আরেক রকম ● দশম বর্ষ সপ্তম সংখ্যা ● ১-১৫ এপ্রিল, ২০২২ ● ১৬-৩০ চৈত্র, ১৪২৮

সম্পাদকীয়

জাতীয় নিলাম করপোরেশন


অবশেষে সমস্ত সমালোচকদের এতদিনের অভিযোগ ধূলিসাৎ করে একটি নতুন জাতীয় সংস্থা স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিল নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা গত ৯ মার্চ, ২০২২ একটি নতুন জাতীয় উদ্যোগ গড়ে তোলার অনুমোদন দিয়েছে। অর্থ মন্ত্রকের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রের সম্পূর্ণ মালিকানাধীন 'ন্যাশনাল ল্যান্ড মনিটাইজেশন কর্পোরেশন' (এনএলএমসি) স্থাপিত হবে। এনএলএমসি-র জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। এছাড়া শেয়ার মূলধন হিসেবে দেড়শো কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে ভারত সরকার।

এখানে প্রশ্ন উঠতেই পারে, যে সংস্থায় ভারত সরকার নিজেই ৫ হাজার কোটি টাকা মূলধন বিনিয়োগ করতে চলেছে সেখানে আবার আলাদাভাবে শেয়ার মূলধন হিসেবে দেড়শো কোটি টাকা লগ্নির কী দরকার? হঠাৎ করে নয়। ভুল করেও নয়। রীতিমতো হিসেবনিকেশ করে ভবিষ্যতের কথা ভেবেই এমন ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রয়োজনে শেয়ার বাজার থেকে আরও শেয়ার কেনার সুযোগ এখনই রেখে দেওয়া হল। যদি বাজার থেকে সংগ্রহ করা পুঞ্জীভূত শেয়ারের দাম সরকারের লগ্নি করা প্রাথমিক মূলধনের থেকে বেশি হয়ে যায় তখন অনায়াসে এনএলএমসি বেসরকারি নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ার রাস্তা খোলা রাখার জন্য এমন বন্দোবস্ত করা হয়েছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির উদ্বৃত্ত জমি, বাড়ি এবং সমস্ত স্থাবর সম্পদের দাম নির্ধারণের পর নগদীকরণের দায়িত্ব পালন করবে এনএলএমসি। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ছাড়া যে সব আধা-সরকারি সংস্থায় সরকারের ন্যূনতম অংশীদারিত্ব বা শেয়ার রয়েছে সেই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিরও বাড়তি জমি-বাড়ি ও স্থাবর সম্পত্তির বর্তমান বাজার দর নির্ধারণ ও নগদীকরণ করবে এনএলএমসি।

মন্ত্রীসভার বৈঠকের পর সরকারি বিবৃতিতে জানানো হয়েছে যে বাড়তি স্থাবর সম্পদ নগদীকরণ করে সরকার যথেষ্ট রাজস্ব আয় করতে সক্ষম হবে৷ অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ও আধা-সরকারি সমস্ত সংস্থার জমি-বাড়ি বিক্কিরি-বাট্টা করে রাজকোষের শ্রীবৃদ্ধি করার জন্য স্থাপিত হতে চলেছে এনএলএমসি।

বর্তমান সরকারের। মূল লক্ষ্য বিলগ্নিকরণ ও বি-রাষ্ট্রীয়করণ। এই লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্য প্রতিটি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের এখন প্রাথমিক কাজ সংস্থার সম্পদের মূল্য নির্ধারণ। অর্থাৎ আজকের বাজার দর অনুযায়ী সংস্থাটির সম্পদের দাম কত হতে পারে তার হিসাব কষা। প্রায় শ' আড়াই রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানে গত বছর সাত-আট ধরে নিত্যদিনই এই আঁক কষা চলছে। এহেন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের জন্য প্রতিটি সংস্থায় একটি নির্দিষ্ট কর্মীবাহিনী গড়ে তুলতে হয়েছে। এই বাহিনীর প্রধান কাজ -
• নির্দিষ্ট সম্পদের শনাক্তকরণ।
• সেই সম্পদের দাম নির্ধারণ।
• শনাক্ত জমির মালিকানা সংক্রান্ত বিরোধের নিষ্পত্তি।
• প্রস্তাবিত সম্পদ নিলাম করার পদ্ধতি প্রণয়ন।
• নিলামে অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুক ক্রেতার জন্য আকর্ষণীয় শর্ত বিপণন।

