ্ধের প্রভাবঃ

এক, অর্থনীতিবিদদের মতে, বৈশ্বিক অর্থনীতিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব টের পাওয়া যাবে ধীরে ধীরে এবং লম্বা সময় ধরে। যুদ্ধের প্রভাব প্রথমে পড়বে দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ দুই দেশের উপর। ইতিমধ্যেই ইউক্রেন অর্থনীতি সেটা টের পাচ্ছে, অন্যদিকে একাধিক নিষেধাজ্ঞার ধাক্কায় রাশিয়ায় সাধারণ মানুষের 'ত্রাহি মধুসূদন' অবস্থা। আমেরিকা-ইউরোপের প্রায় সমস্ত দেশের আকাশপথ এই মুহূর্তে রাশিয়ান অ্যাভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রির জন্য বন্ধ, 'সুইফট' থেকে রাশিয়ান ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ফিফা, উয়েফা, অলিম্পিক থেকে শুরু করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় রাশিয়াকে ব্রাত্য ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন ক্রীড়া সংস্থা এবং ক্লাব রুশ কোম্পানীর সমস্তরকম স্পন্সরশিপ বাতিল করেছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ইতিমধ্যেই বিভিন্ন উৎপাদন ক্ষেত্র থেকে মূলধন তুলে নিচ্ছে, যুদ্ধের খরচ মেটাতে গিয়ে দেশটির তহবিলে টান পড়েছে, ব্যাংকগুলো আন্তর্জাতিক যোগাযোগ হারিয়ে নগদের সংকটে ভুগছে। এই সবকিছু নিয়ে রাশিয়া যতই যুদ্ধক্ষেত্র দাপাক, দেশের সাধারণ মানুষ মোটেই ভালো নেই সেটি খুবই স্পষ্ট।

দুই, যুদ্ধকে ঘিরে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ক্রমাগত বেড়ে চলেছে, যেটা আগামী দিনে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এর অন্যতম কারণ হল রাশিয়া বিশ্বের অন্যতম প্রধান পেট্রোলিয়াম তৈল রপ্তানিকারী দেশ। রাশিয়াতে দৈনিক ১১ মিলিয়ন ব্যারেল তেল উৎপাদিত হয়। সারা বিশ্বে মোট যে তেল ব্যবহৃত হচ্ছে তার ১১-১২ শতাংশ আসে রাশিয়া থেকে। যুক্তরাষ্ট্র সহ ইউরোপ ও এশিয়ার বহু দেশ রাশিয়ার তেলের উপর নির্ভরশীল। এছাড়া ইউরোপের ৪০ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাসের যোগানদার হল রাশিয়া। পশ্চিমা দেশগুলো অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করতেই একদিকে শেয়ার বাজারে ধস নামা শুরু হয়েছে, অন্যদিকে তেলের দামে ঊর্ধ্বগতি দেখা দিয়েছে। এখন নিষেধাজ্ঞা-প্রতি নিষেধাজ্ঞার চক্করে পড়ে আন্তর্জাতিক বাজারে তেল ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কারণে মূল্যবৃদ্ধিও আকাশছোঁয়া হতে চলেছে।

তিন, বিবদমান দুই প্রতিপক্ষ ছাড়াও যুদ্ধের প্রভাব অন্য দেশগুলোর উপরও পড়বে, বলাই বাহুল্য। এই মুহূর্তে বিশ্ব অর্থনীতিতে রাশিয়ার অবদান ৬ শতাংশ, সংখ্যার নিরিখে কম মনে হলেও বাস্তবক্ষেত্রে মোটেই তা নয়। ১৯৭৩ সালের বিশ্বব্যাপী 'তেল সংকটের' সময় বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মধ্যপ্রাচ্যের অবদান ছিল এর চেয়েও কম। সেই তেল সংকট বিশ্বের ধনী-দরিদ্র সমস্ত অর্থনীতিকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিল। পৃথিবীতে জ্বালানির যোগানদার মুষ্টিমেয় কতকগুলি দেশ, যার মধ্যে রাশিয়ার অবস্থান একদম প্রথম সারিতে। এই মুহূর্তে রাশিয়া তার দাবা বোর্ডে এই ঘুঁটিটাই বুদ্ধি করে সাজাচ্ছে। ন্যাটোর দেশগুলো তাদের ওপর একের পর এক আর্থিক নিষেধাজ্ঞা চাপাচ্ছে, কিন্তু ভুললে চলবে না সমগ্র ইউরোপের প্রাকৃতিক গ্যাস চাহিদার ৪০ শতাংশ এবং জ্বালানি তেলের এক তৃতীয়াংশ রাশিয়া একাই সরবরাহ করে। রাশিয়া এই জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দিলে, বিশ্ব অর্থনীতির চাকা আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যাবে। এ ধরণের উদাহরণ কিন্তু হাতের কাছেই আছে। ২০২১ সালে একইভাবে ইউক্রেন সংকট গভীর হওয়ার সময় মস্কো ইউরোপের দেশগুলোকে চুক্তির বাইরে একফোঁটা অতিরিক্ত গ্যাস সরবরাহ করেনি। আর তাতেই সারা ইউরোপ জুড়ে গ্যাসের দাম হু হু করে বেড়ে গিয়েছিল।

