আরেক রকম ● দশম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা ● ১-১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ● ১৬-৩০ মাঘ, ১৪২৮

প্রবন্ধ

জার্মানিতে নেতাজি - একটা অস্বস্তিকর প্রশ্ন

রজত রায়




নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ১২৫তম জন্মজয়ন্তী উদযাপনের লক্ষ্যে দেশ জুড়ে নানা অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। নেতাজির দেশপ্রেম, বীরত্ব ও আত্মত্যাগের কথা এই উপলক্ষ্যে দেশবাসী বার বার স্মরণ করছেন। এ কথা নির্দ্বিধায় স্বীকার্য যে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে সুভাষচন্দ্র একজন প্রথম সারির দেশপ্রেমিক যোদ্ধা হিসাবেই চিহ্নিত থাকবেন এবং গান্ধীজির মতোই নেতাজিকেও ইতিহাস দেশের এক বিশিষ্ট রাষ্ট্রনায়ক হিসাবেই স্বীকৃতি দিয়ে যাবে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াই শুরু করে যেভাবে তিনি প্রথমে গণআন্দোলনের মাধ্যমে, তার পরে ভারতীয় সেনাদের নিয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজ তৈরি করে যুদ্ধ করেন, এবং শেষে নিজেও বীরের মৃত্যু বরণ করেন, সেই ইতিহাস এখনও দেশবাসীকে রোমাঞ্চিত করে এবং দেশের আপামর মানুষ তাঁকে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করে থাকেন।

নেতাজি ও গান্ধীজি, ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষিতে দুজনেই ব্রিটিশ সরকারের দৃষ্টিতে তাদের প্রধান শত্রু বলে বিবেচিত ছিলেন। দুজনকেই ব্রিটিশ শাসকরা বার বার কারাগারে বন্দী করে দমন করতে চেষ্টা করেছে। শেষবার ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে ব্রিটিশরা নেতাজিকে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে নিজগৃহে অন্তরীণ করে। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। হিটলারের জার্মানি ইউরোপের অধিকাংশ দেশ দখল করে ব্রিটেনকে কোনঠাসা করতে আকাশপথে ক্রমাগত হামলা চালাচ্ছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে দেশকে স্বাধীন করার পক্ষে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি অনুকূল বুঝে এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে নেতাজি যেভাবে গোপনে দেশত্যাগ করে অনেক কষ্ট করে কাবুল, মস্কো হয়ে জার্মানিতে পৌঁছলেন, তারপরে ক্রমে সাবমেরিনে জাপান যাত্রা, দক্ষিণ এশিয়া থেকে আজাদ হিন্দ বাহিনীর ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করা এবং ভারতের মাটিতে তেরঙ্গা পতাকা তুলে ধরার সেই রোমাঞ্চকর ইতিহাস এখন সবারই জানা।

কিন্তু এতদসত্ত্বেও কিছু অস্বস্তিকর প্রশ্ন থেকেই যায় নেতাজির কর্মকাণ্ডকে ঘিরে। হিটলারের জার্মানিতে ১৯৪১ সালের ২ এপ্রিল থেকে ১৯৪৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নেতাজি ছিলেন। ততদিনে জার্মানি ও তার অধিকৃত দেশগুলিতে (যেমন হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, চেকশ্লোভাকিয়া, ফ্রান্স প্রভৃতি) নাৎসিদের ইহুদিনিধন যজ্ঞ পুরোমাত্রায় শুরু হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু নেতাজির ওই সময়ের অজস্র চিঠিপত্র, বক্তৃতা ও বিবৃতির মধ্যে কোথাও এই বিষয়ের কোনও উল্লেখ পাওয়া যায় না কেন? সেটার কারণ কি এটাই যে ভারতের স্বাধীনতাযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জার্মানির কাছ থেকে সামরিক সহ সবরকম সাহায্য পাওয়ার আশায় তিনি সচেতনভাবে ইহুদিনিধন যজ্ঞ (holocaust) নিয়ে কোনও নিন্দা বা সমালোচনা করার পথে পা বাড়াননি? নাকি, তিনি জার্মানিতে থাকলেও নাৎসি সরকারের ঘেরাটোপের মধ্যে নাৎসি অফিসারদের দ্বারা পরিবৃত হয়ে থাকার কারণে বাইরে কী ঘটছিল তা জানার সুযোগই পাননি? দুটি সম্ভাবনাই বিশদভাবে খতিয়ে দেখার অপেক্ষা রাখে। আর সেটা করতে হলে নেতাজির জীবনের শেষ ১২ বছরের কাজকর্ম একটু খুঁটিয়ে দেখা দরকার।

প্রথমে দেখা যাক হিটলারের জাতিদ্বেষ নীতি এবং তারই জের টেনে ইহুদিদের সমূলে ধ্বংস করার (final solution) জন্য নাৎসিরা যে গণনিধন যজ্ঞ করে, সে ব্যাপারে নেতাজি সুভাষচন্দ্র আদৌ অবহিত ছিলেন কি না। কারণ, অস্ট্রিয়ার ইতিহাসবিদ Roman Hayes নেতাজিকে নিয়ে লেখা তাঁর 'Bose in Nazi Germany' বইয়ে একটা যুক্তি দিয়েছেন যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন যখন নেতাজি বার্লিনে যান, তখন তাঁকে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে অনেকটা বিচ্ছিন্ন থেকে একটি ভিলাতে বাস করতে হত, ফলে জার্মানিতে যে ইহুদিনিধন যজ্ঞ চলছিল তার আঁচ তাঁর পক্ষে পাওয়া কঠিন হতেই পারে। এই আপাত বিচ্ছিন্নতার কথা কিছুটা মেনে নিলেও তা জার্মানি এবং জার্মানির পদানত ইউরোপের দেশগুলিতে ইহুদিদের বিরুদ্ধে নাৎসি সরকারের সংগঠিত প্রয়াসের কথা সুভাষচন্দ্রের কর্ণগোচর হতো না, এ কথা বিশ্বাস করা বেশ কঠিন।

প্রথমেই মনে রাখতে হবে যে জার্মানিতে নেতাজি দু'দফায় দীর্ঘ কাল কাটিয়েছেন। প্রথমবার তিনি জার্মানি যান ১৯৩৩ সালের জুলাই মাসে। মার্চ মাসে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে চিকিৎসার কারণে জেল থেকে ইউরোপে যেতে দেয়। নেতাজি প্রথমে ভিয়েনাতে গিয়ে চিকিৎসা করান। তারপর কিছুটা সুস্থ হলে হাঙ্গেরি, চেকশ্লোভাকিয়া, পোল্যান্ড, সুইটজারল্যান্ড ও ইতালিতে গিয়ে সেখানকার সমাজের বিশিষ্ট প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা এবং বিভিন্ন সভায় ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা তুলে ধরেন। ওই সব দেশের বেশ কিছু মানুষের সঙ্গে তাঁর সখ্যতা গড়ে ওঠে। বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং নেতাজির দাদা শরৎচন্দ্র বসুর পৌত্র সুগত বসু তাঁর লেখা নেতাজির জীবনী 'His Majesty's Opponent - Subhas Chandra Bose and India's Struggle against Empire' গ্রন্থে এরকম কয়েকজনের কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন, চেকশ্লোভাকিয়ার তদানীন্তন বিদেশমন্ত্রী এদুয়ার্দ বেনেস (Edouard Benes), যিনি পরে হিটলার চেকশ্লোভাকিয়া দখল করার আগেই তাঁর দেশের প্রেসিডেন্ট হবেন। এ ছাড়া রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে শান্তিনিকেতনে অধ্যাপনা করে যাওয়া ভারততত্ত্ববিদ ভিনসেন্স লেসনি (Vincence Lesny)। লেসনির সঙ্গে নেতাজি ভারত ও চেকশ্লোভাকিয়া দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রাগে একটি মৈত্রী পরিষদ প্রতিষ্ঠার কথা আলোচনা করেন। পরের বছর মে মাসে তার প্রতিষ্ঠা করা হয়। নেতাজির আজাদ হিন্দ বাহিনী ও সরকার গঠন পর্ব থেকে তাঁর অন্যতম সহযোগী এ সি এন নাম্বিয়ারের সঙ্গে প্রাগে দেখা হয়। কারণ, ওই বছর মার্চ মাসেই নাৎসি সরকার নাম্বিয়ারকে জার্মানি থেকে বহিষ্কার করায় তিনি প্রাগে থাকছিলেন। তারপর পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশ শহরে তাঁকে সেখানকার ওরিয়েন্টাল ইনস্টিটিউট থেকে অভ্যর্থনা দেওয়া হয়। ওয়ারশ থেকে নেতাজি ১৯৩৩ সালের জুলাইয়ে ট্রেনে চেপে প্রথম বারের মতো বার্লিনে পৌঁছান। তার আগে সে বছরই ৩০ জানুয়ারি হিটলার তার ঘোষিত ইহুদি-বিদ্বেষ কর্মসূচি নিয়ে জার্মানিতে ক্ষমতায় এসে যায়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে থেকেই কাইজারের সহায়তা নিয়ে দেশকে ইংরেজ শাসনমুক্ত করার জন্য বহু ভারতীয় বিপ্লবী জার্মানিতে এসে থাকছিলেন। তাঁদের মধ্যে ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, লালা হরদয়াল, রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপ উল্লেখযোগ্য। গদর পার্টিকে ভারতের মাটিতে সক্রিয় করে তোলা, রাসবিহারী বসুর সঙ্গে যোগাযোগ করে ভারতে দেশ জুড়ে থেকে ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ করার প্রচেষ্টায় বার্লিন কমিটি সক্রিয় ছিল। কিন্তু জার্মানির সহায়তায় ভারতে অস্ত্রবোঝাই জাহাজ পাঠানোর চেষ্টা ইংরেজরা বিফল করে দেয়। সেই অস্ত্রের ডেলিভারি নিতে অপেক্ষা করতে গিয়েই বাঘা যতীন তাঁর সঙ্গীদের সঙ্গে ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে প্রাণ দেন।

