দশম বর্ষ ষষ্ঠ সংখ্যা ● ১৬-৩১ মার্চ, ২০২২ ● ১-১৫ চৈত্র, ১৪২৮

প্রবন্ধ

বাংলা ভাষায় অনুবাদ-চর্চা

নীলাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়


অনুবাদ-কাজ-এর সঙ্গে কিছুটা জড়িয়ে থাকার জন্য সাহস করে বাংলা ভাষায় অনুবাদ-চর্চা প্রসঙ্গে স্বল্প পরিসরে আলোচনার জন্য কলম ধরতেই মনে হল - কোত্থেকে শুরু করা যায়? প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে নজরে এল আমাদের অনুবাদ-সাহিত্য আহামরি কিছু সমৃদ্ধ নয়; আবার খুব একটা যে গরিব তাও নয়। মন্তব্য-টা প্যারাডক্স নয়। বরং বলা যায় পিয়াঁজের রূপক। খোসা ছাড়ানো শুরু হলেই কিছুটা বোধগম্য হতে পারে।

আমাদের ছেলেবেলায় (১৯৬৫-৬৬...) বিদেশি ক্লাসিক সমূহের সঙ্গে আমাদের প্রাথমিক-পরিচয় করানোর ব্যাপারে 'দেব সাহিত্য কুটীর'-এর ধারাবাহিক উদ্যোগের কথা এখনকার প্রজন্মকে জানানো উচিত। সুন্দর মলাটের, স্বল্পায়তন সেই বইগুলোকে ঠিক অনুবাদ হয়তো বলা সঙ্গত নয়। তবে 'বিদেশি ক্লাসিকের সার-সংক্ষিপ্ত আখ্যান' বলা যেতেই পারে। অধুনা-বিস্মৃত(?) নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় ও সুধীন্দ্রনাথ রাহা-র যাদু-কলমের কথা উল্লেখ করতেই হবে। নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ-র দুটি বই 'শেক্সপীয়ারের কমেডি' ও 'শেক্সপীয়ারের ট্র্যাজেডি'; প্রথম আমাদের সেই চিরকালীন কবি ও নাট্যকারের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছিল। প্রতি নাটকের মূল গল্পটি, তার যাবতীয় ঘাত-প্রতিঘাত সহ সহজ-সরল ভাষায় লিখেছিলেন কিশোর-কিশোরীদের জন্য। সেসব বই এখন আর পাওয়া যায়না। কেউ হয়তো তেমন খোঁজও করেন না। নৃপেন্দ্র ও সুধীন্দ্র-র দৌলতে বাঙালি ছেলে-মেয়েরা বিশ্ববিখ্যাত বইগুলোর সঙ্গে পরিচিত হতে পেরেছিল। কে কোন বইয়ের অনু-কথন করেছিলেন এখন আর মনে নেই। তবে কিছু ক্লাসিকের নাম তো করাই যায়। যেমন - ট্রেজার আইল্যান্ড, থ্রী মাশকেটিয়ার্স, বেন হুর, ক্যুয়ো ভাদিস্, দ্য লাস্ট ডেজ্ অফ পম্পেই, কিং সলোমন'স্ মাইন, অ্যাডভেঞ্চারস অফ টম সইয়ার, অ্যান ইম্প ইন দ্য বটল, ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট, ব্ল্যাক টিউলিপ, ব্ল্যাক অ্যারো, আইভান-হো, দ্য লাস্ট অফ দ্য মোহিকানস্, স্যামসন অ্যান্ড ডালাইলা, দ্য হানচ্ ব্যাক অফ নোতরদাম, অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট ইত্যাদি।


ননী ভৌমিক (১৯২১-১৯৯৬)

