দশম বর্ষ ষষ্ঠ সংখ্যা ● ১৬-৩১ মার্চ, ২০২২ ● ১-১৫ চৈত্র, ১৪২৮

সমসাময়িক

শান্তির পক্ষ নিন


রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে উদ্বেগ থামছেই না। সমাধান খুঁজতে দুই দেশের প্রতিনিধিরা বারবার বৈঠকে বসেছেন। কিন্তু, চতুর্থ দফার বৈঠকও ফলপ্রসূ হয়নি। এরই মধ্যে সংঘর্ষ অব্যাহত। শুধু মারিওপোলেই আড়াই হাজারের বেশি নাগরিক মারা গেছেন বলে দাবি ইউক্রেনের। খারকিভে ক্রমাগত রকেট হামলা চলছে। বিধ্বস্ত ইউক্রেনের ডনবাস শহর। আরপিন শহরে বহুতলগুলি ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে। শহরের প্রায় ৩০ শতাংশ এলাকা রাশিয়ার সেনার দখলে চলে গেছে বলে দাবি করছে ইউক্রেন। রাশিয়ার দাবী অনুসারে, তাদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কয়েক হাজার সৈন্য। ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য দেশ নয়। কিন্তু ইউক্রেন ও পুতিনের সংঘর্ষের মূলে রয়েছে কিভের ন্যাটো ঘনিষ্ঠতা। এমনটাই অভিযোগ ক্রেমলিনের। এদিকে, রাষ্ট্রসংঘের প্রধান অ্যান্টোনিও গুতেরেস বিশ্বের সব দেশকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছেন যে এই যুদ্ধের জেরে খিদের হারিকেন বয়ে যাবে গোটা বিশ্বের উপর দিয়ে। গোটা বিশ্বের খাদ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। যে উন্নয়নশীল দেশগুলি মহামারীর প্রভাব থেকে ঘুরে দাঁড়াতে সংগ্রাম করছে... যেখানে রেকর্ড মুদ্রাস্ফীতি, ক্রমবর্ধমান সুদের হার এবং ঋণের বোঝা বেড়ে গিয়েছে, সেই দেশগুলির জন্য এই যুদ্ধ আরও বড় ধ্বংসের সূচনা করবে, কারণ বিশ্বের ৪৫টি স্বল্পোন্নত দেশ তাদের গমের অন্তত এক-তৃতীয়াংশ ইউক্রেন বা রাশিয়া থেকে আমদানি করে। এর মধ্যে রয়েছে বুরকিনা ফাসো, মিশর, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কঙ্গো, লেবানন, লিবিয়া, সোমালিয়া, সুদান এবং ইয়েমেন। অবিরত যুদ্ধের ফলে উদ্ভুত অভূতপূর্ব পরিবেশ সংকতের কথা তো না হয় বাদই দেওয়া গেল।

এই যুদ্ধে কোনও রকম পক্ষাবলম্বন ভুল কাজ। ন্যাটো-র সম্প্রসারণ ও পশ্চিমী বিশ্বের আগ্রাসন, বিশেষত আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী নীতিকে সমর্থনের প্রশ্নই নেই। তার ওপর ইউক্রেনে আছে একটি প্রায় ফ্যাসিবাদী সরকার, যাদের কার্যকলাপ মূলত শ্বেতাংগ আধিপত্যের নীতিকে মান্যতা দিচ্ছে। তার ওপর আমেরিকার সংগে তাদের ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতা, অস্ত্রাগারের অভিমুখ রাশিয়ার সীমান্তের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া, ন্যাটোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হতে চেয়ে ক্রেমলিনের ওপর চাপ বাড়িয়ে যাবার নীতি নিন্দাযোগ্য। কিন্তু পুতিন কোনও মসিহা নন। তিনি নিজেও রাশিয়াতে যথেচ্ছ পরিমাণে দমনমূলক নীতি নিয়েছেন। ইউক্রেনের দিকে সৈন্যবাহিনী নিয়ে যাওয়া, অনবরত হামলা, নির্বিচারে রকেট ও গোলাবারুদ বর্ষণের ভেতর দিয়ে তাঁরও একপ্রকার আগ্রাসী মুখ স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

