আরেক রকম ● দশম বর্ষ পঞ্চম সংখ্যা ● ১-১৫ মার্চ, ২০২২ ● ১৬-৩০ ফাল্গুন, ১৪২৮

সম্পাদকীয়

যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই


এ কথা বুঝে নিতে হবে নির্দ্বিধায় যে, আজকের পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে কোনও মূল্যেই যুদ্ধ হতে দেওয়া যাবে না, কারণ শান্তির কোনও বিকল্প নেই। যে পৃথিবী গত একশো বছরের মধ্যে দুটো বিশ্বযুদ্ধ দেখেছে, তার আর সত্যিই আবার নতুন একটা রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যাবার মত সামর্থ্য নেই। রাশিয়া ও ইউক্রেনের ভেতর ক্রমবর্ধমান টেনশনে ইন্ধন দিয়ে চলেছে আমেরিকা ও ন্যাটো, সুপরিকল্পিতভাবে। দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী বলে ক্রমাগত অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দিয়ে চলেছে ওয়াশিংটন। ন্যাটোর ভেতর ইউক্রেনকে অন্তর্ভুক্ত করার অর্থই যে রাশিয়ার নিরাপত্তাহীনতা আরেকটু বাড়িয়ে দেওয়া, সে কথা কি তারা জানত না? পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর সাম্রাজ্যবাদী বিস্তৃতি, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রত্যক্ষ মদতে বড় স্কেলে সৈন্যদল ও অস্ত্র নিয়ে আসা, এগুলো কোন বিশ্বশান্তির ইঙ্গিত? যখন রাশিয়া এবং ইউক্রেন, দুই দেশের নেতৃত্বই বারেবারে সংযত হবার কথা বলেছেন, তখনও আমেরিকা, ব্রিটেন এবং ন্যাটোর অন্যান্য সদস্য দেশগুলি রাশিয়াকে প্ররোচিত করেই গেছে। কেন গত সাত বছরে একবারও রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতিকে একবারও তলব করেনি, যা থেকে জানা যেতে পারত শান্তিপূর্ণ সমাধানের কী রাস্তা বেরিয়েছে। তার বদলে প্লেন বোঝাই সৈন্য আর অস্ত্র নিয়ে গেছে আমেরিকা, উপদ্রুত অঞ্চলগুলোতে। ফলত যা প্রত্যাশিত, তাই ঘটেছে। ইউক্রেনীয় সেনার স্পেশাল ইউনিটের প্রায় ২০০ সৈনিক রাশিয়ার হাতে মারা গিয়েছে। গুঁড়িয়ে গিয়েছে ২১১টি সামরিক পরিকাঠামো। শুধু তাই নয়, পশ্চিমি দেশ থেকে ইউক্রেনের হাতে পৌঁছনো বিপুল পরিমাণ অস্ত্রের ভাণ্ডারও রাশিয়া বাজেয়াপ্ত করেছে, যার মধ্যে রয়েছে আমেরিকার পাঠানো জ্যাভলিন অ্যান্টি ট্যাঙ্ক ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তিও। এ ছাড়াও, সেনা অভিযানের শুরুতেই চেরনোবিল পরমাণু কেন্দ্র দখল করে নেয় রাশিয়া। ইউক্রেনের দাবি, চেরনোবিলের ৮০-র বেশি কর্মীকে পণবন্দি করে রেখেছে রুশ সেনা। অপরদিকে রক্তাক্ত হয়েছে রাশিয়া নিজেও। রাশিয়ার ১৪টি এয়ারক্র্যাফট, আটটি হেলিকপ্টার, ১০২টি ট্যাঙ্ক এবং ৫৩৬টি অস্ত্রভর্তি যান নষ্ট হয়েছে। নিহত হয়েছেন শতাধিক রাশিয়ান সৈনিক। মানে, যুদ্ধ কোনও পক্ষেই ইতিবাচক ফলাফল কিছু আনছে না। সাধারণ মানুষ ও সৈনিকের জীবনহানির মত মর্মান্তিক ঘটনাই আপাতত গোটা চিত্র অধিকার করে আছে।

এই প্রসঙ্গে ভারতের অবস্থান কিছুটা ইতিবাচক। ইউক্রেন ইস্যুতে রাষ্ট্রসংঘে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে ভারত। চিনও রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোট দেয়নি। উল্লেখ্য, ইউক্রেনের উপর রাশিয়ার হামলার বিরোধিতায় রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে একটি প্রস্তাব পেশ হয়েছিল। সেই প্রস্তাবনা পেশের পক্ষে বা বিপক্ষে ভোট না দিয়ে ভোটদানের থেকে বিরত থাকল ভারত, চিন। মোটামুটি সমদূরত্বের আভাস মেলে এরকম অবস্থান থেকে। ভারতের কূটনীতিকরাও বলছেন যে, আলোচনার টেবিলের বিকল্প এই মুহূর্তে আর কিছু নেই।

মনে রাখা দরকার যে, রাশিয়া যদি সাম্রাজ্যবাদী হয়, তাহলে আমেরিকা ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য করতে চেয়ে সেই আগুনে ঘি ঢেলেছে বলেই আজ সাম্রাজ্যবাদকে পুতিন নিজেদের 'প্রতিরক্ষা বিষয়ক অপারেশন' বলে চালাতে পারছেন। কূটনীতির সুযোগ যখন ছিল, দু'তরফের কেউই সদিচ্ছা দেখাননি। ইউরোপ তাই আজ আবার এক সর্বগ্রাসী রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সম্মুখীন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শুধু প্রথম দু'দিনের রক্তপাতই যদি ধরে নেওয়া হয়, তাহলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী পরিস্থিতিতে ইউরোপের কোনও স্বাধীন দেশে এতবড় আক্রমণ হানা হয়নি।

আমেরিকার রাশিয়াকে ঘিরে ধরতে চাওয়া, এবং রাশিয়ার এই ইউক্রেন অভিযান, দুটোই নিন্দনীয়। তাই খুব সংগতভাবেই পৃথিবী জুড়ে কমিউনিস্ট পার্টিগুলো আওয়াজ তুলেছে - যুদ্ধ নয় শান্তি চাই। যে দেশগুলো ইউক্রেনকে অস্ত্র পাঠাচ্ছে, যেমন কানাডা বা চেক রিপাবলিক, সেসব দেশের কমিউনিস্টরা বিক্ষোভে পূর্ণ করে তুলছেন রাজপথ। দাবী খুব স্পষ্ট - যুদ্ধের আগুনে নতুন করে ঘি যেন না দেয় সেসব দেশের সরকার। বামপন্থীদের এই যুদ্ধে কোনও পক্ষ নেবার জায়গাই নেই। একটাই পক্ষ হতে পারে, শান্তির পক্ষ। কারণ রাশিয়া বা পুতিন কোনও মসিহা নন, বরং দক্ষিণপন্থী দেশনেতা, এবং ইউক্রেনেও ফ্যাসিস্তদের বাস, যারা সেখানকার কমিউনিস্ট পার্টি, প্রান্তিক মানুষ, তৃতীয় লিঙ্গের অধিকার সমস্তই ব্যান করেছে। এই যুদ্ধ প্রসঙ্গে দুই পক্ষ থেকেই সমদূরত্ব রাখতে হবে। জোরালো কণ্ঠে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা নিরসনের দাবী তুলতে হবে, শান্তির সপক্ষে কাঁপিয়ে তুলতে হবে রাজপথ।