আরেক রকম ● দশম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা ● ১-১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ● ১৬-৩০ মাঘ, ১৪২৮

প্রবন্ধ

ভাওইয়ার সেকাল ও একাল (স্যালকার দিন আর অ্যালকার দিন)

ড. সুখবিলাস বর্মা


ভাওইয়া-চটকা একটি লোকসংগীত। লোকসংগীত হল লোকের অর্থাৎ কোন নির্দিষ্ট এলাকার জনগোষ্ঠীর সংগীত। আমার Ethnomusicological Study of Bhawaiya, ভাওইয়া, ভাওইয়া-চটকা প্রভৃতি পুস্তকে এই বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা রয়েছে। 'International Folk Music Council' কর্তৃক গৃহীত লোকসংগীতের তিনটি মূল বৈশিষ্ট্য - ধারাবাহিকতা, রূপান্তর বা উদ্ভাবন ও নির্বাচন সব লোকসংগীতেরই অঙ্গ। কিন্তু ভাওইয়ার ক্ষেত্রে রয়েছে এরও অধিক কিছু। উত্তরবঙ্গের সব জেলা, পশ্চিম আসাম, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল অর্থাৎ প্রাচীন কামরূপের সমস্ত অঞ্চল জুড়ে যে লোকসংগীত প্রাচীন কাল থেকে গীত হয়ে আসছে তা ভাওইয়া নামে পরিচিত। এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদের কথা, সৌন্দর্য সুষমার কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই ভাওইয়ার ক্ষেত্রে লোকসংগীতের উল্লিখিত তিনটি বৈশিষ্টের সঙ্গে যুক্ত হয় উত্তরবঙ্গের প্রকৃতি। প্রসঙ্গত উল্লেখ করছি লোকসংগীতের গায়ক, সংগ্রাহক, গবেষক খালেদ চৌধুরীর অভিমত, "আর একটা জিনিস যা আমাকে সবচেয়ে বেশী প্রভাবিত করেছে সেটা হল প্রকৃতি। সেটাই আবার আমার কাছে হঠাৎ revealed হয়, আমি যখন উত্তরবঙ্গের লোকসংগীত শুনি। - উত্তরবঙ্গের গানে এসে দেখছি প্রকৃতি একেবারে সামনে। সেখানকার মোষ, সেখানকার হাতি, সেখানকার পাখি, সেখানকার নদী - সেখানকার সব কিছু নিয়ে গানটা আছে। কখনো রূপকে আসছে, কখনো সেটা সোজাসুজি আসছে। প্রতিটি জিনিস, লতাপাতা সব কিছু ধরে প্রত্যেকের সঙ্গে কথা বলা হচ্ছে। এই যে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের একাত্মভাবে জড়িয়ে থাকা লোকসংগীতের বিশেষ চরিত্র, এটা অন্যান্য জায়গাতেও আছে। তবে আমরা বাংলা গানের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্যটা উত্তরবঙ্গের গানেই সবচেয়ে বেশী পাই।" ভাওইয়া নিয়ে আব্বাসউদ্দীন আহমেদের হৃদয়ের কথাও একই রকমের, "উত্তরবঙ্গের ভাওইয়া গানের বিচার করতে গেলে সকলের আগে উত্তরবঙ্গের মানচিত্রের দিকে আমাদের চাইতে হয়। - খেয়ালি প্রকৃতির এই দুরন্তপনার ভেতরে এই গান জেগে ওঠে বিদ্যুতের মতো ধারালো সুরে - মহিষের পিঠে চড়া হাজারো মইষালের দীপ্ত কণ্ঠশিখায়। সেই সুরে সুর মিলিয়ে বেজে ওঠে কত বেণু, কত দোতারা।"