প্রথম মহাযুদ্ধে বিজিত জার্মানি থেকে কাইজারের বিদায়ের সঙ্গেই জার্মানিতে ভারতীয় বিপ্লবীদের 'বার্লিন কমিটি' অনেকটাই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। তার এক যুগেরও বেশি সময়ের ব্যবধানে আবার এক ভারতীয় বিপ্লবী ব্রিটিশদের হাত থেকে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে জার্মানির সাহায্য প্রত্যাশী হয়ে সেখানে এসে পৌঁছলেন - নেতাজি। কিন্তু তার কিছুদিন আগেই জার্মানিতে শক্তিশালী কমিউনিস্ট পার্টি ও সোশ্যাল ডেমোক্রাট পার্টি (এসডিপি) থাকা সত্ত্বেও এই দুই বাম শক্তি নিজেদের সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে জোটবদ্ধ হয়ে নাৎসি পার্টির বিরুদ্ধে নির্বাচনে লড়তে পারল না। আর সেই সুযোগে ১৯৩৩ সালে হিটলার ক্ষমতায় এসে গেল।

প্রথম দফায় সুভাষচন্দ্র ১৯৩৩ সালের জুলাই থেকে ১৯৩৬ সালের মার্চ পর্যন্ত ইউরোপে (জার্মানি সহ) থাকার সুবাদে হিটলারের ইহুদি বিদ্বেষের বহিঃপ্রকাশ দেখার সুযোগ ভালোভাবেই পেয়েছিলেন। কারণ, হিটলার ক্ষমতায় আসার পর ১৯৩৩ থেকেই ইহুদিদের উপর আক্রমণ বাড়তে শুরু করে। সেই সঙ্গে শুরু হয় নাৎসিদের মতাদর্শবিরোধী যাবতীয় বইয়ের - প্রকাশ্যে বহ্ন্যুৎসব। তার পরে ১৯৩৫ সালে আইন করে ইহুদিদের নাগরিকত্ব, সম্পত্তির অধিকার থেকে শুরু করে ন্যূনতম নাগরিক অধিকারগুলি কেড়ে নেওয়া হয়। একই সঙ্গে আরও একটি আইনে জার্মান জাতির 'রক্তের শুদ্ধতা' বজায় রাখতে অন্য জাতির (বিশেষ করে ইহুদিদের) সঙ্গে বিবাহ নিষিদ্ধ করা হয়। তার আগেই ১৯৩৪ সালে জার্মানিতে ইহুদিদের জন্য চিকিৎসা বিদ্যা, আইন শাস্ত্র ইত্যাদি পড়া বন্ধ হয়ে যায়। অচিরেই তাদের জন্য স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজাও বন্ধ হয়ে যাবে। সেনা বিভাগে চাকরিও ইহুদিদের জন্য নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। ইহুদিরা তখন প্রাণভয়ে জার্মানি ছেড়ে পালাতে শুরু করেছে।

নেতাজি ওই পরিস্থিতি সম্পর্কে আদৌ অবহিত ছিলেন না, এমন মনে করার কোনও সঙ্গত কারণ নেই। বরং হিটলারের ইহুদি নীতি যে ভয়ঙ্কর পথে যেতে চলেছে, তা তিনি ভালোই আঁচ করতে পেরেছিলেন। Leonard Gordon তাঁর 'Brothers Against Raj' বইয়ে এবং অধ্যাপক সুগত বসু তাঁর 'His Majesty's Opponent' বইয়ে কিটি কুর্টি (Kitty Kurti) নামে এক ইহুদি চেক মহিলার কথা উল্লেখ করেছেন, যাঁর সঙ্গে ১৯৩৩ সালে বার্লিনেই কিছুটা আকস্মিকভাবে নেতাজির পরিচয় হয়। সুগত বসু জানিয়েছেন, কিটি নেতাজিকে বার্লিনের রাস্তায় হাঁটতে দেখে তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রতি আকৃষ্ট হন। তার অল্পদিন পরেই বার্লিনের আমেরিকান কালচারাল ক্লাবে নেতাজির বক্তৃতা শোনার সুযোগ হয় কিটির। এর পরেই কিটি ও তাঁর স্বামী আলেক্স নেতাজিকে নিজেদের বাড়িতে আমন্ত্রণ করেন। এভাবে অন্তরঙ্গ আলাপচারিতার সুবাদে ওই চেক দম্পতি ক্রমশ নেতাজির ঘনিষ্ঠ হন, এবং পরেও বার্লিনে এলেই নেতাজি কিটিদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। আগেই বলেছি যে ১৯৩৫ সালে আইন করে ইহুদিদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নেয় নাৎসিরা। সেটা ছিল ১৯৩৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর। সেই বছরই ডিসেম্বর মাসে নেতাজি চিঠি লিখে ওই চেক দম্পতির জীবনের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উদ্বেগ জানালেন। বললেন, বার্লিনের অবস্থা ক্রমশই দমবন্ধ হয়ে আসছে, তোমরা এখনও কেন এখানে বসে আছ? ১৯৩৬ সালের জানুয়ারিতে নেতাজি বার্লিনে যান এবং কিটি কুর্টিদের সঙ্গে দেখা করে অবিলম্বে জার্মানি ছেড়ে পালাতে পরামর্শ দেন। নেতাজিকে ওই চেক দম্পতি এই বলে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেন যে তাঁরাও জার্মানি ছেড়ে চেকশ্লোভাকিয়া চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন। নেতাজি তাঁদের সতর্ক করে বলেন, চেকশ্লোভাকিয়া জার্মানির নাগালের বড্ড কাছে, আর ছোট এবং দুর্বল রাষ্ট্র। ওখানে না গিয়ে ভিসা পাওয়া মাত্র আমেরিকা চলে যাওয়াই ভালো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে কিটি কুর্টি নেতাজির সেই পরামর্শ কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করে বলেছেন, নাৎসিদের নেতাজি অত্যন্ত নিচু নজরে দেখতেন, এবং সেটা তিনি তাঁদের সামনে গোপন করার চেষ্টা করতেন না। (Kitti Kurti, Subhas Chandra Bose as I knew him, Firma K L, 1966)

