আরেক রকম ● দশম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা ● ১-১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ● ১৬-৩০ মাঘ, ১৪২৮

সম্পাদকীয়

শিক্ষা প্রলয়


পশ্চিমবঙ্গে বন্ধ হয়ে গেল ৮৯টি স্কুল। পড়ুয়া না থাকায় স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার। শিক্ষাবিদদের প্রশ্ন, স্কুল বন্ধ কি কোনো সমাধান? দাবি উঠেছে এ নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশের।

কোভিডে দেড় বছর বন্ধ ছিল রাজ্যের স্কুল। নভেম্বর মাসে স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুল খুলেছে। নবম, দশম, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির অফলাইন ক্লাস চলেছে। এরই মধ্যে স্কুল বন্ধের দুঃসংবাদ। রাজ্যের ৮৯টি স্কুল আপাতত বন্ধ হয়ে গেল। এই স্কুলগুলি জুনিয়ার হাই ও হাইস্কুল স্তরের। এই স্কুলগুলির অধিকাংশে পড়ুয়া নেই বললেই চলে। পড়ুয়ার অভাবেই স্কুল বন্ধ করে দিয়েছে মধ্যশিক্ষা পর্যদ। এই স্কুলগুলি থেকে ৩১১ জন শিক্ষক-শিক্ষিকাকে বদলি করা হবে অন্যত্র। রাজ্যের বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে। বন্ধ হওয়া স্কুলের শিক্ষকদের সেখানে পাঠানো হবে। ইতিমধ্যে ১৭০ জনের বদলির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে পর্ষদ।

বন্ধ হওয়া স্কুল সবচেয়ে বেশি রয়েছে হাওড়াতে। খোদ কলকাতা-সহ এই তালিকায় রয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনা, পূর্ব মেদিনীপুর, বীরভূম, আলিপুরদুয়ার ও অন্যান্য জেলা। স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ শিক্ষাবিদ। বক্তব্য, ‘একজন ছাত্র থাকলেও একটা স্কুল চালাতে হবে। তবেই তো আরো পড়ুয়া আসবে। স্কুল তুলে দেওয়া কোনো সমাধান নয়। এই বিষয়টা নিয়ে আমি একেবারে বিভ্রান্ত। সরকারের উচিত এ নিয়ে ব্যাখ্যা দেওয়া। কেন তারা স্কুল বন্ধ করল, এ বিষয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করা দরকার।’

এই সংবাদ ২০২১-এর ডিসেম্বরের। তার আগে এসেছিল, ২৪৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয় চিরতরে বন্ধ হয়ে যাওয়ার খবর। শিশুদের সংখ্যা বাড়ছে। স্কুল তো বাড়ার কথা। কমছে। বিপজ্জনকভাবে কমছে। তার চেয়েও আশঙ্কাজনক, বিদ্যালয় নভেম্বরে খোলার পর শিক্ষক শিক্ষিকারা দেখলেন, বহু ছেলে মেয়ে আসছেন না। কেন? বাড়ি বাড়ি খোঁজ নিতে যাওয়ার মতো শিক্ষক আজো আছেন। তাঁরা গেলেন। এবং জানলেন, কিছু ছেলে কাজে লেগেছে। অর্থোপার্জনের কাজে। কেউ কেউ অন্য রাজ্যেও চলে গেছে। কিছু মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। কিছু মেয়ে অন্তঃসত্ত্বা।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের এক বড় অংশ ২২ মাস স্কুল বন্ধ থাকায় পড়া ভুলে গেছে। মধ্যবিত্ত পরিবারে দেখিয়ে দেওয়ার লোকজন থাকায় পড়া থামেনি। কিন্তু সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের অবস্থা করুণ।

এর মধ্যে সরকার ঘোষণা করেছে, পাড়ায় স্কুল। এতে ভালো হবে না মন্দ সময় বলবে। খোলা জায়গায় ক্লাস হবে ভাগ করে। গ্রামে নয় জায়গা মিলবে। শহরে নগরে? কতটা হবে দেখা যাক।

সমস্যা থাকবে আরো। শৌচাগারের কী হবে?

পানীয় জলের?

