আরেক রকম ● দশম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা ● ১৬-২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ● ১-১৫ ফাল্গুন, ১৪২৮

সমসাময়িক

প্রসঙ্গ হিজাবঃ প্রশাসনিক পদক্ষেপ জরুরী


হিজাব বিষয়ে সাম্প্রতিক বিতর্ক এমন কিছু স্পর্শকাতর জায়গা তৈরি করে দিচ্ছে যেগুলোর সতর্কতার সঙ্গে মুখোমুখি হওয়া বাঞ্ছনীয়। কয়েক সপ্তাহ আগে কর্ণাটক রাজ্যের কয়েকটি কলেজ হিজাব পরা তাদের ইউনিফর্ম নীতিবিরুদ্ধ বলে 'ক্লাসের ভেতর হিজাব পরা' নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে বিতর্কের সূত্রপাত হয়। পরে সেই ছাত্রীদের আবার ক্যাম্পাসে ঢুকতে দেওয়া হলেও তাদেরকে কোন ক্লাসে অংশ না নিয়ে আলাদা একটি কক্ষে বসে থাকতে বলা হয়। কলেজ কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্যাপক ক্ষোভ-সমালোচনার সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে মুশকান নামক এক ছাত্রী হিজাব পরে কলেজে ঢুকতে গেলে হিন্দুত্ববাদী যুবকেরা তাঁকে তাড়া করে, তিনিও পালটা রুখে দাঁড়িয়ে ‘আল্লাহু আকবর’ স্লোগান দেন। এ পর্যন্ত সবাইয়েরই জানা। এ বিষয়ে বিতর্কে সবাই কোনও না কোনও পক্ষ অবলম্বন করছেন। বিজেপি কোন দিকে সেই অনুমানের জন্য কোনও পুরষ্কার নেই। মানবতাবিরোধী সমস্ত রকম অবস্থানেই তারা সবার আগে থাকবে সেটা প্রত্যাশিত। কিন্তু তার পরেও কয়েকটা ব্যাপার পরিষ্কার করে না বললে চলছে না।

প্রশ্নটা হিজাব সম্পর্কে আমার আপনার কী বক্তব্য আদৌ সেটা নিয়ে নয়। হতেই পারে হিজাব প্রগতির প্রতীক, হতে পারে প্রতিক্রিয়ার প্রতীক। সে বিষয়ে কথা পরে হবে। মূল প্রশ্ন হল, ভারতের সংবিধান হিজাব পরার অধিকার দিয়েছে কী না। যদি দেয়, তাহলে সেটা পাড়ার গুণ্ডা এসে দুম করে কেড়ে নিতে পারে না। হ্যাঁ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ড্রেস-কোড থাকতেই পারে। কিন্তু যদি থাকেও, সেটার একটা মৌল নীতি থাকতে হবে। হিজাব যদি নিষেধের তালিকাভুক্ত হয়, এবং শুধুই হিজাব যদি হয়, তাহলে সেই নীতি মানবাধিকার লঙ্ঘনের পর্যায়ভুক্ত হয়ে পড়ে। এটা প্রথম দিক।

দ্বিতীয় দিক হল, যখন মুশকানের দিকে কতিপয় হিন্দুত্ববাদী যুবক তেড়ে গেল, তখন পুলিশ কী করছিল? একটা মেয়ে কলেজ যাচ্ছে আর পঞ্চাশটা ছেলে তাকে তাড়া করছে, এ তো প্রায় ইভটিজিং-এর পর্যায়ে পড়ে, যাকে হিজাবের পিতৃতন্ত্র ইত্যাদি তত্ব কপচে আটকানো সম্ভব না। পুলিশ প্রশাসন কী করছিল? বামফ্রণ্টের সময়ে যখন দাঙ্গা পরিস্থিতি হয়েছিল জ্যোতি বসু পুলিশকে বলেছিলেন দাঙ্গাবাজ দেখলেই গুলি চালাতে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেছিলেন, দাঙ্গা করতে এলে মাথা ভেঙে দেওয়া হবে। এই প্রশাসনিক দৃঢ়তা কর্ণাটকে ছিল না, এবং না থাকার পেছনে রাজনীতি পরিষ্কার। বিজেপির অ্যাজেন্ডায় সার-জল জুগিয়ে যাওয়া।

তৃতীয়ত, হিজাব পিতৃতান্ত্রিক বা মধ্যযুগীয়, তাই তাকে ব্যান করতে হবে, এই যুক্তির অন্তর্গত সমস্যাটা হল, ভারতের একটা বিশাল অংশের মানুষকে তা মুহূর্তে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। একটি পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের মুসলিম মেয়ে তখনই কলেজ যেতে পারে যদি তার মাথায় হিজাব থাকে। সর্বত্র না হলেও অনেক ক্ষেত্রেই এটা সত্যি। ঠিক যেমন অনেক গ্রামাঞ্চলের বিবাহিত মেয়ে মাথায় ঘোমতা ও সিঁদুর দিয়ে তবেই কলেজে পড়াশোনার সুযোগ পায়। এক্ষেত্রে তার হিজাব বা ঘোমটা কেড়ে নেবার অর্থই হল তাকে শিক্ষালাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা। লিবারাল হবার দায় মেটাতে গিয়ে প্রান্তিক বর্গকে শিক্ষার মত মৌল অধিকারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা কাজের কথা নয়।