শুধু ইহুদিদের প্রতি তীব্র বিদ্বেষ পোষণ করা ছাড়াও নাৎসিরা যে তাদের উদ্ভট জাতিতত্ত্বে প্রভাবিত হয়ে ভারতীয় সহ অনেক ধরণের মানুষকেই ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখত, তা নিজের অভিজ্ঞতাতেই টের পেয়েছিলেন নেতাজি। মিউনিখের রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে তাঁকে 'নিগার' অভিধায় অভিহিত হয়েছিল। ভারতীয় ছাত্রদেরও যে জার্মানিতে প্রায়শই ঘৃণার শিকার হতে হচ্ছিল, সে কথাও তাঁদের কাছ থেকে জানতে পারেন। নেতাজি ১৯৩৪ সালেই জার্মান বিদেশ মন্ত্রকের কাছে এক লিখিত স্মারকলিপি দিয়ে ভারত-জার্মানির পারষ্পরিক সম্পর্কের অধোগতি নিয়ে তাঁর ক্ষোভ জানান। একই সঙ্গে তিনি জার্মান সংবাদপত্রে ভারতের সম্পর্কে ক্রমাগত নেতিবাচক প্রচারও বন্ধ করার দাবি জানান (Sugata Bose, His Majesty's Opponent, pp. 95)। ১৯৩৬ সালে মিউনিখে হিটলার যখন এক বক্তৃতায় 'Mein Kamph'-এ লেখারই পুনরাবৃত্তি করে দাবি করে, এটাই ভবিতব্য যে শ্বেতকায় জাতিরাই গোটা দুনিয়া শাসন করবে, সঙ্গে সঙ্গে তিনি তার প্রতিবাদ করে বিবৃতি দেন এবং জার্মানিস্থ ভারতীয় ছাত্রদেরও এর কড়া নিন্দা করতে বলেন (Ibid, pp. 109)। জার্মানিতে নাৎসিদের উত্থান দেখার সঙ্গেই ইতালিতে গিয়ে ফ্যাসিবাদের প্রবক্তা এবং স্বৈরতন্ত্রী শাসক মুসোলিনীর সঙ্গেও তাঁর দেখাসাক্ষাৎ শুরু হয়। উপলক্ষ্য ছিল রোমে 'ইতালিয়ান ওরিয়েন্টাল ইনস্টিটিউট'-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, যা কিনা ১৯৩৩ সালের ডিসেম্বর মাসে আয়োজন করা হয়। নেতাজিকে ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য মুসোলিনির তরফে আমন্ত্রণ আসে। ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রায় ৬০০ ভারতীয় ছাত্রকে রেলভাড়া দিয়ে ও এক সপ্তাহের জন্য রোমে থাকার ব্যবস্থা করে এনে মুসোলিনির ভাষণ শোনানো হয়। এ কথা ঠিক যে মুসোলিনির ফ্যাসিবাদী চিন্তাধারার সঙ্গে সুভাষচন্দ্র অপরিচিত ছিলেন না। তবে হিটলারের নাৎসি পার্টি এবং মুসোলিনির ফ্যাসিস্ত পার্টি, দুইয়ের সম্পর্কেই তাঁর যতই নেতিবাচক ধারণা থাকুক না কেন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়ার জন্য যেখানে যতটুকু সাহায্য পাওয়া যেতে পারে, তিনি তা সাগ্রহে নিতে চাইছিলেন। ব্রিটিশ বিরোধিতা - এই একটি মাত্র মাপকাঠিতে নেতাজির কাছে কোনও দেশ, বা কোনও রাজনৈতিক শক্তিই (মতবাদ) অচ্ছুৎ ছিল না।

নেতাজি ছাড়াও আরও দুই বিশিষ্ট ভারতীয়কে মুসোলিনি ইতালিতে আমন্ত্রণ করে নিয়ে এসেছিলেন - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মহাত্মা গান্ধী। ১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথ, এবং ১৯৩১ সালে গান্ধী। ফ্যাসিবাদি রাষ্ট্রের জনক মুসোলিনি তার রাষ্ট্রপরিচালনার স্বপক্ষে বিশ্বে জনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যেই আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় পরিচিত বিশিষ্ট জননেতা, চিন্তাবিদদের ইতালিতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছিল। রবীন্দ্রনাথকে আমন্ত্রণ জানানোর আগে মুসোলিনি দুই প্রাচ্যতত্ত্ববিদ ফরমিকি ও তুচ্চিকে ইতালি থেকে বিশ্বভারতীর অধ্যাপনার কাজে শান্তিনিকেতনে পাঠান। সেই সঙ্গে বেশ কিছু বইও পাঠান বিশ্বভারতীর গ্রন্থাগারে। এর পর যখন রবীন্দ্রনাথকে ইতালিতে আমন্ত্রণ জানান, তখন কবি সরল মনে তা গ্রহণ করেন। ইতালিতে পৌঁছে রবীন্দ্রনাথ বার বার বেনেডিক্ট ক্রোচের সঙ্গে দেখা করতে চান, কিন্তু মুসোলিনির সরকার নানা অজুহাতে তা হতে দেয়নি। বরং রবীন্দ্রনাথের ইতালি সফরকে মুসোলিনি ভালোভাবেই তার ফ্যাসিস্ত সরকারের প্রচারে কাজে লাগায়। ইতালি থেকে রবীন্দ্রনাথ রোমা রঁলার উদ্যোগে সুইজারল্যান্ডে গিয়ে দেখা করেন। তখন রোমা রঁলা তাঁকে ফ্যাসিস্ত শাসনের অন্ধকার দিকগুলি সম্পর্কে অবহিত করেন। এই কাজে ইতালি থেকে গোপনে আরও কয়েকজন এসে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে সেখানকার দমনপীড়ন সম্পর্কে তথ্য দেন। তারপরই ক্ষুব্ধ রবীন্দ্রনাথ ইতালির ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে প্রতিবাদ জানিয়ে এক চিঠি লেখেন যা 'ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান'-এ প্রকাশিত হয়। গান্ধীও ১৯৩১ সালের ডিসেম্বরে দ্বিতীয় গোল টেবিল বৈঠক ব্যর্থ হওয়ার পর লন্ডন থেকে দেশে ফেরার পথে মুসোলিনির আতিথ্য স্বীকার করে ইতালি যান এবং মুসোলিনির সঙ্গে প্রাথমিক সাক্ষাৎকারের পর তার সম্পর্কে কিছুটা ইতিবাচক মন্তব্য করেন। তার আগে লন্ডন থেকে তিনি সুইজারল্যান্ডে রোমা রঁলার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তখন রোমা রঁলা তাঁকে বার বার ইতালি যেতে নিষেধ করেছিলেন, কিন্তু গান্ধী তা না শুনে ইতালি গিয়ে মুসোলিনির সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তার দু'বছর পর মুসোলিনির আমন্ত্রণে সুভাষচন্দ্র রোমে 'ইতালিয়ান ওরিয়েন্টাল ইনস্টিটিউট'-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে মুসোলিনির ভাষণ শোনেন। এর পরেই সুভাষচন্দ্র মুসোলিনি সম্পর্কে মন্তব্য করেন। লোকটা যেমনই হোক, বক্তৃতাটা ভালোই দিয়েছে। এ ছাড়াও মুসোলিনির সঙ্গে নেতাজির মুখোমুখি আলোচনার যে বিবরণ ঐতিহাসিকরা দিয়েছেন, তাতে দেখা যায় যে, আলোচনা বেশ ইতিবাচকই ছিল। (Sugata Bose: His Majesty's Opponent, pp. 165-166)

দুজনের মধ্যে যে বেশ ভালই সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তার প্রমাণও রয়েছে। নিজের শারীরিক অসুস্থতা ও চিকিৎসার কারণে নেতাজির কাজে মাঝে মধ্যেই ব্যাঘাত ঘটলেও এরই মধ্যে তিনি প্রধানত ভিয়েনায় বসে ব্রিটিশদের হঠিয়ে স্বাধীন হওয়ার জন্য ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রচেষ্টার উপর এক বিস্তারিত বই - 'Indian Struggle' লেখেন। বইটি লেখা শেষ হয় ১৯৩৫ সালে। তারপর আচমকাই পিতৃবিয়োগের খবর পেয়ে সুভাষচন্দ্র ১৯৩৫ সালের ৮ জানুয়ারি দেশে ফেরার জন্য জাহাজে ওঠেন। জাহাজে শরীরের পীড়া বেড়ে ওঠায় তাঁকে ইতালির নেপলস বন্দরে নেমে পড়তে হয়। সেখানে একটু সুস্থ বোধ করায় তিনি ক'দিন ইতালিতে থেকে যান। এরই মধ্যে তিনি রুশ দুতাবাসে গিয়ে রুশ বিদেশমন্ত্রী লিতভিনভের সঙ্গে দেখা করেন এবং মুসোলিনির সঙ্গে আবারও দেখা হলে তাঁকে এক কপি 'Indian Struggle' উপহার দেন (Ibid, pp. 100)। মুসোলিনির ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে নেতাজির মনোভাব যে বেশ অনুকূল ছিল, তা বোঝা যায় ১৯৩১ সালের ডিসেম্বরে গান্ধীজি বিলেত থেকে ফেরার পথে ইতালিতে ক'দিন থেকে মুসোলিনির সঙ্গে সাক্ষাৎ করা সম্পর্কে নেতাজির মন্তব্য থেকে। গান্ধীজি ও মুসোলিনির ওই বৈঠককে 'ঐতিহাসিক' আখ্যা দিয়ে নেতাজি বলেন, এই প্রথম গান্ধীজি এমন একজন মানুষের সংস্পর্শে এলেন যিনি আধুনিক ইউরোপে একজন সত্যিকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। ওখানে থাকাকালীন ফ্যাসিস্ত যুব সংগঠনের একটি প্যারেডে উপস্থিত থাকা এবং ফ্যাসিস্ত সরকারের প্রতি গান্ধীজির মনোভাব নিয়ে ফ্যাসিবিরোধী মহলে যতই হৈচৈ হোক না কেন, ভারতের স্বার্থের দিক থেকে দেখলে গান্ধীজি ইতালিতে গিয়ে এক বিরাট কাজ করেছেন।

Mahatma's attitude towards the Fascist authorities, including his attendance at a demonstration of the Fascist Party boys (the Balilla) was seriously criticised in anti-Fascist circles. But there is no doubt that from the point of view of India, the Mahatma rendered great public service by his visit to Italy.

