আরেক রকম ● দশম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা ● ১-১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ● ১৬-৩০ মাঘ, ১৪২৮

প্রবন্ধ

পাঠ প্রতিক্রিয়া - ‘বিবর্তনঃ আদি যুদ্ধ আদি প্রেম’

মধুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়


১৮৫৯ সালে ‘অন দ্য অরিজিন অফ স্পিসিস’ প্রকাশিত হবার পরে স্বভাবতই কার্ল মার্কস বইটি পড়েন, ওই সময়ে মার্কস-এর ‘এ কান্ট্রিবিউশন টু দ্য ক্রিটিক অফ পলিটিকাল ইকোনমি’ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ‘Nothing ever gives me greater pleasure,’ ১৮৬০ সালে মার্কস বলেন, ‘than to have my name linked onto Darwin’s.’[১] শুধু তাই নয়, তাঁর ক্যাপিটাল গ্রন্থে ডারউইনের বিবর্তন বিষয়ক কাজকে তিনি 'যুগান্তকারী' হিসেবে অভিহিত করেন। মানব ইতিহাসের বিবর্তনের নিয়ম ও পদ্ধতি বুঝতে যেমন মার্কস-এর গ্রন্থাবলী সাহায্য করে তেমনই জীবজগতের বিবর্তনের বিধি ও কৌশল জানতে সাহায্য করে ডারউইনের গ্রন্থ। যুক্তিবাদ আলোচনার পূর্বশর্ত হল বিবর্তনবাদ নিয়ে প্রাথমিক ধারণার প্রসার। এহেন গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব, যা পরবর্তীকালে 'ডারউইনবাদ' নামে পরিচিত হয়েছে, তা নিয়ে বাংলার যুক্তিবাদী ও সমাজ সচেতন মানুষ কতটা অবহিত?

বিবর্তন নিয়ে শেষ যে বাংলা বইটি এই বাংলায় বহুপঠিত হয়েছিল, সেটি ষাট বছরের বেশি পুরনো। অথচ বিগত ছয় দশকে বিবর্তন বিজ্ঞানের ব্যাপক আধুনিকীকরণ হয়েছে, এসেছে জিনবিদ্যা, বদলেছে নানা পুরনো চিন্তা ভাবনা। আধুনিকতম বিজ্ঞানকে বাংলা ভাষায় মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার প্রচেষ্টায় এখন এক বিরাট শূন্যস্থান তৈরি হয়েছে, সাধারণ পাঠকের কথা ভেবে বাংলায় বিজ্ঞান চর্চা, মানুষের উদ্ভব ও জন্মরহস্য নিয়ে ভালো বই চোখে পড়ে না। আজকের পাঠকের জন্য বাংলা ভাষায় বিবর্তনবাদ নিয়ে এমন এক গ্রন্থের প্রয়োজন আছে, যা বিজ্ঞানের বস্তুনিষ্ঠ বিষয়মুখী তথ্য সরল ও সরসভাবে পরিবেশন করে সাধারণভাবে সমগ্র পাঠককুলকে আকৰ্ষণ করতে পারবে। বিবর্তনের মূলসূত্রগুলো কী, প্রাকৃতিক নির্বাচন ও যৌন নির্বাচন কেমন করে জীবনের অজস্র জটিলতার সরল ব্যাখ্যা দিতে পারে, আর কীভাবে এক ধরনের বনমানুষ আস্তে আস্তে মানুষ হয়ে উঠল আজকের জেনারেশনের উপযোগী ভাষায় তা লেখা সহজ কাজ নয়।

এই অবস্থায় জয়ন্ত দাসের সদ্য প্রকাশিত বই ‘বিবর্তনঃ আদি যুদ্ধ আদি প্রেম’ পড়তে গিয়ে মনে হল, এক সফর শেষ করলাম। শুধু বাংলা ভাষায় নয়, বিবর্তন নিয়ে এত ভাল বই আমি বহুদিন পড়িনি। এই বইয়ে বিবর্তনবাদ বোঝানোর জন্য বিভিন্ন তথ্যসমূহ বুকের ওপরে পাষাণসম চেপে বসেনি; বরং ক্ষুরধার যুক্তি, মৌলিক উদাহরণ ও সাক্ষ্যপ্রমাণ সহযোগে সরল ও সরস ভাষায় বিবর্তনের কথা তুলে ধরা হয়েছে। বইটি পড়তে গিয়ে আরেক প্রাপ্তি শিবরামীয় পানের সংশ্লেষ, যা কেতাবি বিজ্ঞান বই পাঠের ক্লান্তি দূর করে।

