আরেক রকম ● দশম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা ● ১-১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ● ১৬-৩০ মাঘ, ১৪২৮

সম্পাদকীয়

পূর্ব ভারতে অশান্তির উস্কানি


আসামের বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকেই উত্তর পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে ধারাবাহিকভাবে উত্তেজনা ছড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সবগুলি রাজ্যেই এখন তথাকথিত ডাবল ইঞ্জিনের সরকার। তবুও একের পর এক রাজ্য নিজেদের মধ্যে বিবাদ-বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছে। অবস্থা এতই সঙ্গিন যে কোথাও কোথাও কেন্দ্রীয় আধা সামরিক বাহিনীর সাহায্য নিতে হচ্ছে।

মে মাসে বিধানসভা নির্বাচনের পর জুন মাসে ঘটলো কিমিন কান্ড। অরুণাচল প্রদেশের কিমিন-এ গিয়েছিলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী। কিমিন-এর আধা সামরিক বাহিনীর ছাউনি থেকে কয়েকটি সরকারি প্রকল্পের উদ্বোধন উপলক্ষে তাঁর আগমন। কিন্তু সরকারি বার্তায় ফলাও করে বলা হয় যে, আসামের কিমিন থেকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী কয়েকটি সরকারি প্রকল্পের উদ্বোধন করেছেন। স্থানীয় মানুষ যারপরনাই বিরক্ত। এলাকাটিতে নিশি জনজাতির বসবাস। নিশি জনজাতির মানুষ এখন শান্ত নিরীহ জীবনযাপনে অভ্যস্ত। তবে একবার ক্ষেপে গেলে পূর্বসূরিদের মতো অস্ত্র হাতে তুলে নিতে দেরি করে না।

ডাবল ইঞ্জিনের সরকার বোধ হয় সেটাই চায়। নিশি-দের বিরক্তি প্রশমনে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ভেতরে ভেতরে ফুঁসতে থাকা নিশি যুবকেরা গত কয়েক মাসে নিজেদের সঙ্ঘবদ্ধ করেছে। এবং জানুয়ারিতে অরুণাচল প্রদেশের প্রতিটি জেলায় ছত্রিশ ঘন্টার হরতাল পালনের আহ্বান জানায়। 'অল নিশি ইউথ অ্যাসোসিয়েশন'-এর ডাকা এই হরতালে ভালোই সাড়া মেলে। রাজধানী শহর ইটানগর এবং পাশের জনবহুল শহর নাহারলাগুন-এ আপিস-কাছারি, ইশকুল-কলেজ এমনকি দোকান বাজার বন্ধ থাকে। ফলাফল, হরতাল ব্যর্থ করার জন্য ব্যাপক ধরপাকড়, গ্রেপ্তার ইত্যাদি। সরকার সম্ভবতঃ এমনটাই চেয়েছিল। শান্ত রাজ্য অরুণাচল প্রদেশে অশান্তির উস্কানি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পুলিশি-রাজ।

জুন মাসে অরুণাচল প্রদেশের পর জুলাই-এ সংবাদ শিরোনামে চলে আসে আসাম-মিজোরাম সীমান্ত সংঘাত। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে দুই রাজ্যের পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। দু'পক্ষের গুলি বিনিময়ে বেশ কয়েকজন নিরীহ গ্রামবাসীর প্রাণ যায়। দুটি রাজ্যের সরকার একে অপরের বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ দায়ের করে। অতঃপর দুই মুখ্যমন্ত্রীকে দিল্লিতে ডেকে নিয়ে গিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একটা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের বন্দোবস্ত করেন। এবং দুই রাজ্যের সীমানা বরাবর ১৬৫ কিলোমিটার এলাকা কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়।

আগস্টের সূচনা পর্বে আসাম-মিজোরাম বিবাদ মিটতে না মিটতেই অশান্ত হয়ে ওঠে মেঘালয়। জনৈক বৃদ্ধ এবং প্রায় অথর্ব সমাজকর্মীকে মাঝরাতে বাড়িতে ঢুকে হত্যা করে মেঘালয় পুলিশ। সর্বজনশ্রদ্ধেয় মানুষটির হত্যা মেনে নেয়নি মেঘালয়ের মানুষ। উত্তাল হয়ে ওঠে রাজধানী শিলঙ সহ সমগ্র মেঘালয়। সরকারকে নতজানু হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে কোনোরকমে মানুষের ক্ষোভ নিবারণ করতে হয়।