সম্ভবত বিশ শতকের ষাট-এর দশকে রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের এক দ্বিপাক্ষিক সাংস্কৃতিক চুক্তি অনুযায়ী বেশ কয়েকজন বাঙালি মৌলিক লেখককে মস্কোয় পাঠানো হয়, রাশিয়ান ক্লাসিক উপন্যাসের বাংলায় ভাষান্তরকরণের উদ্দেশে। সেই ভাষান্তরিক-দের দলে ছিলেন ননী ভৌমিক, সমর সেন প্রমুখ। অনুবাদের কাজের জন্যে মস্কোয় তাঁদের বেশ কয়েক বছর থাকতে হয়েছিল এবং দুনিয়ার অন্যতম কঠিন রুশ-ভাষা শিখতে হয়েছিল। অনুবাদের কাজ হয়েছিল, রুশ ভাষা থেকে বাংলা ভাষায়। দস্তয়েভস্কির অনেক উপন্যাস ননী ভৌমিক বাংলায় অনুবাদ করেছেন, উদাহরণ 'বঞ্চিত ও লাঞ্ছিত'। বস্তুত ননী ভৌমিক একজন প্রথিতযশা ঔপন্যাসিক ছিলেন। তাঁর 'ধুলোমাটি' উপন্যাস গত শতাব্দীর চল্লিশ দশকে পাঠকমহলে আলোড়ন তুলেছিল। পরবর্তীকালে তিনি মস্কোতে থেকে যান ও অনুবাদের কাজেই পুরোপুরি ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কবি সমর সেন সেই সময় মস্কোর অনুবাদ-কমিউনে থাকার সময়ে যে বইগুলো রুশ ভাষা থেকে বাংলায় তর্জমা করেন, তাদের কয়েকটির উল্লেখ করা যায়। যেমন - টলস্টয়ের 'ইভান ইলিচের মৃত্যু', 'ক্রেয়ুৎজার সোনাটা'। তবে ১৯৮০-র দশক জুড়ে গ্লাসনম্ত ও পেরেস্ত্রৈকার প্রভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাবার ফলে সরকারি মদতে সেই অনুবাদ কর্মশালা বন্ধ হয়ে যায়। তবে এখনও অনুবাদ-প্রতিভার বিরল-বিচ্ছুরণ ছড়িয়ে মূল রুশ ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদ করে চলেছেন অরুন সোম। টলস্টয়ের 'যুদ্ধ ও শান্তি' এবং দস্তয়েভস্কির 'অপরাধ ও শাস্তি' এবং 'ব্রাদারস্ কারামাজভ'-র মতো মহাকাব্যিক উপন্যাসগুলো অনুবাদ করে তিনি সুধীজনের অকুন্ঠ প্রশংসা পেয়েছেন। বিখ্যাত রুশ প্রকাশনা বহুদিন বন্ধ। কলেজ স্ট্রিটের 'মনীষা' পুস্তক বিপণীর অতীতের রমরমাও এখনকার প্রজন্ম-পড়ুয়ারা ঠিক কল্পনা করতে পারবেন না। তাই অরুণ সোম-এর অনবদ্য অনুবাদগুলোর প্রকাশ-ভার এখন 'সাহিত্য অকাদেমি'-র সৌজন্যে।

'সাহিত্য অকাদেমি'-র প্রসঙ্গ যখন উঠলই, তখন অনুবাদের ক্ষেত্রে এই সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠানের কথাও খানিক বলা উচিত। 'সাহিত্য অকাদেমি' সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠান। মুলত তাদের কাজ হল, নানা রাজ্য বা প্রদেশের সাহিত্যকে বাংলায় অনুবাদ করা। এই রাজ্যে অবস্থিত অকাদেমির প্রধান কাজ হল দেশের অন্যান্য ভাষা যেমন, তামিল, তেলেগু, কন্নড়, ওডিয়া, হিন্দি প্রভৃতি ভাষার কবিতা, গল্প, উপন্যাস বাংলাতে অনুবাদ। সাহিত্য অকাদেমির এই সর্বভারতীয় উদ্যোগের ফলেই আমরা মুন্সী প্রেমচাঁদ, ফনীশ্বরনাথ রেণু, কমলা দাস প্রমুখ নানা ক্লাসিক লেখকের রচনা এখন বাংলা ভাষায় পড়তে পারি। আবার অন্যান্য রাজ্যের আধুনিক প্রজন্মের সাহিত্যকেও তাঁরা ভাষান্তরিত করেন। আবার অন্য রাজ্যে কর্মরত সাহিত্য অকাদেমির কাজ হল, বাংলা সহ বিভিন্ন প্রদেশের সাহিত্যকে সেই রাজ্যের ভাষায় অনুবাদ করা। যেমন, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র প্রমুখ লেখকের সাহিত্য হিন্দি, কন্নড়, তামিল, তেলেগু ইত্যাদি প্রাদেশিক ভাষায় অনুবাদ করে ভিন্ন রাজ্যের পাঠককে সমৃদ্ধ করা হয়েছে। অতএব অনুবাদ সাহিত্যে 'সাহিত্য অকাদেমি'র অবদান অসীম।

