আরেক রকম ● দশম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা ● ১-১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ● ১৬-৩০ মাঘ, ১৪২৮

প্রবন্ধ

MSP যদি আইন হয়? কিছু যুক্তি-তক্কো ও গপ্পো

রঞ্জন রায়


ভূমিকা

শান্তিপূর্ণ গণ-আন্দোলনের সামনে সরকার নতমস্তক

গত নভেম্বরে গুরুনানক জয়ন্তীর দিনে প্রধানমন্ত্রী টেলিভিশনের পর্দায় দেখা দিয়ে গোটা দেশের জনতাকে সম্বোধন করে ঘোষণা করেন যে উনি এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলতে থাকা কৃষক আন্দোলনের মূল দাবিগুলো মেনে নিয়ে তিনটে কৃষি সংশোধনী আইন বাতিল করতে রাজি। এমনকি, ফসলের ন্যায্য দাম পাওয়ার দীর্ঘকালীন লক্ষ্যে কৃষকদের ফসল বিক্রির নূন্যতম সমর্থন মূল্য নির্ধারণের (এমএসপি) জন্যে আইন বানানোর যে দাবি - সেটিও গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে রাজি।

সবাই একটু অবাক। যে আন্দোলনকে এতদিন বর্তমান শাসকদল ও সরকার এবং তাদের আর্থিক বদান্যতায় পুষ্ট মিডিয়া সমানে দেশদ্রোহী, মাওবাদী এবং খালিস্তানিদের আখড়া বলে গালমন্দ করে এসেছে তাদের সামনে এমন পশ্চাদপসরণ!

কৃষকেরা ঠেকে শিখেছে। তারা বলল যে, খালি তিনটে আইন বাতিল করা মানে তো ব্যাক-টু-স্কোয়ার-এ! এটা দরকারি, কিন্তু যথেষ্ট নয়।

ওঁদের মূল দাবি দুটো -

এক, এমএসপি বা মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইসকে সরকারের নির্দেশের জায়গায় আইন করে দিতে হবে যাতে ওই দামের নীচে ফসল কেনা দণ্ডনীয় অপরাধ হয়।

দুই, ওই ন্যূনতম সমর্থন মূল্য নির্ধারণের সময় স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ মেনে উৎপাদন মূল্যের হিসেব কষার সময় C1-কে নয়, C2-কে যেন ভিত্তি ধরা হয়। স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ ছিল সরকার যেন ন্যূনতম সমর্থন মূল্য প্রত্যেক ফসলের C2-র ১৫০%-কে বিবেচনা করে। তবেই কৃষকেরা অন্ততঃ তাদের ব্যয়ের দেড়গুণ দাম পাবে, অর্থাৎ ফসল বেচে অন্ততঃ ৫০% লাভ ঘরে তুলবে। অর্থাৎ কৃষকেদের কাছে স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশই তাঁদের দাবি; কোন আকাশের চাঁদ নয়।

কারণ ফসলের ন্যায্য দাম পাওয়ার দাবিতে ওরা গত কয়েক বছর ধরে নিয়মিত পথে নেমেছেন।

প্রধানমন্ত্রীর দু’টি বক্তব্য এবং বাজার-পন্থী অর্থনীতিবিদেরা

কিন্তু সেই টেলিভিশন ভাষণে প্রধানমন্ত্রী দু’টো গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন যা নিয়ে মাঠে নেমেছেন কর্পোরেট হাউসের মুখিয়া এবং কিছু বাজারপন্থী অর্থনীতিবিদেরা।

এক, তিনটে কৃষি সংস্কার বিল আনা হয়েছিল কৃষকদের স্বার্থরক্ষার জন্য, কিন্তু সেটা সরকার তাঁদের বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে।

দুই, সরকার সেগুলো শেষমেশ দেশের স্বার্থে ফেরত নিল।

দেশের স্বার্থ বলতে? শাসক দলের মুখপাত্র এবং চ্যানেলে এবং গুরুদ্বারার জত্থেদার জ্ঞানী হরপ্রীত সিংহের একটি বক্তব্য থেকে যা বোঝা গেল - অনেক ভেজাল শিখবিরোধী ও দেশবিরোধী তত্ত্ব এই আন্দোলনে শরিক হয়েছে। তাদের আসল লক্ষ্য রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ও সুরক্ষায় অন্তর্ঘাত! এমনকি হিন্দু-শিখ দাঙ্গা! দেশের জন্য আজীবন নিবেদিত প্রাণ প্রধানমন্ত্রী বৃহত্তর স্বার্থে এগিয়ে এসে এই পদক্ষেপ নিয়ে সেসব ষড়যন্ত্র বানচাল করে দিয়েছেন।

