দশম বর্ষ ষষ্ঠ সংখ্যা ● ১৬-৩১ মার্চ, ২০২২ ● ১-১৫ চৈত্র, ১৪২৮

সমসাময়িক

ছাপ্পা ভোট, ধাপ্পা ভোট, সন্ত্রাস কবলিত ভোটের সুবর্ণ জয়ন্তী


সাম্প্রতিক পুর নির্বাচনে ছাপ্পা ভোট প্রবর্তনের সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করা হল। ১৯৭২-এর ১১ মার্চ পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে প্রথম জবরদস্তি ভোটের প্রয়োগ হয়। প্রকৃত ভোটারদের ভয় দেখিয়ে ভোট কেন্দ্রে প্রবেশ করতে না দিয়ে একচেটিয়া ভাবে সমস্ত ব্যালট পেপারে দলীয় প্রার্থীদের পক্ষে ছাপ মেরে চলে শাসকদলের দুষ্কৃতীবাহিনী। ভীতি প্রদর্শনের জন্য প্রয়োজনে বোমা-বন্দুক ব্যবহার করতেও দ্বিধা বোধ করেনি। সামগ্রিকভাবে ভোট লুটের এহেন প্রক্রিয়া যা ইংরেজিতে 'রিগিং' বলে অভিহিত তা অচিরেই বাংলা ভাষায় প্রয়োগ করা শুরু হয়। স্বভাবতই এর ফলে বাংলা শব্দভান্ডার সমৃদ্ধ হয়। এবং পশ্চিমবঙ্গের সমাজ জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয় দুর্বৃত্তরাজ।

এই নির্বাচনের সময় পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রপতি শাসনাধীন। বকলমে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে রাজ্যের প্রশাসন। আরও নির্দিষ্ট করে বললে বলতে হয় পশ্চিমবঙ্গের জন্য ভারপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় তখন রাজ্যের হর্তাকর্তা। ১৯৭২-এর নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করে তিনি পরের পাঁচ বছর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।

সেই পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা কতটা দুঃসহ ছিল তা প্রবীণরা এখনও ভুলে যাননি। এক ভীত সন্ত্রস্ত পরিবেশে তখন বঙ্গবাসীর বসবাস। চতুর্দিকে ঘরছাড়া, সন্তানহারা মানুষের হাহাকার। প্রশাসন ও শাসকদলের দুষ্কৃতীদের দাপটে জনজীবন বিপন্ন। ভুক্তভোগীদের অভিজ্ঞতা ও প্রত্যক্ষদর্শীদের স্মৃতি ছাড়াও ওই পাঁচ বছরের প্রশাসনিক কীর্তিকলাপ নিয়ে বহু আলোচনা গবেষণা হয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে অনেক বই। সে সময়কার প্রশাসক বা শাসকদলের পক্ষ থেকে কোনো গবেষণাপত্র বা পুস্তকের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতে শোনা যায়নি।

'গণতন্ত্রের উৎসব' বলে অধুনা প্রচলিত শব্দবন্ধ জন্ম নেওয়ার অনেক আগে ১৯৭২-এর ১১ মার্চ ঘটে যাওয়া গণতন্ত্রের প্রহসনের দিন নির্বাচন চলাকালীন তখনকার ছয় বামপন্থী দলের যুক্তফ্রন্ট প্রতিটি নির্বাচন কেন্দ্র থেকে নিজেদের প্রার্থীদের প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়। এতকিছুর পরেও হাতে গোনা কয়েকজন বামপন্থী বিধায়ক নির্বাচিত হলেও প্রহসনের নির্বাচনের প্রতিবাদে বিধানসভা পরিহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তখনকার ছয় বামপন্থী দলের যুক্তফ্রন্ট দ্বিধাহীন ভাষায় সর্বত্র প্রচার করত যে লুটপাটের বিধানসভা তারা বর্জন করেছে। বাস্তবে কোনো বামপন্থী বিধায়ক সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণ করেননি।