ছাত্রছাত্রী কমছে শিক্ষক-শিক্ষিকা উদ্বৃত্ত।

তার মধ্যে নতুন নিয়োগ নেই। বেশ কিছু বিদ্যালয়ে এক বা দুজন শিক্ষক। তার মধ্যে মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিকে নতুন সমস্যা। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বদলির সুবিধার জন্য 'উৎসশ্রী' পোর্টাল চালু হয়েছে। এতে গ্রামাঞ্চলের বিদ্যালয়গুলো ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। তার মধ্যে সুখবর আছে, বদলি চেয়ে বদলি পেয়েও কিছু শিক্ষক পুরাতন বিদ্যালয় ছাড়ছেন না। ছাত্র বিক্ষোভে। বিক্ষোভ ভালো কারণে। প্রিয় স্যারকে ছাড়বেন না। শেষ পর্যন্ত ভালোবাসার জয় হয়েছে। শিক্ষক বাড়ির কাছে বদলি পেয়েও যাননি। এই সমস্ত শিক্ষকরা সমাজের গর্ব। সভ্যতার সৌধ।

অন্যদিকে শিক্ষিত বেকার বাড়ছে। ডোমের পদেও আবেদন করছেন পিএইচডি করা মানুষ। রেলের সাধারণ পদে নিয়োগের জন্য পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল। ৩৭,৫০০ পদ। পরীক্ষা দিয়েছিলেন এক কোটি তরুণ-তরুণী। পাস দেখানো হয়েছে, সাড়ে সাত লাখকে। ফল প্রকাশের পর বিক্ষোভ। তুমুল। বিহারের বেশ কয়েকটি স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেন পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ দুর্নীতির। বেছে বেছে কিছু নির্দিষ্ট পরীক্ষার্থীর কেন্দ্রে সহজ প্রশ্ন দেওয়া হয়েছে। বাকি জায়গায় কঠিন প্রশ্ন। অভিযোগ উঠেছে, পড়াশোনায় খারাপরা সুযোগ পেয়েছে। ভালোরা পাননি। বিহারে রাজ্য বনধ পর্যন্ত হয়েছে। দুটি রাজনৈতিক দল সিপিআই(এমএল) লিবারেশন ওজন অধিকার পার্টি বিক্ষোভে সামিল। সব বিরোধী দল আন্দোলনে সহমর্মিতা জ্ঞাপন করেছে। বিহার জ্বলছে। উত্তরপ্রদেশেও আগুন ছড়াচ্ছে আন্দোলনের।

এর পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গে নিয়োগের দাবিতে আন্দোলন হচ্ছে। বিদ্যালয় সেবা আয়োগের ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। নিয়োগ প্রক্রিয়া আদালতের আদেশে স্থগিত। বহুদিন বিদ্যালয়ে নিয়োগ নেই। রাজ্য সরকারের চাকরিতে বহু পদ শূন্য। শক্তিশালী বিরোধী দল নেই আন্দোলন গড়ে তোলার। ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে হতাশা নামছে। ফলে এবার কলেজগুলোতে বহু আসন শূন্য থেকেছে। এমনকী যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল বিভাগেও আসন ফাঁকা। চাকরি নেই, কাজ নেই। তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রী কমছে।

আর কেন্দ্রীয় সরকার চাইছে, সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো তুলে দিতে। তার সঙ্গে গোপন সঙ্গত অনেকের। এর বিরুদ্ধে এসএফআই, লকডাউন বিরোধী গণউদ্যোগ সহ নানা সংগঠন পথে নেমেছে স্কুল কলেজ খোলার দাবিতে। ২৭ জানুয়ারি বিকাশ ভবন অভিযান ছিল। যেভাবে সরকার আন্দোলন দমন করেছে তা অত্যন্ত আশঙ্কার। বাস অটো থেকে নামা মাত্র আটক করা হয়েছে। বিকাশ ভবন করুণাময়ী এলাকা পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ।

এখন আন্দোলন করতে না দিয়ে আটক করে কি সব ঠেকানো যাবে?

অন্ধ হলেই কি প্রলয় বন্ধ হবে?

পুনশ্চঃ তেসরা ফেব্রুয়ারি অষ্টম থেকে দ্বাদশ ও কলেজের ক্লাস শুরু। প্রথম থেকে সপ্তম শ্রেণি পাড়ায় পাড়ায়। ঘোষণা মুখ্যমন্ত্রীর।