আরেক রকম ● দশম বর্ষ পঞ্চম সংখ্যা ● ১-১৫ মার্চ, ২০২২ ● ১৬-৩০ ফাল্গুন, ১৪২৮

সম্পাদকীয়

রাজ্যে গণতন্ত্রের অন্তর্জলি যাত্রা


'গণতন্ত্র' কথাটি শুনতে খুব ভালো। হাজার হাজার পৃষ্ঠা রোজ ব্যয় হয় ভারতের গণতন্ত্র কত মহান তা প্রমাণ করতে এবং তাকে আগলে রাখার জন্য দেশ তথা রাজ্যের নেতারা যারপরনাই ব্যস্ত। কিন্তু রাজনীতি যেমন বর্তমানে ব্যবসায় পরিণত হয়েছে 'গণতন্ত্র' শব্দটি আপাতত সেই ব্যবসায় চলনশীল একটি মুদ্রার থেকে বেশি কিছু নয়। আমাদের রাজ্যে নাকি ফ্যাসিবাদকে হারাতে আমরা বাঙালি জাতীয়তাবাদকে অগ্রাধিকার দিয়ে এমন একটি সরকার নির্বাচিত করেছি যারা নাকি ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সর্বাধিক কার্যকরী রক্ষাকবচ। এমন একটি কথাকে প্রতিষ্ঠিত করার দায় নিজেদের হৃষ্টপুষ্ট কাঁধে গ্রহণ করেছে রাজ্যের সংবাদমাধ্যম এবং বুদ্ধিজীবিদের একাংশ। অথচ আমাদের রাজ্যে সরকার সর্বপ্রকারে গণতন্ত্রকে প্রতিনিয়ত ধ্বংস করে চলেছে যা নিয়ে তারা হিরন্ময় নীরবতা পালনকেই সর্বশ্রেষ্ঠ কর্তব্য হিসেবে ধরে নিয়েছেন।

যুবক-যুবতীদের এত বছর চপ শিল্পের গুণাবলী বুঝিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মনে করছেন যে এই গল্প থেকে বেরিয়ে নতুন কিছু করতে হবে। অতএব তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছেন বীরভূমের দেউচা-পাচামি অঞ্চলে এক বৃহৎ কয়লা খনি প্রতিষ্ঠার কাজে। আজকের পৃথিবী যেখানে জলবায়ুর সমস্যা এবং বিশ্ব উষ্ণায়ণের সমস্যা নিয়ে জর্জরিত, যেখানে কয়লার ব্যবহার কমানোর কথা বলা হচ্ছে পৃথিবী জুড়ে সেখানে আমাদের রাজ্যে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহৎ খোলামুখ কয়লা খনি খোলার জন্য মুখ্যমন্ত্রী তথা রাজ্য সরকার বদ্ধপরিকর। মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলনে বলছেন যে, পরিবেশের ব্যাপারটা নাকি তিনি দেখে নেবেন। অথচ, দেশের আইনে বলা আছে যে, পরিবেশের উপর কী প্রভাব পড়বে তার রিপোর্ট না দেখে কোনো প্রকল্প গ্রহণ করা যায় না। নতুন জমি অধিগ্রহণ আইন বলছে মানুষের সম্মতি ব্যতিরেকে জমি নেওয়া যাবে না। অথচ রাজ্য সরকার প্রকল্প ঘোষণা করে দিয়েছে, জমি নেওয়ার জন্য ক্ষতিপূরণ প্যাকেজ ঘোষণা হয়ে গেছে। কিন্তু কোন আইনের মাধ্যমে এই সিদ্ধান্তগুলি নেওয়া হয়েছে বা হচ্ছে, তা নিয়ে সরকার কোনো কথা বলতে রাজি নয়। দেশ তথা রাজ্য যে মুখ্যমন্ত্রীর মুখের কথায় চলে না, গণতন্ত্রে বিধি মেনে আলোচনার মাধ্যমে এগোতে হয় এই মৌলিক পাঠ ভুলেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী।

