আরেক রকম ● দশম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা ● ১৬-২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ● ১-১৫ ফাল্গুন, ১৪২৮

প্রবন্ধ

আরেক রকম-এর কর্মাধ্যক্ষ রবীন মজুমদার স্মরণে

সুজিত পোদ্দার




'আরেক রকম' পত্রিকার কর্মাধ্যক্ষ রবীন মজুমদার-এর ২৩শে জানুয়ারী ২০২২, বিরাশি বছর বয়সে জীবনাবসান হয়েছে। বার্ধক্য জনিত কারণে অল্প কিছুদিন তিনি বাড়িতে এবং হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।

২০১৩-র জানুয়ারিতে 'আরেক রকম' প্রথম প্রকাশিত হওয়ার কিছুদিন পর থেকেই পত্রিকার দপ্তরের দায়িত্ব নিয়ে এককভাবে পত্রিকা বন্টন এবং দপ্তর পরিচালনার সমস্ত দায়িত্ব পালন করেছেন রবীন মজুমদার। ২০২০-র মার্চের পর কোভিড অতিমারির কারণে পত্রিকা ছাপা বন্ধ করে দিতে হয়। যতদিন পত্রিকা ছাপানো হয়েছে ততদিন তিনি এই দায়িত্ব সামলে দিয়েছেন। পত্রিকার ছাপা বন্ধ হলেও রবীনবাবুর সঙ্গে পত্রিকার সকল সহকর্মীদের প্রতিনিয়ত যোগাযোগ ছিল।

'আরেক রকম' পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত সবাই জানেন, রবীনবাবু পত্রিকার প্রকাশনা এবং বিলি-বন্টন ব্যবস্থার ব্যাপারে খুবই সচেতন ছিলেন। সঠিক সময়ে প্রেস থেকে পত্রিকা বের করে এনে, প্রতি মাসের ১লা এবং ১৬ তারিখের মধ্যে প্রতিটি কাগজে গ্রাহকের নাম ঠিকানা লিখে জিপিওতে পৌছে দিতে হয়। নির্দ্দিষ্ট দিনে জিপিও না পৌঁছলে স্বল্প মাশুলে পত্রিকা পাঠানো সম্ভব নয়। শুধু জিপিও নয়, বিভিন্ন পদ্ধতিতে শহরের অন্যান্য বিক্রয়স্থল এবং রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হয়। এছাড়াও লোক মারফত বিভিন্ন স্থানে পত্রিকা পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতেন তিনি। প্রয়োজনে অনেক সময় নিজেও পত্রিকার বান্ডিল নিয়ে ট্রেনে চেপে কোনো জেলায় বা লাগোয়া শহরে পৌঁছে দিতেন। সব কাজই সময়ের মধ্যেই করতে হতো। অর্থের সঙ্কুলান নেই। লোকবলহীন অবস্থায় একান্তই নিজের চেষ্টায় প্রায় আট বছর কাল রবীনবাবু এই পরিশ্রম করে 'আরেক রকম' পাঠকের কাছে পৌঁছে দিয়ে গেছেন।

রবীনবাবুর সঙ্গে পাঠকদের খুবই খোলামেলা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। কোন গ্রাহক পত্রিকা পেতে একদিন দেরি হলে রবীনবাবুকে ফোন করতেন। রবীনবাবু আনন্দের সঙ্গে ব্যবস্থা নিয়ে প্রয়োজনে নিজে পত্রিকা পৌঁছে দিতেন। আবার যদি কোনো বাৎসরিক গ্রাহক, চাঁদার মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার পরও পুনর্নবীকরনে বিলম্ব করতেন, ফোনে গ্রাহককে স্মরণ করিয়ে দিতেও পিছপা হতেন না রবীনবাবু।

'আরেক রকম' পত্রিকা প্রথম প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালের ১লা জানুয়ারি। এরপর প্রতি মাসের ১ এবং ১৬ তারিখ নিয়মিত ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয়েছে 'আরেক রকম', যতদিন না অতিমারির কারণে ছাপা বন্ধ করে দিতে না হয়। ২০১২ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে পত্রিকা প্রকাশনার ব্যপারে অশোক মিত্র উদ্যোগ নেওয়া শুরু করেন। মিহির ভট্টাচার্য, শঙ্খ ঘোষ, গৌরী চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ আরও কয়েকজনের সঙ্গে আলোচনা করে পত্রিকা প্রকাশনার ব্যাপারে অগ্রসর হতে থাকেন। পত্রিকার উদ্দেশ্য আদর্শগত দিক, বিষয় সূচি ইত্যাদি বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা হলেও ছাপা এবং পত্রিকার বিক্রি-বন্টন ব্যবস্থার বিষয়ে বিশদে আলোচনা হয়নি। ছাপার ব্যপারে মিহির ভট্টাচার্য এবং অভিজিত মুখার্জী এগিয়ে আসেন। কিন্তু বিলি ব্যবস্থার কোন সুরাহা করা যাচ্ছিল না। ইমানুল হকের সহায়তায়, পোদ্দার কোর্টের একটি সংস্থার মাধ্যমে প্রথম সংখ্যা থেকে পত্রিকার বিলি বন্দোবস্ত করা হয়। কিন্তু অফিস না হলে, নিজস্ব বন্টন ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়।

