আরেক রকম ● দশম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা ● ১-১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ● ১৬-৩০ মাঘ, ১৪২৮

সমসাময়িক

আইএএস থাকলে সুবিধা না গেলে সুবিধা?


আইএএস একটি সর্বভারতীয় সার্ভিস। আইএএস অফিসারদের কেন্দ্র এবং রাজ্য দুই সরকারের অধীনেই কাজ করতে হয়। কে কখন কোথায় কাজ করবে তা নিয়ন্ত্রিত হয় ভারতীয় সিভিল সার্ভিস আইনের ক্যাডার অধিনিয়ম দ্বারা। প্রতিটি রাজ্যের জন্য বা দুই তিনটি ছোট রাজ্যকে মিলিয়ে একটি করে ক্যাডার তৈরি হয়েছে। কেন্দ্রীয় পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় পাশ করে চাকরিতে ঢোকামাত্র প্রত্যেক অফিসারকে কোনও একটি ক্যাডারে স্থান দেওয়া হয়। কেন্দ্র রাজ্য পরামর্শ করে ঠিক করে কোন ক্যাডারে কতো অফিসার দরকার।

এভাবে নাহয় অগ্রাধিকার দিয়ে রাজ্যের প্রয়োজন মেটানো গেল কিন্তু কেন্দ্রের প্রয়োজন মিটবে কি করে? অধিনিয়ম অনুযায়ী কেন্দ্র সরাসরি কোনও আইএএস অফিসার নিয়োগ করবে না। কেন্দ্রে অফিসার আসবে রাজ্য থেকে। রাজ্য সরকার প্রতি বছর জেনে নেবে কোন অফিসার কেন্দ্রে যেতে চায়। নিজের অবস্থা বুঝে ঠিক করবে কতোজনকে ছাড়া উচিত হবে। সেই অনুযায়ী ইচ্ছুক অফিসারদের তালিকা পাঠানো হবে কেন্দ্রে। সব রাজ্যের তালিকা দেখে কেন্দ্রীয় সরকার ঠিক করবে কোন পোস্টের জন্য কাকে নেওয়া হবে।

কিন্তু যিনি কোনও একটি ক্যাডারের অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন তিনি কেন্দ্রে যেতে চাইবেন কেন? কেন্দ্রে কাজের বৈচিত্র্য বেশি প্রমোশনের সুযোগ বেশি বিদেশ যাত্রার সুযোগ বেশি। অবসরের পর পুনর্নিয়োগের সম্ভাবনা বেশি। অনেক রাজ্যে দেখা গেছে আইএএস অফিসারের পরিবর্তে প্রাদেশিক সিভিল সার্ভিসের অফিসারদের অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রবণতা। সেই কারণেও অনেকে কেন্দ্রে যেতে চাইবে। মোটের উপর ধরে নেওয়া যায় যে কেন্দ্রে যতো অফিসার দরকার তার বেশি সংখ্যায় অফিসাররা কেন্দ্রে যেতে ইচ্ছুক হবে। তাই কেন্দ্র বাছ-বিচার করেও প্রয়োজন মতো ভাল অফিসার অনায়াসে পেয়ে যাবে। নির্বাচিত অফিসার কেন্দ্রে কাজ করবে পাঁচ বছর। তারপর ফিরে যাবে নিজের ক্যাডারে। একটা নির্ধারিত সময় ক্যাডারে কাটিয়ে সে আবার ফিরতে পারবে কেন্দ্রে।

স্বাধীনতার প্রথম পঞ্চাশ বছরে সমস্যা হয়নি কেন্দ্রে শূন্যপদ পূর্ণ করতে। কিন্তু ক্রমেই দেখা গেল কেন্দ্রে যাবার ঔৎসুক্য কমে আসছে। বেশ কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে কেন্দ্রের অধীনে সেন্ট্রাল সার্ভিস থেকে জয়েন্ট সেক্রেটারি স্তরে নিয়োগ বেড়েছে। এছাড়াও বলা হচ্ছে অফিসারের ঘাটতি মেটাতে প্রাইভেট সেক্টর থেকে ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞদের আনা হবে। রাজ্য থেকে কেন্দ্রে এসে সময়মতো প্রমোশন পাবার পথ সঙ্কীর্ণ হয়ে আসছে। তাহলে কেনই বা রাজ্যের অফিসার আসতে চাইবে কেন্দ্রে? যদি দেখা যায় কেন্দ্রে সরকার চলছে, না চলছে একনায়কের হুকুম। ভাল চাকরি রিজার্ভ করা হচ্ছে কোনও একটি রাজ্যের অফিসারদের জন্য। তাহলে নিশ্চয়ই সমস্যা বাড়বে।