কলকাতার 'প্যাপিরাস' প্রকাশনা ধারাবাহিকভাবে অনুবাদের প্রাঙ্গণে কাজ করে চলেছেন। তাঁদের গ্রন্থ-তালিকা অনুবাদ-সাহিত্যের স্বর্ণখনি। কিছু উদাহরণ - ভৈকর মুহম্মদ বশীরের শ্রেষ্ঠগল্প, সাদাত হাসান মান্টোর নির্বাচিত গল্প সংকলন, ইন্দিরা গোস্বামীর আধালেখা দস্তাবেজ, ওমপ্রকাশ বাল্মীকির উচ্ছিষ্ট, গিরিশ কারনাডের নাটক পরের পর অনুদিত হয়েছে। যেমন, তুঘলক, হয়বদন (অনুবাদঃ শঙ্খ ঘোষ), রক্তকল্যাণ, নাগমন্ডল, যামিনী, ভাঙা ভাঙা ছবি প্রভৃতি। অনুদিত হয়েছে বিজয় তেন্ডুলকরের 'কন্যাদান' নাটক। ঝঁ পল সার্ত্রের নাটক - মাছি, কপাট, ছায়াবিহীন অনুদিত হয়েছে বাংলায়। বের্টোল্ড ব্রেখট্-এর 'গ্যালিলেওর জীবন' অনুবাদ করেছিলেন মোহিত চট্টোপাধ্যায়, যা কলকাতার রঙ্গমঞ্চে দিনের পর দিন অভিনীত হয়েছে।