জনৈক শুভানুধ্যায়ীর আনুকূল্যে মধ্য কলকাতার ফিয়ার্স লেনে 'আরেক রকম"-এর নিজস্ব দপ্তর খোলার ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়। ২০১৩-র ১৬ই এপ্রিল থেকে এই দপ্তরের কাজ শুরু হয়। সূচনাকালে দপ্তরে উপস্থিত ছিলেন অশোক মিত্র, কবি শঙ্খ ঘোষ, মিহির ভট্টাচার্য, তীর্থংকর চট্টোপাধ্যায় ও আরও অনেকে। সেদিন অশোকবাবুর অনুরোধে ব্যাঙ্ক কর্মচারী আন্দোলনের নেতা মলয় চট্টোপাধ্যায় রবীন মজুমদারকে পত্রিকার দপ্তরে নিয়ে এসে সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন।

এরপর থেকে রবীনবাবু 'আরেক রকম' পত্রিকার দপ্তরের দায়িত্ব নিয়ে, পত্রিকা ছাপার অক্ষরে নির্দিষ্ট দিনে বের করার দায়িত্ব নেন। 'আরেক রকম' প্রকাশিত হওয়ার পর পত্রিকা পাঠক এবং লেখক সকলের কাছে পৌছে দেওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। পত্রিকা পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়া এবং লেখকদের কাছ থেকে লেখা আদায় করার সব দায়িত্ব এককভাবে নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন রবীনবাবু। প্রথম দিকে রবীনবাবুর কোন সহকারী ছিল না। কিন্তু দায়িত্ব ও কাজ বেড়েই চলছিল। ২০১৩-র নভেম্বর মাসে তিনি একজন পূর্ব পরিচিত ব্যক্তিকে নিজের কাজের সঙ্গে যুক্ত করেন। চন্ডী পাইন আংশিক সময়ের কর্মী হিসেবে নিযুক্ত হলেও মাসে দু'বার পত্রিকা প্রকাশিত হলে ওঁদের দুজনকেই অনেক সময় দিনরাত কাজ করতে হয়েছে শুধু পত্রিকা পাঠকের কাছে সঠিক সময়ে পৌছে দেওয়ার তাগিদে।

রবীনবাবু কর্মজীবনে ইউবিআই-এর কর্মী ছিলেন। কর্মজীবনে তাঁকে অনেক দায়িত্বপূর্ণ পদে কাজ করতে হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতার নিরিখে পত্রিকার দায়িত্ব খুবই সুন্দরভাবে সামাল দিয়েছেন। রবীনবাবুকে প্রতিদিন মধ্যমগ্রাম থেকে কলকাতায় আসতে হতো। 'আরেক রকম'-এ কাজের জন্য তিনি কোনো পারিশ্রমিক বা সান্মানিক ভাতা গ্রহণ করতেন না। ব্যাঙ্ক কর্মচারী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে তিনি অনেক সময় প্রাক্তন সহকারীদের সহায়তা নিয়ে পত্রিকা বন্টনের কাজ নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সম্পন্ন করতেন।

এলাকায় তিনি সমাজসেবী সাস্কৃতিক কর্মী হিসেবে পরিচিত। অন্যান্য কাজের সঙ্গে এইসব কাজও চালিয়ে যেতেন। কিন্তু 'আরেক রকম' পত্রিকার প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা ছিল একেবারেই অন্য রকম।

যে কোনো বাধা বা ব্যক্তিগত অসুবিধা অতিক্রম করে পত্রিকা প্রকাশনা এবং বন্টন ব্যবস্থার সমন্বয় ঘটিয়ে পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যা পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতেন। সম্পাদকমন্ডলী সঠিক সময়ে কাগজ ছাপতে না দিলে কাগজ ছাপার পর বিভিন্ন ব্যবস্থার মারফত সঠিক সময়ে কাগজ পাঠকের কাছে পৌছে দেওয়া সম্ভব নয়। তাই রবিনবাবুকে সর্বদাই সম্পাদক, প্রেস কর্মচারী এবং নিজের দপ্তর-এর সঙ্গে সংযোগ রেখে কাজ করে যেতে হয়েছে।

রবীনবাবু পত্রিকা পাঠকের কাছে পৌছে দেওয়াকে ব্রত হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি সবসময় বলতেন, পত্রিকার কাজে কোনো বিচ্যুতি, পক্ষান্তরে অশোক মিত্রের সম্মানহানির সমান। তাই পত্রিকা পাঠকের কাছে ঠিক সময়ে পৌঁছে দেওয়া যেমন নিজ কর্তব্য বলে গণ্য করতেন, তেমনি কোনো ছাপার ভুল বা লেখার গুণমান পত্রিকার সুনামের সঙ্গে মানানসই না হলে এই ব্যাপারেও সম্পাদকমন্ডলীর সদস্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন। রবীনবাবুর চলে যাওয়া পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত সকলের কাছে খুবই বেদনাদায়ক। অপূরণীয় ক্ষতি।