এবং চতুর্থত, একটা পক্ষ বিজেপির বিরোধীতা করতে গিয়ে হিজাবকে নারীমুক্তির অংশ হিসেবে তুলে ধরছেন যেভাবে, সেটাও সমস্যাজনক। লড়াইটা শিক্ষার অধিকারের পক্ষে, হিজাব বা বোরখার পক্ষে নয়। শরীরে হিজাব বোরখা বা ধর্মচিহ্ন বহন করাকে নর্মালাইজ করার পক্ষেও নয়। তাহলে যে মুসলিম মেয়েরা বোরখা বা হিজাবকে না বলছেন, ইরানে যেভাবে হিজাববিরোধী নারীবাদী আন্দোলনগুলো হচ্ছে, তাঁদের লড়াইকে অসম্মান করা হয়। হিজাবের বিরুদ্ধেও লড়তে হবে, কিন্তু সেটা লড়বেন শিক্ষার আলোতে আলোকিত মুসলিম মেয়েরা নিজেরা। তাঁদের লড়াই হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রের ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া ফতোয়ার মাধ্যমে হবে না। বরং এতে করে প্রতিক্রিয়াস্বরূপ একটা বড় অংশের সংখ্যালঘু মেয়েরা সেই হিজাবের পক্ষেই দাঁড়াবেন, যেভাবে টুইন টাওয়ার ধ্বংস হবার পর আমেরিকার মুসলিম সমাজে বোরখার প্রচলন বেড়ে গিয়েছিল। এই প্রতিবাদ এগিয়ে যাওয়ার দিকে নয়, বরং সার্বিকভাবে মুক্তির বিপরীতেই দাঁড়িয়ে থাকে। যাঁরা বলছেন হিজাব চয়েসের প্রশ্ন, তাঁরা ভুলে যাচ্ছেন যে চয়েস একটি সামাজিক নির্মাণ, তা আকাশ থেকে পড়ে না। যুগ যুগ ধরে সমাজ সংস্কৃতি ও পিতৃতন্ত্র এই চয়েসকে নির্মাণ করে এত সুচারুভাবে যে একসময়ে তা নর্মালাইজ হয়ে যায়। যেভাবে সিঁদুর বা শাঁখা বা লোহা বাঁধানো ইত্যাদি চিহ্নগুলো হয়েছে। অবশ্যই, যে পরবে তার স্বাধীনতা, কিন্তু তার বিরুদ্ধে সচেতনতাও সমান জরুরী।

মোদ্দা কথাটা হল, এই বিতর্কের মধ্যে পিতৃতন্ত্র বা মধ্যযুগ এনে ফেললে পরিসর এতই বেড়ে যাবে যে তাতে মৌল প্রশ্নগুলো খুঁজে পাওয়া যাবে না। মৌল প্রশ্ন হল, প্রশাসন কোন দিকে অবস্থান করছে? রাজ্যে দাঙ্গার পরিস্থিতি তৈরি হলে পুলিশকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কেন? কেনই বা সংবিধান প্রদত্ত অধিকারকে বাতিল করতে গেরুয়া ফেট্টি পরা গুণ্ডারা রাস্তায় নেমেছে? তাদের আটকাবার জন্য প্রশাসন কই? কলেজ যদি ড্রেস কোড তৈরি করে তবে সেটা সার্বজনীন হওয়া উচিত, সেটার উল্লেখ পাচ্ছি না কেন? এই উত্তরগুলোর মধ্যে দিয়েই সরকারের ইচ্ছা, দায় ও প্রবণতাকে উন্মুক্ত করা সম্ভব। হিজাব কেন পরে আসা উচিত নয়, নাকি উচিত, এগুলো অন্য প্রশ্ন, বৃহত্তর দার্শনিক ক্ষেত্রের জন্য সেগুলো তোলা থাক। আশু সমস্যা যেখানে হয়েছে, কর্নাটকে শিক্ষাক্ষেত্রে প্রায় অঘোষিত ধর্মঘট জারি ও সেই থেকে উদ্ভুত সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা, সেগুলোর নিরসন করতে হলে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ এই মুহূর্তে দরকার। নাহলে বুঝতে হবে এই গণ্ডগোল হিন্দুত্ববাদের অ্যাজেন্ডার অংশ, তখন তাকে আটকাবার জন্য সর্বস্তরের সমাজকে রাস্তায় নামতে হবে।