ফ্রানজ্ কাফকার মতো চিরকালীন লেখকের কিছুটা কঠিন, পরাবাস্তব উপন্যাস দুর্গ (The Castle) ও বিচার (The Trial) বাংলায় ভাষান্তরিত হয়েছে। যদিও ইউরোপীয়ান সাহিত্যের অধিকাংশটাই ভাষান্তরিত হয়েছে মূল ভাষা থেকে নয়; ইংরেজি অনুবাদ থেকে। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল, ফরাসী বা স্প্যানিশ ভাষার সাহিত্য এইসব ভাষা থেকে বাংলায় অনুদিত হয়েছে খুবই কম। কারণ ফরাসী বা স্প্যানিশ জানেন এমন অনুবাদকই বিরল। আমি যতদূর জানি, অরুণ মিত্র, লোকনাথ ভট্টাচার্য, পৃথ্বীন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় ও চিন্ময় গুহ ছাড়া ফরাসি-জানা অনুবাদক আপাতত নেই। আর্তুর রাঁবো-র কবিতার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়েছেন লোকনাথ ভট্টাচার্য। 'মাতাল তরণী' অনুবাদ-সাহিত্যে ক্লাসিক। অরুণ মিত্র অনেক কাজ করেছেন মূল ফরাসি থেকে। যেমন, ভলতেয়ারের-কাঁদিদ, সার্ত্র ও তার শেষ সংলাপ, আরাগঁ, পাঁচশো বছরের ফরাসি কবিতা ইত্যাদি। 'বোদলের এবং বোদলের-কাব্যের অনুবাদ' প্রবন্ধে কবি অরুণ মিত্র অনুবাদের সমস্যা নিয়ে নানান প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন। বুদ্ধদেব বসু-র শার্ল বোদলেয়ার (বোদলের নয়, যা সঠিক উচ্চারণ)-এর কবিতা গত শতাব্দীর সত্তর-দশকে কাব্যমোদীদের খুবই উপকৃত করেছিল। পঞ্চাশ বছর পরে আজও এই অমূল্য বইটির খোঁজ পড়ে, কারণ বোদলের-এর প্রায় সব কবিতাই বুদ্ধদেব নিষ্ঠা সহকারে অনুবাদ করেছেন। কিন্তু মুশকিল হল, বুদ্ধদেব ফরাসী জানতেন না। অনুবাদের ক্ষেত্রে তাঁকে ইংরেজি অনুবাদের সাহায্যই নিতে হয়েছে। ফলে, তাঁর অনুবাদ ত্রুটিপূর্ণ। অরুণ মিত্র-র প্রবন্ধ থেকে বেশ কিছুটা উদ্ধৃতি করা হল - "...ভাষান্তরে অনেক সময়ই কবিতা আর কবিতা থাকেনা, কতকগুলো শব্দের সমষ্টিতে দাঁড়ায়। বোঝা যায়, তা নেহাত অনুবাদ। বোদলের-অনুবাদে বুদ্ধদেব বসুর কৃতিত্ব এই যে, এতগুলো কবিতার তিনি পাঠযোগ্য রূপান্তর ঘটিয়েছেন। অনেক অনুবাদই কবিতার স্বাচ্ছন্দ্য পেয়েছে। কিন্তু সেটাই সব নয়, এমনকী আসলও নয়। মূলের বৈশিষ্ট্য কতখানি থাকল, সে প্রশ্ন একান্তভাবে বিবেচ্য। কিছু অনুবাদ বাস্তবিকই ভালো। সেগুলোতে যেন মূল কবিতার স্পর্শ পাওয়া যায়, ধ্বনিতে এবং ভাবে। যেমন, 'পণ্য কবিতা', 'শত্রু', 'সৌন্দর্য', 'সপ্রাণ মশাল', 'আধ্যাত্মিক ঊষা', 'বিতৃষ্ণা', 'আবেগ', 'এখনো ভুলিনি তাকে', 'মহাপ্রাণ সেই দামী', 'পাতকিনী', 'সিথেরায় যাত্রা', 'শিল্পীদের মৃত্যু', 'গহ্বর' প্রভৃতি কবিতা। ...কিন্তু ব্যর্থ অনুবাদও যথেষ্ট। বোদলের-এর অনুবাদ সম্পর্কে কতকগুলো বিষয় মনে রাখতে আমরা বাধ্য। যথা, বোদলের শব্দের যাথার্থ্যকে অসাধারণ মুল্য দিতেন, ছন্দ ও মিলের গুরুত্বও তাঁর কাছে অসামান্য; তাঁর রচনা পরিষ্কার, বাক্যের গঠনে তাঁর বিন্দুমাত্র শিথিলতা নেই এবং প্রায়ই তা গদ্যসুলভ, তাঁর প্রকাশভঙ্গিতে 'কাব্যিকতা' নেই; পাঠকের অনুভূতির কাছে তাঁর কবিতার যে - আবেদন তার অন্যতম নির্ভর বিশিষ্ট চিত্রকল্পে, এবং এ সবকে অবলম্বন করে তাঁর নিরুচ্ছাস আবেগ তাঁর কবিতায় এক অদ্ভুত তীব্রতা সঞ্চার করে। দুঃখের বিষয়, বর্তমান অনুবাদে অনেক ক্ষেত্রেই এসব বিষয় বিবেচনা করা হয়নি।

"যেমন ধরা যাক, 'পাঠকের প্রতি'। মূল কবিতা সনাতন ফরাসী ছন্দ 'আলেকসাঁন্দ্রাঁ'-কে, অর্থাৎ মোট বারোটি স্বরধ্বনির এক একটি ছত্র। এই সনাতন ছন্দ বোদলের-এর অতি প্রিয়। এ ছন্দকে বাংলায় অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ ছত্রের অক্ষরবৃত্তে রূপান্তরিত করাই বাঞ্ছনীয়। এবং বুদ্ধদেব বসু বহু কবিতায় তাই-ই করেছেন। কিন্তু এ কবিতায় করেননি। হ্রস্ব ছন্দের মাত্রাবৃত্তে মূলের চলনই নেই এবং শব্দের কায়দায় এ কবিতা প্রায় মৌলিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। 'জঘন্য সব বস্তু আমাদের কাছে আকর্ষণীয়' - এই সরল বাক্যকে যদি করা হয় 'বীভৎসে বাঁধি রমনীয় নির্বন্ধে', তাহলে কাব্যিক হয় বটে, কিন্তু বোদলেরকে পাওয়া যায়না। প্রকৃতপক্ষে, এ কবিতাটি পড়লে মনে হয় যেন সুধীন্দ্রনাথ দত্তীয় কোনো আধুনিক বাংলা কবিতা পড়ছি। ছন্দ বহু কবিতায় এইরকম পাল্টানো হয়েছে।

