দশম বর্ষ ষষ্ঠ সংখ্যা ● ১৬-৩১ মার্চ, ২০২২ ● ১-১৫ চৈত্র, ১৪২৮

প্রবন্ধ

রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের হিন্দুত্ব এবং অখন্ড হিন্দুরাষ্ট্রের আসল চেহারা

অশোক সিংহরায়


'অখণ্ড হিন্দুরাষ্ট্র' প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে রাজস্থানের দলিত কিশোর ভানোয়ার মেঘওয়ানশি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘে যোগদান করেন। কিন্তু এক নিদারুণ অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে তার বিশ্বাসভঙ্গ হল। তাঁর সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা এবং উপলব্ধিতেই পালটে গেল মতটা, পালটে গেল পথটা। তারই বর্ণনা এবং বিশ্লেষণ করেছেন তিনি তাঁর 'ম্যায় এক স্বয়ংসেবক থা' গ্রন্থে (২০১৯); যার ইংরেজি অনুবাদ করেছেন জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা নিবেদিতা মেনন - 'I could not be Hindu - The story of a Dalit in the RSS' (২০২০)।

ভানোয়ার মেঘওয়ানশি সংঘ হিন্দু জাতীয়বাদের কথা বলে কিভাবে জাতিত্ব বা বর্ণভেদ প্রথাকে প্রশ্রয় দেয়, সঙ্কীর্ণ বিজ্ঞান-বিরোধী, যুক্তিবাদ বিরোধী, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিরোধী, নারীবিদ্বেষী স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতা কিভাবে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের দ্বারা সমগ্র সমাজকে শাসন করার মধ্যযুগীয় ধারণাকেই লালন করে - তারই বিস্তৃত, প্রাণবন্ত চিত্র এঁকেছেন এই গ্রন্থে।

সংঘ কি এবং কেনঃ ১৯২৫ সালে ডঃ কেশব বলিরাম হেডগাওয়ারের নেতৃত্বে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের জন্ম হয়। ব্যক্তির চরিত্র গঠনই এর উদ্দেশ্য বলা হলেও এর বৃহত্তর উদ্দেশ্য হ'ল 'হিন্দুত্ব' এবং 'অখন্ড হিন্দুরাষ্ট্র'-র ধারণা সমাজের সর্বস্তরে পৌঁছিয়ে দেওয়া এবং সমাজকে সেই পথে চালিত করা। তাই সমাজের সর্বস্তরেই এর শাখা সংগঠন তৈরি হয়। যেমন, মহিলা সংগঠন রাষ্ট্রীয় সেবিকা সমিতি (১৯৩৬), ছাত্রসংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ (১৯৪৮), বনবাসী কল্যাণ আশ্রম (১৯৫২), ভারতীয় মজদুর সংঘ (শ্রমজীবীদের মধ্যে বামপন্থী প্রভাবকে মোকাবিলা করার জন্য ১৯৫৫-য় প্রতিষ্ঠিত), ভারতীয় কিষান সংঘ, সরস্বতী শিশুমন্দির পরিবর্তিত নাম বিদ্যাভারতী (শিশুদের সংঘের আদর্শে দীক্ষিত করার জন্য সারা ভারতে যে সমস্ত বিদ্যালয় কয়েক হাজার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে), ভারত বিকাশ পরিষদ (১৯৬৩); বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (১৯৬৪), বজরঙ্গ দল, দুর্গাবাহিনী (মহিলাদের) প্রভৃতি। নিয়মিত প্রকাশিত হয় হিন্দুস্তান সমাচার, স্বদেশ, পাঞ্চজন্য, রাষ্ট্রধর্ম, মাদারল্যান্ড, অর্গানাইজার প্রভৃতি মুখপত্র; আছে সংঘ নিয়ন্ত্রিত অজস্র প্রকাশনা সংস্থা। এছাড়াও অজস্র আঞ্চলিক সংগঠন আছে যারা আরএসএস-এর নির্দেশে চলে। রেজিষ্টিকৃত না হয়েও আরএসএস পৃথিবীর সর্ববৃহৎ এনজিও।