মূল ধারা ও বিভিন্ন সংযোগকারী বিষয়ের পর্যালোচনার জন্য ছোট ছোট বারোটি বাহুল্যবর্জিত অধ্যায়ে বইটি লেখা হয়েছে।

কেন আমি বাবা মায়ের মত দেখতে, প্রথম অধ্যায় শুরু হয়েছে এই প্রশ্ন দিয়ে। লেখক বিভিন্ন ধর্মে সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে যে চর্চা আছে তা আলোচনা করে ডারউইনিয় বিবর্তনের সপক্ষে তথ্যগুলি পেশ করেছেন। বিখ্যাত বিবর্তনবাদী লেখকদের মত বৈরিভাব উদ্রেক না করেও লেখক ধর্মীয় শাস্ত্রের তত্ত্বগুলিকে বিবর্তনের আলোকে পর্যালোচনা করেছেন। সেই সময়ের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাকে চিহ্নিত করে নির্মোহ দৃষ্টিতে যুক্তি দিয়ে শাস্ত্র-তত্ত্বগুলিকে ছিন্ন করে লেখার এই পদ্ধতি বইয়ের পাঠযোগ্যতা বৃদ্ধি করবে।

দ্বিতীয় অধ্যায়ে ডারউইনিয় বিবর্তনের মূল তিনটি সূত্র ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন বোঝাতে গিয়ে তিনি যোগ্য ও অযোগ্য এই শব্দদুটিকে বিবর্তনীয় প্রেক্ষাপটে ব্যাখ্যা করেছেন। যোগ্যতমের জয়, স্বার্থপর জিন এই সব বাজার চলতি শব্দবন্ধ শেষ পর্যন্ত সমাজের স্থিতাবস্থা রাখার পক্ষেই ব্যবহৃত হয়। আসলে বিবর্তনবাদ যে সেই অর্থে যোগ্যতমের জয় শব্দ ব্যবহার করেনি তা অনেকেরই অজানা থেকে গেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে অধ্যায়টি মূল্যবান।

বাঙালির জ্ঞানচর্চার বাইরে বেরিয়ে তৃতীয় অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে প্রাণীর যৌন নির্বাচন নিয়ে। সেখানে বিস্তারিতভাবে এসেছে পোকা থেকে বিভিন্ন ধরণের এপ-এর যৌন নির্বাচন পদ্ধতির কথা, এমনকি মানুষ-মানুষীর আলোচনাও বাদ যায়নি। কেন স্ত্রী-পছন্দ প্রকৃতিতে এত গুরুত্বপূর্ণ? কোন প্রাণীতে পুরুষ-পছন্দ গুরুত্ব পায়? বহুগামিতা কি পুরুষের স্বাভাবিক ধর্ম? প্রাকৃতিক নির্বাচন ও যৌন নির্বাচন পরস্পর বিপরীতধর্মী হলে কোন বৈশিষ্ট্য প্রাণীর মধ্যে প্রাধান্য পায়? এই অধ্যায়ের কিছু অনুশীর্ষর নাম বলি; স্বয়ংবর সভা, আদিম রিপু, হরণ ও মনোহরণ, নীড় ছোট, তুঁহু বিনে, একের জন্য কোটি, বরণমালা তোমার তরে, নিষিদ্ধ কথা। চির-নাবালক বাঙালি সরস ও উৎকৃষ্ট সাবালক আলোচনার পরিসর পাবেন এই অধ্যায়ে।

চতুর্থ অধ্যায়ে আছে মানুষের উদ্ভব ও বিবর্তনের কথা। কবে দু'পায়ে মানব হাঁটল, কীভাবে বিভিন্ন মানব প্রজাতি এই পৃথিবীতে সহাবস্থান ও প্রতিযোগিতা করেছে বিভিন্ন তথ্য প্রমান সহকারে তার আলোচনা করা হয়েছে। তবে এই অধ্যায়টি দীর্ঘ, আরেকটু নির্মেদ হলে ভাল হত।

পঞ্চম অধ্যায়ে লেখক জেনেটিক সাক্ষ্য সহকারে বিবর্তনের ধারাবাহিকতা ব্যাখ্যা করেছেন। বংশগতি ব্যাখ্যা করার প্রয়োজনে এই অধ্যায়ে লেখক জিন, জিনের পরিবর্তন, ডিএনএ, কোষ, ইত্যাদি প্রসঙ্গ এনেছেন। বিজ্ঞানের জটিল বিষয় নিয়ে আলোচনা করলেও সকলের বোধগম্য করবার জন্য চমৎকার সব উদাহরণ দিয়ে আলোচনা শুরু ও শেষ হয়েছে। তবে এই অধ্যায়টিও হয়তো আরও সরল করা যেত।