আফসোস একটাই, তিনি আরও বেশিদিন থেকে সেখানকার লোকজনের (মুসোলিনি) সঙ্গে আরও অন্তরঙ্গ সম্পর্ক তৈরি করলেন না কেন। (The Indian Struggle, 1920-1942, Edited by Netaji Research Bureau, 1964, pp. 230-231) । বুঝতে অসুবিধা হয় না যে আর ক'বছর পরেই প্রথমে মুসোলিনি ও পরে হিটলারের সঙ্গে নেতাজির হাত মেলানোর যুক্তিভূমি তখন থেকেই তৈরি হচ্ছিল।

মুসোলিনির আহ্বানে রোমে যাওয়ার সুবাদে নেতাজির কিন্তু একটা বড় লাভ হয়েছিল ইউরোপে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কয়েকশ' ভারতীয় ছাত্রের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ হওয়ায়। তখন নেতাজি জার্মানিতে নয়, অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনাকে ঘাঁটি করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ঘুরে ঘুরে ভারতীয় ছাত্রদের এবং প্রবাসী ভারতীয়দের মধ্যে তরুণ প্রজন্মকে সংগঠিত করতে শুরু করেন। আর সেই সঙ্গে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ইউরোপে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। সে জন্য চেকশ্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, রুমানিয়া, বুলগেরিয়া, তুরস্ক, আয়ারল্যান্ড প্রভৃতি দেশে যান। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে ১৯৩৩ সালের জানুয়ারি মাসে হিটলার জার্মানিতে ক্ষমতায় আসে। সুগত বসু মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, হিটলারের ঘোষিত ইহুদি বিদ্বেষ নীতি কীভাবে genocide বা final solution-এর দিকে এগোবে, তা সুভাষচন্দ্রের কাছে স্পষ্ট ছিল না। কিন্তু হিটলারের আমলে ইহুদিরা যে ক্রমশই বেশি করে বিপন্ন হয়ে উঠবে তা আন্দাজ করতে তাঁর অসুবিধা হয়নি। কারণ, ভারতীয় ছাত্রমহল এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গে মতামত আদান-প্রদানের পরে তিনি একটা ধারণা তৈরি করতে পারছিলেন। তাই ১৯৩৩ সালেই বার্লিনে চেক ইহুদি কিটি কুর্টির সঙ্গে আলাপ হওয়ার পরে তাঁকে তিনি দেরি না করে আমেরিকায় আশ্রয় নিতে পরামর্শ দেন। এ ছাড়াও মোটামুটি ওই সময়েই প্যারিসে গিয়ে আঁদ্রে জিদ ও আঁদ্রে মালরোর মতো দুই বিশিষ্ট ফ্যাসিবিরোধী সাহিত্যিকের সঙ্গে দেখা করে মতবিনিময় করেন।

ইউরোপে তিন বছর কাটানোর ফলে ততদিনে ইতালির ফ্যাসিবাদী সরকার এবং জার্মানির নাৎসি সরকার সম্পর্কে নেতাজির ধারণা অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে যায় এবং তিনি তা প্রকাশ্যেই ব্যক্ত করতেও দ্বিধা করেননি। মুসোলিনির ইতালি আবিসিনিয়া আক্রমণ করলে তিনি তার তীব্র নিন্দা করে প্রবন্ধ লিখতে পারেন (The Secret of Abyssinia and its Lesson, Subhas Chandra Bose, Modern Review, Vol. 61, No. 5, November, 1935), আবার ১৯৪১ সালে হিটলারের জার্মানি সোভিয়েত রাশিয়া আক্রমণ করলে তিনি জার্মান বিদেশমন্ত্রী রিবেনট্রপকে জানাতে দ্বিধা করেন না যে, ভারতীয় জনগণ এই যুদ্ধে জার্মানিকেই আক্রমণকারী হিসাবে দেখবে, এবং ভারতের স্বাধীনতা সম্পর্কে কোনও নীতিগত অঙ্গীকারের ঘোষণা ছাড়াই রাশিয়ার মাটি দিয়ে জার্মান সেনাবাহিনী যত বেশি করে ভারতের কাছে এগিয়ে আসবে, ততই ভারতীয়রা তাকে আর একটি আগ্রাসী বৈরী শক্তি হিসাবেই দেখবে।

নেতাজি দ্বিতীয় ও শেষবার জার্মানি যান ১৯৪১ সালে। নেতাজি গোপনে দেশত্যাগ করে জার্মানিতে পৌঁছেছিলেন ১৯৪১ সালের ২ এপ্রিল। মনে রাখতে হবে তখন হিটলারের সামরিক অভিযানের অভিমুখ ঘুরে গেছে, ব্রিটেনকে পদানত করার বদলে সোভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করার প্রস্তুতি সারা। সেই বছরই মাত্র দু'মাস পরেই ২২ জুন হিটলারের বাহিনী সোভিয়েত রাশিয়া আক্রমণ করবে। এই অবস্থায় জার্মানিকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের যুদ্ধ করতে প্রয়োজনীয় সামরিক সাহায্য চেয়ে নেতাজি বিশেষ সাড়া পাচ্ছিলেন না। তার অবশ্য সামরিক কারণ ছাড়া অন্য কারণও ছিল। হিটলার তার 'Mein Kamph' বইয়ে ইহুদিদের জার্মানির সবচেয়ে বড় শত্রু বলে চিহ্নিত করার সঙ্গেই নিজের উদ্ভট জাতিতত্ব অনুযায়ী ভারত এবং অন্যান্য এশিয় দেশগুলির স্বাধীনভাবে নিজেদের রাষ্ট্র পরিচালনার যোগ্যতাই নেই বলে দাবি করেছিল। হিটলারের মতে, এদের ইউরোপীয় শক্তিগুলির পদানত উপনিবেশ হয়ে থাকাই ভবিতব্য। সাদা চামড়ার ইউরোপীয়দের জাতি হিসাবে উন্নত এবং কালা ও বাদামি চামড়ার মানুষদের নিম্নশ্রেণীর বলেই তার দাবি ছিল। ১৯২৫ সালে প্রথম প্রকাশিত নিজের বই 'Mein Kamph' (আমার সংগ্রাম)-এ হিটলার সাফ দাবি করে, "England will never lose India unless she admits racial disruption in the machinery of her administration (which at present is entirely out of the question in India) or unless she is overcome by the sword of some powerful enemy. But Indian risings will never bring this about. We Germans have had sufficient experience to know how hard it is to coerce England. And apart from all this, I as a German would rather see India under British domination than under of any other nation." (Mein Kamph, pp. 536, Jaico Publishing House, New Delhi, 1988).

"...I mentioned England and Italy as the only countries with which it would be worthwhile for us to strive to form a close alliance and that this alliance would be advantageous I should like here to underline again the military importance of such an alliance." (Ibid, pp. 541)

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত ব্রিটিশ জাতি সম্পর্কে জার্মানির মানুষের মনে যে যথেষ্ট ভ্রান্ত ধারণা ছিল, তা ফ্ল্যান্ডার্সের রণাঙ্গনে ইংরেজ সেনাদের মুখোমুখি হয়ে ভাঙতে শুরু করে। হিটলার নিজেই তা স্বীকার করে বলেছেন,
"The delusion was so profound that the Englishman was looked down upon as a shrewd businessman, but personally a coward even to an incredible degree. Unfortunately, our lofty teachers of professional history did not bring home to the mind of their pupils that it is not possible to build up such a mighty organisation as the British Empire by mere swindle and fraud."