সংঘের রাজনৈতিক দলঃ ১৯৪৮ সালে গান্ধী হত্যার জন্য সংঘ বিভিন্ন আইনি বাধার সম্মুখীন হয়। প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক দলই আরএসএস বিরোধী হয়ে উঠে। সেই সময় সংঘ প্রধান সরসঞ্চালক গুরুজি সদাশিব গোলওয়ালকার সংঘের অনুমোদিত একটি রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন অনুভব করেন। সুযোগ এসে গেল যখন, হিন্দু মহাসভার প্রাক্তন নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় জওহরলাল নেহেরুর মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের জন্য আরএসএস-এর সাহায্য প্রার্থনা করলেন। ১৯৫১ সালে 'ভারতীয় জনসংঘ'-র প্রতিষ্ঠা হয় যার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং সাধারণ সম্পাদক হন দীনদয়াল উপাধ্যায়। ১৯৫৩ সালে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর দলটি পুরোপুরি আরএসএস-এর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ১৯৭৫ সালে দলটি জরুরি অবস্থার বিরোধিতায় জয়প্রকাশ নারায়ণের আন্দোলনে সামিল হয় এবং পরে জনতা দলের সাথে মিশে গিয়ে কেন্দ্রের স্বল্পস্থায়ী সরকারে যোগদান করে। ১৯৮০ সালে আবার অটল বিহারী বাজপেয়ী এবং লালকৃষ্ণ আদবানির নেতৃত্বে ভারতীয় জনতা পার্টিতে রূপান্তরিত হয়।

সংঘের মতাদর্শ এবং কার্যক্রমকে রাজনৈতিক মদত দেওয়াই বিজেপির দায়িত্ব। সমস্ত শাখা-সংগঠন এবং রাজনৈতিক দল বিজেপি (পূর্বতন জনসংঘ) সংঘের কঠোর নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে, রাজ্য নেতৃত্বে, এমনকি আঞ্চলিক নেতৃত্বে থাকার প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে সংঘের সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত থাকা এবং সংঘের নিয়ন্ত্রণে থাকা।

স্বয়ংসেবক ভানোয়ার মেঘওয়ানশিঃ হিন্দু-জাতীয়তাবাদের উন্মাদনায় মাত্র তেরো বছর বয়সে ভানোয়ার আরএসএস-এর শাখায় যুক্ত হয়। তার বাবা এবং পরিবারের অন্য সদস্যরা আরএসএস বিরোধী এবং কংগ্রেস দলের সমর্থক হলেও তার সরকারি স্কুলের ভূগোলের শিক্ষক বংশীলাল সেনের প্রভাবে তার এই সংঘের শাখায় যোগদান। ক্রীড়াপ্রেমী, সুগায়ক শিক্ষক ভূগোলের ক্লাসে পড়াতেন যে, সূর্য এক বিশাল অগ্নি-গোলক যার কাছে কারও পৌঁছনো সম্ভব নয়; অথচ শাখায় সূর্য-প্রণামের মন্ত্র শেখাতেন এবং কিভাবে হনুমান সূর্যকে গিলে ফেলছিল তার গল্প বলতেন। বিভ্রান্ত ভানোয়ার যখন জিজ্ঞেস করত, "গুরুদেব, সূর্য দেবতা না অগ্নিগোলক?", তিনি উত্তর দিতেন "শাখায় তিনি দেবতা, স্কুলে তিনি অগ্নি-গোলক"। মহাবলশালী বজরঙ্গবলী নাকি সূর্যকে শুধু মুখে পুরে ফেলেননি; চিবোতেও শুরু করেন; অন্য দেবতাদের অনুরোধে নিরস্ত হন। যুক্তির চেয়ে বিশ্বাস বড় - এই বিশ্বাস নিয়েই শুরু হয় ভানোয়ারের সংঘ-যাপন। শাখাতে একে অন্যকে "জি" সম্বোধন করত। দলিত বালক "ভানোয়ারজি ভাইসাহাব" সম্বোধনে পুলকিত হ'ত।

