আরেক রকম ● দশম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা ● ১-১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ● ১৬-৩০ মাঘ, ১৪২৮

সমসাময়িক

প্রসঙ্গ পেগাসাস


ঝুলি থেকে বেড়ালটা বেরিয়েই পড়ল শেষমেষ। নিউ ইয়র্ক টাইমসের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭ সালে ইজরায়েল সফরের সময়ে ভারতের সঙ্গে সেদেশের বেশকিছু প্রতিরক্ষা চুক্তি হয়েছিল। সেইসব চুক্তির মধ্যে ছিল ফোনে আড়িপাতার ইজরায়েলি স্পাইওয়্যার পেগাসাস। কেনার জন্য ভারত সরকার খরচ করেছিল ২০০ কোটি টাকা। সে বছর জুলাইয়ে মোদীর ইজরায়েল সফরের সময়ই এ সংক্রান্ত ‘প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি’ সই হয়েছিল। যদিও সংসদ এবং সুপ্রিম কোর্টের প্রশ্নের মুখে এ বিষয়ে জাতীয় নিরাপত্তার ‘যুক্তি’ দিয়ে জবাব এড়িয়ে গিয়েছিল কেন্দ্র।

বহুদিন ধরেই বিরোধী দলগুলো অভিযোগ জানিয়ে আসছে যে মোদি সরকার পেগাসাস কিনেছিল দেশের নেতাদের এবং জনসাধারণের উপর গুপ্তচরবৃত্তি করার উদ্দেশ্যে। তাঁদের ফোনে আড়ি পাতা হয়েছে। বিরোধী দল এবং আদালতকে নিশানা করেছে ক্ষমতাসীন দল। সেই অভিযোগেই শিলমোহর দিল মার্কিন সংবাদপত্রের রিপোর্টটি। এই ইস্যুতে আপাতত নতুন করে মামলা দায়ের করা হল সুপ্রিম কোর্টে। মামলার আবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালে ভারত-ইজরায়েল যে চুক্তি হয়েছিল তা সংসদে অনুমোদন করা হয়নি। তাই তা বাতিল করা জরুরি। একই সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টকে একটি ফৌজদারী মামলা নথিভুক্ত করার জন্য উপযুক্ত নির্দেশ জারি করার ও বিচারের স্বার্থে স্পাইওয়্যার ক্রয় চুক্তি ও জনসাধারণের অর্থ অপব্যবহারের অভিযোগগুলি খতিয়ে দেখার জন্য তদন্ত করার নির্দেশ দেওয়ারও আর্জি জানানো হয়েছে।

বেশ কিছু বছর আগে এডওয়ার্ড স্নোডেন একটি সাক্ষাতকারে বলেছিলেন যে, প্রযুক্তি নিজে থেকে পিছু হটতে পারে না। কিন্তু তাকে যদি সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হয়, তাহলে সেই প্রযুক্তিই একদিন বৃহৎ কর্পোরেট রাষ্ট্রের জন্ম দেবে, যার নখাগ্রে রাখা থাকবে নাগরিকের ব্যক্তিগত জীবন, গতিবিধি, জীবনের গোপন অধ্যায়, রাজনৈতিক মতবাদের সমস্ত তথ্য। কে এই প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করবে ও সামলাবে? সামলাবার দায়িত্ব সরকার, তার রাষ্ট্রব্যবস্থা, প্রশাসন এবং সর্বোপরি গণতান্ত্রিক কাঠামোর সমস্ত স্তরের আধিকারিকদের। স্নোডেনের সেই সাক্ষাতকার আজ দৈববাণী রূপে প্রতিভাত হচ্ছে, যখন জর্জ অরওয়েল কথিত সেই ১৯৮৪-র রাষ্ট্রব্যবস্থার ভূত নরেন্দ্র মোদীদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে।

তাৎপর্যপূর্ণভাবে, ২০১৭ সালেই ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের বাজেট দশ গুণ বৃদ্ধি করা হয়েছিল, যার সিংহভাগ সাইবার সিকিওরিটিতে। ২০১৯-এ মোদির দ্বিতীয় জয়ের পর ইউএপিএ আইনকে সম্প্রসারিত করা হয়েছিল যাতে তার আওতায় শুধু 'দেশদ্রোহী' সংস্থাগুলিই নয়, সন্দেহভাজন ব্যক্তিরাও পড়েন। কারণ সহজবোধ্য। সংস্থার ফোন নম্বর হয় না, হয় আদতে ব্যক্তিদের নম্বর। তাই নজরদারি চালাতে গেলে সন্ত্রাসবাদবিরোধী আইনের অভিমুখ ব্যক্তির দিকে ঘোরাতে হবে। ভীমা কোরেগাঁও মামলায় যে ষোল জন অ্যাকটিভিস্ট, আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তাঁদের আট জনের নম্বর পেগাসাসের তালিকায় পাওয়া গেছে।

