দশম বর্ষ ষষ্ঠ সংখ্যা ● ১৬-৩১ মার্চ, ২০২২ ● ১-১৫ চৈত্র, ১৪২৮

প্রবন্ধ

‘ইভান ইলিয়িচের মৃত্যু’

অমিয় দেব


‘ইভান ইলিয়িচের মৃত্যু’ আমার প্রথম তলস্তয়। পড়েছিলাম পঁয়ষট্টি বছর আগে, তুলনামূলক সাহিত্যে এম.এ. পড়বার সময়। ইংরেজি অনুবাদে। পরে অন্য তলস্তয়ের সঙ্গেও আরো দু-একবার পড়েছি। এবার পড়লাম, এই ২০২২-এর অব্যাহত কোভিড-অতিমারীতে প্রায় গৃহবন্দি অবস্থায়, মস্কোর রাদুগা প্রকাশনের এক ইংরেজি তলস্তয় সংকলনে (১৯৮৮)। যতবার পড়েছি, এই আখ্যান খুব নাড়া দিয়েছে। মূল রুশে বেরিয়েছিল ১৮৮৬-তে। ততদিনে জগজ্জয়ী ‘যুদ্ধ ও শান্তি’ ও ‘আন্না কারেনিনা’-র লেখক লেভ তলস্তয় পাল্টে গেছেন। যে-আত্মিক সংকট তাঁর হয় পঞ্চাশ বছর বয়সে এবং যে-মুক্তি তিনি শেষ পর্যন্ত অর্জন করেন, তা তাঁর ‘স্বীকারোক্তি’ গ্রন্থে (১৮৭৯-৮২) বিশদভাবে বলা আছে। এই আখ্যান বুঝি-বা তারই এক পরিণত কল্পরূপ।

এর শুরু হয়, সেদিনের সদ্যপ্রাপ্ত কড়কড়ে খবর কাগজে শোকসন্তপ্ত পত্নী প্রাস্কোভিয়া ফিওদরোভ্‌না গলোভিনা কর্তৃক প্রদত্ত, বিচারবিভাগের বরিষ্ঠ সদস্য ইভান ইলিয়িচ গলোভিন-এর মৃত্যুসংবাদ ও অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার দিনক্ষণ জেনে, তাঁর সতীর্থদের তাৎকালিক প্রতিক্রিয়া জ্ঞাপন করে। তা একেবারেই লারশফুকো-সম্মত। যে-আইনের কূটকচালি তাঁরা একটু আগেই করছিলেন তা ঝুলিয়ে রেখে, এই উচ্চবর্গীয়েরা সঙ্গে সঙ্গে ভাবতে লাগেন ইভান ইলিয়িচের শূন্যস্থান কে পূরণ করতে পারে, আর তার ফলে অন্য কার কার কী কী পদোন্নতি সম্ভব। এবং তাতে, কিছু আনুষঙ্গিক লাভের অঙ্কও কষে ফেলেন একজন। কী হয়েছিল ইভান ইলিয়িচের, সেই জিজ্ঞাসা আসে এর পরে - আগে স্বার্থ, পরার্থ পরে। আসলে, মৃত্যু যে তাঁদের না নিয়ে ইভান ইলিয়িচকে নিল, তাতে কি তাঁরা সুখী না হয়ে পারেন ! কিন্তু বন্ধুর জন্য তো শোকপ্রকাশ করতেই হবে, ধরা যাক, পিওত্‌র ইভানোভিচকে একবার গিয়ে তো দাঁড়াতেই হবে মরদেহের সামনে, সমবেদনা জানাতে হবে সদ্য স্বামীহারা প্রাস্কোভিয়া ফিওদরোভ্‌নাকে - তবে সান্ধ্য তাসের আড্ডাটি পুরো মাটি না করে। আপন বর্গের প্রতি এখন তলস্তয় নিষ্ঠুর। এই মৃত্যু যদি ইভান ইলিয়িচের না হয়ে পিওত্‌র ইভানোভিচের হত, বা তাঁর বিভাগীয় সতীর্থদের অন্য কারো, তাহলে ইভান ইলিয়িচও ঠিক তা-ই করতেন।