শাখাতে প্রত্যহ সকালে বা সন্ধ্যায় দৌড়, শারীরিক ব্যায়াম, খেলাধূলা, যোগ, বৌদ্ধিক নিবেশ, প্রার্থনা থাকত। (পরে ভানোয়ার আত্মরক্ষার স্বার্থে স্বয়ংসেবকদের লোকচক্ষুর অন্তরালে কঠোর পরিশ্রমসাধ্য শারীরিক ব্যায়াম, ছুরি-লাঠি-তরোয়াল চালনার পাঁচ দিনের প্রারম্ভিক প্রশিক্ষণ এবং পনেরো দিনের আধিকারিক প্রশিক্ষণ পেয়েছে। জেনেছে হিন্দুধর্মের সামরিকীকরণ এবং সামরিক বাহিনীর হিন্দুত্বকরণই সংঘের আসল উদ্দেশ্য)। সাদা সার্ট, কালো টুপি, বেল্ট, বাদামি জুতো এবং খাকি হাফ-প্যান্ট ছিল শাখার আনুষ্ঠানিক পোষাক। সংঘে যে ছয়টি প্রধান উৎসব পালিত হ'ত তার মধ্যে প্রজাতন্ত্র দিবস, স্বাধীনতা দিবস থাকত না। হিন্দু-জাতীয়তাবাদের প্রেরণাদায়ক প্রার্থনা করা হ'ত "নমস্তে সদা বৎসলে মাতৃভূমি"। সংঘের সমস্ত আদেশ ছিল সংস্কৃত ভাষায় (দেব ভাষায়); মনে হ'ত যেন ঈশ্বরের সরাসরি আদেশ।

ডিসেম্বর, ১৯৯০: অযোধ্যার রাম জন্মভূমি-বাবরি মসজিদ বিতর্কের ঢেউ ভানোয়ারের গ্রাম সিরদিয়াস এবং সংলগ্ন শহর ভিলওয়ারাতেও এসে পৌঁছল। অযোধ্যায় করসেবার জন্য দলে নির্বাচিত হয়ে পনেরো বছরের দশম শ্রেণীর ছাত্র ভানোয়ার চলল মর্যাদা-পুরুষোত্তম রামের জন্মভূমিকে মুক্ত করার লড়াইয়ে। মাথায় গেরুয়া পট্টি বেঁধে, কপালে রক্ত-লাল টিকা লাগিয়ে দলে দলে "জয় শ্রীরাম, জয় জয় শ্রীরাম" ধ্বনি দিতে দিতে সন্ধ্যায় যখন আজমিরে লক্ষ্মৌগামী ট্রেনে উঠল, তখন তাদের সাথে আরএসএস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বিজেপির নেতা এবং পরিচিত ব্যবসায়ীদের দেখে তার 'রামসেবক' হিসেবে নিজের জন্য গর্ব হ'ল। "মন্দির ওহি বনায়েঙ্গে" ধ্বনির মধ্যে যখন ট্রেন ছাড়ল তারা কিন্তু সবাই নেমে গেল। শুধু তার মতো দলিত-প্রান্তিক-আদিবাসী রামভক্তের দল এবং কিছু সাধু-সন্ত-তপস্বী-ঋষি চলল রামের জন্মভূমি পুনরুদ্ধারে। তারপর টুন্ডলা স্টেশনে মুল্লা-য়েমের পুলিশ (রামভক্তরা তৎকালীন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মুলায়ম সিং যাদবকে এই নামেই সম্বোধন করত) তাদের গ্রেফতার করে অস্থায়ী জেলে গাদাগাদি করে ঢুকিয়ে দিল; পরে ছেড়ে দিলে কখনও রেললাইন ধরে হেঁটে, আগ্রায় মুসলিমদের হাতে নিগৃহীত হয়ে, মালগাড়ির খালি ওয়াগনে চেপে, বিনা টিকিটে ট্রেনে চেপে পনেরো দিন পরে বাড়ি ফিরে এল। এই ঘটনায় বিজেপি, আরএসএস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতাদের উপর ক্ষুব্ধ হলেও হিন্দু-জাতীয়তাবাদের উন্মাদনা থেকে মুক্ত হল না। একমাত্র হিন্দুদের সবই অখন্ড ভারতে, জেরুজালেম বা মক্কা-মদিনায় নয়, কাজেই হিন্দুরাই ভারত মায়ের প্রকৃত সন্তান - সংঘের এই বক্তব্যকে আরো দৃঢ়তার সঙ্গে আঁকড়ে ধরল। 'পাঞ্চজন্য' পত্রিকা ভানোয়ারকে বৌদ্ধিকভাবে ধর্মান্ধ করে তুলেছিল।

