আরেক রকম ● দশম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা ● ১৬-৩১ জানুয়ারি, ২০২২ ● ১-১৫ মাঘ, ১৪২৮

প্রবন্ধ

প্রাণ চায়, সমাজ না চায়

অম্লানকুসুম চক্রবর্তী


অশীতিপর মানুষটি বহু কষ্টে টোটো থেকে নামলেন। শরীর ভর দেওয়া দুটো ক্রাচে। একটা বিরাট বাড়ির সামনে থামলেন। দোতলার উপরে ব্যাঙ্ক। লাগোয়া এটিএম-টাও সেখানেই। দেখলেন, উপরে ওঠার সিঁড়ির লাগোয়া দেওয়ালে একটি প্রিন্ট-আউট লাগানো রয়েছে। তাতে লেখা - "আমরা দুঃখিত। এই এটিএম-টিকে আমরা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষদের উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে পারিনি। আমাদের অপারগতা আপনারা ক্ষমা করবেন। অনুগ্রহ করে আমাদের ব্যাঙ্কের অন্য শাখার এটিএম-এর সদ্ব্যবহার করুন।" অতঃপর দেড় কিলোমিটার টোটোযাত্রা করে অন্য শাখার এটিএম-এ গিয়েও দেখলেন একই পোস্টার শোভা পাচ্ছে সেখানে। তফাৎ শুধু একটাই। এক্ষেত্রে এটিএম-টা দোতলায় নয়, রাস্তার উপরেই। কিন্তু সিঁড়ি ভাঙতে হবে অন্তত গোটা পাঁচেক। বৃদ্ধ মানুষটির পক্ষে তা করা সম্ভব ছিল না। পরিচিত মানুষটি ফোনের ওপ্রান্ত থেকে পরে দীর্ঘশ্বাস মিশিয়ে বলেছিলেন, "খোঁড়া কিংবা ল্যাংড়া এমন ডাকনামের বদলে সমাজ ভাল নাম জুটিয়ে দিয়েছে একটা। 'বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন'। শুনতে কি মিষ্টি লাগে, তাই না ভাই? চাহিদা যে আসলে মিটেছে কতটা, তা শুধু জানি আমরাই। ব্রাত্য হয়ে জন্মেছিলাম। ময়েশ্চারাইজার মাখার মতো সারা জীবন ধরে গায়ে মাখলাম নানা লোকের থুতু। ইলেকট্রিক চুল্লির মধ্যে ঢুকে যাওয়ার সময়েও ব্রাত্যই থেকে যাব।" শুনেছিলাম, বেসরকারি ব্যাঙ্কে সদ্য অ্যাকাউন্টটি খুলিয়ে দেওয়ার পর রিলেশনশিপ ম্যানেজারেরও কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে।

শহর তিলোত্তমা হয়ে ওঠার পথে, সারা গায়ে বাহারি শপিং মল, ফোয়ারা আর বিভিন্ন অত্যাধুনিক হাবের গয়না জড়িয়ে নেওয়া মসৃণ রাস্তায় স্পিড ব্রেকারের মতো লেগে থাকে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষদের জন্য সেভাবে কিছু না করে উঠতে পারার কথা। যাঁদের শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কথা মাথায় রেখে আমাদের আরও বেশি সহমর্মী হওয়ার প্রয়োজন ছিল, তা না করে আমরা ক্রমাগত উগরে দিয়েছি সম্মিলিত উপেক্ষা। সমাজেরই বাতলে দেওয়া এক অলিখিত নিয়ম যেন তাঁদের প্রতিনিয়ত হুমকি দিয়ে বলে, ঘরবন্দি হয়ে জীবনটা কাটিয়ে দাও চুপচাপ। শপিং মল বলে, মাল্টিপ্লেক্স বলে, তুমি এই দিকে চেয়ে থেকো না, দেখো না। শমন দেয়, এ জন্মে যা যা কম পড়িয়াছিল, দেখো পরজন্মে যেন আর তা না হয়। নিজের কনফিগারেশনটা ঠিকঠাক থাকলে দেখতে পারবে, চাখতে পারবে যাবতীয় পার্থিব সুখ। সামাজিক বার্তা ব্যঙ্গ মিশিয়ে ছুঁড়ে দেয় - স্ক্রিন দেখেই কাটিয়ে দাও ক'দিনের জীবন। বিশেষ চাহিদা নিয়ে বেঁচে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন যাঁরা, তাঁদের অনেকেই জীবনটাকে শূন্য চোখে দেখেন। আর হয়তো, দিন গোণেন।