সারা পৃথিবীর বামপন্থীদের একটা প্রবণতা আছে, আমেরিকার বিরুদ্ধে যারা, তাদেরকেই মিত্র হিসেবে দেখা। সেই প্রবণতার নানাবিধ কারণ আছে, অনেকটাই যুক্তিযুক্ত। গত সত্তর বছর ধরে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে যেভাবে আগ্রাসন চালিয়েছে, আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া, লাতিন আমেরিকার নির্বাচিত সরকারকে ফেলে দিয়ে নিজেদের পুতুল একনায়ক বসিয়ে যেভাবে অবাধ শোষণ ও লুঠতরাজ করেছে, সেই তিক্ত ইতিহাস মাথায় রাখলে বামপন্থী আন্দোলনের প্রধান শত্রু হিসেবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যে চিহ্নিত হবে, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। কিন্তু এটাও মাথায় রাখতে হবে যে ঠাণ্ডা যুদ্ধ অতিবাহিত হবার পর এই বিশ্বের নানা কোণায় যেসব ছোট বড় অ-মার্কিন শাসকেরা মাথাচাড়া দিয়েছেন তাঁরাও ধোয়া তুলসিপাতা ছিলেন না। একসময়ে যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল তখন তার মানবতাবাদী পররাষ্ট্র নীতির কারণেই এসব শাসকেরা নিজেদের সংযত রেখেছিলেন, আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের বিরোধীতায় তাঁদের ভুমিকা কিছুটা হলেও চোখে পড়ত তখন। সোভিয়েত ভেঙে যাবার পর যখন কোনও লাগাম থাকল না, এই শাসকেরাও সমানভাবে স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছেন, নিজেদের দেশে নাগরিকের স্বাধীনতা ও অধিকার হরণে হয়ে উঠেছেন একই রকম নৃশংস। গদ্দাফিকে আক্রমণ আমেরিকার অন্যায় কাজ ছিল, কিন্তু গদ্দাফি নিজেও দেশের ভেতর বহু অন্যায় করেছেন। সাদ্দাম হুসেনের রাজত্বকালে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ছিল ইরাকে। ইরানে কমিউনিস্ট কর্মীরা দলে দলে খুন হয়েছেন মোল্লাতন্ত্রের হাতে, দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। এই সমস্ত শাসকেরাই আমেরিকা বিরোধী হলেও, এবং এসব দেশে আমেরিকার আগ্রাসনকে নিন্দা জানানো দ্যর্থহীন উচিত কাজ হওয়া সত্বেও, তাঁদের নিজেদের অন্যায় তাতে কমে না। এই ধারার শেষ সংযোজন হয়ত ভ্লাদিমির পুতিন। এইসব দেশ বা একনায়কতান্ত্রিক নেতাদের পক্ষে নয়, বামপন্থীদের অবস্থান ছিল সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার যুদ্ধের বিরুদ্ধে। একইভাবে, রাশিয়া বা ইউক্রেণের পক্ষ নেওয়া বামপন্থী অবস্থান হতে পারে না। একমাত্র অবস্থান হতে পারে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরোধীতা করা। তাই বামপন্থীদের ‘আমেরিকার শত্রু আমার মিত্র’ এই নীতি বিষয়ে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। এই রাশিয়া আগের সোভিয়েত নয়, পুতিনও নন মার্শাল স্তালিন, যিনি মানবতার খাতিরে পদক্ষেপ নিচ্ছেন। তাই, ইউক্রেনকে যেমন সমর্থনের জায়গা নেই, ন্যাটোকে তো নেইই, রাশিয়া থেকেও সাবধানী দূরত্ব অবলম্বন করাই বাঞ্ছনীয়।

এই মুহূর্তে মূল স্লোগান হওয়া উচিত শান্তির সপক্ষে। যুদ্ধে যেসব মানুষ নিহত হলেন, গৃহহীন, কর্মহীন হলেন, উদ্বাস্তু হলেন, তাঁদের সুবিচার ও পুনর্বাসনের সপক্ষে গলা তুলতে হবে। এই বিশ্ব গত শতকে দুটো মহাযুদ্ধ দেখেছে। পরেরটা দেখতে গেলে হয়ত পৃথিবীই ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই দাবী তুলতে হবে, যেন রণাঙ্গণ ছেড়ে আলোচনার টেবিলে ফিরে আসা হয়। তর্কের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধানের দিকে এগোতে পারে দুই পক্ষই, অবশ্যই ন্যাটো ও আমেরিকার নজরদারী ও দাদাগিরি উপেক্ষা করেই। প্রয়োজনে শান্তির দাবীতে রাস্তায় নামতে হবে। এই কাজ একমাত্র দেশ বিদেশের বামপন্থী প্রগতিশীল শক্তিই করতে পারে। তাঁদের দিকেই তাকিয়ে এই পৃথিবীর ভবিষ্যত।