জাতি হিসাবে ইংরেজদের সম্পর্কে ধারণা বদলানোর সঙ্গেই ব্রিটিশদের রাষ্ট্র পরিচালন ব্যবস্থা সম্পর্কেও হিটলারের মুগ্ধতা ছিল।

"I had always hated the Parliament, but not as an institution in itself. Quite the contrary. As one who cherished ideals of political freedom, I would not even imagine any other form of Government. ...A certain admiration which I had for the British Parliament contributed towards the formation of this opinion. ..."

এবং ব্যাখ্যা করে আরও বলে, "The dignified way in which the British House of Commons fulfilled its function impressed me greatly, ...I used to ask myself whether there could be any nobler form of government than self-government by the people." (Ibid, pp. 75-76)

ব্রিটিশদের সম্পর্কে এ হেন মুগ্ধতার সঙ্গেই ভারতীয়দের সম্পর্কে হিটলারের যথেষ্ট নিম্নমানের ধারণা ছিল। ভারত, মিশর সহ আরব রাষ্ট্রগুলি এবং ইউরোপের বল্কান অঞ্চলের ছোট ছোট দেশগুলির ঔপনিবেশিক শক্তির হাত থেকে নিজেদের মুক্ত করার চেষ্টা দেখে হিটলার তাদের "League of Oppressed Nations" বলে ব্যঙ্গ করতেও ছাড়েনি। ভারতকে ব্রিটিশশাসন মুক্ত করতে অন্য দেশের সাহায্য বা সমর্থন চাইতে যে সব ভারতীয় বিপ্নবী ইউরোপে যান (এই বই হিটলার ১৯২০-র দশকের গোড়ায় লেখে, তাই এখানে নেতাজির আগের জমানার নেতাদের প্রতি কটাক্ষ করা হচ্ছে) তাদের সম্পর্কে হিটলারের মন্তব্য, "A few Asiatic mountebanks, who put themselves forward as "the champions of Indian Freedom," (Ibid, pp. 536) (সম্ভবত, অন্য অনুবাদে এটাই 'Asiatic jugglers' করা হয়েছে, যা সুগত বসু তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেছেন।)

বুঝতে অসুবিধা হয় না যে হিটলারের এই মনোভাবের কারণে নেতাজি যতই জার্মানির সাহায্য নিয়ে ভারতকে ইংরেজদের শাসনমুক্ত করতে সচেষ্ট হন না কেন, জার্মানি তাঁর প্রস্তাবে সেভাবে সাড়া দিচ্ছিল না। মনে রাখতে হবে, বার্লিনে পৌঁছনোর এক সপ্তাহের মধ্যেই নেতাজি জার্মান বিদেশ মন্ত্রকের কাছে ভারতের মুক্তিসংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে ইউরোপ, আফগানিস্থান সংলগ্ন উপজাতি এলাকা এবং ভারতে অবিলম্বে কীভাবে কাজ শুরু করা দরকার তা ব্যাখ্যা করে একটি বিস্তারিত নোট দেন। তখনও হিটলারের জার্মানির সঙ্গে স্তালিনের সোভিয়েট রাশিয়ার পারস্পরিক অনাক্রমণ চুক্তি বলবৎ রয়েছে। নেতাজির ওই নোটে তাই জাপানকে পূব দিক থেকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামিয়ে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসনমুক্ত করে ব্রিটিশ নৌশক্তির কোমর ভেঙ্গে দেওয়ার কথা বলার সঙ্গেই সে জন্য জাপানকে চিনের সঙ্গে শান্তি স্থাপনের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়ে নেতাজি প্রস্তাব দেন, এ ব্যাপারে সোভিয়েত রাশিয়া, চিন ও জাপানের মধ্যে মধ্যস্থতাকারীর ভুমিকা নিতে পারে। কিছুদিন পরেই ২৯ এপ্রিল জার্মান বিদেশ মন্ত্রী রিবেনট্রপের সঙ্গে তাঁর প্রথমবার বৈঠক হয় এবং সেখানেই নেতাজিকে জানিয়ে দেওয়া হয় যে তাঁর প্রস্তাব নিয়ে তখনই জার্মানি মাথা ঘামাতে আগ্রহী নয়।

নেতাজি অবশ্য অত সহজে হাল না ছেড়ে জার্মানি কীভাবে ভারতকে ব্রিটিশ শাসনমুক্ত করতে এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতন ঘটাতে কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে, তার একটি সবিস্তার পরিকল্পনা লিখিতাকারে জার্মান বিদেশ মন্ত্রকের কাছে দেন। কিন্তু হিটলারের নাৎসি সরকার তখনই দ্রুত কোনও সিদ্ধান্ত না নিয়ে নানা অজুহাতে নেতাজিকে অপেক্ষা করতে ব'লে চলে। নেতাজির প্রধান দাবিই ছিল, জার্মানি, ইতালি ও জাপানের মিলিত অক্ষশক্তি একযোগে ভারতের স্বাধীনতার অঙ্গীকার করে ঘোষণা করুক। মুসোলিনি তাতে রাজি হলেও হিটলার তখনই রাজি হচ্ছিল না। পরে ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর পার্ল হারবারে মার্কিন নৌবহরকে অতর্কিতে বিমানহানায় ধ্বংস করে এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ব্রিটিশ উপনিবেশগুলিতে একের পর এক আক্রমণ করে জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির হয়ে যোগ দেয়। সমরাঙ্গনে জাপানের দ্রুত সাফল্য দেখে নেতাজি দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় জাপানের সামরিক আনুকূল্যে কোথাও ঘাঁটি গেড়ে প্রবাসী ভারতীয়দের সংগঠিত করে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করার ভাবতে শুরু করেন।