শারীরিক প্রতিবন্ধীদের সামাজিক দাবি নিয়ে বহু মানুষ সোচ্চার হচ্ছেন। তাঁরা ক্ষোভ উগরে প্রশ্ন ছুঁড়ছেন, ব্রিটিশ আমলে কিংবা কয়েক দশক আগে তৈরি হওয়া বাড়িগুলোকে না হয় ছেড়েই দেওয়া গেল। হাল আমলে তৈরি হচ্ছে যে প্রাসাদোপম অট্টালিকা কিংবা শপিং মল, গড়ে উঠছে হাল ফ্যাশনের দোকানপাট কিংবা পরিষেবা দেওয়ার আউটলেট, সেগুলোয় কেন থাকছে না বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষদের জন্য জরুরি বন্দোবস্ত? যাঁদের শারীরিক প্রতিবন্ধকতা আছে, তাঁদের নিয়ে তৈরি করা আইন বলে, সমস্ত সরকারি কিংবা বেসরকারি বাড়িগুলোকে তৈরি করতে হবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষদের স্বাভাবিক চাহিদার কথা মাথায় রেখে। তবে আরও বহু আইনের মতো এই বিধিলিপিগুলোও হয়তো মুখ লুকিয়ে থাকে কোনও মোটা বইয়ের মধ্যে। ফলে যা হওয়ার তা হয়। দোকানের পর দোকান, একের পর এক ঝাঁ-চকচকে মল ছাড়পত্র পায়। বিলিয়ন ডলারের বিদেশি ব্যাঙ্ক কলার তুলে বলে, এই দ্যাখো খুলে ফেলেছি আরও একটা শাখা, আপনারই বাড়ির দোরগোড়ায়। আর্টিকেক্টদের ব্লু প্রিন্টে শুধু বিশেষভাবে সক্ষম মানুষদের কথা উপেক্ষিতই থেকে যায়।

বহু রেল স্টেশনে দেখেছি, গমগমে প্ল্যাটফর্মের উপরে, ভিড়ের মধ্যে একলা, পোড়ো বাড়ির মতো জেগে থাকে একটা ঘর। ওয়াশরুম ফর দিব্যাঙ্গ। মানে, বিকলাঙ্গদের জন্য শৌচালয়। সরকারি অভিধানের কোন কালো পাতা 'দিব্যাঙ্গ' বলে এমন সুন্দর, মখমলে একটি শব্দ প্রতিবন্ধীদের জন্য খুঁজে এনেছে তা জানতে ইচ্ছে করে খুব। ধন্য এই শব্দচয়ন। ওই শৌচালয়ের বন্ধ দরজার সামনে ঝুলতে থাকা তালাটা প্রাগৈতিহাসিক কোনও সময়ের জানান দেয়। এক ব্যস্ত রেলস্টেশনে এমনই এক শৌচালয় লাগোয়া চা বিক্রেতাকে বলতে শুনেছিলাম, ‘ওই যে দাদা। ঢাক বাজিয়ে উদ্বোধন হল। ছোটখাটো এক মন্ত্রী এলেন। রেল কোম্পানির কোট পরা অফিসার এসে এক গাল হাসলেন। ঢাক বাজল। কিন্তু অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যাওয়ার পরে সেই যে তালা ঝুলল, তা আর খোলেনি কোনওদিন।’ ওই স্টেশনেরই এক কোণায় ভিক্ষা করা মানুষটিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘বাথরুম পেলে কোথায় যান?’ ভদ্রলোকের দুটো পা-ই হাঁটুর তলা থেকে মিলিয়ে গিয়েছে, ম্যাজিকের মতো। যা জানতে পারলাম তা হল, যেভাবে ঘষে ঘষে, প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে ঘুরে বেড়ান প্ল্যাটফর্মের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত, ঠিক সেভাবেই পৌঁছে যান আম আদমির জন্য করে রাখা সুলভ শৌচাগারে। ‘কিন্তু সেখানে যে প্রবল ময়লা! কাদার সঙ্গে মাখামাখি করে থাকে অন্যের শরীর থেকে বেরনো খারাপ জল।’ আমতা আমতা করে আমি জিজ্ঞেস করতে পেরেছিলাম শুধু এটুকুই। তিনি উত্তর দেননি। আর্তিমাখা হাতের তালু আমার সামনে মেলে ধরেছিলেন ফের। তখন গালে চড় খাওয়ার মতো ব্যথা লেগেছিল কেন?

২০১১ সালের আদমসুমারি বলছে সারা দেশে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা প্রায় ২ কোটি ৬৮ লক্ষ। এর মধ্যে প্রায় দেড় কোটি পুরুষ। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মহিলার সংখ্যা ১ কোটি ১৮ লক্ষ। চক্ষুস্মান মানুষের সংখ্যা ৫০ লক্ষেরও বেশি। কানে ঠিকঠাক শুনতে পান না যাঁরা, তাঁদের সংখ্যাও মোটামুটি একইরকম। চলাফেরায় সমস্যা আছে ৫৪ লক্ষেরও বেশি মানুষের। ওয়াকিবহাল শিবিরের মানুষরা বলছেন, এই সংখ্যাগুলো শুধুমাত্র কয়েক বাইটের তথ্য হয়েই থেকে যায় কম্পিউটারের সার্ভারে, হাইপারলিঙ্ক হয়ে ঘুরে বেড়ায় এক সার্চ ইঞ্জিন থেকে অন্য সার্চ ইঞ্জিনের রেজাল্টে। কাজের কাজ হয়ে ওঠে না কিছুই। আর তাও বা যদি কিছুটা হয়, বাস্তবে তার প্রয়োগ হয় না।