সন্ত্রাস কবলিত এই পাঁচ বছরের মধ্যেই সারা দেশে জারি হয় জরুরি অবস্থা। জুন ২৫, ১৯৭৫ থেকে জানুয়ারি ১৭, ১৯৭৭। সেই দুর্দিনে ঘরহারা, পাড়াছাড়া বামপন্থী কর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সংগঠনকে শক্তপোক্ত করার কাজ করে গেছেন। সে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি। আগের রাতে যেখানে ছিলেন পরের রাতেও সেখানেই ঠাঁই মিলবে কিনা জানা নেই। কর্মস্থলে উপস্থিত হওয়া যাবে কিনা তার ঠিক-ঠিকানা নেই। তবুও সাংগঠনিক কাজে দুর্বলতা ছিল না। হাতে হাতে স্মার্টফোন অথবা ঘরে ঘরে ল্যাপটপ তখন অস্তিত্বহীন। তবে পরিসংখ্যান বিজ্ঞান ছিল। ভারতে পরিসংখ্যান বিজ্ঞানের প্রবর্তক অধ্যাপক প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবীশও ১৯৭২-এর নির্বাচনের সময় জীবিত ছিলেন। কিন্তু কোনো বামপন্থী দল, সংগঠন অথবা কর্মীরা পরিসংখ্যানের খাতা খুলে হিসেব কষতে বসেননি ১৯৭১-এর নির্বাচনের ফলাফল থেকে ১৯৭২-এ কত শতাংশ ক্ষতি হয়েছে। বিধানসভায় আসন সংখ্যা কত কমলো কিংবা কোন কেন্দ্রে কত ভোট কম পড়েছে বলে কোনও গবেষণা বা আলোচনা হয়েছে বলে শোনা যায়নি। এখনকার মতো স্মার্টফোন অথবা ল্যাপটপের সাহায্যে চটজলদি উত্তর খুঁজে পাওয়া না গেলেও খাতায়কলমে অঙ্ক কষে অনেক বিশ্লেষণের সুযোগ ছিল। সেই পথে না হেঁটেছিল কোনো বামপন্থী দল, সংগঠন অথবা তাদের কর্মীরা। সন্ত্রাস জর্জরিত বাংলায় তাঁরা তখন নিজেদের জীবনের তোয়াক্কা না করে সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের বিপদে আপদে ঝাঁপিয়ে পড়তে দ্বিধা করতেন না। একই সঙ্গে চলতো সাংগঠনিক কাজ। ফলাফল - জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারের পর ১৯৭৭-এর মার্চে অনুষ্ঠিত লোকসভা নির্বাচনে বামপন্থীদের জয়জয়কার। তিন মাস পর রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় বামফ্রন্ট সরকার। অর্থাৎ ঘরে বসে আঁক কষা নয় ঘরে-বাইরে, মাঠে-ময়দানে মানুষের জীবন-জীবিকার সমস্যা নিয়ে নিরন্তর মুখর হয়ে বামপন্থীরা ছিনিয়ে এনেছিলেন জয়। এই অসম লড়াইয়ে কতজন বামপন্থী কর্মী প্রাণ হারান, কতজন কর্মচ্যূত হয়েছিলেন, কতজন ঠাঁই হারিয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন তার হিসেব কোথাও নথিভুক্ত হয়েছে কি?

পঞ্চাশ বছর আগের নৃশংস প্রশাসক সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের স্নেহধন্যা এখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর অনুপ্রেরণা ব্যতিরেকে রাজ্যের গাছের পাতা নড়ে না বা গাড়ির চাকা গড়ায় না বলে শোনা যায়। সাম্প্রতিক পুর নির্বাচনের আগে তিনি বলেছিলেন যে আগের মতো ভোট লুটের ঘটনা যেন আর না ঘটে। তবুও ঘটেছে। মাত্র এক বছর আগে গেরুয়া শিবিরকে পর্যুদস্ত করে তৃতীয় বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন তাঁর কেন এত ভয়?

সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়-ও এমন ভয় পেয়েছিলেন। ব্যাঙ্ক ও কয়লা খনি রাষ্ট্রীয়করণ, রাজন্য ভাতা বিলোপ ইত্যাদি জনকল্যাণমূলক কর্মসূচির ফলে তখন ইন্দিরা গান্ধি যথেষ্ট জনপ্রিয়। সর্বোপরি ১৯৭১-এর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর সার্বিক অবদান সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের মানুষও তখন আবেগ আপ্লুত। সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় তবুও কোনো ঝুঁকি না নিয়ে বিধানসভার নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করেছিলেন। একই পথ অনুসরণ করলেন তাঁর গুনগ্রাহী উত্তরসূরী। কয়েক মাস আগে আয়োজিত বিধানসভা নির্বাচনে সাফল্য অর্জন করেছেন। রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছেন অসংখ্য অনুদানের প্রকল্প। টাকার অঙ্ক বেশি নয়। কিন্তু কর্মহীন রাজ্যে, দুর্মূল্যর বাজারে সামান্য আর্থিক সহায়তা দিয়েই নিরন্ন দরিদ্র মানুষের কাছে তিনি পৌঁছনোর চেষ্টা করে চলেছেন। এমনকি বিরোধী দলের কর্মীরাও এইসব প্রকল্পের আবেদন পত্র জমা করার কাজে গরিব মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তবুও তাঁর ভয় যায়নি। ফলাফল আবারও নির্বাচনের নামে প্রহসন।

নির্বাচনের দিন থেকে শুরু করে গণনার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত সমস্ত রকমের সংবাদমাধ্যম নিরন্তর সেই প্রহসনের প্রচার করে গেছে। ফল প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই পাল্টে গেল প্রচারের ধরণ। ছাপ্পা ভোট, ধাপ্পা ভোট, সন্ত্রাস ইত্যাদি হারিয়ে গেল। কোথায় কত ভোটে শাসকদলের প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন, বিরোধী দলের ভোট কত শতাংশ কমেছে ইত্যাদি নিয়ে শুরু হল ধারাবাহিক আলোচনা। সাধারণ মানুষ তো বটেই বামপন্থী কর্মী-নেতারাও সেই হিসেবনিকেশ, কাটাছেঁড়ার জালে জড়িয়ে পড়লেন।

শতাধিক পুরসভার মধ্যে কোনোক্রমে তাহেরপুর পুরসভায় বামপন্থীরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছেন। তার মধ্যেই যেন পাওয়া গেছে আশার আলো। তাহেরপুরে শাসকদলের পরাজয় নিঃসন্দেহে একটি উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। কিন্তু খেয়াল থাকে না যে নবীন এই পুরসভার মোট ভোটার কতজন। শেষ আদমশুমারি অনুসারে তাহেরপুরের জনসংখ্যা ২০ হাজারের থেকে সামান্য বেশি। সেই জয়কে সমগ্র রাজ্যের প্রেক্ষাপটে বিরাট সাফল্য বলে বিবেচনা করলে আত্মসন্তুষ্টি পাওয়া যেতে পারে, সামগ্রিক ভাবে সংগঠনের প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যায় না। সীমিত পরিসরে তাহেরপুর যদি শাসকদলের আক্রমণ প্রতিহত করতে পারে অন্যত্র কেন তা করা হচ্ছে না - এমন আত্মসমীক্ষার প্রয়োজন নেই?

যত দিন দারিদ্র থাকবে, অসাম্য থাকবে, বামপন্থী আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা আদৌ কমবে না, বরঞ্চ আরও বাড়বে। তবুও কেন আন্দোলন হচ্ছে না? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতেই হবে। 'আরেক রকম' পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক অশোক মিত্র এই প্রসঙ্গে অনেকদিন আগেই বলেছিলেন, "আমাদের বামপন্থীরা আত্মঘাতী, কিন্তু এ দেশে বামপন্থা ছাড়া গতি নেই।" (১০ জুন, ২০১৪)

পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এখন সবকিছুই দেখতে, শুনতে, বুঝতে পারছেন। কিন্তু মুখ খুলছেন না। মূক মানুষ যতদিন না মুখর হয়ে উঠছেন ততদিন কি বামপন্থীরা নির্লিপ্ত মনে মুঠোফোনের পর্দায় নিজেদের নিগড় আবদ্ধ করে কালাতিপাত করবেন? নাকি সত্তর দশকের অভিজ্ঞতার আলোকে নিজেদের আরও সঙ্ঘবদ্ধ করে মানুষের প্রতিদিনের সমস্যা সমাধানের জন্য আন্দোলন গড়ে তুলতে উদ্যোগী হবেন সেটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কর্মসূচি পালন নয়, বাৎসরিক অনুষ্ঠান উদযাপন নয়, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গড়ে তুলতে হবে সময়োপযোগী গণ আন্দোলন।