দশম বর্ষ ষষ্ঠ সংখ্যা ● ১৬-৩১ মার্চ, ২০২২ ● ১-১৫ চৈত্র, ১৪২৮

প্রবন্ধ

বিসমিল্লাহর নশ্বর বাড়ি ও অমর সানাই

গৌতম হোড়


হাড়াহা সরাইয়ের একটা ঘিঞ্জি ও ব্যস্ত পাইকারি বাজার পেরিয়ে গলিতে পৌঁছানো গেল। সেই বাজারে মেয়েদের চুড়ি এবং অন্য প্রসাধনী জিনিসের দোকান প্রচুর। বাজারের খুবই সরু গলির থেকে বেরিয়ে যে রাস্তায় পৌঁছনো গেল, তার অবস্থাও তথৈবচ। একটা মোটরসাইকেল গেলে মানুষকে এককোণে সরে দাঁড়াতে হয়। আর বারাণসীর এই গলিগুলি দিয়ে সমানে তীব্র হর্ন বাজিয়ে মোটরসাইকেল, স্কুটার, স্কুটি যতটা সম্ভব দ্রুতগতিতে চলে। বাড়িগুলি সব গায়ে গায়ে লাগানো। সেই হর্ন ও দ্বিচক্রযান যাওয়ার শব্দ গলিতে সারাক্ষণ অনুরণিত হতে থাকে। সেখানে আর সানাইয়ের সুর শোনা যায় না। ২০০৬ সালের ২১ অগাস্ট এখান থেকে সুরলোকে চলে গিয়েছেন ওস্তাদ বিসমিল্লাহ্ খান। এবার চলে যাচ্ছে তাঁর স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি।

বারাণসীর যে বাড়ি ছেড়ে, তাঁর ছোট ঘর ছেড়ে তিনি বিশ্বের কোথাও গিয়ে স্থায়ীভাবে থাকেননি। অনেক দেশ থেকে আমন্ত্রণ ছিল। অনেক শহরের হাতছানি ছিল। কিন্তু গঙ্গা, বারাণসী, তার ওই একান্ত আপন বাড়ির আকর্ষণ ছেড়ে তিনি কোথাও যাননি। বরং যাঁরা বিদেশে তাঁকে থেকে যেতে অনুরোধ করেছেন, তাদের তিনি বলেছেন, ‘‘ওখানে কি গঙ্গা আছে, বারাণসী আছে? তাহলে থাকব কি করে?‘‘

সেই বাড়ি এবার ভাঙা হচ্ছে। তাঁর পুতিরা জানিয়েছেন, আর হয়ত ১৫ দিন বা এক-দুই মাসের মধ্যেই বাড়ি ভাঙার কাজ শুরু হয়ে যাবে। কারণ, বাড়ির জরাজীর্ণ অবস্থা।

যে ঘর ছিল তাঁর যোগাযোগের মঞ্চ

যে ঘরে বিসমিল্লাহ্ বাইরের মানুষের সঙ্গে কথা বলতেন, দেখা করতেন তাঁর ভক্তদের সঙ্গে, সাক্ষাৎকার দিতেন, একতলার সেই ঘরের ছাদ ভেঙে পড়ার মুখে। কয়েকটি বাঁশ দিয়ে তা আটকে রাখা হয়েছে। উপরের সিলিং থেকে চাঙড় ফেটে গেছে। যে কোনোদিন সিলিং পড়ে যেতে পারে।

ওই ঘরে ওস্তাদজির অনেক ছবি ছিল, অনেক মানপত্র, অনেক শ্রদ্ধার্ঘ রাখা ছিল। এখন নেই। সব সরিয়ে রাখা হয়েছে। তুলে রাখা হয়েছে ট্রাঙ্কে।

একটা পনেরো ফুট লম্বা ও আট ফুট চওড়া ঘর। ঘরের সবুজ রঙ অনেক জায়গায় চটে গেছে। আমরা যখন সেই ঘরে ঢুকি তখন লোডশেডিং চলছে। খোলা জানালা দিয়ে আলো এসে ওস্তাদজির চৌকিতে পড়ছে। সিলিংয়ের দিকে তাকাতেই চক্ষু চড়কগাছ। ফেটে ভেঙে পড়ার উপক্রম। কয়েকটা বাঁশ দিয়ে ঠেকানো হয়েছে সেই পতন। তার নীচে বহু পুরনো লম্বা সোফায় বসতে বলেছিলেন তাঁর নাতি-পুতিরা। কিন্তু সত্যি বলতে কী, বসার সাহস পাইনি। অবস্থাটা এমনই।

