আরেক রকম ● দশম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা ● ১৬-২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ● ১-১৫ ফাল্গুন, ১৪২৮

প্রবন্ধ

দেওচা-পাচামিতে কয়লা খনি - ডাল মে কুছ কালা হ্যায়

পার্থপ্রতিম বিশ্বাস


আগামীতে রাজ্য রাজনীতির বিতর্কের নতুন 'এপিসেন্টার' হতে চলেছে বীরভূমের দেওচা-পাচামি'র খনি জট। এই বীরভূমেই রবি ঠাকুর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রুক্ষ প্রকৃতির মাঝে শান্তিনিকেতন। কিন্তু সেই লাল মাটির দেশের ভিন্ন প্রান্তে কয়লার কালো মাটি দখলের লক্ষ্যে এখন ঘনিয়ে উঠছে অশান্তির নতুন মেঘ। উঠে আসছে সেই পুরানো উন্নয়ন সংক্রান্ত বিতর্কের উপাদান, এই দেওচা-পাচামির প্রস্তাবিত খনি প্রকল্পকে কেন্দ্র করে। রাজ্যের সরকার ইতিমধ্যে এই প্রকল্পকে রাজ্যে ভবিষ্যতের শিল্পায়নের সুত্রপাত হিসাবে দেখতে চাইছে। আর ঠিক এর একশো আশি ডিগ্রি বিপরীতে বাতাসের সাথে রয়েছে প্রকল্প এলাকার কয়েক হাজার প্রান্তিক জনজাতির মানুষ যাদের জীবন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে সেখানকার জল জঙ্গল আকাশ বাতাসের সঙ্গে, তারা এমন প্রকল্পের মধ্যে সিঁদুরে মেঘ দেখছে। তাঁদের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশ থেকে উচ্ছেদ, ক্ষতিপূরণ, বিকল্প জীবিকা, বাস্তুতন্ত্রের পরিবর্তন, পরিবেশ ধবংস এমন বহু প্রাসঙ্গিক বিষয় আবারও উঠে আসছে এমন খনি প্রকল্পকে ঘিরে।

ভুমিকা

ইতিমধ্যে শিল্প সম্ভাবনার প্রতীক সিঙ্গুরে তথাকথিত বাহান্ন ফসলা জমিতে এখন অটো মোবাইল শিল্পের পরিবর্তে চারাপোনার চাষের প্রয়োজনে মাছের ভেড়ি তৈরির সরকারি তোড়জোড় চলছে। রাজ্যে শিল্প সম্ভাবনার আরেক বিতর্কিত নাম নন্দিগ্রামে এখন কেমিক্যাল হাবের পরিবর্তে গ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকার জমিতে নোনা জল ঢুকিয়ে কুঁচো চিংড়ির চাষ করে প্রথাগত চাষের পঞ্চত্ব প্রাপ্তির প্রয়াস চলছে সরকারি উদ্যোগেই। এমন প্রেক্ষিতে আবার শিল্পায়নের নামে বারো হাজার একর জমি থেকে স্থানীয় জনজাতি মানুষের উচ্ছেদ একইসাথে বাস্তুতন্ত্র, পরিবেশ, জীবিকা, কর্মসংস্থান এমন বহু প্রাসঙ্গিক বিষয়কে নিয়ে হাজির হচ্ছে বিতর্কের নতুন ক্যানভাসে। ইতিমধ্যেই রাজ্যের সরকার তাদের রাষ্ট্রীয় ব্যাবস্থাকে কাজে লাগিয়ে খনি প্রকল্পের পক্ষে সংবাদমাধ্যম থেকে শুরু করে সমাজের বুদ্ধি বিক্রেতা সকলকেই পথে নামিয়েছে সরকারের সুরে সুর মেলাতে। আর প্রত্যাশিতভাবেই সরকারি উদ্যোগের অস্বচ্ছতার বিরুদ্ধে ভিন্নমতের মানুষেরাও একজোট হওয়ার চেষ্টা করছে। অর্থাৎ একদিকে manufacturing consent-এর সরকারি প্রয়াস আর তার বিরুদ্ধে promoting dissent-এর প্রতিবাদী স্বর উত্তরোত্তর হয়ে উঠতে চলেছে রাজ্য এবং জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষিতে এক নতুন বিতর্ক এক নতুন আঙ্গিকে। সাথে নতুন আশঙ্কার ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছে কারণ এদেশে বহুক্ষেত্রেই সরকারের সাথে সুর না মেলানো মানুষদের কখনও 'দেশদ্রোহী' আবার কখনও 'মাওবাদী' তকমায় চিহ্নিত করার যে প্রবণতা তৈরি হয়েছে সেটি শেষমেশ এমন খনি বিতর্কেও ফিরে আসে কি না সে দিকেই এখন সকলের নজর। আসলে উন্নয়ন বিতর্কের বহুমাত্রিক প্রেক্ষিতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রতিবাদের মধ্যেও বিপদের উপাদান সত্য অন্বেষণে সাহায্য করে, যদি সরকার খোলা মনে বিপদের চরিত্র অন্বেষণে প্রয়াসী হয়। অন্যথায় মানুষের মঙ্গলের নামে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপপ্রয়োগে অমঙ্গলের ভয়ই জোরালো হয়ে ওঠে। দেওচা-পাচামিকে ঘিরে তৈরি হওয়া ডামাডোল তেমনই এক ভয়কে উত্তরোত্তর বাড়িয়ে তুলছে।