হুইলচেয়ারবন্দি কোনও মানুষের মনে যদি ‘থাকব না কো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে’ বলে খেলা করে কয়েকটা ‘অলীক’ শব্দ, সেই সাধ মেটানোর চেষ্টা করলে তিনি কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েন। পাঁচতারা মাল্টিপ্লেক্স বলতেই পারে, ‘টিকিট কাউন্টারের পাশেই তো রাখা রয়েছে হুইলচেয়ার। আমাদের একজিকিউটিভরা আদর করে আপনাকে বসিয়ে দিয়ে আসবেন প্রেক্ষাগৃহের মধ্যে কোনও আরামদায়ক সিটে।’ ক্রাচনির্ভর কোনও মানুষ এমন প্রস্তাব শুনে মোনালিসার মতো হাসেন। বলেন, ‘সে না হয় বুঝলাম, কিন্তু রাস্তা থেকে শপিং মলে ঢোকার জন্য ব্যবস্থা কই? হুইলচেয়ারে ভর করে কি ভাবে প্রবেশ করতে পারব মলের গর্ভে?’ উত্তর মেলে না। রাস্তার উপরে কোনও সাজানো দোকানে যদি ঢুকতে সাধ হয় এমন কোনও মানুষের, তা কর্পূরের মতো উবে যায় সহজে। দোকানে ওঠার সিঁড়ির মধ্যে অন্তত ফুটতিনেকও যদি ঢালু করা থাকত মসৃণভাবে, তাহলে এই সমস্যার হয়তো সমাধান হতো অনেকটাই। দৃষ্টিশক্তি হারানো কোনও মানুষ যদি ভাবেন রাস্তা পেরোবেন কিভাবে, তার উত্তর দিতে খাবি খায় আমাদের সমাজ। চক্ষুস্মানদের নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার ‘বাড়তি’ সময় আছে যাঁদের, তাঁদের একটা বড় অংশ অনেকবার বলেছেন ট্রাফিক সিগনালের সঙ্গে অন্তত মানানসই কিছু শব্দ ব্যবহার করার কথা। মানে, সিগনাল লাল থেকে সবুজ, কিংবা উল্টোটা হওয়ার সময় যদি নির্দিষ্ট কিছু ধ্বনি ব্যবহার করা হয়, তাহলে হাতে লাঠি নিয়ে চলা অন্ধ মানুষটির হয়তো কিছুটা সুবিধা হয়। না, এই ব্যবস্থা প্রয়োগ হয়নি কোথাও। বিশেষ চাহিদা বলতে তো শুধু শরীর নয়, মনেরও চাহিদা বোঝায়। দুর্ঘটনায় দৃষ্টি হারানো, বইপাগল এক মানুষকে বলতে শুনেছিলাম, ‘আমার জীবন থমকে গিয়েছে।’ প্রিয়জনদের দেখতে না পাওয়ার সঙ্গে তাতে মিশে ছিল প্রিয় অক্ষরগুলোর সঙ্গেও সম্পর্ক হারানোর আক্ষেপ। বলেছিলেন, ‘নেশার মতো পড়তাম যে সাহিত্যিকদের লেখা, তাঁদের গল্প-উপন্যাসগুলো পড়তে প্রাণ আনচান করে। উপায় নেই।’ ব্রেলস্ক্রিপ্টের জনক ল্যুই ব্রেলের নাম মুখে আনার সময় হাতটা জোড় করলেন। তারপর বললেন, ‘ব্রেলসাহেব যতটুকু করে গিয়েছেন, তার পরে আর সেভাবে কাজ হল কই? শারদীয় সংখ্যাগুলোতে যে উপন্যাসগুলো বেরোয়, তা পড়ার জন্য মনের ভিতরটা আকুলিবিকুলি করতে থাকে। তবে প্রাণ চায়, সমাজ না চায়। ব্রেইলের দরকার নেই। পরের বছর বইমেলার সময় যখন গুচ্ছগুচ্ছ বই প্রকাশ করেন প্রকাশকরা, তখন ভাবতে পারতেন অডিওবুকের কথা। হলফ করে বলতে পারি ভাই, ব্যবসা মার খেত না। আমাদের জগৎ যে ওটুকুই।’

বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষদের ভাল চেয়ে বহু মুনির বহু মত হাওয়ায় ওড়ে। মেলা থেকে কেনা দশ টাকার বাবল্ তৈরি করা যন্ত্রের সাবানের বলের মতো তা মিলিয়ে যায় জলদি। উইনস্টল চার্চিল বলেছিলেন, ‘তুমি যদি নরকের মধ্যে দিয়েও যাও, যেতে থাকো।’ কিপ গোয়িং। এর মানেটা কিছুই না, অন্ধকার সুড়ঙ্গের শেষে আলোর রেখা আসবেই। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষরা সেই আলোটা অনুভব করতে চান প্রাণভরে। এই আলোর মানে ফ্লাডলাইট নয়। টর্চের সামান্য আলোতেও তারা সন্তুষ্ট। সামাজিকভাবে এইটুকুও কি আমরা তাঁদের জন্য করতে পারি না?