একদা তন্বী এখন পৃথুলা, প্রাস্কোভিয়া ফিওদরোভ্‌নাও যে এই বর্গের খাপে খাপে মিলে যান তার প্রমাণ পাওয়া গেল, এই শোকের মুহূর্তেও (ইভান ইলিয়িচের শেষের ক-দিনের আর্তনাদ যে তিনি কী করে বইলেন তিনিই জানেন, তবু) তাঁর মৃত স্বামীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে পিওত্‌র ইভানোভিচের সঙ্গে যে-কথা বলতে তাঁকে একান্তে টেনে নিয়ে গেলেন, তাতে। সরকার তাঁকে কী পেনশন দেবে তার পাইপয়সা পর্যন্ত তিনি জানেন (‘বন্ধু’ অবাক কারণ তিনি অতটা জানেন না), কিন্তু কোনও উপায়ে কি একটু বেশি আদায় করা যায় না? এমনকী ইভান ইলিয়িচের সুন্দরী কন্যাও (শোকের কালো সাজে, পিওত্‌র ইভানোভিচের চোখে পড়ল, তার রূপ আরো খুলেছে) নিঃসন্দেহে একই বর্গের - যে - ধনবান যুবকের সে বাগদত্তা সেও তার সঙ্গে রয়েছে - তার সুখের সময়ে বাবার এই কাণ্ডে সে বুঝি কিঞ্চিৎ বিরক্তই। কাঁদছে কেবল বালক পুত্র। সে এখনো বড়ো হয়নি। অন্ত্যেষ্টির ধর্মীয় ক্রিয়াকালে ‘বন্ধু’ পিওত্‌র ইভানোভিচ একবারও মরদেহের দিকে না তাকিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন; শেষ হওয়া মাত্র বেরিয়ে পড়লেন। তাঁকে গাড়িতে তুলে দিতে এসে, তাঁর জিজ্ঞাসু দৃষ্টির উত্তরে, এ-বাড়ির অল্পবয়সী ভৃত্য, চাষীর ছেলে গেরাসিমই খালি বলল, ‘এ ঈশ্বরের ইচ্ছা; আমরা সকলেই একদিন মারা যাব।’

ফরাসি ‘কম্‌ ইল ফো’, ঠিক যেমনটা হওয়া উচিত, তা-ই ছিল ইভান ইলিয়িচের জীবনের মূল সূত্র। ভালো ছাত্র, ভালো ডিগ্রি, কর্মজীবনের ভালো আরম্ভ, জীবনসঙ্গিণী নির্বাচনও যথোপযুক্ত - প্রেম-প্রণয়-পরিণয়। সার্থকতার পথ মসৃণ। তবে বিবাহিতের সুখে যদি একদা দৈনন্দিনের ছায়া পড়তে শুরু করে, বা পত্নীর ঈর্ষায় মলিন হয়ে ওঠে দাম্পত্য, তাহলে কাজের জগতে আশ্রয় নেওয়াই শ্রেয় - যত কাজ তত মুক্তি। তাছাড়া, ঘরের অশান্তি কি বাইরের আড্ডায় বা বিনোদনে পুষিয়ে নেওয়া যায় না? এক মফস্বল থেকে আরেক মফস্বল, অথচ পদোন্নতিতে, কী আশ্চর্য, এক কনিষ্ঠ তাঁকে ডিঙিয়ে গেল একবার, পরে আরো দু-একজন - একটা বিহিত তো করতেই হয়। শেষ পর্যন্ত তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুর দৌলতে তা হলও। আইনেরই নতুন ও উচ্চতর পদ। এবার খোদ পিটার্সবুর্গে। সার্থকতার প্রতীক হয়ে উঠল যে-নব নির্বাচিত গৃহ তাকে মনের সুখে সাজিয়ে তোলাই তো এবার কর্তব্য। স্ত্রী-কন্যা-পুত্রকে কুটুম্বসকাশে রেখে এসেই এই মহতী ‘কম্‌ ইল ফো’। এবং তাতে নিজেকেও হাত লাগাতে হবে। আর তা করতে করতে একদিন মই বেয়ে উপরে উঠতে গিয়ে পা পিছলে পড়তে পড়তেও বেঁচে গেলেন বটে, কিন্তু এক জানলার হাতলে একটা খোঁচা লাগল। গাত্রপার্শ্বে। তেমন কিছু না। হঠাৎ কখনো এই একরতি ব্যথার বোধ। পাত্তা না দিলেই হল।