কয়লা পোড়া বিদ্যুৎ - কয়লা তোলার খনি

সম্প্রতি এদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গ্লাসগো জলবায়ু সম্মেলনে গিয়ে গোটা বিশ্বের সাথে সহমত হয়ে অঙ্গীকার করে দেশে ফিরেছেন যে আগামি পঞ্চাশ বছরে আমাদের দেশ জলবায়ুর বিষম পরিবর্তন রুখতে দূষণ নিয়ন্ত্রণে আরও সক্রিয় ভুমিকা গ্রহণ করবে। বলাই বাহুল্য উন্নয়নশীল যে কোনও দেশেই বায়ু দূষণের সিংহ ভাগ জুড়ে থাকে কয়লা, পেট্রোল, ডিজেলের মতো জীবাশ্ম জ্বালানিকে অর্থনীতির চালিকা শক্তি হিসাবে ব্যবহার। তথাকথিত উন্নত জীবনযাপনের লক্ষ্যে এমন কয়লা-ডিজেল নির্ভর জ্বালানি থেকে কতো দ্রুত আমরা পরিবেশবান্ধব শক্তি ব্যবহারে পারদর্শী হবো? কীভাবে আমরা পরিকল্পিত উপায়ে আমাদের বাস্তুতন্ত্রের পুনর্বিন্যাস ঘটাবো এমন ভাবনাই দুনিয়া জুড়ে হয়ে উঠছে মুখ্য। কিন্তু এমন ভাবনার সম্পূর্ণ বিপরীতে গিয়ে রাজ্যের সরকার এই দেওচা-পাচামির খনির কয়লাকে আগামী একশো বছরের জন্য এই রাজ্যের তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাঁচামাল হিসাবে চিহ্নিত করেছে। এক দিকে দেশের সরকার খাতায় কলমে কয়লা-ডিজেলের মতো জ্বালানি ব্যবহারে নির্ভরতা কমাতে চাইছে আবার সেই দেশেরই এক অঙ্গরাজ্য আগামী একশো বছর এই দূষণযুক্ত তাপবিদ্যুতের লক্ষ্যে নতুন কয়লা খনি প্রকল্প হাতে নিচ্ছে। এমন প্রয়াস সেই অর্থে এক অনৈতিক প্রয়াস এবং দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন ভাবনার বিরুদ্ধেও বটে। এই নিরিখে সারণিতে বিগত সাত বছরে (২০১৪-২০২১) দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের চালচিত্র দেওয়া হলো।

সাল উৎপাদিত বিদ্যুৎ তাপ বিদ্যুৎ (%) জল বিদ্যুৎ (%) অপ্রচলিত শক্তি (%) পরমাণু বিদ্যুৎ (%)
২০১৪ ২.৮৩ লক্ষ মেগাওয়াট ৭০ ১৬-১৭ ১২ ১-২
২০২১ ৩.৯২ লক্ষ মেগাওয়াট ৬০ ১২ ২৬ ১-২