সামরিক ক্ষেত্রে বড় খেলোয়াড় হলেও, অর্থনীতির মাঠে রাশিয়া খুব একটা শক্তিধর প্রতিপক্ষ নয়। রাশিয়ার বার্ষিক জিডিপি ১.৪৮ ট্রিলিয়ন ডলার, যেখানে সংখ্যাটি যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য ক্যালিফোর্নিয়ার ক্ষেত্রে ২.৪৫ ট্রিলিয়ন ডলার, টেক্সাসের ১.৮ ট্রিলিয়ন ডলার এবং নিউইয়র্কের ১.৬৮ ট্রিলিয়ন ডলার। অর্থনীতি ছোট হলেও জ্বালানি তেল আর প্রাকৃতিক গ্যাসের সংগ্রাহক হিসেব রাশিয়ার গুরুত্ব বিশ্ব অর্থনীতিতে অনন্য। দেশটি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম জ্বালানি তেল উৎপাদক, যুক্তরাষ্ট্র এবং সৌদি আরবের ঠিক পরেই। অন্যদিকে গ্যাস উৎপাদক দেশ হিসেবে রাশিয়ার স্থান দ্বিতীয়, শীর্ষস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। একথা অনস্বীকার্য যে রাশিয়ার রপ্তানিকৃত জ্বালানি শক্তির জোরেই বিশ্বের শীতপ্রধান দেশগুলির ঘর গরম থাকে, বিশ্বের আরও অনেক দেশের কারখানা এবং যানবাহন সচল থাকে। এখন রাশিয়া যদি এই জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয় তাহলে সমগ্র ইউরোপ এবং বিশ্বের আরও অনেক দেশের অর্থনীতি চরম সংকটের মধ্যে পড়বে।

চার, পেট্রোলিয়াম তেল ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কারণে প্রায় সমস্ত দেশেই মুদ্রাস্ফীতি একটা বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিচ্ছে। গত দু'বছর ধরে করোনা ভাইরাসের সাথে নিরন্তর লড়াইয়ে প্রতিটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সমস্ত অস্ত্রগুলো ব্যবহার করা হয়ে গেছে। সম্প্রতি করোনার নেতিবাচক প্রভাব থেকে বাঁচার জন্য বিশ্বজুড়ে সম্প্রসারণমূলক মুদ্রাস্ফীতি নীতি চালু হয়েছে। যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট মুদ্রাস্ফীতি এই নীতিকে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে। এখন সম্প্রসারণ নীতিকে পরিবর্তন করতে গেলে বিশ্ব অর্থনীতির পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যাবে।

পাঁচ, ইউক্রেন-রাশিয়ান যুদ্ধ 'তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের' দিকে ঝুঁকে পড়ার আশঙ্কায় অনেক দেশই নিরাপত্তার স্বার্থে প্রতিরক্ষা খাতে বাজেট বৃদ্ধিতে সচেষ্ট হচ্ছে। জার্মানি ইতিমধ্যেই এই আর্থিক বছরে প্রতিরক্ষা খাতে ১০ হাজার কোটি ইউরো বৃদ্ধির ঘোষণা করে দিয়েছে, যেটি তাদের জিডিপির ২ শতাংশ। খুব শীঘ্রই আরও অনেক দেশের পক্ষ থেকে এই ধরণের ঘোষণা আসবে বলে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের অভিমত। যেটি গুরুত্বপূর্ণ সেটি হল, এই অতিরিক্ত ব্যয় দেশের নিরাপত্তা হয়তো বাড়াবে, তবে দেশজ উৎপাদন বাড়াবে না।