"...কেনই বা চিত্রকল্প পাল্টে দেওয়া হবে অথবা ঋজু উক্তিকে ভাষার কৃত্তিমতায় দুর্বোধ্য করে তোলা হবে? এসবের ফলে অনেক কবিতা বোদলেরীয় চারিত্র্য পায়নি। যেমন, Léthé-র রূপান্তর কি মূলের তীব্রতাকে একটুও আভাসিত করে? 'শুধু তোর শয়ন-পরে আমার এ-কান্না ঘুমোয়/ খোলা ঐ খন্দে ডুবে কিছু বা শান্তি লোটে'; কিংবা 'নিয়তির চাকায় বাঁধা নিরুপায় বাধ্য আমি,/ নিয়তির শাপেই গাঁথি ইদানিং ফুলমালা,' (লিখি) - এরকম প্রকাশভঙ্গি বোদলের থেকে সুদূর এবং কথাগুলো মূলের বক্তব্যও যথাযথ বহন করেনি।

"ফরাসীতে 'n’importe où' মানে - যে কোনোখানে। সুতরাং 'Voyage' কবিতায় 'nétant mile part, peut etre n’importe on'-এর অর্থ 'কোথাও নেই বলে, যে কোনোখানেই থাকতে পারে।' কিন্তু অনুবাদে পাইঃ 'কোথাও তা নেই তাই মনে হয় নেই কোনোখানে।' ...ফরাসীতে 'lubricité'-এর অর্থ কামুকতা। তাকে করা হয়েছেঃ পিচ্ছিলতা। ফলে, যে-বাক্যাংশের অর্থ 'কামুকতার সঙ্গে সরলতা যুক্ত হয়ে' তা অনুবাদে দাঁড়িয়েছেঃ 'সরলে পিচ্ছিলে মেশা'। (অলংকার, চতুর্থ স্তবক)। এই কবিতারই ষষ্ঠ স্তবকের la এবং elle শব্দদুটিকে প্রেয়সীর সঙ্গে সম্পর্কিত করা হয়েছে বলে মনে হয়। কিন্তু ও দুটি শব্দ 'আমার আত্মার' সর্বনাম। ফরাসীতে 'ame' স্ত্রীলিঙ্গ শব্দ। স্বভাবতই স্তবকটি অনুবাদে অর্থহীন হয়ে পড়েছে। 'Lubrique' মানে কামুক। 'এক শব' কবিতায় 'femme lubrique'-এর অনুবাদ পড়ি 'আর্দ্র নারী'।"

বঙ্গাব্দ মাঘ ১৩৭৩-এ প্রকাশিত হয় 'অন্য দেশের কবিতা' - অনুবাদক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। ফরাসী, ইতালি, জার্মান, স্প্যানীশ ও রুশ - এই পাঁচটি ভাষার কবিতার বাংলা-অনুবাদ করেছেন সুনীল। ভূমিকায় বলেছেন, 'অনুবাদ-কবিতা সম্পর্কে নানা ব্যক্তির নানা মত আছে, আমি এতগুলি কবিতার অনুবাদক, তবু আমার ব্যক্তিগত দৃঢ় বিশ্বাস, অনুবাদ-কবিতার পক্ষে কিছুতেই বিশুদ্ধ কবিতা হওয়া সম্ভব নয়, কখনো হয়নি। কোলরিজ বলেছিলেন, 'একটি কবিতার সেইটুকুই বিশুদ্ধ কবিতা, যার অনুবাদ সম্ভব নয়।' এই অনুবাদকের করা, ইতালির কবি জুমেপ্পে উনগারেওি-র 'একটি গ্রামের ভগ্নস্তূপ' - কবিতাটি উদ্ধৃত করছিঃ 'এই গৃহগুলির/ কিছুই অবশিষ্ট থাকে না/ শুধু কয়েকটি/ দেয়ালের ভগ্নাংশ/ কত মানুষ/ যারা ছিল আমার আপন/ কেউ নেই/ এমনকি দেয়ালও না/ কিন্তু আমার হৃদয়ে/ একটি ক্রুশচিহ্নও হারায়নি/ আমার হৃদয়/ একরকম অত্যাচারিত গ্রাম...' ফেদরিকো গার্সিয়া লোরকা-র একটি কবিতার অপূর্ব অনুবাদঃ 'যদি মরে যাই/ জানলা খুলে রেখো/ শিশুটির মুখে কমলালেবু/ (জানলা থেকে আমি দেখতে পাই)/ গম পেষাই করছে এক চাষা/ (জানলা থেকে শব্দ শুনতে পাই)/ যদি মরে যাই/ জানলা খুলে রেখো।'