সুখের শেষ নেই। দাম্পত্যে জোড়া লেগেছে। রূপসী কন্যার কত পাণিপ্রার্থী! আজ এই ভোজ তো কাল ওই ভোজ। এমনকী নাচের আসরও। তাছাড়া কত নিমন্ত্রণ, কত সেজেগুজে বেরোনো! আমাদের ইভান ইলিয়িচ অন্য সব ইভান ইলিয়িচের মতোই সার্থক। যেমন কাজের জায়গায় - নখাগ্রে বিধিবিধান - তেমনি সমাজে। তুঙ্গে বৃহস্পতি। কিন্তু? না, ওটা আছে, ওই ব্যথাটা, হয়তো সুপ্ত। তবে লুপ্ত নয়। এবার গল্প ওটা নিয়েই। আখ্যানের তিন-চতুর্থাংশ জুড়ে। ধীর লয়ে। আর তার ভাঁজে ভাঁজে শ্লেষ।

কেমন যেন এক বিস্বাদ প্রথমে, যেখানটায় লেগেছিল সেখানে হঠাৎ একটু ভার ভার, মনটা বিমর্ষ হয়ে থাকা, আবার ধীরে ধীরে খিটখিটে হয়ে ওঠা, এটাতে ওটাতে দোষ ধরতে থাকা, স্ত্রীর সঙ্গে কলহ, বাড়ির হাওয়া ভারী, স্পষ্ট কোনও অসুখ নয় তবে ধরণটা অসুস্থতার, অবশেষে স্ত্রীর কথায় ডাক্তার দেখানো, এক সবজান্তা ভিষগ যিনি স্বীয় শাস্ত্রজ্ঞানের অভিমানে যেন তাঁরই যমজ, একগাদা ওষুধ, মূত্র পরীক্ষান্তে ওষুধ পরিবর্তন, আরো ডাক্তার, ছোটো-বড়ো, নানা বিশেষজ্ঞের নানান মত, অবশেষে তাঁর বন্ধুর এক বিচক্ষণ ডাক্তার বন্ধু কর্তৃক কিঞ্চিৎ আশ্বস্ত হওয়া, কিন্তু তা হজম করার আগেই ওই ‘ওটা’ অর্থাৎ সেই ব্যথার থাবা, যেন লুকিয়ে বসে ছিল, মোক্ষম মুহূর্তে এসে হাজির হল, আর ছাড়ার পাত্র নয়, ধন্বন্তরী এলেও না, আস্তে আস্তে বোঝা গেল আর নিস্তার নেই ইভান ইলিয়িচের - বন্ধুদের চোখে করুণা, বাড়িতেও কি তাই নয়, অন্তত তাকে এড়িয়ে তো স্ত্রী-কন্যার সমাজ-সুখ অব্যাহত, ভাবী জামাতা এসে একদিন বুঝি-বা মায়া করেই ওঁদের সময়কার সারা বার্নহার্টের গল্প করে গেল - একমাত্র ব্যতিক্রম ভৃত্য গেরাসিম যে শুধু অম্লানবদনে তাঁর চেম্বারপট সাফ করে যায় না, যন্ত্রণা নিরসনে তাঁর পা দুটো তুলে ধরে রাখতে পারে, এমনকী ওর নিজের কাঁধে, ঘন্টার পর ঘন্টা, যে সত্যিই জানে, জাতস্য হি ধ্রুবো মৃত্যু।