 

সারণির তথ্য থেকে স্পষ্ট যে গোটা দেশ জুড়েই কয়লা নির্ভর তাপবিদ্যুতের পরিমাণ মোট উৎপাদনের ৭০% থেকে কমে হয়েছে ৬০%। পাশাপাশি সৌর বিদ্যুৎ, মিনি জল বিদ্যুতের এর মতো অপ্রচলিত শক্তির ভাগ ১২% থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬%। গত সাত বছরে সৌর বিদ্যুতের উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৫,০০০ মেগাওয়াট। এদেশে ইউপিএ সরকারের থেকে বামপন্থীদের সমর্থন প্রত্যাহারের অন্যতম কারণ ছিল আমেরিকার সঙ্গে আমদানি নির্ভর পরমাণু চুক্তি। কিন্তু গত সাত বছরের তথ্যে প্রমাণিত যে এদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষিতে আত্মনির্ভর পরমাণু বিদ্যুতের পথ গ্রহণ না করলে পরনির্ভর পথে পরমাণু বিদ্যুতের উৎপাদন দেশে বাড়ানো সম্ভব নয়। ফলে পরমাণু বিদ্যুতের উৎপাদন গত সাত বছরে পরিবর্তন না হলেও এদেশে আত্মনির্ভর অপ্রচলিত শক্তির উৎপাদন বেড়েছে ১৪%। এই প্রেক্ষিতে রাজ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কয়লা খনি খুঁড়ে ভবিষ্যতের তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ শেষমেশ পেছনের দিকে এগিয়ে চলার মতোই হতে পারে।

অজানা খনি - অধরা প্রযুক্তি

এখনও পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে প্রস্তাবিত খনিতে জমে থাকা কয়লার মান উত্তম গোত্রের নয়, বরং সেই কয়লা তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতার নিরিখে মধ্যম থেকে অধম গোত্রভুক্ত। কিন্তু আগামী পঞ্চাশ বছর যদি সেই কয়লা পোড়া বিদ্যুতে বাড়ির আলো পাখা চালাতে হয় সেক্ষেত্রে সবচেয়ে বড়ো বিবেচ্য বিষয় হয়ে উঠবে সেই বিদ্যুতের দাম। কারণ খনি থেকে তোলা কয়লার দাম নির্ভর করে সেই কয়লা উত্তোলনে ব্যবহৃত প্রযুক্তির দাম এবং তার মানের ওপর। যেমন এই শতাব্দীর একেবারে শুরুর দিকে এদেশের মোবাইল ফোনের বাল্যকালে যে প্রযুক্তি উপলব্ধ ছিল তাতে ওয়াকি টকির মতো শুঁড়ওয়ালা অ্যান্টেনা লাগানো একটা হ্যান্ডসেটের দাম ছিল কুড়ি হাজার টাকার কাছাকাছি। সেকালে ফোনের ইন-কামিং চার্জ গুনতে হতো মিনিটে ছ' টাকা আর আউট-গোয়িং কলের চার্জ ছিল মিনিটে আট টাকা। বলাই বাহুল্য এমন মহার্ঘ প্রযুক্তির ফোন সেকালে আমজনতার ক্রয় ক্ষমতার বাইরে থাকায় সেই টেলি পণ্য কিংবা পরিষেবা ছিল সাধারণের নাগালের বাইরে। ফলে কয়লা পুড়িয়ে উৎপাদিত বিদ্যুৎ দিয়ে দুয়ারে বিদ্যুৎ প্রকল্প যদি বিশ বছর বাদেও চালু হয় তখন সাধারণের জীবনে সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন হয়ে উঠবে সেই বিদ্যুতের দাম। এই প্রশ্ন এখন আরও জোরালো হচ্ছে এই কারণেই যে প্রস্তাবিত গভীর খনি থেকে কয়লা উত্তোলনের কোনো প্রযুক্তি এদেশে এখনও উপলব্ধ নয়। ফলে, খনি ক্ষেত্রে আমদানি করা নতুন বিদেশি প্রযুক্তির মান এবং দাম কেমন হয় তার ওপরই নির্ভর করবে উৎপাদিত কয়লা এবং পরিশেষে বিদ্যুতের দাম। এখনই এরাজ্যে বিদ্যুতের দাম দেশের রাজ্যওয়ারি বিন্যাসে একেবারে উপরের দিকে। এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রযুক্তিগত অনিশ্চয়তা দূর না হলে এমন প্রকল্পের আর্থিক লাভক্ষতির বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে থাকবে আর অনিশ্চিত হওয়ার আশঙ্কায় থাকবে প্রকল্প এলাকার মানুষের জীবন-জীবিকা।