'অন্য দেশের কবিতা'র অনুবাদে, অনুবাদক কতটা স্বাধীনতা নিতে পারেন? এ ব্যাপারে কোথাও কোনও নির্দেশাবলী নেই। তবে অনুবাদকের বিচার-বুদ্ধির ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করে। অবশ্য বেশি স্বাধীনতা নিলে মূল কবিতার প্রতিই অবিচার করা হয়।

বঙ্গাব্দ ১৩৬৯-এ শঙ্খ ঘোষ ও অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত-র সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়, 'সপ্তসিন্ধু দশ দিগন্ত'। বাংলা ভাষায় এই প্রথম, 'বিশ্ব কবিতার সংগ্রহ'। সমগ্র বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কবিদের শ্রেষ্ঠ রচনার মহানির্বান সংগ্রহ। এই মহাগ্রন্থটি উৎসর্গীকৃত সুধীন্দ্রনাথ দত্ত-কে। গ্রন্থের শুরুতেই অষ্টাদশ শতাব্দির ফরাসী কবি জাঁ পীয়ের ফ্লোরয়াঁ-র একটি হাইকুর রবীন্দ্রনাথ-কৃত অনুবাদঃ "প্রেমের আনন্দ থাকে/ শুধু স্বল্পক্ষণ,/ প্রেমের বেদনা থাকে/ সমস্ত জীবন।" টি. এস. এলিয়ট-এর 'দ্য জার্নি অব দ্য মেজাই'-এর অনুবাদ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। অনুবাদের নামকরণঃ 'তীর্থযানী' - কেন তা হবে? এত রূপকের আশ্রয় এলিয়ট তাঁর কবিতায় নেননি। সহজ ভাষায় 'ঋষিদের যাত্রা' নামকরণ করলে কোনো অসুবিধা ছিল না। যীশুর জন্মের পর ঋষিরা যে তীর্থযাত্রায় বেরিয়েছেন; তা মূল কবিতায় কোথাও এলিয়ট স্পষ্ট করেননি রবীন্দ্রনাথের অনুবাদেও তা এরকমঃ "জন্ম একটা হয়েছিল বটে,/ প্রমাণ পেয়েছি, সন্দেহ নেই।" কিন্তু তীর্থ-র অনুষঙ্গ কবিতার কোথাও নেই। এলিয়ট ইঙ্গিতে বোঝাতে চেয়েছেন, যাত্রা বা ভ্রমণের উপলক্ষ ছিল সেই 'মহাজন্ম'; যা খ্রীষ্টানদের কাছে প্রভু যীশুরই জন্ম। কিন্তু ঋষিরা যে 'তীর্থ' যাত্রায় বেরিয়েছেন অতো প্রত্যক্ষ স্পষ্টতা মূল কবিতায় নেই। বিষ্ণু দে-র কাছে এলিয়ট ছিলেন অন্যতম প্রিয় কবি। তিনি তাঁর প্রায় সব প্রধান কবিতাই অনুবাদ করেছেন। কিন্তু বিষ্ণু দে প্রচুর স্বাধীনতা নিয়েছেন, যা ঠিক মূলানুগ নয়। 'Thine is the kingdom' লাইনটি আছে 'দ্য হলো মেন' কবিতায়। এই লাইনটির আলাদা অনুষঙ্গ আছে ক্রিশ্চিয়ান ধর্মে। কিন্তু বিষ্ণু দে-র অনুবাদে যখন তা শুধুই হয় - 'প্রভু তোমারই তো সব মায়া'; তাতে কাব্যের উৎকর্ষ হয়তো বাড়ে; কিন্তু ক্রিশ্চিয়ান ধর্মের নিহিত অনুষঙ্গ স্পষ্ট হয় না।