ভেবেচিন্তেই তৈরি করা হয়েছিল এই অধিনিয়ম। জেলায় মাঠে ঘাটে কাজের অভিজ্ঞতা কাজে লাগছে কেন্দ্রের নীতি নির্ধারণে। দিল্লিতে অন্য রাজ্যের অফিসারদের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা কাজে লাগছে রাজ্যে ফিরে প্রশাসনকে চাঙ্গা করতে। আরও লাভ। অফিসারদের একটা সর্ব-ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠছে। এই কারণেই আইএএস বেশ খানিকটা সফল হয়েছে কেন্দ্র-রাজ্যে সমন্বয় সাধনে আর যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে বলিষ্ঠ করতে।

অন্যদিকে মাঝেমধ্যেই কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। কখনও যথেষ্ট সংখ্যায় অফিসার পাওয়া যায় না যারা দিল্লিতে আসতে চায়। কখনও রাজ্য সরকার ইচ্ছুক অফিসারদের ছাড়তে চায় না কারণ তাদের নিজেদের অভাব। সদিচ্ছা থাকলে এই সমস্যা কেন্দ্র রাজ্য বসে মিটিয়ে নিতেই পারে। কোনও রকেট বিজ্ঞানের প্রয়োজন হয়না। বছরে একবার বসলেই বোঝা যায় আগামী তিন বছরে কেন্দ্রে কটা বাড়তি পোস্ট দরকার আর কতো অফিসার অবসর নিতে চলেছে। দুটো সংখ্যা যোগ করলেই বোঝা যাবে রাজ্য থেকে কতো অফিসার পাঠানো দরকার। সেইমতো ইচ্ছুক অফিসার না পাওয়া গেলে বাধ্যতামূলক ডেপুটেশনের কথাও ভাবা যেতে পারে। পক্ষপাতিত্ব না হলে খানিকটা জোর খাটানো সবাই মেনে নেবে। তাও কিছু ভুল হবেই। ১৯৯০-এর দশকে উদারীকরণের সময় ভাবা হয়েছিল সরকারের কাজকর্ম কমে যাবে। তাই বাৎসরিক নিয়োগ ১৬০ থেকে কমিয়ে ৬০ করে দেওয়া হয়। সেই ভুলের মাসুল গুণতে হচ্ছে এখনও।

কোথায় কতো অফিসার দরকার সে প্রশ্নে সবসময়ে কেন্দ্র রাজ্য একমত হবে তা অশা করা যায়না। তাই ক্যাডার রুলে বলা আছে মতানৈক্য হলে কেন্দ্রের মত প্রাধান্য পাবে। মোদী সরকার মনে করছেন না এই বিধান যথেষ্ট। তাঁরা চাইছেন সংশোধনী এনে পরিষ্কার করে দিতে যে কেন্দ্রের নির্দেশ এলে কোনও অফিসারকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ছাড়তেই হবে। সংশ্লিষ্ট রাজ্যের বা সেই অফিসারের আপত্তি গ্রাহ্য হবেনা। কেন্দ্রীয় সরকার সেই অফিসারকে কেন্দ্রে নিয়োগ করতে পারবে অথবা যেকোনো রাজ্যে পাঠিয়ে দিতে পারবে।

বোঝাই যাচ্ছে ব্যাপারটা এখন আর সংখ্যাতত্ত্বে সীমিত নেই। কেন্দ্রের উদ্দেশ্য ক্ষমতা বিস্তার। অফিসার জানবে তার চাকরি নিরাপদ করতে হবে কেন্দ্রের শাসকদলকে সন্তুষ্ট রেখে। সকাল-সন্ধ্যে সহযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রীয়তার কথা শুনেও লক্ষ্য রাখতে হবে স্থির। রাজ্যের আর গুরুত্ব রইল কই। রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা আগেই চলে গেছে কেন্দ্রের হাতে। রাজপুরুষের নিয়ন্ত্রণও তাঁরাই নিন।