ভারতীয় অর্থনীতিতে যুদ্ধের প্রভাবঃ

রাশিয়া-ইউক্রেন সামরিক সংঘাত আগামী দিনে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে সাথে ভারতের জন্যেও ধ্বংসাত্মক হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বিশ্ব ব্যাংক। ইতিমধ্যে লন্ডনের তথ্য বিশ্লেষণ সংস্থা 'গ্লোবাল ডেটা' ২০২২ সালে ভারতীয় অর্থনীতির বৃদ্ধির পূর্বাভাস ১০ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে দিয়েছে। তাদের অনুমান, ভারতের প্রবৃদ্ধির হার বর্তমান বছরে দাঁড়াতে পারে সর্বোচ্চ ৭.৮ শতাংশ। বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড মালপাস বলেছেন, "বিশেষ করে গরীব দেশগুলিতে যুদ্ধের ধাক্কা লাগবে সবচেয়ে বেশি। এইসব দেশের মানুষ কোভিড অতিমারীজনিত মূল্যবৃদ্ধির জেরে ইতিমধ্যেই কাহিল, তার ওপর রাশিয়া ও ইউক্রেন যৌথভাবে বিশ্বের প্রায় ২৯ শতাংশ গম এবং ৬০ শতাংশ সূর্যমুখী তেল রপ্তানী করে, ফলত এইসব আবশ্যিক পণ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি গরীব দেশগুলোকে আবার ভীষণরকম বিপন্ন করে তুলবে।" যুদ্ধের প্রভাবে ভারতীয় আমদানিতেও কোপ পড়বে। গ্লোবাল ডেটার হিসেব অনুযায়ী ভারত এই দুই দেশ থেকে যে সমস্ত দ্রব্য কেনে তার মধ্যে অন্যতম হল, অস্ত্রশস্ত্র, খনিজ তেল, প্রাকৃতিক মুক্তা ও দামি পাথর, সার, পেট্রোপন্য, অপরিশোধিত তেল, ভোজ্য তেল ইত্যাদি। যুদ্ধ এই সমস্ত দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি করে ভারতীয় অর্থনীতিকে সংকটের মধ্যে ফেলার সমূহ সম্ভাবনা আছে।

অন্যদিকে শেয়ার বাজারে পতন ভারতীয় অর্থনীতির জন্যে মোটেই ভালো সংকেত নয়। যুদ্ধ শুরুর প্রথম দিনই সেনসেক্সের ১৪০০+ পয়েন্ট আর নিফটির ৪০০+ পয়েন্ট পতন সেই দিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। অপরিশোধিত তেলের দাম বৃদ্ধি ভারতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ব্যারেল প্রতি তেলের দাম বেড়ে ১৫০ ডলার হতে পারে। যদি তাই হয়, তাহলে বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ০.৯ শতাংশ কমে যেতে পারে। অন্যদিকে ভারতের হোলসেল প্রাইস ইনডেক্সে অপরিশোধিত তেলের যোগদান ৯ শতাংশ। সেইহেতু তেলের দামবৃদ্ধি ভারতের হোলসেল প্রাইস ইনডেক্স ০.৯ শতাংশ বাড়াবে। এর সাথে এলপিজি ও কেরোসিনের দামও বৃদ্ধি পাবে। ভারতের মোট আমদানির ২৫ শতাংশ হল জ্বালানি তেল, ব্যবহৃত তেলের ৮০ শতাংশ ভারত বাইরে থেকে আমদানি করে। করোনাকালীন সময়ে ভারতীয় জনগণ পেট্রোল-ডিজেলের দাম বৃদ্ধিতে নাস্তানাবুদ হয়েছে, যুদ্ধের কারণে আবার সেই দামবৃদ্ধি মানুষের জীবনধারণ আরও অসহনীয় করে তুলবে।

