আরেক রকম ● দশম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা ● ১৬-৩১ জানুয়ারি, ২০২২ ● ১-১৫ মাঘ, ১৪২৮

প্রবন্ধ

বাঙালীর সংস্কৃতি ও সমন্বয়ের ঐতিহ্য

অর্ণব রায়


বাঙলা যার মাতৃভাষা সে-ই বাঙালী। রবীন্দ্রনাথ ‘বাঙলা ভাষা পরিচয়’-তে লিখেছিলেন - ‘এতকাল আমাদের যে বাঙালী বলা হয়েছে, তার সংজ্ঞা হচ্ছে, আমরা বাঙলা বলে থাকি’। ব্যক্তিগত ধর্মপরিচয়ের দিক থেকে তিন ধর্মপরিচিত তিন প্রতিভা রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম, মাইকেল মধূসুদনকে বাঙালীরা নিজেদের পরম শ্রদ্ধার স্হান দিয়েছে৷ আবার, ঊনবিংশ শতাব্দীতে ধর্মাচার-আবদ্ধ সমাজে বিদ্যাসাগরেরর মত ধর্মাচরণ না করা ব্যক্তিত্বকেও বাঙলার নবজাগরণের অন্যতম স্রষ্টা বলে বাঙালী স্বীকৄতি দিয়েছে৷ এঁরা এবং এঁদের আলোকবাহী চিন্তার অন্য সহকর্মীরা পরবর্তী প্রায় দুই শতাব্দী ধরে সহমর্মিতাবোধে আধুনিককালের উজ্জ্বল বাঙালী সংস্কৄতির অন্যতম কারিগর৷ ভারতে ব্রিটিশদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থজনিত সাম্প্রদায়িক বিভেদমূলক কর্মসূচী সত্ত্বেও বাঙালী সমন্বয়ের পরিচয় দিয়েছে৷ ব্রিটিশদের দুরভিসন্ধিমূলক ধর্মপরিচয়ের ভিত্তিতে বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবকে আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে রুখে দিয়েছে৷ বাঙালী জাতি নিজ নিজ ধর্মাচার, সামাজিক‍‍-আচারের পার্থক্যগুলিকে বহুক্ষেত্রে বজায় রেখেছে, কিন্তু সামাজিক পরিবেশে, রাজনৈতিক কাজে মোটামুটিভাবে সম্মিলিত পদক্ষেপের সংস্কৄতি গড়ে তুলেছে। সংগীত, নৄত্যকলা, চিত্রাঙ্কন, ভাস্কর্য, খেলাধূলা প্রভৄতি ক্ষেত্রেও বাঙালী বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে শুধু সহিষ্ণুতা নয়, সহযোগিতা ‌আদান-প্রদানের ধারায় বিকশিত হয়েছে। সাম্প্রদায়িকতাজনিত বিভেদচিন্তা, জাতপাতভিত্তিক সঙ্কীর্ণতা বাঙালী জাতির মনন ও সংস্কৄতিতে অগ্রাধিকার পায়নি। স্বাধীনতার সময় সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের চাপানো দেশভাগ দেশের অন্যান্য অংশভাগের মত বাঙলা ভাগকেও বাঙালীকে যে মেনে নিতে হয়েছে তা সে সময়কার স্বাধীনতা সংগ্রামের দেশীয় নেতৄত্বের ক্ষমতায় পৌঁছানোর তাড়াহুড়ো ও অবিমৄষ্যকারিতার জন্য - তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু তা বয়ে এনেছে লক্ষ লক্ষ ছিন্নমূল উদ্বাস্তু জীবনের যন্ত্রণা, সে তো তার অনিবার্য পরিণাম।