উত্তরবঙ্গের প্রকৃতিকে নিয়ে এই আবিষ্টতা ও আকুলতাই বিশেষ ভাবে প্রভাবিত করেছে ভাওইয়া গীতিকার গায়ক গায়িকাদের সংবেদনশীল শিল্পীমনকে। উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সংস্কৃতির উপর প্রকৃতির অসীম প্রভাব রাজবংশী জীবনকে এবং সাথে সাথে ভাওইয়া জগৎ ও মননকে যেভাবে প্রভাবিত করেছে সেটা যারা হৃদয় দিয়ে মর্মে মর্মে অনুভব করেছিলেন তাঁদের কাছ থেকেই পাই ভাওইয়ার অন্তর্নিহিত সুর ও সারকথা।

উত্তরবঙ্গের প্রকৃতি ও রাজবংশী জনগোষ্ঠীর জীবনকে কেন্দ্র করেই ভাওইয়ার সৃষ্টি। সুতরাং ধরে নেওয়া যায় যে তৎকালীন কামরূপের রাজবংশী জীবন-মনন এবং প্রকৃতির অমূল্য সম্পদকে প্রতিফলিত করে যে সংগীত ধারা সৃষ্টি হয়েছিল তাঁর নাম ভাওইয়া। কিভাবে, কোন পথে তা আলোচনা করা যাক।

সব লোকসংগীতের মতো ভাওইয়াও আঞ্চলিক-উপরে সেই অঞ্চলের সীমারেখা চিহ্নিত করা হয়েছে। এই এলাকার আঞ্চলিক জীবন, অর্থাৎ কৃষিনির্ভর শ্রমজীবন, আঞ্চলিক ভাষা অর্থাৎ রাজবংশী ভাষা - ভাষার শব্দ সম্ভার, উচ্চারণভঙ্গি ইত্যাদি সমন্বয়ে সৃষ্টি হয়েছে ভাওইয়া। আর একটু পরিষ্কার করে বললে বলা যায় যে, প্রাচীন কামরূপের রাজবংশী শ্রমজীবি মানুষ, মাটি ও প্রকৃতির একাত্ম বাঁধনে সৃষ্টি হয়েছে বিশিষ্ট সুর ও ছন্দ, যা কালক্রমে গড়ে তুলেছে সুর ও গীতরীতির আঞ্চলিক ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্যকে আরও বিশিষ্টতা দিয়েছে আঞ্চলিক কণ্ঠভঙ্গি ও আঞ্চলিক উচ্চারণভঙ্গি। আবার কৃষি সমাজের উৎপাদক থেকে প্রণয়জীবন আলাদা নয় - শ্রম এবং প্রেম এখানে একসাথে মিশে আছে। প্রেম-প্রনয়ের গান তাই পরোক্ষভাবে ফসল উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত। আবার এই প্রক্রিয়ায় কর্মজীবনে প্রকৃতির সঙ্গে তার সখ্য ও দ্বন্দ্ব। লোকসংগীতে তাই প্রেম ও প্রকৃতির অবাধ বিচরণ।

কিন্তু দারিদ্র্য ও বঞ্চনা গ্রামীন জীবনের অভিশাপ। তাছাড়া সামন্তসমাজে পুরুষ প্রাধান্য, বহুবিবাহ, বৈধব্য, শাঁখা-সিঁদুর প্রথা ইত্যাদির মাধ্যমে কৌম গোষ্ঠীসমাজে এসেছে নতুন মূল্যবোধ, নতুন ধ্যান-ধারণা ও ধর্মচিন্তা। ব্রাহ্মণ্যবাদের বৈদান্তিক ধ্যানধারণা এই বিষয়গুলিকে আরও জটিল, আরও কলুষিত করেছে। সবকিছুর পরিণতিতে প্রেম সার্থকতা লাভ করেনি। বিরহ বিচ্ছেদই তাই লোকসংগীতের মূল সুর। এবং ভাওইয়ার ক্ষেত্রে এই অবস্থারই প্রতিফলন। বিরহ বিচ্ছেদ বঞ্চনার প্রাধান্য - সেকালে ছিল, একালেও আছে।

তবে, সব কি একই রকম আছে? না, তা থাকতে পারে না, থাকেওনি। উপরে উল্লিখিত প্রেম-প্রকৃতি, মূল্যবোধ, ধ্যান-ধারণা ইত্যাদির সমন্বয়ে উদ্ভুত পারিপার্শ্বিকতার পরিবর্তনের সাথে সাথে ভাওইয়ার রূপ, প্রকৃতি ও গুণগত মানের পরিবর্তন হয়েছে।