মনে পড়ে গেল, ২০০১ সালে দেশের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান 'ভারতরত্ন' পেয়েছিলেন তিনি। তার পাঁচ বছর পর তিনি চলে গেছেন। তারপর সরকার থেকেই বলা হয়েছিল, তাঁর বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে। ওখানে তাঁর স্মৃতিবিজড়িত সংগ্রহশালা হবে। ২০০৬ সালে তিনি যখন চলে যান, তখন তো কেন্দ্রে ইউপিএ সরকার। আরো আট বছর দিল্লির রাইসিনা হিলসের উপর সাউথ ব্লকের অফিসে প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে ছিলেন মনমোহন সিং। তারপর গত প্রায় আট বছর ধরে সেখানে আছেন নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী। তিনি আবার বারাণসীরই সাংসদ। উত্তরপ্রদেশেও তারপর থেকে মুলায়ম সিং যাদব, মায়াবতী, অখিলেশ যাদব, যোগী আদিত্যনাথ শাসন করেছেন। তাদের কেউ বারাণসীর সঙ্গে, ভারতীয় সঙ্গীত জগতের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এই মহান মানুষটির স্মৃতি ধরে রাখার, তাঁর বাড়িটি অবিকৃত রেখে একটা সংগ্রহশালা তৈরি করার জন্য বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখালেন না।

একটু আগেই দেখে এসেছি, বাবা বিশ্বনাথের মন্দিরের করিডোর। গঙ্গা থেকে শুরু করে দীর্ঘ করিডোরের কর্মযজ্ঞ এখনো চলছে। হেরিটেজের তোয়াক্কা না করে অসংখ্য প্রাচীন বাড়ি, গলি সব ভেঙে দিয়ে তৈরি হয়েছে ঝাঁ চকচকে বিশাল, সম্ভ্রম আদায়কারী করিডোর। অযোধ্যায় দেখেছি, নির্মীয়মান রামমন্দিরের পাশে তৈরি হচ্ছে ৯০ ফুট চওড়া রাস্তা। তার আশপাশের সব কিছু ভেঙে দিয়ে। রামমন্দিরের আশপাশের দোকানঘর, বাড়ি সব ভাঙা পড়েছে বা পড়বে।

সেই তুলনায় সব জটিলতা কাটিয়ে একটা ছোট বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ করা তো সরকারের কাছে খুবই সামান্য কাজ। কংগ্রেস, বিজেপি, সমাজবাদী পার্টি, বহুজন সমাজ পার্টি কেউই এই কাজটা করে উঠতে পারল না? নাকি বিসমিল্লাহ্কে দেখিয়ে ভোট পাওয়া যাবে না বলে এই অনীহা? অথবা 'ভারতরত্ন' দেওয়ার পর সরকারের আর কোনো কিছু করার থাকে না? যে বিসমিল্লাহ্ গঙ্গার তীরে বালাজি মন্দিরে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রেওয়াজ করতেন, যে বিসমিল্লাহ্ সুরের মূর্ছনায় বিশ্বের মানুষকে মুগ্ধ করে রাখতেন, যে বিসমিল্লাহ্ ছিলেন বিদেশে ভারতীয় যন্ত্রসঙ্গীতের অন্যতম দূত, যে বিসমিল্লাহ্ ছিলেন হিন্দু-মুসলিম সৌভ্রাতৃত্বের অন্যতম সেরা প্রতীক, যিনি গঙ্গাকে ছেড়ে, বারাণসীকে ছেড়ে থাকবেন না বলে, উন্নত দুনিয়ার স্বাচ্ছন্দ্য হেলায় ফিরিয়ে দিয়েছেন, তাঁকে সামনে রেখে যে আশি-বিশের কাহিনি বলা যায় না, মেরুকরণ করা যায় না, তাই তাঁর বাড়ি থাকল না গেল, তাতে কার কী এসে যায়? সরকারের তো নয়ই, রাজনৈতিক দলেরও নয়, সম্ভবত বারাণসীর মানুষেরও নয়, তাঁরাও তো নীরব। কোনও প্রবল দাবিও উঠলো না। সর্বদা ব্রেকিং নিউজের খোঁজে থাকা সংবাদমাধ্যমেরও কিছু যায় আসে না। বিসমিল্লাহর বাড়ি দেখিয়ে টিআরপি বাড়ানো যাবে না যে! তার থেকে রাজনীতিক ও তাদের সমর্থকদের কুৎসিত ঝগড়া দেখানোই ভালো। যতদিন দর্শকরা এই যুক্তিহীন শো পছন্দ করবেন, ততদিন এইসবই চলবে, বিসমিল্লাহ্রা ব্রাত্য হয়ে থেকে যাবেন আড়ালে।

যে ঘরে তিনি থাকতেন

বাড়ির তিনতলায় ছাদের পাশে একটা দশ ফুট বাই দশ ফুটের ঘর। তাতে একটা দড়ির খাটিয়া। একপাশে কাঠের চেয়ার। দেওয়ালময় তাঁর ছবি বা মানপত্র রাখা। মেঝেতে পাতা দড়ির কার্পেট। সঙ্গীত সাধকের উপযুক্ত ঘর। এক সরল, সাধারণ জীবনযাত্রায় বিশ্বাসী শুধু সুরের সাধনা করা মানুষের উপযুক্ত আবাস।