সংঘের স্বয়ংসেবকের স্বপ্নভঙ্গঃ শাখায় ভানোয়ার ক্রমে শিক্ষক থেকে কার্যভ অর্থাৎ শাখা-প্রধান হল। দায়িত্ব এবং সংঘে পরিচিতি বাড়লে একদিন যোধপুরের জেলা প্রচারক শিবজী ভাইসাহাবের কাছে ঘর এবং পরিবার ছেড়ে সংঘের সর্বক্ষণের প্রচারক হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করল। কিন্তু জেলা প্রচারক তার উচ্চমনের প্রশংসা করে জানাল যে তার মতো প্রান্তিক সমাজের যুবক প্রচারক হলে অনেকে আপত্তি করবে; তাকে অপমান সহ্য করতে হবে; এই নিয়ে বাদানুবাদ চলবে; এতে সংঘ দুর্বল হবে। ভানোয়ার হাতে লেখা পত্রিকা "'হিন্দু কেশরী' বের করত; স্থানীয় কাগজে জাতীয়তাবাদী চিন্তা-ভাবনা নিয়ে লেখালেখি করত। সেইদিকে ইঙ্গিত করে তিনি জানালেন যে সংঘ নাগপুর থেকে আসা বার্তাকে হুবহু হিন্দু-সমাজের কাছে পৌঁছে দিতে পারে এমন প্রচারক চায়; ভানোয়ারের মতো প্রশ্ন করা, চিন্তা করা বিচারক চায় না। ভানোয়ার উপলব্ধি করল কেন প্রতিষ্ঠাকাল থেকে তখন পর্যন্ত যে ছ'জন (হেডগাওয়ার থেকে মোহন ভাগবত পর্যন্ত) সরসংঘচালক হয়েছেন তার মধ্যে একজন ক্ষত্রিয় (রাজেন্দ্র সিংহ বা রজ্জুভাইয়া), বাকিরা সবাই ব্রাহ্মণ। এরা সবাই মনোনীত; নির্বাচিত নয়। (পরে জেনেছিলেন সংঘের অখিল ভারতীয় প্রতিনিধি সভায় ৩৬ জন পদাধিকারীর মধ্যে ছাব্বিশ জন ব্রাহ্মণ, পাঁচ জন বানিয়া, তিন জন ক্ষত্রিয়, দুজন অনগ্রসর জাতির; দলিত বা আদিবাসী একজনও নেই)।

অযোধ্যায় করসেবা করতে গিয়ে মৃতদের শহীদ ঘোষণা করে তাদের অস্থিকলস নিয়ে সাধু-সন্ত, সংঘ এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কর্মী এবং কর্মকর্তারা মিছিল করে গ্রামে শহরে ঘুরতে লাগল। ভানোয়ারের গ্রামে মিছিল এবং সভা শেষ হলে ভানোয়ার সবাইকে তাদের বাড়িতে খেতে ডাকল। তার সংঘ বিরোধী বাবা এরা দলিতদের তৈরি খাবার খাবে না বলে আপত্তি করলেও তাতে আমল না দিয়ে বাবার সাথে তর্ক করে তাদের জন্য বাড়িতে পুরি ও ক্ষীর বানানোর ব্যবস্থা করেছিল। ভানোয়ারের এই প্রস্তাবে সবার মধ্যে দ্বিধা দেখা গেল। সংঘের এক কর্তা বলল যে, খাবারগুলি তাদের সঙ্গে দিয়ে দিলে পাশের গ্রাম ভগবানপুরায় সবাইকে খাইয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু পরের দিন সকালে ভানোয়ারের বন্ধু ব্রাহ্মণ কিশোর পুরোষত্তম শ্রোত্রিয় ক্ষীরের পাত্রটি ফেরত দিতে এসে বলল যে, তার দেওয়া সমস্ত খাবার তারা ভগবানপুরায় যাবার পথে রাস্তার ধারে ফেলে দিয়েছে এবং বেশি রাতে রামস্বরুপ শর্মা নামে এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে তৈরি খাবার খেয়েছে। এই কথাটা সে বিশ্বাস করতে না চাওয়ায়, তারা দুজন সাইকেলে অকুস্থলে এসে দেখল সেই খাবার রাস্তার ধারে ছড়িয়ে পড়ে আছে এবং কাক, কুকুর, চিল, পিঁপড়েরা নিজেদের মধ্যেকার বৈষম্য ভুলে খাবারগুলো খাচ্ছে। সেই সন্ধ্যাতেই অস্থি-কলস ব্রাহ্মণদের যে গ্রাম সাবেরিতে পৌঁছেছে সেইখানে গিয়ে ভানোয়ার এই ঘটনার ব্যাখ্যা চাইলে শ্রদ্ধেয় ভাইসাবদের কেউ অস্বীকার করে, কেউ বলে গাড়ি ঘুরতে গিয়ে পড়ে গেছে। ফিরে এসে সংঘের উচ্চপর্যায়ের নেতৃত্বের কাছে জানালে তারা উপদেশ দেন যে এই সমস্ত ছোট ঘটনায় মাথা না ঘামিয়ে নেতিবাচক মনোভাব ছেড়ে ইতিবাচক কাজ করে যেতে হবে। সংঘের সরসংঘচালক বালাসাহেব দেওরসকে সমস্ত ঘটনা লিখে জানালে কোন উত্তর আসে না। সংঘে আদেশ উপর থেকে নীচে আসে; কোন মতামত বা অভিযোগ নীচ থেকে উপরে যাওয়াকে অনুমোদন দেওয়া হয় না। চরম হতাশার মধ্যে ভানোয়ার উপলব্ধি করল হিন্দুরাষ্ট্রের পতাকাবাহীদের কাছে সে একজন 'শূদ্র' মাত্র। সংঘের আদর্শের প্রতি অনুরক্ত স্বয়ংসেবক হয়েও যদি তার ক্ষেত্রে এমন ঘটে, তাহলে তার সম্প্রদায়ের অন্যদের কী অসহনীয় আচরণ সহ্য করতে হয়? ভানোয়ার বুঝল সংঘের হিন্দুরাষ্ট্র শূদ্রদের হতে পারে না।