অর্থাৎ, আসলে উনিই জিতেছেন।

আন্দোলনকারী কৃষকদের প্রতি এইসব তকমা গত এক বছর ধরে এতবার লাগানো হয়েছে যে এই প্রচার দাগ কাটল না। নিন্দুকেরা বলতে লাগল - দেশের স্বার্থ দেখলে সাতশো কৃষক মারা যাওয়ার আগেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হত। আসল উদ্দেশ্য উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব, উত্তরাখণ্ডে বিধানসভার আসন্ন নির্বাচনে নিজেদের কৃষকদরদী ভাবমূর্তি নির্মাণ। কারণ আন্দোলনকারী কৃষকদের সবচেয়ে বড় অংশ এসেছে পাঞ্জাব এবং পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের জাঠ সম্প্রদায়ের থেকে। গরজ বড় বালাই।

কিন্তু প্রথম বিন্দুটি, অর্থাৎ কৃষি সংস্কার আইনে কৃষকের স্বার্থরক্ষার প্রশ্নটি, আমাদের মতে আলোচনার যোগ্য। কৃষকরা প্রথম থেকেই বলে আসছেন যে, আমাদের স্বার্থরক্ষার জন্য আনা বিলে আমাদেরই মতামত কেন নেওয়া হোল না!

ফলে প্রধানমন্ত্রী তাঁর এমএসপি নিয়ে আইন প্রণয়নের ব্যাপারটি খুঁটিয়ে দেখার জন্য প্রস্তাবিত বারো জনের কমিটিতে কৃষক আন্দোলনের প্রতিনিধিদের স্থান দিয়েছেন। কিন্তু সেই কমিটির মত বিনিময়ের কোন ফ্রেমওয়ার্ক এবং টাইমলাইন এখনও নির্ধারিত হয়নি, ফলে উক্ত কমিটির আজ পর্য্যন্ত কোন বৈঠক হয়নি। এ’নিয়ে রাকেশ টিকেইত এবং কৃষক আন্দোলনের অন্যান্য নেতারা অসন্তোষ প্রকাশ করে চলেছেন।

অথচ অন্যদিকে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন নিও-লিব্যারাল ইকনমির পক্ষধরেরা এবং কিছু কর্পোরেট হাউসের মুখিয়ারা।

এঁদের প্রচারের দুটো বিন্দু -

এক, কৃষকদের ফার্স্ট রাউন্ডে জিত হয়েছে, সম্মান রক্ষা হয়েছে। এখন ওরা আবেগে ভেসে না গিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখুক ওরা এমএসপি’কে আইন বানাতে বলে কী হারাচ্ছে! দীর্ঘকালীন প্রেক্ষিতে ভাবলে কোন ইকনমিস্টই ওই তিনটে আইনকে ভুল বলবেন না এবং এখন অব্দি কেউ নাকি এমনটি বলেনি।

দুই, মুক্ত বাজারের খোলা হাওয়ায় নিঃশ্বাস নিলে কৃষকদের লাভ। এমএসপি’কে আইন বানানোর জন্য জিদ করলে, শুধু পাঞ্জাব-হরিয়ানা-পশ্চিম উত্তরপ্রদেশই নয়, সমগ্র ভারতের কৃষির বিপুল ক্ষতি হবে। এর জন্য এঁরা অর্থশাস্ত্রের কিছু বাজারপন্থী যুক্তি দিচ্ছেন।

বলা ভাল, প্রথম বিন্দুর শেষ লাইনটি একেবারে ভুল বা অনৃতভাষণ। বিল পাশ হওয়ার সময় থেকেই বেশ কিছু অর্থনীতিবিদ ওই আইনগুলোর সমালোচনায় মুখর হয়েছেন।

কিন্তু কোনটা ঠিক? ভারতের কৃষি অর্থনীতিতে নীতিগত সংস্কারের কি কোন প্রয়োজন নেই? যেমন চলছে তেমনই চলতে দেওয়া উচিত? যদি তা না হয় তাহলে বাজারের হাতে কৃষিকে তুলে দেওয়াই কি একমাত্র সমাধান বা ইকনমিক্সের ভাষায় ‘অপ্টিমাম সল্যুশন’?