দিন যায়। গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসে এক মস্ত না। আর সবাই থাকবে, তিনি থাকবেন না। কিন্তু কেমন ছিল তাঁর থাকা? বাল্যকালটা যে আনন্দের তা মনে পড়ে। তারপর? একরাশ ছায়া, খালি ‘কম্‌ ইল ফো’, কিন্তু তা কি সত্যিকার যাপন? আর এটা, এই ভয়ংকর যন্ত্রণা, এই ক্রমবর্ধমান আর্তি, এ কি তাঁর প্রতি মুহূর্তের অস্তিত্বের জানান দেওয়া নয়? মরতে মরতেও কি তিনি একভাবে বাঁচছেন না? এতদিন কি তিনি বাঁচতে বাঁচতেও একভাবে মরে ছিলেন না? আর এই যারা এখন তাঁর চারপাশে বেঁচে আছে বলে দেমাক করছে, তাঁরই বর্গের সব নরনারী, তারা কি আসলে মৃত নয়? ব্যতিক্রম শুধু গেরাসিম। সে বেড়ে উঠেছে মাটিতে।

দিন যায়। আর্তনাদে ভরিয়ে তোলেন সারা বাড়ি। কোনও মর্ফিয়া কোনও অহিফেনে তা ঘোচবার নয় । বালক পুত্র এসে তাঁর বুকে মুখ গুঁজে কাঁদে, তাঁকেও কাঁদায়। শেষ পর্যন্ত একদিন, তাঁকে বলে নিয়েই, যাজক ডেকে আনেন স্ত্রী, যদি অন্তিম ভজনায় একটু শান্তি জোটে। মিথ্যে প্রলেপ। মিথ্যা সান্ত্বনা। শুধু অপেক্ষা। আসে মৃত্যু অবশেষে, এসে এক থাবায় এক কালো থলেতে তাঁকে ঢুকিয়ে দেয়। সেই থলের অন্ধকারে এগোতে হয় হামাগুঁড়ি দিয়ে, বুকে হেঁটে। পথের শেষ কোথায়? হঠাৎ সুড়ঙ্গের প্রান্তে আলো ফোটে। ব্যথা মিলিয়ে যায়। মৃত্যু অন্তর্হিত হয়। চৈতন্য ভরে ওঠে আনন্দে। আর একেই পরিবার-পরিজন বলে ইভান ইলিয়িচের ‘মৃত্যু’। আর সেই মৃত্যুঘটিত ‘শোক’ তারা ধারণ করে। আর আপন বর্গসমীপে সেই শোকবার্তা পৌঁছে দেয়। সেই সঙ্গে ধর্মমতে ইভান ইলিয়িচের অন্ত্যেষ্টির আয়োজন করে। ইভান ইলিয়িচ ‘স্বর্গত’ হন। তাঁর শ্লেষে কোনও ফাঁক রাখেন না তলস্তয়। তাঁর ‘স্বীকারোক্তি’ থেকে খুব দূরে নেই আমরা। আবার, তাঁর ‘পুনরুজ্জীবন’-এরও এক সম্ভাবনা হয়তো এতে আমরা দেখি।

________________________________________
এই লেখাটা যখন শেষ করছি তখন রুশ সাঁজোয়া বাহিনী ইউক্রেন আক্রমণ করেছে। ভাবছি ইয়াসনায়া পলিয়ানা সন্নিহিত মাটি কি কেঁপে উঠছে না? যে-ঘাসজমির নীচে ১১২ বছর আগে তলস্তয়নিদ্রা গেছেন তার শান্তি কি অক্ষত আছে? সংলগ্ন বৃক্ষশীর্ষ থেকে কি পাখিরা উড়ে চলে যায়নি? উপরের আকাশ কি মুহুর্মুহু ঝলসে উঠছে না? এ কোন মৃত্যুর আয়োজন?

কৃতজ্ঞতাঃ প্রণব বিশ্বাস ও অম্লান দত্ত