১৯৪২ সালের ২৯ মে নেতাজি ও হিটলারের ঐতিহাসিক সাক্ষাৎ হয়। ওই সাক্ষাৎকারে দুজনের মধ্যে যা যা বিষয়ে কথাবার্তা হয়েছিল, তা নিয়ে এক এক জন ঐতিহাসিক এক এক রকম বিবরণ দিয়েছেন। সুগত বসু জানিয়েছেন, হিটলারের দোভাষী Paul Schmidt ওই বৈঠকের যে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে যে, নেতাজি হিটলারের কাছে পূর্ব দেশে যাওয়ার সম্ভাবনার প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেন। কিন্তু Loenard Gordon তাঁর 'Brothers Against the Raj', 2015, pp. 296-297) বইয়ে দাবি করেন, হিটলারই নেতাজিকে জাপানে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। যদিও সুগত বসুই জানিয়েছেন যে হিটলারের দোভাষী Paul Schmidt-এর দেওয়া তথ্য সবসময় নির্ভরযোগ্য না-ও হতে পারে। কারণ, হিটলার ও নেতাজির মধ্যে ওই বৈঠক ১৯৪২ সালের ২৭ মে হয়েছিল বলে তিনি লিখে রেখেছেন। কিন্তু ফ্যুরারের ডায়েরি, জার্মান সেনাবাহিনীর (Wehrmacht) নথিপত্র অনুযায়ী বৈঠক হয়েছিল ১৯৪২ সালের ২৯ মে। বৈঠকে হিটলার নেতাজিকে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে একটা লেকচার দিয়ে বলে, জার্মানি ভারত থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। (জার্মান সেনাবাহিনীকে) ভারতে পৌঁছতে হলে রাশিয়ার শ্মশানভূমির উপর দিয়ে স্থলপথে যেতে হবে। অন্যদিকে, যুদ্ধে জাপানের অবিশ্বাস্য অগ্রগতির কথা উল্লেখ করে হিটলার নেতাজিকে জাপানের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ করতে প্রস্তাব দেয়। এ ব্যাপারে নেতাজিকে বিমানযাত্রা ঝুঁকিপূর্ণ হবে স্মরণ করিয়ে সাবমেরিনে জাপান যাত্রা করার পরামর্শ দিয়ে হিটলার আরও বলে যে, একটি জাপানি সাবমেরিন শীগগিরই জার্মানিতে পৌঁছবে। সম্ভব হলে সেটিতে করেই নেতাজি যেতে পারেন। আর যদি সেটা সম্ভব না হয় তাহলে জার্মানি তাঁকে সাবমেরিন দিয়ে জাপানে পাঠাবার ব্যবস্থা করবে। Romain Hayes মোটামুটি একই সুরে দাবি করেন যে, হিটলারের পরামর্শই ছিল, নেতাজি এখন থেকে জাপানের উপর বেশি করে নির্ভর করলে এবং ভারতবর্ষের যত কাছাকাছি সম্ভব ঘাঁটি গেড়ে বসে কাজ চালালে ভালো করবেন। সাক্ষাৎকারের শুরুতেই নেতাজি হিটলারকে একজন 'প্রবীণ বিপ্লবী' (old revolutionary) বলে সম্বোধন করেছিলেন বলে Leonard Gordon এবং Romain Hayes উভয়েই উল্লেখ করেছেন। Hayes লিখেছেন, সুভাষচন্দ্রের ওই সম্বোধন (প্রবীন বিপ্লবী) শুনে হিটলার একটু অবাকই হয়েছিল। তবে ভারতের স্বাধীনতা সংক্রান্ত ঘোষণা করার ক্ষেত্রে জার্মানির কোথায় অসুবিধা তা ব্যাখ্যা করে হিটলার জানায়, এমন কিছু অঙ্গীকার প্রকাশ্যে করা ঠিক হবে না, যা রক্ষা করার সামরিক সামর্থ্য তাদের হাতে এখনই নেই। (Minutes of the Bose-Hitler meeting, SCBNG, No. 66; NCW/11, No. 22) বৈঠকে নেতাজি দুটি প্রসঙ্গ তোলেন বলে Hayes দাবি করেন - প্রথমত, যদি জার্মানি এখনই ভারতের স্বাধীনতা সংক্রান্ত অঙ্গীকারের কথা ঘোষণা করতে প্রস্তুত না-ও থাকে, তবুও অন্তত 'Mein Kamph' বইয়ে যে হীনভাবে ভারত ও ভারতীয়দের সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়েছে, সেটা সংশোধন করা হোক। কারণ, ব্রিটিশরা সেটা ব্যবহার করে ভারতীয়দের বিরুদ্ধে প্রচার চালাচ্ছে। উল্লেখ্য, ১৯৪১ সালের ২৯ নভেম্বর বার্লিনে রিবেনট্রপের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠকে নেতাজি এই বিষয়টি তুলে বলেছিলেন যে, 'Mein Kamph'-এ ভারত সম্পর্কে এমন কিছু কথা বলা হয়েছে যা ব্রিটিশরা তাদের প্রচারে ভালোভাবেই ব্যবহার করছে। হিটলারের ভারত সম্পর্কে মনোভাব কী তা ভারতবাসীর জানা প্রয়োজন। রিবেনট্রপ তখন ওই প্রসঙ্গ এড়িয়ে বলে যে, তিনি শীঘ্রই হিটলারের সঙ্গে নেতাজির একটা বৈঠকের ব্যবস্থা করবেন। তার পরে ১৯৪২ সালের ২৯ মে বার্লিনের রাইখ চ্যান্সেলরিতে হিটলারের সঙ্গে নেতাজির ওই ঐতিহাসিক বৈঠক হয়। হিটলার অবশ্য ওই প্রসঙ্গটি অতীতের ব্যাপার বলে উড়িয়ে দেয়। আর নেতাজির দ্বিতীয় প্রসঙ্গটি ছিল যুদ্ধের পরে জার্মানি যেন ভারতকে সমর্থন করা অব্যাহত রাখে, যাতে ভারতকে জাপানের উপর একান্তভাবে নির্ভর করতে না হয়। হিটলার অবশ্য ভবিষ্যতে ভারতের প্রতি সাহায্য শুধুই অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সীমিত রাখার কথা বলে, কারণ সামরিক সাহায্য তখনই করা সম্ভব যদি সেটা জার্মানির নাগালের মধ্যে হয়।

ওই বৈঠকের কথাবার্তায় হিটলারের তরফে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য যথেষ্ট সহায়তার ইচ্ছার অভাব দেখে নেতাজি কিছুটা হতাশই হন - একথা বিভিন্ন ভারতীয় ও জার্মান সূত্রে জানা যায় বলে Leonard Gordon মন্তব্য করেন। বাস্তবিক, ততদিনে হিটলারের সেনাবাহিনী সোভিয়েত রাশিয়া আক্রমণের (Operation Barborossa) সব রকম প্রস্তুতি সেরে ফেলেছে। আর ক'দিন পরেই ২২ জুন তা শুরু হবে। তখন ভারত নিয়ে ভাবার আগ্রহ বা সময় হিটলারের নেই। বরং নেতাজিকে জাপানে পাঠিয়ে দিয়ে সমস্যাটা ঝেড়ে ফেলতেই আগ্রহ বেশি ছিল। হিটলারের সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের ওই বৈঠকের খবর জানাজানির পর আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় ঝড় ওঠে। ক'দিন অপেক্ষা করে নেতাজি সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন। সুগত বসু দেখিয়েছেন, অক্ষশক্তির সঙ্গে এভাবে ঘনিষ্ঠ হওয়ার দরুণ তাঁর ভাবমূর্তি যে মলিন হতে পারে, সে বিষয়ে সচেতন থেকেই তিনি চেষ্টা করেন স্বাধীন ভারতের অভ্যন্তরীণ নীতি ও বৈদেশিক নীতির মধ্যে স্পষ্ট সীমারেখা নির্দিষ্ট করতে। "While standing for full collaboration with the Tripartite Powers in the external sphere, I stand for absolute self-determination for India where her national affairs are concerned, and I shall never tolerate any interference in the internal policy of the Free Indian State." পাছে এ নিয়ে কোনও সংশয় থাকে, তাই তিনি আরও জোর দিয়ে বলেন, "...no one should make the mistake of concluding that external collaboration with the Tripartite Powers meant acceptance of their domination or even of their ideology in (India's) internal affairs." (His Majesty's Opponent, pp. 221-222) Romain Hayes ওই ১২ জুনের সাংবাদিক সম্মেলনের কথা জানিয়ে লিখেছেন যে, নেতাজি হিটলারের সঙ্গে তাঁর বৈঠকের কথা সংক্ষেপে উল্লেখ করার সঙ্গেই এটাও জানাতে ভোলেননি যে এই দুই ডিক্টেটর (হিটলার ও মুসোলিনি) ভারতের বাইরে ভারতবাসীর সবচেয়ে বড় বন্ধু। একই সঙ্গে তিনি নিজের সম্বন্ধে অক্ষশক্তির হাতের পুতুল এই অপবাদ খারিজ করে বলেন যে, যুদ্ধের পরে স্বাধীন ভারতের পুনর্গঠনের ব্যাপারে ভারতবাসীরাই সব সিদ্ধান্ত নেবে।

সুভাষচন্দ্রের আপোষহীন দেশপ্রেম প্রশ্নাতীত। তাই তিনি যখন বলেন যে, স্বাধীন ভারতের ক্ষেত্রে কোনও বিদেশি শক্তিই (অক্ষশক্তি) নাক গলাতে পারবে না, তখন তাঁর আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা নিয়ে কোনও প্রশ্নই উঠতে পারে না। কিন্তু একটা প্রশ্ন, যা দিয়ে বর্তমান প্রবন্ধটি শুরু হয়েছে, তা থেকেই যায়। সেটা নৈতিকতার প্রশ্ন। নিজেকে একজন বরেণ্য রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে গড়ে তোলার পরে নেতাজি মুসোলিনির স্বৈরাচার এবং হিটলারের ইহুদি নিধন যজ্ঞের নিন্দা করলেন না কেন? হিটলারের আতিথ্য গ্রহণ করার পরে নাৎসি সরকারের ঘেরাটোপের মধ্যে থেকে বাইরে কী ঘটছিল, তা নেতাজির জানার উপায় ছিল না বলে Romain Hayes যে অনুমান করেছেন, তা কিন্তু ঐতিহাসিক তথ্য দেখলে টেকে না। সুভাষচন্দ্র মস্কো হয়ে বার্লিন পৌঁছনোর পর তাঁর সঙ্গে নিয়মিত সম্পর্ক রাখার জন্য জার্মান বিদেশ মন্ত্রকে একটি 'স্পেশ্যাল ইন্ডিয়া ডিভিশন' খোলা হয় এবং সেখানে Adam von Trott zu Solz ও তাঁর সহকারী হিসাবে Alexander Werth দায়িত্ব দেওয়া হয়। von Trott একজন Rhodes Scholar হিসাবে অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করেছেন, অভিজাত জার্মান সমাজের সদস্য হওয়ায় কিছুটা রক্ষণশীল মানসিকতার মানুষ, কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক আইনজ্ঞ হিসাবে বহু দেশের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন, কিন্ত গোপনে নাৎসিবিরোধী। ১৯৪৪ সালের জুলাইয়ে হিটলারকে হত্যা করার যে বিফল প্রচেষ্টা জার্মান সেনাবাহিনীর পদস্থ অফিসাররা করেছিল, সেই ষড়যন্ত্রের অংশীদার হিসাবে তাঁকে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়। নেতাজির বিশ্বস্ত সহকর্মী এবং বার্লিনে Free India Center-এর দায়িত্বপ্রাপ্ত এ সি এন নাম্বিয়ার সম্ভবত von Trott-এর আসল পরিচয় জানতেন। কিন্তু Leonard Gordon জানাচ্ছেন যে, নেতাজি এবং জার্মানির বিদেশ মন্ত্রকের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সংযোগরক্ষাকারীর ভূমিকায় থাকলেও von Trott ও নেতাজির মধ্যে আদৌ কোনও বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেনি। এই দাবির সপক্ষে তিনি von Trott-এর স্ত্রীকে লেখা চিঠি (৮ আগস্ট, ১৯৪১) উদ্ধৃত করেছেন। তিনি জানিয়েছেন যে von Trott নেতাজিকে তাঁর কাজে যথাসম্ভব সাহায্য করলেও তাঁর মনে হয়েছিল যে নাৎসি স্বৈরাচারী শাসন কীভাবে জার্মান ট্র্যাডিশনের যা কিছু ভালো তা সব ধ্বংস করে চলেছে, তা নেতাজি বুঝতে পারেননি। (Leonard Gordon, Brothers Against the Raj, pp. 268) অথচ নেতাজি ১৯৪২ সালে গোয়েবসলের 'Der Angriff' পত্রিকায় একটি লেখায় সম্ভবত ভারতীয়দের আর্যজাতি হিসাবে যুক্তিবিস্তার করে একটি প্রবন্ধ লেখেন যাতে ইহুদিদের বিরুদ্ধে কিছু বিরূপ মন্তব্য থাকায় ইহুদিদের The Jewish Chronicle নেতাজিকে "India's Anti-Jewish Quisling" বলে তীব্র সমালোচনা করে। তবে পরে নেতাজির লেখা সম্বলিত গোয়েবলসের ওই পত্রিকাটি পাওয়া যায়নি। (Ibid, pp. 399)