এই প্রসঙ্গে অবশ্যই প্রশ্ন আসে - সেকাল বলতে কত কাল আগের কথা বোঝায়? প্রাচীন কামরূপের জীবন মননের কথা ছেড়ে দিলেও, ভাওইয়ার সেকাল বলতে ষোড়শ শতাব্দীর প্রারম্ভকালকে তো বিবেচনায় আনাই যেতে পারে।১৫১০/১৫১৫ খ্রিষ্টাব্দে শুরু বিশ্বসিংহের রাজত্ব, শুরু হিন্দুকৃত (Hinduised) রাজবংশী জীবন ও সংস্কৃতি। সমাজ নৃতত্ত্বের পন্ডিতদের মতে তার আগে সংস্কৃতায়ন (Sanskritisation) মাধ্যমে রাজবংশীদের ছিল কোচ পরিচিতি, কোচ জীবন। সুতরাং রাজবংশী সংস্কৃতির ভাওইয়ার প্রাচীন/সেকালের রূপ ও প্রকৃতি পেতে হলে ষোড়শ বা সপ্তদশ শতাব্দীতে ভাওইয়া কেমন ছিল তা জানা প্রয়োজন। কিন্তু কোথায় পাবো তেমন ভাওইয়ার নমুনা? সব লোকসংগীতের মতো ভাইয়ারও দলিলভুক্তি (documentation) তো শুরু হয়েছে সেদিন। মাঠে ঘাটে কৃষক শ্রমিকরা কাজ করতে করতে মনের আনন্দে গান করত, সন্ধ্যাবেলা কীর্তন করত সবাই মিলে, হরিলুঠের গান করত। কেউ কখনো সেগুলো লিখে রাখেনি। লেখাপড়াই জানতো না, লিখে রাখার প্রশ্ন আসে কি করে?

১৯৫৩ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত গ্রামের স্কুলে চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময়ে উপরোক্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে ভাওইয়া শিখেছি, ঢোল খোল করতাল বাজাতে শিখেছি। সেই সবকে মূলধন করেই আমার সংগীতজীবন। আমার পূর্ববর্তী প্রজন্মের গায়ক গায়িকাদেরও একই অভিজ্ঞতা। বিংশ শতাব্দীর আগে ভাওইয়ার কি রূপ ছিল, কি বৈশিষ্ট্য ছিল তা কারুর জানা নেই। সবচেয়ে প্রাচীন ভাওইয়ার নমুনা হিসাবে লিখিত দলিল আমরা পাই ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দে গ্রিয়ারসন-এর 'Linguistic Survey of India'-র সৌজন্যে - 'পর্থম জৈবন কালে না হৈল মোর বিয়া, আর কতকাল রহিম ঘরে একাকিনি হয়য়া রে, বিধি নিদয়া', 'ও প্রাণ সাধুরে, যদি সাধু বাণিজ্যে যাও অষ্ট অলঙ্কার খুলিয়া নেও, আমি রব সাধু বাপো মাওয়ের ঘরে রে'। এই গানগুলি গ্রিয়ারসন সংগ্রহ করেছিলেন রংপুরের গ্রামগঞ্জের মাঠ ঘাট থেকে। এই গানগুলি বিশেষ ক'রে 'ও প্রাণ সাধুরে' গানটি উত্তরবঙ্গের সর্বত্র জনপ্রিয়। গ্রিয়ারসন তাঁর সার্ভে রিপোর্টে গানগুলি লিপিবদ্ধ করেছিলেন কিন্তু উল্লেখ করেননি গানগুলি কোন সময়কার, কতো পুরনো। সেটা সম্ভবও ছিল না কারণ তথ্য সংগ্রাহকরা যাদের কাছ থেকে এই তথ্য পেয়েছিলেন তাঁরাই সেই খবর জানতেন না। সুতরাং সেকালের গান, গানের কথা কেমন ছিল সে ধারণা আমাদের নেই। তাছাড়া গান তো কবিতা নয়। গানের প্রধান সম্পদ সুর, কথার উচ্চারণ, স্বরক্ষেপ - সবমিলে যাকে বলা হয় (timbre) টিম্ব্র। লোকসংগীতের ক্ষেত্রে সুরধারা। পুরাতন ভাওইয়ার সুরের পরিচয় পাওয়ার কোন উপায় নেই। এর জন্য কোনও আর্কাইভ তো উত্তরবঙ্গে ছিল না। কোচবিহারের রাজাদের মধ্যে মহারাজ হরেন্দ্র নারায়ণের সুখ্যাতি ছিল সাহিত্য সংস্কৃতি সংগীতের পৃষ্ঠপোষক হিসাবে। তিনিও এ বিষয়ে তেমন উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। তাছাড়া এই রাজবংশের দেশী সংস্কৃতির প্রতি - ভাওইয়া গানের প্রতি তেমন নজর ছিল না। মোট কথা, ভাওইয়ার প্রাচীন সুরের নমুনা আমাদের কাছে নেই। আমরা শুধু অনুমান ভিত্তিতে বলতে পারি যে কাতি, সাইটোল, সোনারায়, গোরখনাথ বা গোন্নাথ পূজার তিন/চার স্বর বিশিষ্ট গানগুলি হোল ভাওইয়া সুরধারার প্রাচীন গান - সেকালের গান।