ভানোয়ার সংঘের সঙ্গ ত্যাগ করল। তার কথায়, "এখন আমার সারাজীবনের কাজ হবে অসৎ হিন্দুত্ব এবং হিন্দুরাষ্ট্রের স্বপ্নের আসল চেহারাটা প্রকাশ করা।... আমি সংকল্প করলাম আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে এই বিশাল সংগঠনের বিরুদ্ধে আমৃত্যু লড়াই চালিয়ে যাব।" যে ধর্ম তাকে শূদ্র বানিয়েছে সেই ধর্ম ত্যাগ করে ধর্মান্তরিত হতে চাইলেও কোনও সংগঠিত ধর্মকেই তার গ্রহণযোগ্য মনে হল না। কারও সবকিছু প্রশ্নের উত্তর প্রাচীন ভারত, কারও কোরাণ, কারও বাইবেল। ১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর যখন অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভেঙে দেওয়া হল, যে দিনটার জন্য সে একসময় মরতেও রাজি ছিল, চারিদিকে উল্লসিত হিন্দুত্ববাদীদের পটকা ফাটাতে, মিষ্টি বিতরণ করতে দেখেও তার কোন জয়ের আনন্দ হল না। বাড়িতে তার বাবা বললেন, "ঈশ্বরের একটা বাড়িই তো ভাঙা হল। এই বিজেপির লোকেরা ভোটের জন্য আমাদের একজনের বিরুদ্ধে আরেকজনকে লড়িয়ে দিচ্ছে।"