কিন্তু সব মানুষ যেহেতু তাঁর দলের পোষ্য নয়, তাই প্রতিবাদ হওয়াই স্বাভাবিক। নিজেদের জমি-জীবিকা-বাস্তুতন্ত্র-পরিবেশ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করছেন স্থানীয় আদিবাসী সমাজের মানুষ। তারা এককাট্টা হচ্ছেন এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে। কিন্তু বিরোধিতা করার অধিকার আর রাজ্যবাসীর নেই। অতএব ডিসেম্বর মাস থেকেই সেখানে শুরু হয়েছে শাসকদলের দামাল ছেলে এবং পুলিশের দমনপীড়ন। কলকাতা থেকে বেশ কিছু মানুষ সেই আদিবাসী মানুষদের সাহায্য করতে তাঁদের আহ্বানে দেউচা-পাচামিতে গিয়েছেন। বারংবার তাঁদের শাসকদলের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। ২০ ফেব্রুয়ারি দেউচাতে একটি জনসভা করে ফেরার পথে কলকাতা থেকে আগত প্রসেনজিৎ বসুর নেতৃত্বাধীন একটি দলের উপর চড়াও হয় সেখানকার তৃণমূলের গুণ্ডারা। তারপরে যা হওয়ার তাই হয়। পুলিশ এসে প্রসেনজিৎ বসু সহ নয় জনকে গ্রেপ্তার করে খুনের চেষ্টার মিথ্যা মামলা রুজু করে। ফলত, ৯ দিন ধরে কলকাতার সাথীরা এবং আরো কয়েকজন স্থানীয় আদিবাসী প্রতিবাদী জেলে আটক, যাদের মধ্যে রয়েছেন শিক্ষক, বিজ্ঞানী, ছোট ব্যবসায়ী-সহ অন্যান্য পেশার মানুষ, যাদের একমাত্র দোষ তাঁরা রাজ্য সরকারের স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়েছিলেন, আদিবাসী মানুষদের আন্দোলনের সঙ্গে সহমর্মিতা প্রকাশ করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু শাসকদল এবং দলদাস পুলিশের মিলিত ষড়যন্ত্রে তারা কারাগারের অন্তরালে এতগুলি দিন কাটাচ্ছেন। রাজ্য সরকারের মধ্যে যদি বিন্দুমাত্র গণতান্ত্রিক চেতনা বাকি থাকে তবে কলকাতার প্রতিবাদী সাথী এবং দেউচা-পাচামির আদিবাসী সাথী যাদের বিনা প্রমাণে মিথ্যা মামলায় জেলে পোরা হয়েছে তাদের অবিলম্বে নিঃশর্তে মুক্তি দেওয়া উচিত।

কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের মধ্যে কি আদৌ ন্যূনতম গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ আর অবশিষ্ট আছে? তাদের কাণ্ডকারখানা দেখে তেমন মনে হওয়ার কোনো কারণ নেই। প্রত্যেকটি নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করার এত সুতীব্র আকাঙ্ক্ষা খুব কম রাজনৈতিক দলের মধ্যেই দেখা যায়। ২০২১ সালের নির্বাচনের ফলাফলের পরিপ্রেক্ষিতে বলাই যায় যে, এখনো তৃণমূল কংগ্রেস হয়ত সুস্থ পরিবেশে নির্বাচন হলে অধিকাংশ আসনেই জয়লাভ করবে। কিন্তু ক্ষমতার লিপ্সা তাদের এতটাই বেশি যে শুধুমাত্র জিতলে তারা খুশি নয়। একশ শতাংশ আসনে যেনতেন প্রকারেণ জয়লাভ করাই তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। কারণ দুর্নীতি করে টাকা আয় করার উপায় হিসেবে ক্ষমতার সমস্ত কেন্দ্রে নিজেদের অধিষ্ঠিত রাখতে হবে। অতএব কোনো তৃণমূল প্রার্থী তথা তাদের নেতারা একটি আসনেও হারতে রাজি নয়। তাই রাজ্যের ১০৮টি পুরসভা নির্বাচনে দেখা গেল শাসকদলের তাণ্ডব। অবাধে বুথ-দখল, ছাপ্পাভোট, বিরোধী দলের পোলিং এজেন্টদের বুথ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া, বিরোধী কর্মী তথা প্রার্থীদের উপর নির্বিচারে আক্রমণ - সমস্ত কিছুর সাক্ষী থাকল রাজ্য। বলতে লজ্জা হলেও বলতেই হয়, বর্তমানে উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব, গোয়ার মতন রাজ্যে যে নির্বাচন হচ্ছে তাতে নানা শক্তি মরণপণ লড়াই করলেও পশ্চিমবঙ্গের মতো ভোট সন্ত্রাসের ছবি সেখানে নেই। আমরা যে ক্রমশ পেছন দিকে এগিয়ে চলেছি দুর্বার গতিতে তা আর আলাদা করে বলে দিতে হয় না। এই গতি যাতে আরো ত্বরাণ্বিত হয়, তার দায়িত্ব নিয়েছে আমাদের রাজ্যের তথাকথিত শিক্ষিত আমলা তথা পুলিশের আধিকারিকগণ। তারা শাসকদলের ছাপ্পা ভোট দেওয়ার অধিকার সুরক্ষিত রাখার জন্য বদ্ধপরিকর। অতএব ভারতের সংবিধানের শপথগ্রহণকারী আমলাকুল, বেমালুম অন্ধ হয়ে যান নির্বাচনের দিন। গণতন্ত্রের শবের উপর তৃণমূলের আস্ফালন চলতে থাকে যেখানে অন্ত্যেষ্টির দায়িত্ব পান হোমড়াচোমড়া আমলারা।