'অন্য জলবাতাস অন্য ঢেউ', চিন্ময় গুহ-র অনুবাদে 'একশ বছরের শ্রেষ্ঠ ফরাসি কবিতা'। এই অনুবাদক ফরাসী জানেন। সুতরাং তাঁর অনুবাদ-এর সদর্থক গ্রহণযোগ্যতা আছে। খুব কম কথার কবি 'য়াজেন গিমভিক'-এর সংক্ষিপ্ততম কবিতার অনুবাদঃ 'দিগন্ত/ গাছগুলিকে লক্ষ করছে।' কিংবা, 'গোলাপ/ যা জানে না/ গোলাপ হতে।'

অনুবাদক হিসেবে তরুণ ঘটক-এর নামোল্লেখ করতেই হবে; কারণ তিনি মূল স্প্যানিশ থেকে অনুবাদ করেন। তাঁর 'ডন কিহোতে' অনুবাদ-সাহিত্যে এক অনন্যোপায় ক্লাসিক।

মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় সমস্ত জীবন শুধু অনুবাদই করে গেছেন। শঙ্খ ঘোষ যাঁর সম্বন্ধে বলেছিলেন, "আমাদের মধ্যে সবথেকে বেশি বিদেশি বইয়ের পাঠক।" মানবেন্দ্র স্প্যানিশ ভাষা যত্ন নিয়ে শিখেছেন ও অসংখ্য অনুবাদ করেছেন। বিশ্বলেখক গার্সিয়া মার্কেসের বিশিষ্ট উপন্যাসগুলির অনুবাদ করে মানবেন্দ্র বাঙালি পাঠকদের কাছে চিরকালই অমর হয়ে থাকবেন। নোবেল-জয়ী চেসোয়াভ মিউশ (পোল্যান্ড)-এর একটি কবিতার অনুবাদিত অংশ - 'মেয়েটি আর আমার মাঝখানে ছিলো এক টেবিল,/ আর টেবিলের ওপর একটা গেলাস/ তার কনুইয়ের খরখরে চামড়া ছুঁয়েছিলো ঝকমকে উপরিতল/ যেখানে তার বগলের ছায়ার রেখা প্রতিফলিত হচ্ছিলো।'

'বহুল দেবতার বহুস্বর' - শঙ্খ ঘোষ-এর অনুবাদ কবিতার এক দুর্লভ সংগ্রহ। কবি ও অনুবাদক বলেছেনঃ "এদেশ-ওদেশের কবিতা থেকে অনুবাদ করেছি নানা সময়ে নানা রকমের প্রবর্তনায়, অনেকেই যেমন করেন। অনেকের মতো আমিও একথা জানি যে কবিতার ঠিক-ঠিক অনুবাদ হয় না কিছুতেই, তবু করতেই চাই অনুবাদ, ভালোলাগার টানে। এসব লেখাকে অনুবাদ না বলে 'অনুসর্জন' বলাই কি তাই সংগত?" এই গ্রন্থের অন্তর্ভুক্তির বৈশিষ্ট্য উল্লেখযোগ্য। অনুবাদিত হয়েছে সাঁওতালি গান, ভিয়েতনামী লোকসংগীত, হো চি মিন-এর কবিতা, ভারতীয় কবি চেরাবান্তা রাজু, পল রোবসন, হুয়ান রামোন হিমেনেথ ও অন্যান্য আরও মহাকবিরা। চেরাবাল্ডা রাজু-র 'কী আমাদের জাত' কবিতার অনুবাদ - 'কী আমাদের জাত, আর ধর্মই বা কী/ মাটি ছেনে যখন ইটের পাঁজা বানাচ্ছি/ যে-ইট দিয়ে তৈরি হবে তোমাদেরই ঘর/ খিদেয় ঝুঁকে বইছি যখন শস্য এ বুকভর!'