নতুন লড়াইয়ের ময়দানেঃ ১৯৯৩ সালে ১৮ বছরের পালটে যাওয়া ভানোয়ার ভিলওয়ারার মাণিক্যলাল ভার্মা গভর্মেন্ট কলেজে বি.এ. ডিগ্রি ক্লাসে ভর্তি হল। সে বছরই আরেক বিদ্রোহী স্বয়ংসেবক এবং এবিভিপির প্রাক্তনী ব্রিজরাজ কৃষ্ণ উপাধ্যায়ের নেতৃত্বে সাম্প্রদায়িকতা-বর্ণবাদ বিরোধী ছাত্র-সংগঠন 'বিদ্যার্থী অধিকার রক্ষক সংঘ' গঠিত হল যার সাধারণ সম্পাদক হল ভানোয়ার মেঘওয়ানসি। তাদের কাজ হল সংঘের ছাত্র সংগঠন এবিভিপি-র কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে গুন্ডামির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এবং সংঘের যে সমস্ত কর্মকর্তা মঙ্গলগড় খনি এলাকায় অবৈধ বিস্ফোরক এবং বোতলজাত মদ তৈরির সাথে যুক্ত মানুষদের অর্থের বিনিময়ে সুরক্ষা দেয় (সংঘে থাকার সময় ভানোয়ার যা কল্পনা করতেই পারত না) তাদের স্বরূপ প্রকাশ করা। সংঘীরা যুক্তির থেকে লাঠির উপর বেশি বিশ্বাস করে। কাজেই তাদের উপর, বিশেষত ব্রিজরাজের উপর বারবার শারীরিক আক্রমণ হত। একবার তার মাথার খুলিতে স্ক্র-ড্রাইভার ঢুকিয়ে তাকে মৃত ভেবে ফেলে গিয়েছিল সংঘীরা; কিছু সহৃদয় পথচলতি মানুষ তাকে সঠিক সময়ে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ায় দীর্ঘ চিকিৎসায় সে বেঁচে গিয়েছিল।

এতদিন সংঘ অন্য বিশ্বাসের, অন্য ধর্মের যেসব মানুষদের বিপজ্জনক বলত তাদের সঙ্গে বিশেষত মুসলমানদের সঙ্গে মিশে, মসজিদে ঢুকে, মাদ্রাসায় বসে, তাদের রান্নাঘর-শোবার ঘর দেখে, তাদের সঙ্গে বসে এবং খেয়ে তার উপলব্ধি হল যে তাদের হাসি-কান্না-রাগ-দেশপ্রেম হিন্দুদেরই মতো; অধিকাংশ মুসলিমের অবস্থা দলিত-প্রান্তিক মানুষদের মতোই। তাদের শত্রুও এক। যে মনু তার 'মনুস্মৃতি'-তে বর্ণভেদের বিধান দিয়েছে, শাখাতে একসময় তিনি নিয়মিত গাইতেন "মনুষ্য তু বড়া মহান হ্যায়/ তু মনু কি সন্তান হ্যায়" ভেবে এখন আতঙ্কিত হলেন। মনুবাদী সংঘের পক্ষে বর্ণাশ্রম, অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে কথা বলা কখনও সম্ভব নয়। কবীর, পেরিয়ার, ফুলে, আম্বেদকরের লেখা পড়ে তিনি বুঝতে পারলেন, এতদিন সংঘ কত বিপজ্জনক তত্ত্ব, ভুল তথ্যে তাদের প্রশিক্ষিত করার নামে কু-শিক্ষিত করেছে। সংঘ শূদ্রদের এবং মেয়েদের সমানাধিকারকে স্বীকার করে না। তারা সেই সমস্ত কিংবদন্তী এবং লোকশ্রুতিকে গুরুত্ব দেয় যেখানে শূদ্ররা বর্ণপ্রথার প্রতি বিশ্বস্ত এবং নিবেদিত। যেমন অনুমিত দলিত বাল্মিকীর রামের মহিমা রচনা, অস্পৃশ্য নারী শবরীর দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর রামের দেখা পাওয়া এবং তারপর রামকে খেতে দিয়ে সেবায় তুষ্ট করে মুক্তি পাওয়া, তীরন্দাজ একলব্যের গুরুদক্ষিণা হিসেবে নিজের বুড়ো আঙুল গুরু দ্রোণকে দান করা ইত্যাদি।