সেদিক থেকে বিচার করলে এমএলএমসি স্থাপনের সিদ্ধান্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী। সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের আর আলাদাভাবে বিশেষ কর্মীবাহিনীর প্রয়োজন থাকবে না। সকলের জন্য একই বিষয়ের বিশেষায়িত কাজ এমএলএমসি করে দেবে। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের বাড়তি সম্পদ নির্ণয় করা থেকে শুরু করে তার মূল্য নির্ধারণ ও নগদীকরণ করে দেবে এমএলএমসি। মামলা মোকদ্দমার যাবতীয় ঝুট-ঝামেলা সামাল দেবে নবগঠিত এমএলএমসি। নিলামের বাজারে বিক্রয়যোগ্য সম্পদকে ক্রেতার জন্য আকর্ষণীয় শর্তে বাজারজাত করার দায়িত্ব পালন করবে এনএলএমসি। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে বিলগ্নিকরণ ও বি-রাষ্ট্রীয়করণ প্রক্রিয়ায় এখন থেকে এনএলএমসি-র ভূমিকা হতে চলেছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

গত সেপ্টেম্বরে, কেন্দ্রীয় সরকার আনুমানিক ৬ লক্ষ কোটি টাকার একটি চার বছরের জাতীয় নগদীকরণ পাইপলাইন (এনএমপি অর্থাৎ ন্যাশনাল মনিটাইজেশন পাইপলাইন) প্রকল্প প্রণয়ন করে। নগদীকরণ করা সম্পদের মোট আনুমানিক মূল্যের ৬৬ শতাংশেরও বেশি সড়ক, রেলওয়ে এবং বিদ্যুৎ ক্ষেত্র থেকে আসবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। এনএলএমসি প্রকৃতপক্ষে এনএমপি-র উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য স্থাপিত হতে চলেছে। মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্তের পর জারি করা সরকারি বিবৃতি অনুসারে, জমির নগদীকরণ সরাসরি বিক্রয় বা ছাড়ের মাধ্যমে বা অনুরূপ উপায়ে হতে পারে। এই প্রক্রিয়ার অধীনে, সরকার একটি নির্দিষ্ট লেনদেনের জন্য ক্রেতাকে জমির স্বত্বাধিকার হস্তান্তর করবে।

এখনও পর্যন্ত, বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান প্রায় ৩ হাজার ৪০০ একর উদ্বৃত্ত জমির নথি ভারত সরকারের অর্থ মন্ত্রকের অন্তর্গত 'ডিপার্টমেন্ট অফ ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড পাবলিক অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট' ('ডিপাম' বলে বেশি পরিচিত)-কে নগদীকরণের জন্য প্রস্তাব জমা দিয়েছে। বিইএমএল বেঙ্গালুরুতে প্রায় ১২৩.৩৯ একর এবং মহীশূরে প্রায় ৪০১.২৩ একর উদ্বৃত্ত জমি চিহ্নিত করেছে। বন্ধ করে দেওয়া এইচএমটি লিমিটেড নগদীকরণের জন্য বেঙ্গালুরুতে প্রায় ৮৯.৫০৬ একর জমি নির্ধারণ করেছে।

রেল ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় দেশের সবচেয়ে বেশি সরকারি জমির মালিক। সরকারি তথ্য অনুসারে, রেলওয়ের ভূ-সম্পত্তির আয়তন ১১.৮০ লক্ষ একর। এর মধ্যে নাকি ১.২৫ লক্ষ একর জমি খালি রয়েছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের নিয়ন্ত্রণে থাকা প্রায় ১৬.৩৫ লক্ষ একর জমি তাদের সীমানার বাইরে রয়েছে।

সরকারি বয়ানে বলা হয়েছে যে, এনএলএমসি এই সম্পদগুলির নগদীকরণকে সহজ করবে। এনএলএমসি বেসরকারি বিনিয়োগ করতে সাহায্য করবে। নতুন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সৃষ্টি করে স্থানীয় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিকাঠামোর জন্য আর্থিক সংস্থান তৈরি করতে অব্যবহৃত বাড়তি সম্পদের যথাযথ ব্যবহারকেও সক্ষম করবে বলে সরকারের বিবৃতিতে জানানো হয়েছে।