সর্দার পটেলকে বলা হয় আইএএস-এর জনক। আইসিএস-এর মতো একটা ‘এলিট’ সার্ভিস স্বাধীন ভারতের কাজে লাগবে কিনা তা নিয়ে গণপরিষদে জোর বিতর্ক হয়। নেহেরু এর পক্ষে ছিলেন না। পটেলের সমর্থনেই ভূমিষ্ঠ হয় আইএএস। পটেল চেয়েছিলেন নির্ভীক নিরপেক্ষ অফিসার। তিনি বলেছিলেন এ দেশ বাঁচবে না যদি আমরা এমন অফিসার তৈরি করতে না পারি যে নির্ভয়ে তার মনের কথা বলতে পারবে। মোদীর সরকার পটেলের ৬০০ মিটার উঁচু মূর্তি তৈরি করে ভাবছেন তাঁরা ঋণমুক্ত। পটেলের কথা মনে রাখার দায়িত্ব তাঁদের নেই।

মোদী তাঁর ক্যাবিনেটের মন্ত্রীদের গুরুত্ব কমিয়ে প্রায় শূন্য করে দিয়েছেন। দুই একজন ছাড়া তাঁদের দেখাও যায় না শোনাও যায় না। উনি নির্ভর করেন কিছু ঘনিষ্ট আমলার উপর। অথচ ইদানীংকালে সংসদে দাঁড়িয়ে তিনি একাধিকবার আইএএস-এর নিন্দায় মুখর হয়েছেন। এক শ্রেণীর আমলাদের হাতে সব ক্ষমতা তুলে দিয়ে এ আমরা কেমন শক্তিধর তৈরি করেছি যে প্লেনও চালাবে আর সারের কারখানাও? আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে এটা স্ববিরোধিতা। কিন্তু তা নয়। কোনও অফিসারেই তাঁর আপত্তি নেই সে যদি তাঁর কথা শোনে। সর্দার যা চেয়েছিলেন তাঁর ভক্ত চান ঠিক উল্টোটা।

তবে একথা ঠিক নয় যে সব দোষ কেন্দ্রের। বেশিরভাগ রাজ্যই কেন্দ্রে নাম পাঠাতে চায়না। পারলে পাঠাবোই না। না পারলে এমন অফিসারের নাম পাঠাবো যাকে রাজ্যে কেউ চায়না। রাজ্যের সিনিয়ার অফিসার দিল্লিতে থাকলে রাজ্য সরকারের লাভ হওয়া উচিত। কেন্দ্রের অনুদান অনুমোদন পেতে সুবিধা হওয়া উচিত। কিন্তু তাঁর যদি কোনও ক্ষমতাই না থাকে তাহলে কি লাভ? তাই এদিক ওদিক একটা দুটো সংশোধনীতে কোনও সমস্যার সমাধান হবার নয়।

রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে আমরা কি দেখলাম? রাজ্যে করোনা প্রতিরোধে নেতৃত্ব দিতে হবে বলে তাঁকে কেন্দ্রের অনুমোদন নিয়ে তিন মাসের এক্সটেনশন দেওয়া হল। প্রধানমন্ত্রী রাজ্যে এলেন পরিস্থিতি দেখতে। কলাইকুন্ডা বিমানবন্দরে মিটিং ডাকা হল। সেখানে মুখ্যমন্ত্রী এবং মুখ্যসচিবের উপস্থিত থাকার কথা। তাঁরা সভাকক্ষে এসে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কিছু কথোপকথনের পরে প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়ে অন্যত্র মিটিং করতে চলে যান।

প্রধানমন্ত্রীর মিটিং-এ না থাকার অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। কিন্তু অফিসার রাজ্যে কর্মরত তাই কেন্দ্রের আওতার বাইরে। কি করণীয়? অবসর নেবার আগের দিন তাঁকে বলা হয় দিল্লিতে কেন্দ্রীয় সরকারে যোগ দিতে। বলা বাহুল্য এই নির্দেশ ছিল সম্পূর্ণ বেআইনি। কিন্তু করোনা অপেক্ষা করতে পারে। মোদী পারেন না। এ ধরনের নির্দেশ যাতে আইনসিদ্ধ হয় তাই কি আনা হল ক্যাডার রুলে সংশোধনীর প্রস্তাব? হতে পারে। মোদী নাকি কাউকে ক্ষমা করেন না।