ষষ্ঠ অধ্যায়ে লেখক আলোচনা করেছেন দেহ গঠনে পূর্ব পরিকল্পনা বিষয়ে যেসব ভাবনা আছে তা নিয়ে। যে কোন প্রত্যঙ্গের আদিরূপে গিয়ে বোঝা যায় প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে কোন পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই ধাপে ধাপে দীর্ঘ সময় ধরে সেই জটিল প্রত্যঙ্গ তৈরি হয়েছে। এই বিষয়ে তিনি বিশেষভাবে আলোচনা করেছেন আমাদের চোখের কথা। কারণ অনেকেই ভাবেন চোখ তো একেবারেই এসেছে, এর তো বিভিন্ন ধাপ সম্ভব নয়। সম্ভব। প্রমাণ সহকারে লেখক দেখিয়েছেন কোন পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই কীভাবে এসেছে আজকের স্তন্যপায়ীদের চোখ।

স্বার্থপর জিন আজকের চলতি লব্জ। লম্বা অনুর এক টুকরো কীভাবে স্বার্থপর হয়? সপ্তম ও অষ্টম অধ্যায়ে লেখক স্বার্থপর জিন ও তার সামাজিক পরার্থপরতা নিয়ে আলোচনা করেছেন। মা ও সন্তানের মধ্যে যে সম্পর্ক সেখানেও কি লুকিয়ে আছে স্বার্থপর জিনের আচরণ? আর সিবলিং রাইভালরি? তার ব্যাখ্যা কি প্রাকৃতিক নির্বাচনের সাহায্যে করা যায়?

নবম ও দশম দুটিই অনু অধ্যায়। এই দুই অধ্যায়ে লেখক আলোচনা করেছেন কীভাবে বিভিন্ন প্রজাতি বিবর্তনের ফলে উদ্ভুত হয়েছে। সীমান্ত ও সঙ্গমের দুরূহতা, সহযোগিতা ও প্রতিযোগিতা কীভাবে বিভিন্ন প্রজাতির বিবর্তনে সাহায্য করে চলেছে উদাহরণ সহযোগে তা আলোচনা করা হয়েছে।

এই বইয়ের বিশেষ মূল্যবান দুটি অধ্যায় হল, একাদশ ও দ্বাদশ অধ্যায়। আমাদের মনে বিবর্তন নিয়ে বিভিন্ন ভুল ধারণা থেকে গেছে, সেই ধারণাগুলি নিয়ে আমরা বিশেষ আলোচনাও করি না। এগুলি হল বিশ্বাস, সংস্কার। শেষ অধ্যায়ে লেখক ধৈর্য সহকারে প্রশ্ন উত্তরের ঢঙে বিবর্তন নিয়ে আমাদের বিভিন্ন ভুল ধারণা ও বিশ্বাস আধুনিক বিবর্তনের আলোকে আলোচনা করেছেন।

বইটির দীর্ঘ বিশ্লেষণধর্মী মুখবন্ধ লিখেছেন জিনবিদ্যার বিশিষ্ট অধ্যাপক, ন্যাশনাল সায়েন্স চেয়ার পার্থ প্রতিম মজুমদার। সুলেখক আশীষ লাহিড়ীও রিভিউ করে বইটির গুরুত্বের কথা জানিয়েছেন।

ছোটখাট কয়েকটি ত্রুটি চোখে পড়েছে। চিত্রগুলো আরও স্পষ্ট হতে পারত। কয়েকটি অধ্যায় একত্রিতভাবে লিখলে হয়তো বইটা সামান্য সংক্ষিপ্ত হত। এসব সত্ত্বেও বলতে পারি, একই সঙ্গে জরুরি ও সুখপাঠ্য এই বই বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার এক মাইলফল। বইটির আরেক শক্তি এর ভাষা। কাঁথা স্টিচের মত ভাষার ফোঁড় তুলে আধুনিকতম বিবর্তনবাদের যুক্তিসমৃদ্ধ আলোচনা বহু সৃষ্টিবাদী মানুষকেও নতুনভাবে ভাবতে সাহায্য করবে, এই আস্থা রাখি।

লেখক জয়ন্ত দাসকে ধন্যবাদ এই কঠিন কাজটি করবার জন্য।


বিবর্তনঃ আদি যুদ্ধ আদি প্রেম
ডা. জয়ন্ত দাস
প্রকাশকঃ গাঙচিল
ডিসেম্বর ২০২১
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ২৬৬
মুদ্রিত মূল্যঃ ৫০০ টাকা


তথ্যসূত্রঃ
১) J Spargo, Karl Marx: His Life and Work, p. 200, New York, 1910.