ন্যূনতম সমর্থন মূল্য আইনঃ লাভ-লোকসান

ন্যূনতম সমর্থন মূল্য (মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস) অর্থাৎ সরকার যে দামে কৃষকের বিভিন্ন অবিক্রীত শস্য কিনতে রাজি তার ভিত্তি কোন আইন নয়, বরং ‘কমিশন ফর এগ্রিকালচারাল কস্টস এন্ড প্রাইসেস (সিএসিপি)-র রেকমেন্ডেশন, যার জোরে এটি ১৯৬৬-৬৭ থেকে শুরু হয়েছে।

আরম্ভ হয়েছিল গম নিয়ে, এখন তাতে ধান, গন্না, তেল, তিসি সমেত যুক্ত হয়েছে আরও ২১টি আইটেম।

কৃষকদের দাবি সমস্ত কৃষি উপজের জন্য এই সুরক্ষা কবচ আইন করে উপলব্ধ করানো হোক।

এই দাবির বিরুদ্ধে যুক্তিঃ

কৃষি এবং তার সঙ্গে যুক্ত পশুপালন, দুগ্ধ উৎপাদন ইত্যাদিতে কৃষকেরা কেন ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না?

কারণ বর্তমান সরকার নিয়ন্ত্রিত কৃষি উপজের বিপণন ব্যবস্থা বা মন্ডী। এটি খোলা-বাজারের চাহিদা/যোগান নিয়মকে অকেজো করে দিচ্ছে। ফলে চাষিরা দরাদরি করে সুবিধেমত ভাল দাম পাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না। এই ব্যবস্থা সেই সময়ের উপযোগী যখন ভারত খাদ্যশস্য এবং অন্য ফসল উৎপাদনে অনেক পিছিয়ে ছিল। উৎপাদনের মাত্রা দেশের জনসংখ্যার উপভোগের জন্য যতটুকু দরকার তার থেকে কম ছিল। ফলে খাস্যশস্য, আবশ্যক দ্রব্য, তেল ইত্যাদি বিদেশ থেকে আমদানী করতে হত।

বর্তমানে ভারতের কৃষি উৎপাদন জনসংখ্যার দরকারের চেয়ে কম নয়, বরং এখন সমস্যা অতি-উৎপাদনের (ওভারপ্রোডাকশন), এবং সংগঠিত বাজারের অভাবে কৃষি উপজের দাম পড়ে যাওয়ার।

খোলা-বাজারের সমর্থক অর্থনীতিবিদরা যেমন প্রধানমন্ত্রীর ইকনমিক অ্যাডভাইসরি কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিবেক দেবরায় বা অশোক গুলাটিরা (Infosys Chair Professor at ICRIER) বলছেন - এখন শুধু কৃষি পণ্যের খোলা-বাজার ব্যবস্থাই চাষিদের ভাল দাম পাইয়ে দিতে পারে, সরকার নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থার গঙ্গাযাত্রার সময় হয়েছে। তাই ওই তিনটে আইন করা হয়েছিল।

নিও-লিবারেল নিদানঃ নতুন বোতলে পুরনো মদ

এঁরা যা বলছেন তার সার কথা হল কৃষিতে সরকারের নাক গলানো বন্ধ করে বাজারের হাতে তুলে দিতে হবে। আর কে না জানে যে বাজার হচ্ছে রিসোর্স বা সম্পদের অপ্টিমাম বা ন্যায্য বিনিয়োগের সেরা খেলোয়াড়। বাজারের নিয়ম অনুযায়ী খোলা মাঠে খেলতে দিলে সাপ্লাই ডিমান্ড ব্যালান্স হয়ে ভারতের কৃষি উন্নতির শিখরে পৌঁছবে। যেমনঃ

● কৃষিপণ্যের খোলা বাজার হলে যে কেউ বিনা বাধায় কৃষির উপজ যে কোন জায়গায় কিনতে পারবে। কিষান তার পছন্দমত দামে দেশের যে কোন প্রান্তে ফসল বেচতে পারবে। ক্রেতারা মণ্ডীতে এমএসপি দরে কিনতে বাধ্য হবে না।