শিল্পায়নের আরেক নাম 'দেওচা-পাচামি'!

আধুনিক বিদেশি খনি প্রযুক্তি শ্রম নিবিড় নয় বরং সেগুলি পুঁজি নিবিড়। ফলে এমন পুঁজি নিবিড় প্রযুক্তিতে প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থানের সুযোগ তুলনায় কম। এমনকি খনি শিল্পে তেমন গুরুত্বপূর্ণ অনুসারী শিল্প না থাকার কারণে পরোক্ষ কর্মসংস্থানও বিপুল সংখ্যায় ঘটে না। এদেশে এই মুহূর্তে কোল ইন্ডিয়ার তথ্য অনুযায়ী বার্ষিক ষাট কোটি টন কয়লা তোলার জন্য ২০২১ সালে তাদের কর্মসংস্থানের পরিমাণ ছিল ২ লক্ষ বাহাত্তর হাজার। ফলে প্রস্তাবিত খনি প্রকল্পে বার্ষিক 8 কোটি টন কয়লা তুলতে পারলেও ঐকিক নিয়মেই সেখান থেকে সরকারি দাবি অনুযায়ী এক লক্ষের কর্মসংস্থান সম্ভব নয়। চা কিংবা চপের দোকানকে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র হিসাবে বিবেচনা করলেও কোনভাবেই সেই হিসাব মিলবে না। ফলে রাজ্যে বিকল্প শিল্পায়নের প্রচেষ্টা হিসাবে এই খনি প্রকল্পের বিজ্ঞাপন আদৌ বাস্তবসম্মত নয় বরং কেউ যদি এটাকে 'নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো' এমন দৃষ্টিতেও দেখতে চায় সেখানে বাধ সাধবে এই খোলা মুখ খনি প্রকল্পের স্বচ্ছতা নিয়েও। বিরোধী অবস্থানে থাকার সময় রাজ্যে আজকের শাসক দল যারা টাটার সাথে তৎকালীন বাম সরকারের চুক্তি জনসমক্ষে আনার দাবিতে সোচ্চার হয়েছিল জনস্বার্থে আজ তাঁরা কেন নীরব এমন ঝুঁকিবহুল খনি প্রকল্পের প্রযুক্তি দাতা কিংবা বানিজ্যিক সংস্থার সাথে হওয়া চুক্তি নিয়ে! আর এখনও যদি তেমন কোন চুক্তি না হয়ে থাকে তাহলে এই প্রকল্পের সবুজ সংকেত রাজ্য সরকার দিল কি করে যেখানে হাজার হাজার জনজাতি মানুষের জীবন-জীবিকা সমেত সেই এলাকার বাস্তুতন্ত্র গুরুতর প্রশ্নের মুখে? এখানেই 'ডাল মে কুছ কালা হ্যায়' এমন সন্দেহ তৈরি হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে সরকারি স্তরে এই প্রকল্প নিয়ে স্বচ্ছতার প্রশ্ন।