তবু কিছু মানুষ থেকে যায় যারা নির্বাচনের বেড়াজালের বাইরেও প্রতিনিয়ত বিরুদ্ধতার আগুন জ্বালিয়ে রাখে নিজেদের জীবনে। যারা মানুষের স্বার্থে লাগাতার আন্দোলনে শামিল থাকেন। এই ব্যক্তিরা রাষ্ট্র তথা শাসককুলের কাছে সর্বাধিক বিপজ্জনক। অতএব, দেউচা-পাচামির আন্দোলনকারীদের জেল হয়। অন্যদিকে, আনিস খানের মতন প্রতিবাদী তরুণকে তাঁর বাড়িতে গিয়ে হত্যা করে পুলিশ। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে পুলিশ-প্রশাসন এবং তৃণমূলের গুণ্ডাবাহিনী মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। অতএব আপনি যদি শাসকদের বিরুদ্ধে মুখ খোলেন তাহলে শাসকদলের গুণ্ডা অথবা পুলিশের হাতে আপনি নিগৃহীত হবেন। তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে আবারো আপনার কপালে জুটবে তৃণমূল অথবা পুলিশের অত্যাচার। যেমন আনিস খানের খুনের প্রতিবাদ করলে গ্রেফতার হতে হয় যুবনেত্রী মীনাক্ষি মুখার্জিকে। এই নিরন্তর নিপীড়ন অব্যাহত রয়েছে। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের উপর এই আক্রমণের বিরুদ্ধে যদি প্রগতিশীল সমাজ মুখ না খোলে, যদি বিজেপি-র দোহাই দিয়ে তৃণমূলের অত্যাচারকে মান্যতা দেওয়া হয় তবে তার থেকে জনবিরোধী কাজ পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান রাজনীতিতে আর নেই।

বামপন্থীদের গুরুত্ব এখানেই। তৃণমূল এবং বিজেপি উভয় জনবিরোধী অগণতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রাম এবং আন্দোলনই একমাত্র পথ। এই আন্দোলনের পথে হাঁটতে হলে বন্ধু দরকার, যার মাধ্যমে তৈরি হবে মানুষের জোট যা একদিন তৃণমূল এবং বিজেপিকে পরাস্ত করতে পারবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি বামপন্থীরা আন্দোলনের জোটের তুলনায় গত কয়েক বছর নির্বাচনী জোটকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। এই ভুল যত তাড়াতাড়ি শুধরে বামপন্থীরা আন্দোলনের জোট গড়তে শুরু করবেন ততই তাদের এবং রাজ্যবাসীর মঙ্গল।