গ্রিয়ারসনের সার্ভে থেকে উঠে আসা রংপুর, দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি প্রমুখ জেলার গানের লিপির নমুনার পর আমরা এই গানের গ্রামোফোন রেকর্ড পাই গত শতাব্দীর তিরিশের দশকে।

প্রকৃত রূপবৈশিষ্ট্য সহ সর্বসমক্ষে ভাওইয়াকে পরিচিত করার মানসে কোচবিহারের হরিশ্চন্দ্র পাল কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, নিম্ন-আসামের বিভিন্ন গ্রাম থেকে প্রতিভাবান উদীয়মান ভাওইয়া-চটকা গায়ক খুঁজে বের করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন কোচবিহার রাজ্যের দিনহাটা, পরবর্তীতে কোচবিহার শহরের রেডিও, গ্রামোফোন, গ্রামোফোন রেকর্ডের পাইকারি ও খুচরো বিক্রেতা, ফিলিপ্স ও অন্যান্য রেকর্ড কোম্পানিগুলোর ডিস্ট্রিবিউটর। কোচবিহার রাজ্য সহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা ও আসামের ছোটো বড় শহর ও গঞ্জের রেডিও, গ্রামোফোন, রেকর্ড ইত্যাদির ব্যবসা উপলক্ষ্য করে তিনি যেখানেই যেতেন সেখানেই এলাকার ভাওইয়া গায়ক গায়িকার খোঁজ করতেন। এভাবেই হরিশবাবু খুঁজে বের করেছিলেন প্যারিমোহন দাস, কেশব বর্মণ, নায়েব আলি টেপু, কেদার চক্রবর্তী, বিরজা সেনগুপ্ত, গঙ্গাধর দাস, গঙ্গাচরন বিশ্বাস, সুনীল দাস প্রমুখ ভাওইয়া জগতের অনামি বহু গায়ককে। আব্বাসউদ্দীন, সুরেন বসুনিয়া সহ এইসব অমর শিল্পীদের কণ্ঠে তিরিশ থেকে ষাটের দশকে গ্রামোফোন রেকর্ড থেকে ভাওইয়ার যে নমুনা পাই, সেগুলোর মধ্য থেকেই রাজবংশী জীবনের প্রতিনিধিত্বমূলক কিছু গানকে সেকালের গান হিসাবে মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।