ভূবিজ্ঞানীদের অনুমান অনুযায়ী এই প্রকল্প এলাকার পরিধি ১২.৩১ বর্গ কিলোমিটার, যার মধ্যে দেওচা এলাকায় ৯.৪৮ বর্গ কিলোমিটার আর দেওয়ানগঞ্জ এলাকায় পড়ে ২.৮৩ বর্গ কিলোমিটার। এক অর্থে এই কয়লার ভাণ্ডার দেশের বৃহত্তম কয়লার ভাণ্ডারও বটে। কিন্তু এমন অনুমানের পেছনে প্রযুক্তিসন্মতভাবে যতগুলো 'বোর হোল' করে অনুসন্ধানের প্রয়োজন ছিল তার এক তৃতীয়াংশ সংখ্যার অনুসন্ধানের ভিত্তিতেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এমন তথ্য। ফলে সীমিত সংখ্যক গভীর কূপ খননের মাধ্যমে উপনীত হওয়া এমন সিদ্ধান্তের নির্ভরযোগ্যতা প্রশ্নাতীত নয়। পৃথিবীর এবং এদেশের বহু অঞ্চল জুড়ে সোনা, রূপা, প্লাটিনাম, পেট্রোলের মতো খনিজ সম্পদ মাটির নিচে জমে থাকলেই যে সেগুলিকে খনি বানিয়ে তুলে ফেললে পরতায় পোষাবে অর্থাৎ লাভজনক হবে ব্যাপারটা এতো সরল নয়। ফলে মাটির নিচে বিশাল কয়লা ভান্ডারের সন্ধান পেলেই যে সেটি লাভজনক খনির চেহারা নেবে এমন ধারণাও অতি সরলীকৃত। এদেশের মাটির নিচে পরমাণু বিদ্যুতের বিকল্প জ্বালানি 'থরিয়াম'-এর পৃথিবীর তিন চতুর্থাংশ ভাণ্ডার জমে রয়েছে। কিন্তু সেটাকে নিষ্কাশনের কোনো জাতীয় উদ্যোগ না থাকার কারণে আমাদের দেশে পরমাণু বিদ্যুতের কাঁচামাল 'ইউরেনিয়াম' আমদানির ওপর নির্ভর করতে হয়।

অপরিকল্পিত উন্নয়ন - বিপন্ন বাস্তুতন্ত্র

এদেশে খোলা মুখ কয়লা খনির গভীরতা গড়পড়তা ১৫০ মিটারের মধ্যে সীমিত। কিন্ত প্রস্তাবিত খনিতে কয়লা সম্পূর্ণভাবে তুলতে গেলে মাটির তলায় ৮০০-৯০০ মিটার ভেদ করে পৌছতে হবে সেই কালো সোনার স্তরে। এদেশের খনি শিল্পের ইতিহাসে এত গভীর 'খোলা মুখ' খনির অভিজ্ঞতা নেই। ফলে এমন ব্যতিক্রমী শিলাস্তরের আবরণ ভেদ করে ব্যতিক্রমী গভীরতায় গিয়ে কয়লা তোলার ক্ষেত্রে প্রয়োজন হবে বিদেশি প্রযুক্তি। এই প্রকল্প এলাকায় কয়লার স্তরের ওপর প্রহরীর মতো ছেয়ে আছে হিমালয় যুগের শক্ত পুরু পাথরের স্তর যা প্রায় পঞ্চাশ তলা বাড়ির সমান। এই বিপুল গভীরতার পাথরের স্তর ভেদ করে খোলা মুখ খনি বানিয়ে কয়লা তোলা কতটা পরিবেশ বান্ধব কিংবা বাস্ততন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক এমন প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে সঙ্গত কারণেই। কারণ সেই ভয়ঙ্কর শক্ত শিলান্তর ফাটাতে খোলা মুখ খনিতে যে পরিমাণ ও মানের বিস্ফোরক ব্যবহার করা দরকার তা হবে অতীব শক্তিশালী। সেই তীব্রতার বিস্ফোরণে সন্নিহিত অঞ্চলের জলস্তরের ভারসাম্য বিঘ্নিত সম্ভাবনা প্রবল। ফলে এই অঞ্চলের চাষবাস, নদী-নালা, খাল বিলের জলপ্রবাহের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। প্রভাব পড়তে পারে সন্নিহিত অঞ্চলের বাড়ি ঘর, রাস্তা, সেতুর কাঠামোতেও। খনিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক বিস্ফোরকের প্রভাব পড়তে পারে গভীর খনিগর্ভে জমা বিপুল জলের স্তরে। খনিতে জমা সেই দূষিত জল কীভাবে কোথায় পরিশোধন করে ফেলা হবে সেই প্রশ্নের উত্তর এখনও অধরা। ফলে আমদানি করা বিদেশি প্রযুক্তি এই প্রকল্পে ব্যাবহার করা হলেও প্রকল্প এলাকার পরিবেশের ওপর তার সার্বিক প্রভাব নিয়ে কোনো 'Environmental Impact Assesment Report' জনসাধারণের জন্য উপলব্ধ নয়। এখানে উল্লেখ করা উচিত যে, দেড় দশক আগে এই রাজ্যে বাম সরকারের আমলে পরিবেশ বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কায় পূর্ব মেদিনীপুরের 'হরিপুরে' পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের প্রবল বিরোধিতা করেছিলো সেদিনের বিরোধী দল যারা আজ রাজ্যের শাসক। ফলে আজ দেওচা-পাচামিতে কয়লা খনি প্রকল্প যে পরিবেশ বান্ধব সেটা প্রমাণের প্রাথমিক দায় তাদেরই। এখানে মনে রাখা উচিত যে এমন প্রযুক্তি বিদেশে থাকা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক অতীতে এই প্রকল্প থেকে ছয় রাজ্যের সম্মিলিত সংস্থা 'বেঙ্গল বীরভূম কোলফিল্ডস লিমিটেড (বিবিসিএল)'-এর হাত গুটিয়ে নেওয়া প্রাথমিকভাবে প্রমাণ করে এই প্রকল্প হয় অলাভজনক কিংবা ঝুঁকিবহুল। কারণ এমন বিশাল কয়লার ভাণ্ডার থেকে নিশ্চিত আয়ের চেয়ে অনিশ্চিত ব্যয়ের ঝুঁকি বহুগুনে বেশি বলেই হাত গুটিয়েছিল তারা। ফলে জাতীয়স্তরে বাতিল একটি অলাভজনক প্রকল্প রাজ্যস্তরে রাতারাতি কি করে লাভজনক হয়ে উঠলো সেটাই এখন হয়ে উঠেছে বহুমূল্যের প্রশ্ন।