এনএলএমসি সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের উদ্বৃত্ত ভূ-সম্পদ নগদীকরণ করবে, এবং এই বিষয়ে কেন্দ্রকে সহায়তা ও প্রযুক্তিগত পরামর্শ প্রদান করবে। এনএলএমসি পরিচালন পর্ষদ বোর্ড প্রবীণ সরকারি কর্মকর্তা এবং বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত হবে। পর্ষদের অধ্যক্ষ ও অন্যান্য সদস্যদের বেসরকারি ক্ষেত্র থেকে যোগ্যতা-ভিত্তিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিয়োগ করা হবে বলে সরকারি বিবৃতিতে বলা হয়েছে। এনএলএমসি-তে ন্যূনতম সর্বক্ষণের কর্মী কাজ করবেন এবং তাঁদের চুক্তির ভিত্তিতে সরাসরি বাজার থেকে নিয়োগ করা হবে। বেসরকারি ক্ষেত্র থেকে অভিজ্ঞ পেশাদারদের নিয়োগ, বেতন নির্দিষ্ট করার দায়িত্ব এনএলএমসি পালন করবে। সরকারের কোনো অনুমোদন লাগবে না।

কী বিচিত্র দ্বিচারিতা। অনবরত প্রচার চলছে সত্তর বছরে দেশের কিছুই হয়নি। পাশাপাশি একের পর এক এতদিনের রাষ্ট্রীয় সম্পদ জলের দরে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। তারপরেও যখন বিক্রি হয়ে যাওয়া প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য স্থাবর সম্পত্তি পড়ে থাকছে তখন তা বিক্কিরি-বাট্টা করার জন্য কত কারিকুরি। ১৮ হাজার কোটি টাকায় বিক্রি হয়ে গেল এয়ার ইন্ডিয়া। কীভাবে এই মূল্যায়ন করা হয়েছিল তার উত্তর দেওয়ার বালাই নেই। এখন এয়ার ইন্ডিয়ার জমি বাড়ি নিয়ে টানাটানি। কারণ দেশে বিদেশে এয়ার ইন্ডিয়ার জমি বাড়ি অভিজাত এলাকায় অবস্থিত। আমেদাবাদ, লখনৌ, মেঙ্গালুরু, জয়পুর, গুয়াহাটি ও তিরুবনন্তপুরম বিমানবন্দর মাত্র ১,৮১৮ কোটি টাকার বিনিময়ে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। বেসরকারি সংস্থা আবার যাত্রীদের টিকিটের সঙ্গে 'ডেভেলপমেন্ট ফী' জুড়ে দেয়। চুক্তি অনুযায়ী ডেভেলপমেন্ট ফী-র একটা অংশ সরকারের খাজানায় আসার কথা। ২০২১-২২ অর্থ বর্ষের প্রথম দশ মাসে সরকার এই ছ'টি বিমানবন্দর থেকে ডেভেলপমেন্ট ফী খাতে মাত্র ৩৩১ কোটি টাকা পেয়েছে। রাষ্ট্রীয় সম্পদের লুট করার কয়েকটি দৃষ্টান্ত দেখেই বোঝা যায় কী ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে দেশের অর্থনীতি নিমজ্জিত।

এতদিন তবুও সরকারি তত্বাবধানে বিক্রির জন্য দরদাম স্থির করা হচ্ছিল। এখন সরকারি প্রতিষ্ঠান এনএলএমসি-র পরিচালন পর্ষদে বেসরকারি মতামত গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির অব্যবহৃত ও উদ্বৃত্ত সম্পদ নির্ধারণ করা হবে। এনএলএমসি-তে নিযুক্ত বেসরকারি বিশেষজ্ঞরা সেইসব সম্পদের মূল্যায়ন করবেন। দেশের স্বার্থ পুরোপুরি বেসরকারি হাতে তুলে দিয়ে রাজকোষ কতটুকু সমৃদ্ধ হয় সেটাই এখন দেখার বিষয়।