ছাদের এক কোণে পাতা কাঠের চৌকি। তাতে বসে খোলা আকাশের নীচে তিনি রেওয়াজ করতেন প্রতিদিন। সেই সুর ছড়িয়ে যেত চারপাশে।

এই ঘর সমেত পুরো বাড়ি এবার ভাঙা হবে। ভাঙবেন তাঁর উত্তরপুরুষরাই। তাঁর অন্তত পাঁচ জন পুতির সঙ্গে কথা হয়েছে। তাঁদের সকলের বক্তব্য হলো, সরকারের দিকে তাকিয়ে অনেকগুলো বছর চলে গেছে। শুধুই আলোচনা হয়। সেই আলোচনায় সবসময় সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছে। তারপর আর কাজ এগোয় না। তাই বীতশ্রদ্ধ হয়ে তারা ঠিক করেছেন, তাঁরা নিজেরাই বাড়ি ভেঙে নতুন করে তুলবেন। বাণিজ্যিক এলাকা বলে নীচের তলাটা বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করা হবে। দোতলায় থাকবে বিসমিল্লাহ্ খান সংগ্রহশালা। সেখানে তাঁর ব্যবহৃত জিনিস, পুরস্কার, শ্রদ্ধার্ঘ, সানাই সব রাখা থাকবে।

তিনতলায় থাকবেন বিসমিল্লাহের উত্তরসূরিরা। তাদের সংখ্যাও কম নয়। এখন বাড়িতে ৩২ জন থাকেন। তিনতলাটা তাদের জন্য থাকবে। কীভাবে বাড়ি হবে, কী করে অর্থের জোগাড় হবে, তা নিয়ে পরিবার অনেকবার আলোচনায় বসেছে। স্বাভাবিকভাবে পারিবারিক একটা মতৈক্য না থাকলে এই কাজটা করা সম্ভব নয়। এখন সকলেই বুঝতে পেরেছেন, বাড়ির যা অবস্থা, তাতে তাদের একটা ব্যবস্থা নিতেই হবে। তাই মোটামুটি মতৈক্য হয়েছে বলে তাঁর পুতিদের দাবি।

বালাজি মন্দিরে

বিসমিল্লাহর বাড়ি থেকে অলিগলি হয়ে প্রায় মিনিট পঁচিশেকের হাঁটাপথে গিয়ে পৌঁছনো যায় বালাজি মন্দিরে। তার জন্য অসংখ্যবার মানুষকে জিজ্ঞাসা করতে হলো, শেষপর্যন্ত পৌঁছনো গেল সেখানে। গঙ্গার প্রায় উপরেই মন্দির। সেখানেই মন্দিরের সামনের একটি চাতালে বিসমিল্লাহ্ রেওয়াজ করতেন। সেই চাতালও ভেঙে পড়েছে। মন্দিরের নহবতখানাতেও বিসমিল্লাহ্ বাজাতেন। সেই নহবতখানাও ভেঙে গিয়েছিল। সেটা আপাতত সারাই করে বন্ধ রাখা হয়েছে। সেখানকার মানুষ জানেন, পূজারি জানেন বিসমিল্লাহ্ এখানে রোজ এসে রেওয়াজ করতেন, তাঁর পুতিরা জানিয়েছেন, তিনি বলতেন, ওখানেই তাঁর সিদ্ধি হয়েছিল, কিন্তু সেই জায়গাও আর নেই।

সানাইয়ের সুর

তাহলে কি তাঁর সাধের বারাণসী থেকে মুছে যাবে বিসমিল্লাহর স্মৃতি?

এই প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগে একটা ছবি আপনাদের সামনে তুলে ধরি। সন্ধ্যা নামছে। আলো ধীরে ধীরে কমছে। বিসমিল্লাহ্র বাড়ির তিনতলায় তাঁর তিন পুতি সানাই বাজাচ্ছেন সেই চৌকির উপর বসে। সঙ্গে পরিবারের আরো মানুষ। চারপাশের বাড়িগুলো থেকে মানুষ ভিড় করেছেন ছাদে, জানালায়, বারান্দায়। বিসমিল্লাহর প্রিয় রাগ, প্রিয় ধুন বাজছে। সুরের মায়াজাল তৈরি হচ্ছে।

বিসমিল্লাহর পরিবারের মানুষরা বলছিলেন, সম্ভবত এটাই শেষ অনুষ্ঠান। এরপর বাড়ি ভাঙা পড়বে। তৈরি হবে নতুন বাড়ি।

এটাই বাস্তব। একসময় নবীনদের এভাবেই জায়গা ছেড়ে দেয় প্রবীণরা। কিন্তু সেই সঙ্গে সবকিছুর বিসর্জন হয় না। অবহেলা একটা বাড়িকে ভেঙে দিতে পারে। কিন্তু থেকে যায় অনেক অনেক কিছু। তাঁর সানাইয়ের সুর যে ছড়িয়ে গেছে দেশে-বিদেশে, সেই সুর মুছবে না। তা থেকে যাবে মানুষের হৃদয়ে। বাড়ি ভাঙা পড়বে, কিন্তু সুর থাকবে, থাকবেই।