সাম্প্রতিক ঘটনায় ভারত খুব চাপে আছে। যথেষ্ট চিন্তাভাবনা করে মোদি সরকারকে তাদের ভূমিকা ঠিক করতে হচ্ছে। যুদ্ধ শুরুর হওয়ার পর বার দুয়েক প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ফোনে যোগাযোগ হয়েছে। খবরে প্রকাশ আলোচনায় মোদিজী পুতিনকে হিংসা পরিত্যাগ করে আলাপ-আলোচনার মধ্যে দিয়ে সমস্যা সমাধানের জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন। মোদিজী বলেছেন, "সৎ ও আন্তরিক আলোচনার মাধ্যমেই রাশিয়া ও ন্যাটোর মতপার্থক্য দূর করা সম্ভব।" আসলে এই যুদ্ধটা ওপর ওপর রাশিয়া আর ইউক্রেনের মধ্যে হলেও, আসল দ্বন্দ্বটা মূলত আমেরিকা আর রাশিয়ার মধ্যে। এই মুহূর্তে ভারতের সাথে দুই দেশের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ। সামরিক ক্ষেত্রে ভারত অনেকটা রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল। মোট সামরিক সরঞ্জামের প্রায় ৫৫ শতাংশ রাশিয়া থেকে আমদানি করা হয়। অন্যদিকে গত ১০ বছরে আমেরিকার সাথে ভারতের সম্পর্ক মজবুত হয়েছে। ইউক্রেনের সাথেও বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক ভাল। স্বভাবতই ভারত এই তিন দেশের কারোর সাথেই সম্পর্ক খারাপ করতে চায় না। ইউক্রেনে সংকট বাড়লে, ভারতের সাথে তাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ধাক্কা খাবে। সাম্প্রতিক হিসেব বলছে, ২০২০ আর্থিক বছরে ইউক্রেন এবং ভারতের মধ্যে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১.৯৭ বিলিয়ন ডলার, আর আমদানির পরিমাণ ৭২০.২১ মিলিয়ন ডলার। এর সাথে রাশিয়া থেকে ওই একই সময়ে আমদানির পরিমাণ ছিল ৫.৯৪ বিলিয়ন ডলার। যদিও পুতিনের সাথে মোদিজীর বৈঠকে এই আশ্বাস জোরদার হয়েছে, আগামী দিনেও দুই দেশ একযোগে কাজ করবে এবং সাম্প্রতিক দুর্যোগ দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে কোনোরকম প্রভাব ফেলবে না।

অর্থনীতিতে নিষেধাজ্ঞার অভিজ্ঞতা রাশিয়ার জন্য নতুন কিছু নয়। এরকম একটা পরিস্থিতির আন্দাজ করেই পুতিন ৬৩০ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত গড়ে তুলেছেন। এই পরিমাণ অর্থ আগামী দুই বছর রাশিয়ার যাবতীয় আমদানি বিল মেটাবার পক্ষে যথেষ্ট। তবে বৈদেশিক বাণিজ্যে নিষেধাজ্ঞা তো কেবলমাত্র রপ্তানিতে নয় আমদানিতেও পড়বে, তাই বিদেশি মুদ্রার যথেষ্ট যোগান রাশিয়ান অর্থনীতির জন্য ততটা সুখবর নয়। ইতিমধ্যেই রুবল অবমূল্যায়নের কোপে পড়েছে, বৈদেশিক বাণিজ্য পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে, শেয়াবাজারের অবলুপ্তি ঘটেছে, এইসব কিছু মিলিয়ে পুতিন মোটেই ভালো নেই। অন্যদিকে ভলোদমির জেলেনস্কি যতই ন্যাটোর কাছ থেকে কোনওরকম সামরিক সহযোগিতা পাচ্ছেন না বলে আক্ষেপ করুন, বিশেষজ্ঞদের মতে এই ক্রান্তিকালে সমস্ত দেশ সামগ্রিক বিশ্বকে 'তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের' অভিশাপ এবং যন্ত্রণা থেকে বাঁচানোর জন্য যে পদক্ষেপ নিচ্ছে, আগামী দিনের পৃথিবী তার জন্য কৃতজ্ঞ থাকবে।