ধরা যাক ধনেশ্বর রায়ের কথা। ধনেশ্বর তখন তিরিশের কাছাকাছি বয়সের যুবক। কণ্ঠে সুমিষ্ট সুর, কলমে বাছা বাছা মজার শব্দের গাঁথুনিতে রচিত ভাওইয়া চটকা। তেমনি একখানি সমাজচিত্রমূলক চটকা দিয়ে শুরু তাঁর সংগীত জীবন। 'বাপই মনভোলা! বাপই মনভোলা! তোর সঙ্গে মুই যাবার চাছং বাশকাটার মেলা'। উত্তরবঙ্গের বাঁশকাটার মেলা বেশ নামকরা। বাঁশকাঁটা ছাড়াও আশপাশের অনেক গ্রাম থেকে বহু মানুষ সমবেত হন এই মেলায়। নায়িকা এক উদ্ভিন্নযৌবনা বিধবা; তার মন মজেছে পাড়ার এক যুবকের দোতরার ডাঙ্ আর ভাওইয়া গানে। সে তার মনের মানুষকে নিয়ে মেলায় যেতে চায় - সেখানে তারা সার্কাস দেখবে, জুলাপি খাবে, আরও কত কি মজা করবে। দুজনেই গরিব - যুবকটি পরিশ্রম করে ইতিমধ্যে হাতে কিছু পয়সা করেছে। নায়িকা সে কথা জানে - তাই যুবকের উপর সে ভরসা করতে চায়। 'মোরো আছে বাপই দুই আনা পইসা, মুই করোঙ বাপই তোরে আশা'। বাস্তবে গ্রাম্য মেলায় এই চিত্র বিরল নয়। ধনেশ্বরের দ্বিতীয় গান 'বুড়াটা মাসে মাসে বত্ত পালে হরির নামের মালা জপে, ঐ বুড়াটা বিদুয়া নিবার চায়। বুড়ার বড় ব্যাটা উঠিয়া কয় ওটা কথা হবার নয়, ঐ বিদুয়া মোকে নেওয়া খায়'। এ গানের কথাও বেশ মজার। বাংলায় বিধবা বিবাহ নিয়ে বড় রকমের সমাজ সংস্কারের কাজ করেছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। এই সংস্কার কাজের মধ্য দিয়ে সমাজের কত অংশের মানুষ উপকৃত হয়েছেন এ নিয়ে তর্কের শেষ নেই। কিন্তু গরীব ও নিম্নবর্ণের মধ্যে বিধবা বিবাহ প্রচলিত ছিল। উত্তরবঙ্গে রাজবংশী সমাজে গ্রাম্য গরীব শ্রেণীর মধ্যে বিধবা বিবাহের ('বিদুয়া বিয়াও') প্রচলন ছিল। এই প্রথায় আনুষ্ঠানিক বিয়ে বলে কিছু নেই। বিধবা মেয়ে বা মহিলাটিকে যিনি (তিনি বিপত্নীক হতে পারেন, অবিবাহিত যুবক বা বয়স্ক পুরুষ হতে পারেন) স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করতে চান, তিনি নিজে বা কারুর মাধ্যমে কথাবার্তা চালিয়ে বিধবার সম্মতি আদায় করেন। বিধবাটি যদি বোঝেন যে প্রস্তাবকারী পুরুষটির তাকে ভরণপোষণ দেওয়ার ক্ষমতা আছে এবং এই ব্যবস্থায় তার নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হবে/প্রস্তাবকারীর প্রতি তার মনের দুর্বলতা রয়েছে ইত্যাদি, তবে তিনি রাজি হয়ে যান। একটি নির্দিষ্ট দিনে বিধবা নারী প্রস্তাবকারীর বাড়ীতে চলে যান এবং তার শোবার ঘরে প্রবেশ করেন। (একে বলা হয় 'ঘর সোন্দানি', মানে ঘরে ঢুকে পড়া)। পুরুষটির পক্ষ থেকে গ্রহণ করা হল, অর্থাৎ তিনি বিধবার সব দায়িত্ব নিলেন, বিধবাকে আপন করে নিলেন। তাই এর নাম 'বিদুয়া নেওয়া'। ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে সেদিন বা পরবর্তী কোন দিনে পুরুষটি সাধ্যমত ভোজের ব্যবস্থা করে। ধনেশ্বর রচিত গানটিতে এক বিদুয়া নেওয়াকে কেন্দ্র করে একটি মোটামুটি সম্পন্ন পরিবারের বাপ ব্যাটার মধ্যে কল্পিত লড়াই ঝগড়ার ব্যঙ্গচিত্র।