তিনি প্রথমেই সংঘের দলিত-প্রান্তিক-আদিবাসী স্বয়ংসেবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেখলেন তাদের প্রত্যেকেরই অভিজ্ঞতা প্রায় একইরকম; কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার অধিকাংশই শান্ত চিত্তে এটা মেনে নিয়েই সংঘে আছে। সংঘের জন্মলগ্ন থেকেই নিয়ন্ত্রণ ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বানিয়াদের হাতে, দলিত-প্রান্তিক-আদিবাসী মানুষরা ব্যবহৃত হয়েছে মসজিদ ভাঙতে, মুসলিম, খ্রিস্টান, সংঘচ্যুত বিদ্রোহী, দলিত অধিকার-গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের আক্রমণ করতে। (পরবর্তী সময়ে গোধরাতে ট্রেনে আগুন লাগানোর যে নৃশংস ও নিন্দনীয় ঘটনা ঘটেছিল তাতে হত ষাট জন করসেবকদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল দলিত-প্রান্তিক-জনজাতির মানুষ। আবার এই ঘটনার বদলা হিসেবে গান্ধীর গুজরাটকে গডসের গুজরাটে পরিণত করে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির গুজরাট সরকারের প্রশাসনের মদতে তথাকথিত নৈতিক, শৃঙ্খলাবদ্ধ, জাতীয়তাবাদী আসলে গেরুয়া তালিবান রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের বিভিন্ন শাখা সংগঠনগুলি দ্বারা মুসলিমদের উপর যে বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড এবং প্রকাশ্য গণধর্ষণ সংঘটিত করা হয়েছিল সেখানেও ব্যবহার করা হয়েছিল দলিত-প্রান্তিক-পশ্চাদপদ জনজাতির মানুষদেরই। আবার পুলিশের গুলিতে এবং সহিংসতার বলিও হয়েছিল তারাই। সংঘের বা তার শাখা সংগঠনের উচ্চবর্ণের যে নেতারা এই হিংসার প্ররোচনা দিয়েছিল তাদের গায়ে আঁচড়ও লাগেনি।) সংঘের শিক্ষানুযায়ী যে মনুর বিধানে তারা শূদ্র তাকে তারা শ্রদ্ধা জানায়, অথচ যে বাবাসাহেব আম্বেদকরের নেতৃত্বে রচিত সংবিধান তাদের সমানাধিকার দিয়েছে তার সম্বন্ধে অজ্ঞ।

কলেজের শিক্ষা শেষ করে সরকারি প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন ভানোয়ার। কিন্তু সেইসময় রাজস্থানে হিন্দু প্রাথমিক শিক্ষকদের মধ্যে আরএসএস-এর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল। শিক্ষক হিসেবে একটি পশ্চাদপদ জাতির গ্রামের স্কুলে যোগদান করে দলিত বলে তাকে নানাভাবে হেনস্থা হতে হয়। প্রতিবাদ করে শিক্ষক সংগঠন, প্রশাসন কারও কাছে সহযোগিতা না পেয়ে চাকরি থেকে পদত্যাগ করে দলিত-বহুজন রাজনীতি, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী সামাজিক আন্দোলন, মজদুর কিষান শক্তি সংগঠনের কাজে নিজেকে সম্পূর্ণ নিয়োজিত করলেন। বেশ কিছু বন্ধু মিলে 'ডায়মন্ড ইন্ডিয়া' মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করলেন, যা ক্রমে রাজস্থানে আরএসএস-এর মুখপত্র 'পাঠে কান'-এর বিকল্প হিসেবে উঠে এল। 'ডায়মন্ড ইন্ডিয়া'-র অডিও বিভাগ থেকেও আরএসএস, অন্যান্য চরমপন্থী হিন্দু ও মুসলিম সংগঠনের বিরোধিতা করে, জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা করে, উমা ভারতী, স্বাধ্বী ঋতম্ভরার বিষাক্ত সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষপূর্ণ বক্তৃতার পালটা জবাব দিয়ে ক্যাসেট বার করা হতে লাগল যা মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হল। যদিও তাঁর কথায়, "আমার কোনো সংগঠিত ধর্মে উৎসাহ নেই, প্রয়োজনও নেই। এখন মন্দির, মসজিদ এবং গুরুদোয়ারা সবই আমার কাছে সমান" এবং "যজ্ঞে অংশগ্রহণ করলেই দলিতদের অবস্থা উন্নত হয়ে যাবে না"; তবু দলিতদের সাংবিধানিক সমানাধিকার আদায়ের প্রশ্নে যেখানে দলিতদের মন্দিরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি, যজ্ঞে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি, মুসলিমদের কোনো পরিত্যক্ত মসজিদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে, কোনো দলিতকে উচ্চবর্ণের ব্যবহৃত পুকুরে স্নান করার জন্য অর্থ জরিমানা করা হয়েছে তার বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়িয়েছেন, তার পত্রিকায় প্রতিবাদ করে লিখেছেন, এমনকি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছেন। গুজরাট গণহত্যার পরে যখন অশোক সিংঘল, প্রবীণ তোগাড়িয়া এবং হিন্দি ভাটের মতো বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতারা রাজস্থানকে দ্বিতীয় গুজরাট বানানো হবে বলে ভয় দেখিয়েছে তখন শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং দাঙ্গার বিরোধিতা করে রাজস্থানের একটা বড় অংশে পনেরো দিন ধরে সাইকেল যাত্রা করেছেন। আরএসএস রাজস্থানে ত্রিশূল দীক্ষার অনুষ্ঠান করেছে, তাঁদের মজদুর কিষান শক্তি সংগঠন আওয়াজ তুলেছে - "তরোয়াল নয়, ত্রিশূল নয়, আমরা চাই বাঁচার অধিকার, কাজের অধিকার"।