● ফসলের ব্যাপারীদের মজুত করার ব্যাপারে বাধা সরিয়ে দিলে বড় বিজনেস হাউস এবং স্টার্ট আপ কৃষিতে পুঁজি বিনিয়োগ করতে উৎসাহী হবে। ফলে বড় বড় আধুনিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সাইলো তৈরি হবে। নতুন সব টেকনোলজি এলে ফসলের সংরক্ষণ ভাল হবে। কৃষকের ফসল অবিক্রীত হয়ে পড়ে থাকবে না। সরকারও আমাদের ট্যাক্সের পয়সায় খামোখা বাড়তি ফসল কিনে এফসিআইয়ের গুদামে ভরতে বাধ্য হবে না।

● কন্ট্র্যাক্ট ফার্মিং-এর ফলে কমার্শিয়াল ক্রপের চাষ বাড়বে। তবেই কৃষকের আয় দু'গুণ হবে। খোলা বাজারে বড় পুঁজিপতি এবং রপ্তানীকারীরা বিদেশের চাহিদা অনুযায়ী সেই রকম ফসলের জন্য চাষীদের সঙ্গে লাভকারী চুক্তি করবে। দেশের রপ্তানি বাড়বে, ফলে জিডিপি বাড়বে।

● ভাল দাম পেয়ে ধান-গম ছেড়ে অন্য ফসলের দিকে ঝুঁকলে মোট কৃষিযোগ্য জমির অনেকটাই অন্য ফসলের চাষে গেলে ভূগর্ভস্থ জল কম খরচ হবে। জমির উর্বরতা কম নষ্ট হবে। কৃষিকাজ পরিবেশ সচেতন হবে।

● তাই এমএসপি’কে আইন বানিয়ে বাধ্যতামূলক করা কোন কাজের কথা নয়। তাহলে চাষি খালি ধান ও গম চাষে আটকে থাকবে। রফতানি যোগ্য ফসল উৎপাদনের রিস্ক নেবেনা। ফলে ভাল দাম দিয়ে ফসল কেনার মত ক্রেতা পাবে না। কৃষিতে প্রাইভেট ইনভেস্টমেন্ট বাড়বে না। যেমন, পাঞ্জাবে মোট কৃষির ৭.৪% আসে ফল ও শাকসব্জি উৎপাদন থেকে। আর পোলট্রি ডেয়ারি ইত্যাদি কৃষির প্রায় ৩১.৫%। কিন্তু সে অনুপাতে ফলের রস বা ক্যানিং ইন্ডাস্ট্রি, শস, জ্যাম ইত্যাদির ইন্ডাস্ট্রি নেই। তেমনই দুগ্ধজাত পণ্যের জন্য চিলিং প্ল্যান্ট ও অন্য প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রি সেভাবে গড়ে ওঠেনি। সেই জন্যেই দুগ্ধ উৎপাদকেরা ন্যায্য দাম না পেয়ে সেবার রাস্তায় দুধ ফেলে দিলেন।

● ডিজিটাল মার্কেটিং শুরু হলে কৃষক ঘরে বসে গোটা দেশের বাজারের হাল-হকিকত এবং পণ্যের বাজার দর জানতে পারবেন এবং তাঁর ইচ্ছেমত দেশের যেকোন প্রান্তে বেচতে পারবেন। কমার্শিয়াল লেনদেন খোলাখুলি এবং স্বচ্ছ হবে। কৃষকদের ঠকানো সহজ হবেনা।

● কাজেই উৎপন্ন ফসল কৃষকের ক্ষেত থেকে উপভোক্তার ঘর পর্যন্ত পৌঁছতে যে সাপ্লাই চেইন এবং ভ্যালু চেইন তার মধ্যে সরকারি হস্তক্ষেপ কম করে গোটা পদ্ধতিটা সহজ এবং যুক্তিযুক্ত করতে হবে। তাই রপ্তানির জন্য ইন্সেন্টিভ দিতে সাবসিডি থাকবে এবং ট্যাক্সের দর আরও কম করতে হবে, মন্ডীর চার্জ ৩%-এর বেশি হলে চলবে না। লক্ষ্য হবে ব্যক্তিগত পুঁজির বিনিয়োগকে আকর্ষণ করা, কিন্তু কৃষকের জন্য মাগনায় বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং ইউরিয়ায় চড়া হারে সাবসিডি দেওয়া বন্ধ করতে হবে।