অনুমান করা হচ্ছে যে, প্রস্তাবিত কয়লা খনির ওপরের পুরু শিলাস্তর ভেঙে আনুমানিক ১৪০ কোটি টন পাথরকুচি মিলতে পারে। সেগুলি অদূর ভবিষ্যতে এই রাজ্য কিংবা প্রতিবেশী রাজ্যগুলিতে নির্মাণ শিল্পে কাঁচামালের যোগান হবে। আর সেই সঙ্গে খানিক লক্ষ্মীর ভাণ্ডার ভরতে পারে সেই পাথর বেচে। কিন্তু সেক্ষেত্রে যে পরিমাণ ধুলোর দূষণ ঘটবে সেটা আটকাতে কি প্রযুক্তি নির্ভর পরিকল্পনা হচ্ছে সেটাও অজানা। অস্পষ্ট পরিকল্পনাতে বোঝা দায় এই বিপুল পরিমাণ পাথর কেটে অন্যত্র চালান করে দেওয়ার পর সেই পঞ্চাশ তলা সমান খনির গর্ত ভরাট হবে কি দিয়ে? ইতিমধ্যে এক বেসরকারি সংস্থার সমীক্ষা রিপোর্টে প্রকাশ ২০১৯ সালে এ অঞ্চলে ১৮০টা পাথরের খাদান আর প্রায় দুই হাজারের কাছাকাছি ক্রাশার প্ল্যান্ট চলে যেগুলির এক চতুর্থাংশ আইনি আর বাকিটা বেআইনি। ইতিমধ্যে সেই অঞ্চলের এমন পাথর খাদানের ধুলোর ধাক্কায় অসংখ্য মানুষ দুরারোগ্য 'সিলিকোসিস' ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছে। এই অবস্থায় কয়লা খনি প্রকল্পে উপরি পাওয়া এই বিপুল পাথরের খাদান সেই অঞ্চলের জনস্বাস্থ্যের যে নতুন বিপদ হবে না - সেটা নিশ্চিত করার দায় রাজ্যের সরকারের। আর এমন বহু প্রশ্নের উত্তর দিয়েই মীমাংসা করতে হবে 'দেওচা- পাচামি' খনি প্রকল্পের আশু এবং দীর্ঘমেয়াদী ঝুঁকির উপাদানগুলিকে।