সংবিধান প্রদত্ত দলিত সমানাধিকার এবং গণতান্ত্রিক অধিকার আন্দোলনকে দমন করার উদ্দেশ্যে সংঘ ২০১২ সাল থেকে গভীরভাবে চিন্তা করে এবং পুরোনো কৌশলকে পর্যালোচনা করে নতুন রণনীতি পরিকল্পনা করে। প্রথমত, এই সমস্ত প্রশ্ন যে সংগঠন তুলবে বা আন্দোলন সংগঠিত করবে, তাদের প্রভাবশালী মুখদের বিধায়ক, সাংসদ বা মন্ত্রিত্বের লোভ দেখিয়ে আন্দোলনের ধার কমিয়ে দেওয়া। উদাহরণ হিসেবে রাম বিলাস পাশওয়ান, ডঃ উদিত রাজ, অটওয়ালের নাম করেছেন। দ্বিতীয়ত, সাহিত্য বা ইতিহাসকে বিকৃত করা বা নতুন করে লেখা। তৃতীয়ত, সংবিধান রচনার নেতৃত্বে থাকা আম্বেদকর যিনি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের সমতার কথা বলেছেন তাঁকে মিথ্যাচারে চিত্রিত করা। যেমন আম্বেদকর মুসলিম-বিদ্বেষী ছিলেন, হিন্দুরাষ্ট্রের সমর্থক ছিলেন, সংঘের সভায় গিয়েছিলেন, গৈরিক পতাকাকে জাতীয় পতাকা হিসেবে গ্রহণ করার পক্ষপাতী ছিলেন, তিনি কাশ্মীরে ৩৭০ ধারার বিরোধী ছিলেন ইত্যাদি ইত্যাদি যার সবগুলিই সম্পূর্ণ মিথ্যা। চতুর্থত, দলিত, আদিবাসীদের অধিকার এবং গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা করার আন্দোলন করছে যে প্রগতিশীল এবং বাম শক্তি তাদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহী, বিদেশী খ্রিস্টানদের সাহায্যপুষ্ট, দেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে চায় প্রভৃতি কুৎসা রটিয়ে বদনাম করা। মোদ্দা কথা হল মুসলিম, খ্রিস্টান, দলিত, আদিবাসী, ধর্মনিরপেক্ষ বাম এবং গণতান্ত্রিক শক্তি যাতে কখনও একতাবদ্ধ হতে না পারে তা নিশ্চিত করা।

সংঘের যন্ত্রণাময় অভিজ্ঞতা এবং দলিত-বহুজন-জনজাতি ও কিষান-মজদুরের অধিকার রক্ষার সামাজিক এবং রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতায় ভানওয়ার মেঘওয়ানশি আমাদের সতর্ক করেছেন এই বলে, "সময় নিষ্ঠুর। কিছু ঘটার জন্য শান্তভাবে অপেক্ষা করা, নিরপেক্ষ থেকে নিজের জীবন কাটিয়ে দেওয়া - এগুলো বিকল্প নয়। এখন এমন সময় যখন আমাদের বিশ্বাস এবং আচরণ গুরুতরভাবে পরীক্ষিত হচ্ছে এবং যদি আমরা সত্য এবং অবিচল থেকে সম্মুখীন না হই, ইতিহাস আমাদের কখনও ক্ষমা করবে না।" আশাবাদী ভানোয়ার মেঘওয়ানশি তার বই শেষ করেছেন, "ইনকিলাব জিন্দাবাদ - বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক" এই স্বপ্ন উচ্চারণে।

 


I could not be Hindu - The story of a dalit in the RSS
by Bhanwar Meghwanshi
Published by Nabayan