১৯৪১ সালের ২ নভেম্বর বার্লিনে নেতাজির Free India Center-এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। সেখানে নেতাজির উদ্যোগে একদল ভারতীয় ছাত্র ও পেশাদার কর্মী জড়ো হন। তাঁদের মধ্যে নাম্বিয়ার, আবিদ হাসান, এন জি স্বামী, প্রমোদ সেনগুপ্ত, জে কে ব্যানার্জি, হবিবুর রহমান, গিরিজা মুখার্জি প্রমুখ ছিলেন। এঁদের মধ্যে নাম্বিয়ার, আবিদ হাসান, স্বামী প্রমুখ ঘোরতর নাৎসিবিরোধী এবং প্রমোদ সেনগুপ্তের মতো অনেকেই ছিলেন বামপন্থী, কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় এঁরা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আটকে পড়েছিলেন। নেতাজির সঙ্গে কাজে নামার পরে নাৎসিরা এঁদের থেকে নজর ফিরিয়ে রাখতে শুরু করে। ততদিনে জার্মানি ও ইতালিতে কমিউনিস্ট পার্টি নাৎসি ও ফ্যাসিস্ত সরকারের আক্রমণে ধ্বংস হয়ে গেছে। বহু নেতা ও কর্মী মৃত, অনেকেই জেলে ও কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে এবং বাকিরা ভিনদেশে পলাতক। এই যখন অবস্থা তখন তা নেতাজির সঙ্গে থাকা বামপন্থী ভারতীয়দের অজানা থাকার কথা নয়। আর সে কারণেই ইহুদি সহ সবরকমের 'বিরোধী শক্তি'কে আগাগোড়া নির্মূল করার জন্য হিটলারের পরিকল্পনা ও কর্মকাণ্ড এই ভারতীয়দের মাধ্যমে নেতাজির কর্ণগোচর হওয়াটাই স্বাভাবিক। অথচ যে নেতাজি হিটলারের সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের পরেই জার্মান বিদেশমন্ত্রকের প্রতিনিধিদের সামনে তার তীব্র নিন্দা করেন, সেই নেতাজিই হিটলারের ইহুদি নিধন যজ্ঞ সম্পর্কে মৌনব্রত ধারণ করেন। তিনি যে এটা অজ্ঞানতাবশতঃ করেননি, বরং সচেতনভাবেই করেছেন তা স্পষ্ট হয়ে যায় যখন তাঁকে বলতে শুনি, "It would be a grievous mistake to be carried away by ideological considerations alone. The internal politics of Germany or Italy or Japan do not concern us - they are the concern of the people of those countries." (His Majesty's Opponent, pp. 221)

বলতে দ্বিধা নেই, ইহুদি নিধন যজ্ঞ বা গণতন্ত্রকে হত্যা করে স্বৈরাচারী শাসন প্রতিষ্ঠাকে কোনও যুক্তিতেই সেই দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে মুখ ফিরিয়ে থাকা যায় না। এখানেই নৈতিকতার প্রশ্নটি ওঠে। যদি রাষ্ট্রনায়ক নিজেই এত বড় গণহত্যা সম্পর্কে জেনেও মুখ ফিরিয়ে থাকেন, তা হলে তা অন্যায় বলেই গণ্য করতে হবে। সুগত বসু তাঁর বইয়ে যে অধ্যায়ে এই প্রশ্নটি নিয়ে আলোচনা করেছেন, তার শীর্ষকটাই ইঙ্গিতবহ - The Terrible Price of Freedom. কিছুটা কৈফিয়তের সুরেই সুগত বসু মন্তব্য করেন,
Bose's single-minded absorption in the cause of India's independence led him to ignore the ghastly brutalities perpetrated by the forces of Nazism and fascism in Europe. By going to Germany because it happened to be at war with Britain, he ensured that his reputation would long be tarred by the opprobrium that was due the Nazis. A pact with the devil: such was the terrible price of freedom. (Ibid, pp. 203) তিনি এটাও বলেছেন যে যাদের সঙ্গে তিনি হাত মেলাচ্ছেন সেই নাৎসি সরকারের ক্ষতিকারক চরিত্র সম্পর্কে নেতাজি অবশ্যই অবগত ছিলেন। যদিও নাৎসিরা কতটা ভয়ঙ্কর ক্ষতিকারক হয়ে উঠতে পারে তার সম্যক ধারণা ১৯৪২ সালে তাঁর ছিলনা। কিন্তু সেই সঙ্গে তিনি এটাও মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, স্বৈরাচারী রাষ্ট্রনায়কদের সঙ্গে মৈত্রী করার ক্ষেত্রে নেতাজি একা নন। রুজভেল্টও তো স্তালিনের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। (Ibid, pp. 221) সুগত বসু এটা ঠিকই বলেছেন যে, ১৯৪২ সালে হিটলার ও নাৎসিদের ভয়ঙ্কর চেহারা, বিশেষ করে ইহুদি নিধন যজ্ঞের কথা আন্তর্জাতিক দুনিয়ার সামনে সেভাবে আসেনি। জার্মান অধিকৃত পোল্যান্ডে গড়ে তোলা আউশভিৎজ (Auschwitz) কনসেনট্রেশন ক্যাম্প হিটলারের Final Solution কর্মকাণ্ডের সবচেয়ে কুখ্যাত প্রতীক, যেখানে অন্তত ১৫ লক্ষ মানুষকে গ্যাস চেম্বারে হত্যা করা হয়। তাদের ৯০ শতাংশই ইহুদি। এই আউশভিৎজ ১৯৪৫ সালের জানুয়ারি মাসে সোভিয়েত লাল ফৌজ মুক্ত করলে হিটলারের ইহুদি নিধন যজ্ঞের কীর্তি আন্তর্জাতিক দুনিয়ার নজরে আসে। নেতাজি তখনও বার্মা রণাঙ্গনে আজাদ হিন্দ বাহিনীর নেতৃত্বে রয়েছেন। কিন্তু তখনও তাঁর মুখে এ নিয়ে কোনও কথা শোনা যায়নি। ১৯৪৫ সালের মে মাসে জার্মানি নিঃশর্তে আত্মসমর্পণ করলে কিন্তু নেতাজি মুখ খুলেছিলেন। বলেছিলেন, হিটলার একসঙ্গে দুই ফ্রন্টে যুদ্ধ করতে গিয়েই পরাজয় ডেকে এনেছে। হিটলারের সঙ্গে হাত মেলানোর জন্য নেতাজির সমর্থনে প্রায়ই এটা বলা হয় যে, 'শত্রুর শত্রু আমার মিত্র' এই চাণক্যনীতিতে কোনও দোষ নেই। কিন্তু এখানে হিটলারের সঙ্গে হাত মেলানো নিয়ে প্রশ্ন করা হচ্ছে না, প্রশ্ন তোলা হচ্ছে ইহুদি নিধন যজ্ঞ সম্পর্কে একটাও নিন্দাবাক্য উচ্চারণ না করে নীরব থাকার জন্য। একজন প্রথম সারির দেশপ্রেমিক রাষ্ট্রনায়ক নেতাজির কাছে ভারতের মুক্তিসাধনাই ছিল একমাত্র লক্ষ্য। তাই হয়ত হিটলারকে এ নিয়ে খোঁচাখুঁচি করতে চাননি, তাই তিনি স্বচ্ছন্দে বলতে পারেন "...The internal politics of Germany or Italy or Japan do not concern us - they are the concern of the people of those countries." সারা জীবন সত্য ও আদর্শের আরাধনা করে যাওয়ার পরে নেতাজির এই অবস্থান বড়ই বিচিত্র, এবং অস্বস্তিকরও বটে। Romain Hayes এই অস্বস্তির কথাই তুলে ধরে মন্তব্য করেন, "Racism was fundamentally contrary to everything he stood for and this is what makes not only his presence but his silence in Germany - and afterwards - so problematic." (Romain Hayes, Bose in Germany, pp. 167)