● কৃষক জনসাধারণের সুবিধের জন্য সারে ভর্তুকির বদলে প্রতি হেক্টর হিসেবে ক্যাশ ট্রান্সফার করা যেতে পারে। আর খাদ্য সুরক্ষার জন্য পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম বা রেশন দোকান তুলে দিয়ে মানুষের অ্যাকাউন্টে ক্যাশ ট্রান্সফার করলেই মঙ্গল। সরকারকে খামোখা ধান, চাল, গম, চিনি কিনে ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়ার গোডাউনে ভরতে হবে না। ভারতের কৃষি উৎপাদন আন্তর্জাতিক বাজারের রফতানি হবে।

মোদ্দা কথা, যুক্তি দেওয়া হচ্ছে যে, ওই তিনটি কৃষি সংস্কার আইন কৃষকের স্বার্থেই ছিল। রাজনৈতিক কারণে চাষিরা ভুল বুঝেছে। আরও বড় ভুল হবে এমএসপি’কে আইন করে বাধ্যতামূলক করলে। তাহলে বাজারের নিয়ম কাজ করবে না। নতুন পুঁজি, নতুন বিনিয়োগ হবে না। নতুন টেকনোলজি আসবে না। চাষিরা ভালো দাম পাবে না। ফড়েদের পোয়াবারো হবে।

গুলাটি প্রায় দু’বছর আগে কৃষি সংস্কার বিল পেশ হওয়ার পর বেজায় খুশি হয়ে বলেছিলেন - এই বিলগুলো কৃষি পণ্যের বিপণনের ক্ষেত্রে বিরাট পরিবর্তন আনবে। এ যেন ১৯৯১ সালে যে নতুন শিল্পনীতি (New Industrial Policy) এবং নতুন বিত্তীয় নীতি (New Financial Policy) ঘোষণা করা হয়েছিল তার পরিপূরক।

সত্যিই তো, তিন দশক আগে খোলা বাজারের দর্শনকে মাথায় রেখে নতুন শিল্প ও বিত্তীয় নীতি হয়েছিল, কৃষিই বা কেন বাদ যায়!

বর্তমান সরকারের প্রস্তাবিত কৃষির করর্পোরেটাইজেশন কি স্থায়ী সমাধান নয়? ইউরোপ আমেরিকার অভিজ্ঞতা কী বলে?

● কৃষি অর্থনীতিবিদ দেবেন্দ্র শর্মা বিভিন্ন চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেনঃ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রস্তাবিত কৃষির এই খোলাবাজারের মডেলটি নতুন কিছু নয় বরং ইউরোপ আমেরিকায় অনেক আগে থেকেই পরীক্ষিত একটি ব্যর্থ মডেল। এর ফলে ওদের দেশে কৃষকদের আমদানি বছরের পর বছর সমানে কমছে এবং কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে। প্রথম বিশ্বের ওসব দেশে কৃষি এবং তার পণ্য রপ্তানি মূলতঃ সরকারি সাবসিডি নির্ভর। প্রতি বছর বিশ্ব ব্যাপার সংগঠন বা ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন রীতিমত বৈঠক করে এই ভর্তুকির পরিমাণ ঠিক করে।

● আমেরিকাতে খোলা-বাজারের হাতে কৃষিকে তুলে দেওয়ায় আজ কৃষি উৎপাদনে আমেরিকা বিশ্বে অগ্রগণ্য, কিন্তু কর্পোরেটের নিয়ন্ত্রণ ও কন্ট্রাক্ট ফার্মিং-এর ফলে জনসংখ্যার আগের ১০%-এর তুলনায় এখন মাত্র ২% কৃষিতে মাথা গুঁজে আছেন এবং তার ৮০% হল ছোট এবং সীমান্ত কৃষক। কিন্তু আমেরিকার জিডিপিতে কৃষির যা অবদান তার থেকে অনেক বেশি সরকার সাবসিডি দেয়। কৃষি আয়ের ৪০% আসে সরকারের দেওয়া সাবসিডি থেকে। ইউরোপেও একই অবস্থা।

● কিন্তু ভারতে কৃষির যোগদান জিডিপির ১৭%, অথচ সরকারের কৃষিতে ব্যয় জিডিপির ১% বা বাজেটের ৫%। (টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ০৯/০৩/২০২১)।