১৯৭২ সালের ১৭ই জুন ওয়াশিংটন শহরের ডেমোক্র্যাটিক পার্টির হেডকোয়ার্টারের তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকেছিল পাঁচ জনের একটি দল, পুলিশ যাদের ছিনতাইবাজ ভেবে গ্রেপ্তার করে। পরে দেখা যায় এই পাঁচ জনের মধ্যে চার জন ছিলেন প্রাক্তন সিআইএ কর্মী এবং পঞ্চম জন কাজ করতেন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের রাজনৈতিক প্রচারবিভাগে। আস্তে আস্তে জানা যায় ডেমোক্র্যাটিক দলের অন্যান্য অফিসেও এভাবে হানা দেবার চেষ্টা হয়েছিল একই সময়ে। প্রেসিডেন্ট নিক্সন এফবিআই-কে নির্দেশ দেন যেন তদন্ত ধামাচাপা দেওয়া হয়, কিন্তু ওয়াশিংটন পোস্টের দুই সাংবাদিক নিরলস প্রয়াসে খুঁড়ে আনেন চমকে দেওয়া তথ্য - 'ওয়াটারগেট স্ক্যান্ডাল' নামে যা পৃথিবীবিখ্যাত। নিক্সন বিরোধী দলগুলির ওপর নজরদারি চালাবার উদ্দেশ্যে এই কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন। ঘটনার প্রতিক্রিয়াতে তাঁকে ইমপিচমেন্টের সম্মুখীন হবার উপক্রম হয়েছিল। নিক্সন পদত্যাগ করেন। পৃথিবীর গণতন্ত্রের ইতিহাসে ওয়াটারগেট একটা গুরূত্বপূর্ণ অধ্যায়।

এই ঘটনার পঞ্চাশ বছর হতে চলল। আজকের দুনিয়াতে ওয়াটারগেটের তুল্য অধ্যায়গুলো আরও নির্মম, আরও ভয়ংকর। নিক্সন যেটা করেছিলেন নিজের দল ও মুষ্টিমেয় কিছু প্রশাসনের সাহায্যে, নরেন্দ্র মোদী সেই আখ্যানের ভেতরেই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, কূটনৈতিক কৌশল, দানবিক প্রযুক্তির হিমশীতল অধ্যায়গুলো যোগ করে ফেলেছেন। প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন নজরদারি রাষ্ট্রের চেহারাকে। সবথেকে বড় কথা, নিক্সনকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। মোদির কিছুই হবে না। বিরোধীরা যতই ঐক্যবদ্ধ হন না কেন, বিজেপি আপাতত গণতন্ত্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ স্তম্ভগুলোকে কিনে নিয়েছে। তাই কিছু জনস্বার্থ মামলা ও বিরোধীদের সংসদ কক্ষ ত্যাগের মত টোকেন প্রতিবাদ বাদে আর বিশেষ কিছু করা যাচ্ছে না এখনও, যাতে কেন্দ্রীয় সরকার বিপদে পড়ে। নিউ ইয়র্ক টাইমসের রিপোর্ট সামনে আসার পরেও কেন্দ্রীয় সরকার স্বভাবসিদ্ধ ঔদ্ধত্য দেখিয়ে চলেছে। কারণ স্পষ্ট - এই রিপোর্ট বেরোবার আগেই সবাই জানত যে পেগাসাস মোদিই কিনেছেন, এবং কেন্দ্রীয় সরকারও জানে যে সবাই তা জানে। তাই নতুন করে চিন্তিত হবার আশংকা তাদের নেই, একইরকম গাজোয়ারি মনোভাব বজায় রাখতে তারা বদ্ধপরিকর।

এটা আজ স্পষ্টভাবে বুঝে নিতে হবে যে বিজেপি গণতন্ত্রের শত্রু, এবং প্রযুক্তি হোক বা মন্দির, নিজেদের প্রয়োজনে সমস্ত কিছুকে মানবতার বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারে। এই সরকারের ওপর মারণ আঘাত হানতে বিরোধীরা কতটা ঐক্যবদ্ধ, এবং তাঁদের সদিচ্ছাই বা কতটা, নাকি বিজেপি ক্রমান্বয়ে এই ঔদ্ধত্যের রাজনীতিই করে যাবে, সেটা সময়ই বলবে।