সেপ্টেম্বর-অক্টোবর উৎসবের মরশুমে তেমন কোনো অঘটন না ঘটলেও নভেম্বরে ঘটলো নাগাল্যান্ডের ভয়াবহ ঘটনা। সাপ্তাহিক ছুটি কাটানোর জন্য ঘরে ফেরা খনি শ্রমিকদের উপর আচমকা গুলি চালায় সামরিক বাহিনীর কমান্ডো বাহিনী। প্রাণ হারালেন চোদ্দো জন নিরীহ গ্রামবাসী। নাগাল্যান্ডের মোন জেলার ওটিং গ্রামের এই ঘটনায় উত্তাল হয়ে ওঠে সমগ্র নাগাল্যান্ড। বাতিল হয় ডিসেম্বর মাসের হর্নবিল উৎসব যা রাজ্যের বাৎসরিক অনুষ্ঠান। বর্জন করা হয় বড়দিন ও নববর্ষের উৎসব। মুখ্যমন্ত্রীকে ঘটনার প্রতিবাদ করতে হয়েছে। এখন সকলেই বুঝতে পারছেন যে আফস্পা আইনের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য ওটিং-এর হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল। এত কিছুর পর এখনও নাগাল্যান্ডে ধিকি ধিকি জ্বলছে ঘৃণার আগুন।

এই তালিকায় সাম্প্রতিক সংযোজন কামতাপুরী লিবারেশন অর্গানাইজেশন (কেএলও) নামের এক নিষিদ্ধ বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের সঙ্গে আসামের মুখ্যমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় সরকারের আলোচনার প্রস্তাব। কেএলও কয়েক বছর আগে বাংলার উত্তরাঞ্চলে এবং আসামের দক্ষিণাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল। কেএলও-র দাবি বাংলা, আসাম ও বাংলাদেশের আটটি জেলা নিয়ে পৃথক রাজ্য গড়ে দিতে হবে। এই দাবির পক্ষে প্রথম দিকে কিছু মানুষ জড়ো হলেও কিছুদিনের মধ্যেই কেএলও জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। কেএলও নেতারা আত্মগোপন করে। অনেকে দেশান্তরী হয়। বাদবাকি সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদীরা আত্মসমর্পণ করে সমাজের মুলস্রোতে ফিরে আসে।

আসামের মুখ্যমন্ত্রী সম্প্রতি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সবকটি সংগঠনকে একই ছাতার নীচে আনার উদ্যোগ নিয়েছেন। গুয়াহাটির আমিনগাঁওতে প্রথম বার এক মঞ্চে আলোচনায় অসম ও পশ্চিমবঙ্গের কেএলও-র নেতা-নেত্রীরা মিলিত হলেন। কোচ-রাজবংশী সংগঠনগুলিকে এক মঞ্চে এনে নতুন করে আলোচনা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। প্রাক্তন কেএলও সন্ত্রাসীরাও সেখানে উপস্থিত। আত্মগোপনকারী কেএলও নেতার প্রতিনিধিও সেই বৈঠকে ছিলেন। কেন্দ্রীয় সরকারের আগ্রহে এবং আসাম সরকারের উদ্যোগে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আলোচনার টেবিলে বসলেও কোচ ও রাজবংশীরা অনেক মতে বিভক্ত বলে সংবাদমাধ্যমের খবর। সংগঠনগুলি জানিয়েছে, রাজ্য না হলেও অন্তত কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল চায় তারা।

পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের পর উত্তরবঙ্গের জন্য আলাদা রাজ্যের দাবি তুলেছিলেন আলিপুরদুয়ারের সাংসদ। তিনি আবার এখন কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী। কোচবিহারের সাংসদও কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী। তাঁদের মুখে এখন কোনো কথা নেই।

কোচ-রাজবংশী সংগঠনগুলি ও প্রাক্তন কেএলও সন্ত্রাসী এবং আত্মগোপনকারী কেএলও প্রতিনিধিকে এক ছাতার তলায় আনার প্রক্রিয়ার মধ্যে অশুভ ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। আসামের মুখ্যমন্ত্রী একদিকে নিয়মিত স্থানীয় জনজাতির মানুষের বাসস্থান উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন আবার অন্যদিকে বিভিন্ন ধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের একজোট করার চেষ্টা করে চলেছেন।

ঘটনাক্রমকে পরপর সাজিয়ে বিশ্লেষণ করলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে পুরোটাই একটা সামগ্রিক পরিকল্পনার অংশ। উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে অসংখ্য জনজাতির বসবাস। প্রতিটি জনজাতিরই জনসংখ্যা যথেষ্ট কম। কিন্তু তাদের প্রত্যেকের স্বাধীন স্বত্তা আছে। রয়েছে নির্দিষ্ট আচার-আচরণ সমৃদ্ধ সমাজজীবন। একের সঙ্গে অন্যের মেলে না। এই সুযোগটাই ব্যবহার করতে চাইছে আধিপত্যবাদ। প্রতিটি জনজাতিকে আলাদাভাবে উস্কানি দিয়ে চলেছে যাতে তারা শুধুমাত্র নিজের নিজের সমস্যা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকে। একজোট হয়ে দেশের মৌলিক সমস্যা সমাধানের দাবি যেন তারা তুলতে না পারে। ভারতীয় সমাজের মূল ধারণা 'বিভেদের মধ্যে ঐক্য' নষ্ট করে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রশ্রয় দেওয়ার বিরুদ্ধে মূলধারার সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলা প্রয়োজন। অন্যথায় দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা ও ঐক্য বিঘ্নিত হবে।