● মুখ খুলেছেন বিশ্ব ব্যাংকের প্রাক্তন মুখ্য অর্থনৈতিক পরামর্শদাতা কৌশিক বসু। বলছেন, ভারতের কৃষিতে সংস্কার দরকার। কিন্তু এই তিনটে আইন কর্পোরেটের স্বার্থে তৈরি এবং কৃষকদের জন্যে ক্ষতিকর। উনি দেখিয়েছেন একই মডেলে কন্ট্রাক্ট ফার্মিং করে ফিলিপাইন্সে চাষিরা প্রথম তিন বছরে ভাল দাম পেল। তারপরই কর্পোরেটের বিশাল মজুতের ফলে ওরা বাধ্য হল অনেক কম দামে ফসল বেচতে এবং অনেক এরিয়ায় খাদ্যশস্যের বদলে উন্নত দুনিয়ার চাহিদা অনুযায়ী কমার্শিয়াল ক্রপের চাষ করে বিরাট খাদ্য সমস্যা দেখা দিল। তারপর ম্যানিলায় ব্যাপক ফুড রায়ট।

● অর্থনীতিবিদ উৎসা পটনায়েক বলেছেন যে, কন্ট্রাক্ট ফার্মিং এবং আয় বাড়াতে ফসল রপ্তানির বড় বড় কথার আড়ালে যা হবে আমেরিকা/ইউরোপে ইথানল/মিথানলের জন্য খাঁটি অর্গানিক কাঁচামালের জোগান দিতে খাদ্যশস্যের উৎপাদন কমানো। ফলে আগামী দিনে ভারতেও ফের খাদ্য সমস্যা দেখা দেবে। (দি হিন্দু, ৩০/১২/২০২০)।

তাহলে বিকল্প কী?

কৃষি অর্থনীতিবিদ দেবেন্দ্র শর্মার মতে, এভাবে সাধারণ কৃষকদের - যাদের প্রধানমন্ত্রী ‘অন্নদাতা’ বলেন - কর্পোরেটের দয়ার পাত্র না করে ওদের দরাদরির ক্ষমতা বাড়ানো হোক। যেমন মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইসকে আইন পাশ করে কৃষকদের ‘অধিকার’ বানিয়ে দেওয়া হোক, তবে ওরা স্বস্তি পাবে।

প্রোফেসর রামকুমারের (টাটা ইন্সটিট্যুট অফ সোশ্যাল সায়েন্স) মতে এপিএমসি এবং মন্ডী সিস্টেমের দুর্বলতার সংস্কার প্রয়োজন, ওসব প্রাইভেট সেক্টরকে তোল্লাই দেয়া আইন নয়। যেমন বিহার ও কেরালায় এপিএমসি আইন নেই। মহারাষ্ট্র দু’বছর আগে সংশোধন করেছে। তাতে কি? আজ বিহারের কৃষকের আয় ভারতের অন্যান্য রাজ্যের তালিকায় বেশ নীচের দিকে। এবং ওই অ্যাক্ট না থাকায় বিহার কেরালার বা মহারাষ্ট্রের কৃষিতে দেশি বিদেশি পুঁজিনিবেশ এবং আধুনিকীকরণের বন্যা বয়ে যায়নি।

সরকার কী কী করতে পারে?

চাইলে অনেক কিছুই।

●প্রথমে দরকার কৃষিক্ষেত্রে সরকারি বিনিয়োগ (ইনভেস্টমেন্ট) বাড়ানো। দেশের জনসংখ্যার ৫০% কৃষিক্ষেত্রে যুক্ত, মোট জিডিপির ১৬% আসে কৃষি থেকে। কিন্তু সরকারের কৃষির জন্যে বাজেট বরাদ্দ জিডিপি’র মাত্র ১৫%। এর মধ্যে পশুপালন মৎস্যপালন সব ধরা আছে।

● মন্ডীতে ট্যাক্স কম করে কৃষকদের লাভ দিতে পারে।

● কন্ট্র্যাক্ট ফার্মিং পুরোটাই খারাপ নয়। কিন্তু সরকার সেই কন্ট্র্যাক্টে থার্ড পার্টি হিসেবে সাইন করে কৃষক স্বার্থ দেখতে পারে, আশঙ্কা দূর করতে পারে, যেমনটি ছোট ও ক্ষুদ্র শিল্প এবং ব্যবসায় ব্যাঙ্ক লোন দেবার জন্যে ১০০% গ্যারান্টি দিয়েছে।

● মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস নির্ধারণে স্বামীনাথন কমিটির রেকমেন্ডেশন পুরোপুরি মেনে সি-২ উৎপাদন ব্যয়ের উপর ১৫০% বৃদ্ধির কথা ভাবতে পারে।