কিন্তু নিজের দেশকে ইংরেজকবল থেকে মুক্ত করার একমুখী সাধনায় যে কোনও ইংরেজ-বৈরী দেশের সাহায্য নেওয়ার যুক্তি গ্রহণযোগ্য হলেও সেইসব দেশের (জার্মানি ও ইতালি) সরকারকৃত গণহত্যা, জাতিদ্বেষপ্রসূত ইহুদি নিধন যজ্ঞ সম্পর্কে নীরব ও উদাসীন থাকা কোনও নৈতিক মানদণ্ডেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। দেশের মুক্তিপ্রচেষ্টায় ওই সব দেশের সহায়তা বন্ধ হয়ে যেতে পারে জেনেও সুভাষচন্দ্রের সামনে ইহুদি ও অন্যান্য মানুষের গণহত্যার (হিটলারের আমলের কয়েক বছরে আউশভিস্ত সহ বিভিন্ন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে ৬০ লক্ষ ইহুদিকে হত্যা করা হয়েছিল) জোরালো প্রতিবাদ করা ছাড়া অন্য কোনও অবস্থান নেওয়ার নৈতিক সমর্থন মেলে না। এ বিষয়ে তাঁর সামনে তাঁরই অন্যতম পথপ্রদর্শক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিন্তু দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গিয়েছেন। আগেই বলা হয়েছে, মুসোলিনির আতিথ্য নিয়ে ইতালি সফর করে যে ভুল রবীন্দ্রনাথ করেছিলেন, তা রমাঁ রোলাঁ তাঁকে ধরিয়ে দিলে তিনি প্রকাশ্যেই মুসোলিনির সমালোচনা করে বিবৃতি দেন। জাপানে প্রথমবার ১৯১৬ সালে সফর করতে গিয়ে জাপানের পুনরুত্থান প্রাচ্যের মধ্যে অগ্রগণ্য সমন্বয়কারী দেশের ভূমিকা নেবে বলে রবীন্দ্রনাথ আশা প্রকাশ করেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে থেকেই জাপান যখন প্রথমে চিন ও পরে এশিয়ার অন্য দেশগুলি দখল করতে সামরিক অভিযান শুরু করে, তখন রবীন্দ্রনাথ সুর বদলে কড়া ভাষায় জাপানের নিন্দা করেন। ১৯৩৮ সালে জাপানের বিশিষ্ট কবি ও রবীন্দ্রনাথের বন্ধু ইওনে নোগুচি (Yone Noguchi) রবীন্দ্রনাথকে জাপানের প্রতি তাঁর মনোভাব বদল করার জন্য অনুনয় করে চিঠি দেন। উত্তরে ১৯৩৮ সালের ২১ সেপ্টেম্বর রবীন্দ্রনাথ লেখেনঃ
'It seems to me that it is futile for either of us to try to convince the other, since your faith in the infallible right of Japan to bully other Asiatic nations into line with your Government's policy is not shared by me... Believe me, it is sorrow and shame, not anger, that prompts me to write to you. I suffer intensely not only because the reports of Chinese suffering batter against my heart, but because I can no longer point out with pride the example of a great Japan.' (Quoted by Amartya Sen in his Tagore and his India, pp. 92, as included in India a Mosaic, New York Review Books, 2000).

১৯১৬ সালে জাপানে যাওয়ার আগেই ১৯১৫ সালে সি এফ এন্ড্রুজের কাছে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সংশয় প্রকাশ করে বলেন, তিনি প্রায় নিশ্চিত যে ভারতের প্রতি জাপানের নজর রয়েছে। সে ক্ষুধার্ত, ...জাপান আসলে ইউরোপের নবীনতম শিষ্য, তার কোনও আত্মা নেই, আছে শুধু বিজ্ঞান... অন্য দেশের মানুষের প্রতি তার কোনও সহমর্মিতা নেই। (Selected Letters of Rabindranath Tagore, pp. 496, ed. by Krishna Dutta & Andrew Robinson, Cambridge University Press, 1997)। জাপানের এই জঙ্গী সাম্রাজ্যবাদী চেহারার সমালোচনা করেই রবীন্দ্রনাথ রাসবিহারী বসুর আমন্ত্রণ খারিজ করে জাপান ভ্রমণে যেতে অস্বীকার করেন। রাসবিহারী ১৯৩৮ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লেখেন। তার আগেই ১৯৩৭ সালের ডিসেম্বরে চিনের নানকিং শহরে জাপ সেনাদের হাতে কুখ্যাত গণহত্যা ঘটে গেছে। রবীন্দ্রনাথ রাসবিহারীকে জানিয়ে দেন যে, জাপানের জঙ্গী সরকার যেভাবে চিনকে ধ্বংস করতে উঠেপড়ে লেগেছে, সেই অবস্থায় তারা তাঁকে সে দেশে কতটা (বাক) স্বাধীনতা দেবে, তা নিয়ে তাঁর যথেষ্ট সন্দেহ আছে। (Ibid, pp. 502)

১৯৩০ সালে রাশিয়া ভ্রমণে গিয়েও রবীন্দ্রনাথ সোভিয়েত ইউনিয়নের মন রাখা কথা বলতে ব্যস্ত হননি। 'রাশিয়ার চিঠি'তে সংকলিত তাঁর একগুচ্ছ চিঠিতে তিনি সে দেশের সমাজে নিচুতলার মানুষের সবার জন্য শিক্ষার সুযোগ করে দিতে রাষ্ট্রের উদ্যোগ দেখে প্রশংসা করতে পিছিয়ে যাননি। তেমনই রাষ্ট্র যেভাবে বলপ্রয়োগের উপর জোর দিচ্ছিল, তা যে বিপজ্জনক পথে নিয়ে যাবে, সেই সতর্কবাণী জানাতেও ভোলেননি। রাশিয়া থেকে বিদায়ের আগে সে দেশের সংবাদপত্র 'ইজভেস্তিয়া'কে দেওয়া তাঁর সাক্ষাৎকারে এ বিষয়ে তিনি আরও খোলাখুলি মন্তব্য করেছেনঃ
"I must ask you: Are you doing your ideal a service by arousing in the minds of those under your training anger, class-hatred, and revengefulness against whom you consider to be your enemies? ...Freedom of mind is needed for the reception of truth, terror hopelessly kills it... For the sake of humanity I hope you may never create a vicious force of violence, which will go on weaving interminable chain of violence and cruelty..." (Tagore and his India, Amartya Sen, pp. 95-96, as included in India a Mosaic, New York Review Books, 2000)। সেই সাক্ষাৎকার ১৯৩০ সালে গৃহীত হলেও সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ ৫৮ বছর ধরে চেপে রেখে অবশেষে গ্লাসনস্ত জমানায় তা প্রকাশ করে। ইতালি, জাপান ও রাশিয়ায় রবীন্দ্রনাথ যে নৈতিক অবস্থানের নজির সৃষ্টি করেন, নেতাজি সুভাষচন্দ্রও সেই পথে হাঁটলে আজ এই অস্বস্তিকর প্রশ্নের অবতারণাই করতে হত না।