এরপর সংগীত জীবনে তিনি গেয়েছেন উত্তরবঙ্গের নদী নালা, কৃষক শ্রমিক, মইসাল, গাড়িয়াল নিয়ে অনেক গান।ইতিমধ্যে উত্তরবঙ্গের প্রকৃতিতে, রাজবংশী জীবনে এসেছে প্রভুত পরিবর্তন। আর সেই পরিবর্তনের প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর রচিত গানে, তাই জীবন সায়াহ্নে তিনি লিখেছেন, 'মইষাল বন্ধু আজি হারেয়া গেইছে রে। নদীর পারোত কাশিয়া নাই, কাশিয়া বাড়িত মইষ নাই; মইষের গালাত ঘণ্টী নাই, সেই মৈষের মইষাল নাই রে। আজি গাড়িয়াল বন্ধু মোর হারেয়া গেইছে রে - আজি কাজল ভোমরা বন্ধু মোর হারেয়া গেইছে রে। - আজি ভাওইয়া গান মোর হারেয়া গেইছে রে'।

সেকালের গান ছিল, 'মইষ চরান মোর মইসাল বন্ধুরে মইসাল কোন বা চরের মাঝে', ছিল, 'ও বন্ধু কাজল ভোমরারে', ছিল 'যেদিন গাড়িয়াল উজান যায়, নারীর মন মোর ঝুরিয়া রয় রে'; আর একালের গান, 'মইষাল বন্ধু আজি হারেয়া গেইছে রে। নদীর পারোত কাশিয়া নাই, কাশিয়া বাড়িত মইষ নাই; মইষের গালাত ঘণ্টী নাই, সেই মৈষের মইষাল নাই রে। আজি গাড়িয়াল বন্ধু মোর হারেয়া গেইছে রে - আজি কাজল ভোমরা বন্ধু মোর হারেয়া গেইছে রে'।

এই মনবেদনার ও আক্ষেপের সুর বেজে উঠেছে তাঁর তিস্তা, মুজনাই, দোলঙ, কাজলি নদী বিষয়ক গানে, তাঁর হৃদয়বিদারক দরিয়া ভাওইয়াতে, 'আজি ও মোর গাড়িয়াল ফিরিয়া রে আইসো। গাড়ি ধরিয়া গেইলেন্ রে গাড়িয়াল চিলমারির বন্দরে, পন্থের দিকে চায়য়া রে আছোঙ ফিরিয়া আইসো ঘরে রে, গাড়িয়াল ফিরিয়া রে আইসো। - জন্মের মতে গেইলেন রে গাড়িয়াল উত্তর বাংলা ছাড়ি, তোমার বাদে এলাও রে কান্দোং অভাগিনী নারী রে, গাড়িয়াল ফিরিয়া রে আইসো'।

গ্রামে গরুর গাড়ি, মোষের গাড়ি এখন চোখে পড়ে না। সে জাগায় এসেছে অটো আর টোটো। শচীমোহন বর্মণ তাই লিখেছেন, 'শুনি যাও শুনি যাও টোটোর ডাইবার স্কুল না জাং মুই তোমার গাড়ীৎ আর, মন মোর আউলিয়া যায় কি হইবে পড়ার'।