খাদ্য-সুরক্ষার প্রশ্ন

কিছু নিন্দুকের আশঙ্কা - চড়া লাভের লোভে যদি বেশির ভাগ কৃষিজমি ফুড ক্রপ (ধান-গম-জোয়ার-বাজরা) ছেড়ে ক্যাশক্রপ বা ইন্ডাস্ট্রির কাঁচামাল তৈরিতে লেগে যায় (সেই নীল চাষের মত), তাহলে ভারত আবার খাদ্যসুরক্ষা হারিয়ে চাল-গম রপ্তানির বদলে ষাটের দশকের মত আমদানি করার দিনে ফিরে যাবে না তো?

এমএসপি’কে আইন করার পক্ষে ভিন্নমতের অর্থনীতিবিদদের আরও বক্তব্যঃ

অধ্যাপক এম কুন্দামল (টাটা ইন্সটিট্যুট অফ সোশ্যাল সায়েন্সের প্রাক্তন অধ্যাপক) বলছেন - কৃষকদের জয় দেখিয়ে দিল যে কৃষি অর্থনীতিকে বাজারের খেয়ালখুশির হাতে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। এখন দরকার সরকারের বিনিয়োগ এবং ভূমি সংস্কার।

● নিশ্চয়ই ধান-গমের চাষ এবং ভূগর্ভস্থ জলের বেহিসাবি দোহন নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিৎ এবং কৃষকদের অন্য ক্যাশ ক্রপ এবং ফসল বৈচিত্র্যের দিকে যাওয়া উচিৎ। কিন্তু সেটা হবে বাজারের হাত ধরে নয়, বরং এমএসপিকে আইন বানিয়ে। অর্থাৎ ন্যূনতম কেনা দাম বেঁধে দিতে হবে - শুধু ধান-গম-তেল-তিসি-ডাল নয় - সমস্ত কৃষি উপজের জন্যে। যেই চাষিরা দেখবে অন্য ফসলে লোকসানের সম্ভাবনা কম, বরং লাভের সম্ভাবনা বেশি - এমএসপি আইন গ্যারান্টির কাজ করছে - তখন তারাও স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে অন্য ফসল চাষের দিকে ঝুঁকবে।

● এর ফলশ্রুতিতে (এমএসপি আইন হলে) ফসল-বৈচিত্র্য বৃদ্ধি পাবে, জমির ‘অপ্টিমাম’ ব্যবহার হবে, কৃষি পরিবেশ-বান্ধব হবে, চাষির আয় বাড়বে। তাই গ্রাম ছেড়ে শহরে ভীড় জমানো কমে যাবে।

● আমাদের অর্থনীতিতে এখনও minimalist state হওয়ার সময় আসেনি। বাজারে অনেক সম্ভাবনা যেমন রয়েছে তেমনই রিস্কও কম নয়। আমাদের ৫০% মানুষ কৃষিতে যুক্ত এবং খাদ্য সুরক্ষার জন্য সরকার দায়বদ্ধ। কাজেই এখনও সরকারের ভূমিকা কৃষিতে না কমিয়ে বরং বাড়াতে হবে।

ডঃ এম এস শ্রীরাম (সেন্টার ফর পাবলিক পলিসি, আই আই এম, ব্যাঙ্গালোর) বলছেনঃ এমএসপি বা ফসল কেনার ন্যূনতম সমর্থন মূল্য যদি আইন হয় তবে তা একদিকে কৃষকদের বাজারের সম্ভাব্য ঝুঁকির বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ হবে এবং চাষবাস আর্থিক দিক থেকে লাভপ্রদ হবে।

উনি আরও বলছেনঃ

● শিল্পের সঙ্গে কৃষির তুলনা হয় না। কৃষি উৎপাদন অনেকটা প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। শিলাবৃষ্টি, খরা, মড়ক, বন্যা এসবের নিয়ন্ত্রণ চাষির ক্ষমতার বাইরে। বড় শিল্পের উৎপাদনে লাভ-লোকসান শেয়ার ধারকদের অনুপাতে সীমিত। পুঁজিতে যার যতটুকু শেয়ার তার ততটুকু সীমাবদ্ধ দায়িত্ব। কৃষিতে চাষির গোটা পরিবার ভোগে। তারপর আছে ‘খাদ্য সুরক্ষা’ নিয়ে সরকারের দায়বদ্ধতা। কাজেই বাজারের হাতে পুরোপুরি ছেড়ে না দিয়ে সরকারকে গ্যারান্টি দিতে হবে।