কবিতাকে তিনি বলতেন 'পদ্য'। আর এই পদ্য রচনায় শক্তি চট্টোপাধ্যায় ছিলেন কিংবদন্তীপ্রতিম। শক্তি বিভিন্ন সময়ে অনুবাদ করেছেন অসংখ্য কবিতা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যের ছাত্র থাকাকালীন বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখের সান্নিধ্য তাঁকে বিদেশি কবিদের কবিতা অনুবাদে উদ্বুদ্ধ করে। বিভিন্ন সময়ে তিনি অনুবাদ করেন ওমর খৈয়াম, গালিব, কালিদাস, হাইনে, লোরকা, মায়াকভস্কি, রিলকে, পাবলো নেরুদা, প্রীতিশ নন্দীর কবিতা। 'গীতা' অনুবাদেও তাঁর উৎসাহ ছিল ববাবর। ভারতীয় ভিন্নভাষী কবিদের কবিতা বাংলা ভাষায় অনুবাদ করার প্রয়োজনীতাও অনুভব করেছিলেন তিনি। কিন্তু শক্তির অনুবাদ অনেক বেশি স্বাধীনতাপ্রিয়। যেমন নেরুদা লিখেছেন - "Body of a woman, white hills, white thigs, you look like a world, lying in surrender"। শক্তির অনুবাদে লাইনগুলো এরকমঃ 'রমনীর রম্যদেহ, ধবল পাহাড় শুভ্র উরু -/ মৃন্ময়ী, তোমার দৃশ্য আত্মসমর্পণে শুয়ে-থাকা..."। বলাই বাহুল্য, এখানে 'রম্য' শব্দটি শক্তির নিজস্ব, রমনীর অনুপ্রাসে বসিয়েছেন। আর 'মৃন্ময়ী' শব্দটি শক্তির খুব প্রিয় বটে; কিন্তু এখানে অপ্রয়োজনীয়।" ...you look like a world, lying in surrender"-এই লাইটি অনুবাদে - 'ধরনীর মতো তুমি দৃশ্যমান, শুয়ে আছো আত্মসমর্পণে' - এরকমও হতে পারত।

টি. এস. এলিয়ট-এর 'দ্য ওয়েষ্টল্যান্ড' চিরকালের আধুনিক মহাকাব্য। বিষ্ণু দে এলিয়টের অনেক কবিতাই অনুবাদ করেছেন। কিন্তু এই অপূর্ব মহাকাব্যটিকে কেন অনুবাদ করেননি জানা নেই। ২০১৮ সালে এই কাব্যটি অনুবাদ করেছেন মঞ্জুভাষ মিত্র। নামকরণ 'পোড়ো জমি'। বেশ সাবলীল ও স্বচ্ছন্দ অনুবাদ। এলিয়ট-এর এই কবিতা বেশ কঠিন ও নানারকম রেফারেন্সে অলঙ্কৃত। মঞ্জুভাষ-এর অনুবাদ পাঠককে সমৃদ্ধ করবে। একটু উদ্ধৃত করছিঃ 'অবাস্তব শহর,/ শীত-সকালের বাদামী রঙের কুয়াশার নীচে, / লন্ডন ব্রীজের ওপর দিয়ে বহমান জনস্রোত, এতজন,/ আমি ভাবিনি মৃত্যু এতজনকে মেরেছে।/ দীর্ঘশ্বাসেরা পড়ছে, হ্রস্ব এবং অনিয়মিত/ আর প্রতিটি মানুষ তার পায়ের সামনে দৃষ্টিকে রেখেছে নিবদ্ধ।"

উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, কলকাতা থেকে বাংলা ভাষায় 'অনুবাদ' পত্রিকা গত ৭৫ বছর ধরে প্রতি মাসে নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে চলেছে। পত্রিকা শুরু করেছিলেন, বৈশম্পায়ন ঘোষাল। এখন তাঁর মেয়ে বিতস্তা ঘোষাল, যিনি নিজে একজন কবি, কথা-সাহিত্যিক ও অনুবাদক, এই পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশ করে চলেছেন। এছাড়া 'ভাষা-সংসদ' নামে এক প্রকাশনারও দায়িত্ব নিয়েছেন বিতস্তা। এই প্রকাশনীটি মূলত অনুবাদিত উপন্যাস, কবিতা ও গল্পের।

আমার জানা নেই, ভারতের অন্য কোনো প্রদেশ থেকে শুধুমাত্র অনুবাদ-নির্ভর মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয় কী না।