উত্তরবঙ্গের তরাই, ডুয়ার্স, পাহাড়ের বন জঙ্গলকে কেন্দ্র করে সেকালের প্রধান গান ছিল হাতীর গান, মাহুতের গান, 'হস্তীর কইন্যা হস্তীর কইন্যা বামোনেরো নারী, মাথায় নিয়া তামকলসী ও, সখি হস্তে সোনার ঝারি সখি ও মোর হায় হস্তী কইন্যারে'। এই সব জঙ্গলে হাতী ধরা হতো, হাতীকে দিয়ে কাজ করানো হতো। কিন্তু সরকারী আইনে এখন হাতী ধরা নিষিদ্ধ। তাই একালের ভাওইয়া গীতিকার শচীমোহন বর্মণ লেখেন, 'আগের হাতি জঙ্গল নাই, হাতি পোষার মানসীও নাই, এইল্লা আজি ব্যবসার জিনিস সরকারে চালায়; দুখের কথা না কন আর, মাহুতগিরি হইছে ছাড়খার, নয়া নয়া পশু প্রেমের নয়া নয়া আইন যাতায়, কইন্যা তমার বাদে আজি মন কান্দিয়া বেড়ায়'।

ইতিমধ্যে উত্তরবঙ্গের জঙ্গলকে কেন্দ্র করে পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে নজর দেওয়া হয়েছে আর ভাওইয়াতে ঘটেছে তার প্রতিফলন। ধনেশ্বর রায়ের সেই গান ইতিমধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, 'ও বৈদেইশা বন্ধুরে, ও মোর সোনা বন্ধুরে একবার উত্তরবঙ্গ আসিয়া যান, হামার জাগাখান দেখিয়া যান, মনের কথা কয়া যান রে, হামার কথাও শুনিয়া যান রে'।

একই মানসিকতায় কামেশ্বর রায় নিজের রচনায় গেয়েছেন, 'ও বন্ধু উত্তরবাংলার গৈরব হামার জঙ্গল পাহাড় বন, দার্জিলিঙের টাইগার হিল আর রংবাহারি চা বাগান; নয়ন ভরি উত্তরবাংলা একবার দেখিয়া যান'। ঊনবিংশ শতাব্দীতে উত্তরবঙ্গে চা বাগান পত্তনকালে রাজবংশীরা চা বাগানে কাজ করতে রাজী ছিল না। সেই কারণে ব্রিটিশ সরকার সাঁওতাল পরগণা, ঝাড়খণ্ড, মধ্যপ্রদেশ থেকে কোল, ভীল, সাঁওতাল, মুণ্ডা, ওঁরাও, খরিয়া, খেরিয়া, আসাম থেকে মেচ, রাভা প্রভৃতি আদিবাসীকে এনেছিল চা শ্রমিক হিসাবে কাজে লাগাতে। এখন উত্তরবঙ্গের শুধু তরাই ডুয়ার্স পাহাড় নয়, সর্বত্র চা বাগান। রাজবংশীরা এখন ছোট ছোট চা বাগানের মালিক ও শ্রমিক উভয় ভূমিকা পালন করছে। শচীমোহনবাবু গান লিখছেন, 'তোমার বাড়ীর বগলোতে করছং চা বাগান, তোমার লাগি সদায় মন মোর করে যে আনচান। বাগানোত বসি দোতরা বাজাং দেখং শুধু চায়া মনটারে বুঝানু হয় মুই দেখিলে তোমার ছায়া'।

উদাহরণ অনেক। কিন্তু এক মারাত্মক জায়গার দিকে এগিয়ে চলেছে ভাওইয়া - একালের ভাওইয়া সরকারী প্রচার যন্ত্রের কাজ করছে, সুরেও দেখা যাচ্ছে পরিবর্তন - ব্যাপকভাবে। উল্লেখ করছি শচীমোহনবাবুর গান, 'ও বন্ধুগন, শুনিয়া যাও কন্যাশ্রীর গান, এই প্রকল্প করিয়া দিদি বাড়াইল হামার মান। কইন্যা সন্তান শিক্ষা পাইবে উন্নত হইবে, নিজের পায়ে দাড়েবার উয়াক সাহায্য করিবে, বার্ষিক ৫০০ আর ২৫,০০০ একবার অনুদান'। এমন আরও বহু প্রকল্প নিয়ে রচিত ভাওইয়ার সংখ্যা অনেক। লক্ষ্যনীয় যে একালের গানগুলির বেশীরভাগটাই চলন্তি বা চটকা সুরে - দরিয়া চিতান বোধ হয় ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্নের দিকে।