উপসংহার

আন্দোলনের চরিত্রঃ

● এই কৃষক আন্দোলনটি অবশ্যই, যেমন অধ্যাপক কুন্দামল বলেছেন, সংকীর্ণ অর্থে কোন শ্রেণী সংগ্রাম ছিল না। কিন্তু আমার প্রশ্নঃ বৃহৎ অর্থে? এটি রাষ্ট্রের দখলদারির বিরুদ্ধে সামগ্রিক কৃষি ব্যবস্থার স্টেক হোল্ডারদের লড়াই এবং তার নেতৃত্বে অপেক্ষাকৃত সম্পন্ন কৃষকেরা রয়েছেন। কিন্তু এতে সক্রিয় সমর্থন জুগিয়েছে পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের জাঠ এলাকার ভূমিহীন কৃষকেরা। কারণ, নতুন তিনটে আইন সবচেয়ে বেশি গরীব ও ভূমিহীন কৃষকদের জীবিকার অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করবে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষক-গরীবেরা ছিলেন না। তবু সেই সংগ্রাম সমগ্র ভারতের জনসাধারণের সংগ্রাম ছিল।

● তাই বর্তমান কৃষক আন্দোলন আসলে গোটা দেশের কৃষক ও অ-কৃষক সবার জন্যেও গুরুত্বপূর্ণ। এবং এমএসপি’কে আইন করে দিলে তা ধনী-গরীব-ভূমিহীন নির্বিশেষে সমস্ত কৃষকের (হরিয়ানার হোক কি বাংলার) অস্তিত্ব রক্ষার ঢাল হয়ে দাঁড়াবে।

বর্তমান প্রতিবেদকের দু’টি প্রশ্নঃ

● যদি শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষার জন্য মিনিমাম ওয়েজ অ্যাক্ট অনুযায়ী আইন করে ন্যূনতম মজুরি বেঁধে দিলে যদি শ্রমের বাজারের বা শিল্পে বিনিয়োগের অর্থনীতি বিপন্ন না হয়, তাহলে অন্ন উৎপাদক কৃষকের স্বার্থ রক্ষায় আইন করে ন্যূনতম ফসল কেনার দাম বেঁধে দিলে কেন কৃষিপণ্যের বাজার এবং কৃষিতে বিনিয়োগের অর্থনীতি বিপন্ন হবে?

● আমেরিকার কৃষকদের আয়ের ৪০%-এর উৎস সরকারি ভর্তুকি। ফ্রান্স ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে কৃষিতে ৯০% সরকারি ভর্তুকি দেওয়া হয়। উদ্দেশ্য খাদ্য সুরক্ষায় কোন আঁচ যেন না আসে। তাহলে আমাদের দেশে কেন প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বের অভিজ্ঞতার ওই ছবিটি জনসাধারণের থেকে আড়াল করে কেন কৃষকদের সাবসিডি তুলে দেওয়ার ওকালতি করা হচ্ছে? কার স্বার্থে!


______________________________
১) C1 = উৎপাদনে কৃষকের বাস্তবিক যতটুকু পয়সা খরচ হয়েছে এবং পারিবারিক শ্রমের বাজার মূল্য। C2 = C1 + পুঁজি জোগাড়ের খরচ (ধরুন বাজার দরে ব্যাঙ্ককে দেয় সুদ) এবং জমির দেয় খাজনা (জমি নিজের হলে বাজার দরে খাজনার মূল্য)।
২) অখিলেশ মিশ্র, সিইও, ব্লু ক্র্যাফট ডিজিটাল ফাউন্ডেশন; ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ২৩ নভেম্বর, ২০২১।
৩) ঐ।
৪) ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ২৫ সেপ্টেম্বর।
৫) অশোক গুলাটি, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ১৭ জানুয়ারি, ২০২২।
৬) অশোক গুলাটি, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ১৮ মে, ২০২০।
৭) দেবেন্দ্র শর্মা, ‘চ্যানেল ইন্ডিয়া টুডে’, ২৪শে সেপ্টেম্বর, ২০২০।
৮) moneycontrol.com; June 30, 2019.
৯) এম কুন্দামল, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ১৭ ডিসেম্বর, ২০২১।
১০) এম এস শ্রীরাম, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ১৫ জানুয়ারি, ২০২২।