যদি আমরা পিছন ফিরে তাকাই, সংস্কৄতি ও জাতিগঠনের প্রধান বাহন যে ভাষা, সেদিক দিয়ে বাঙলা ভাষা গঠনেও বহু নৄতত্ত্বগোষ্ঠীর ভাষার অবদান আছে। অর্থাৎ, বাঙলা ভাষা সংগঠিত আকার নিতে শুরু করেছে অনেক সমন্বয়ের মধ্যে দিয়ে। ভাষাতত্ত্ববিদ সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে পাঁচটি বিভিন্ন রকমের ভাষা ব্যবহারকারী প্রাচীন জনগোষ্ঠীর মিশ্রণে বাঙালী জাতি গঠিত হয়েছে - নেগ্রিটো, অষ্ট্রিক, দ্রাবিড়, আর্য, তিব্বত-চিন বা সাইনো-টিবেটিয়ন। বিভিন্ন দিক থেকে তারা এসেছিল। তবে, প্রধানত, অষ্ট্রিক, দ্রাবিড়, মিশ্র আর্যদের মিশ্রণে বাঙালী জাতি তৈরী হল। খ্রিস্টপূর্ব (বিসি) ৩০০ নাগাদ মৌর্য রাজত্বের সময় থেকে পূর্ব ভারতের গাঙ্গেয় উপত্যকায় সুগ্রথিত রাষ্ট্র্রভিত্তিক সভ্যতার পত্তন হয়। উত্তর-পশ্চিম ভারতে ইতিমধ্যে আর্য ও বিশেষত দ্রাবিড় ও অষ্ট্রিক প্রাগার্য, মিলেমিশে সমবায় ধাঁচের হিন্দুধর্মের বিভিন্ন জাতি গড়ে ওঠে। তবে, প্রাগার্যদেরকে মূলত নীচুজাত বা শূদ্র হিসাবে চিহ্নিত করে শ্রমসাধ্য কাজগুলি করার দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং তাদের শোষিত হওয়াই একমাত্র ভবিতব্য বলে হিন্দুধর্মে ও সমাজে স্বীকৃত হয়। নিজের ইচ্ছা ও যোগ্যতা থাকলেও বৃত্তি পাল্টানো যাবে না, তা জন্মসূত্রেই চিরজীবনের মত নির্ধারিত হয়ে যায় - এমন কঠোরতম অনুশাসন পৃথিবীর আর কোন দেশের ধর্মে-সমাজে দেখা যায়নি সম্ভবত। নিয়তিবাদ প্রাচীন ভারতের হিন্দু ধর্মের এক অদ্ভূত আবিস্কার। এসব নিয়েই সংগঠিত হতে থাকা বহুত্ব-বিশিষ্ট ভারতীয় সংস্কৃতি মৌর্য রাজত্বে গাঙ্গেয় উপত্যকা ধরে বাঙলায় প্রবেশ করে - তখন দেশের রাজার ধর্ম ছিল বৌদ্ধ। অষ্ট্রিক গোষ্ঠীই প্রথম কৄষিকাজ ও সুসভ্য জীবনের প্রবর্তন করে। বহু উথ্বান-পতনের পর, পাল রাজাদের প্রতিষ্ঠার দুই শতকের মধ্যে, মোটামুটিভাবে দশম শতকের সময় মাগধী প্রাকৄত এবং বঙ্গদেশে প্রচলিত তার অপভ্রংশ থেকে একটু বিশিষ্ট চেহারা নিয়ে বাঙলা ভাষা একটি স্বতন্ত্র ভাষা হয়ে উঠল। পাল ও পরে সেন রাজাদের সময় বাঙ্গালী সংস্কৃতির ভিত্তি তৈরী হল, বলা যায়। তারপর বাঙলায় তুর্কী আক্রমণ ও বিজয় হল। তাদের কিছু লোক বাঙলায় রয়ে গেল। তারা বাঙলা পরিচালনার জন্য প্রশাসনে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের প্রচুর সাহায্য পেল। এটাই স্বাভাবিক - শাসকশ্রেণীর অংশ হিসাবে প্রশাসনের হিন্দু-মুসলমানদের শ্রেণীগত ঐক্য ছিল, পরবর্তী মোগল আমলেও ছিল। থেকে যাওয়া তুর্কীদের বাঙলার রমণীদেরকেই বিয়ে করতে হল - তাদের সন্তান, সেই সন্তানদের সন্তান, তাদের পরবর্তী প্রজন্মরা বাঙালী হিসাবেই গড়ে উঠল। স্তেপভূমি অঞ্চল থেকে পরিযান হতে হতে ইরান ঘুরে ভারতে এসে আর্যরা যেমন প্রাগার্যদের সঙ্গে মিশে ভারতীয়, বাঙলায় এসে বাঙালী হল, তেমনি তুর্কী, পরে মোঘলরাও তাই-ই হল। হিন্দু ধর্মের জাতপাতের অত্যাচার-শোষণের কারণে প্রাগার্যদের নিচুবর্ণের বহু মানুষ বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিল। বৌদ্ধধর্ম প্রান্তিক হয়ে যাওয়ার পর তাদের অনেকে ব্রাহ্মণবাদী হিন্দু ধর্মের বাইরে প্রান্তিক অনুষ্ঠানে, আচারে, প্রতীকি উপাসনায়, নতুন-গুরুবাদে অভ্যস্ত হয়ে উঠল। পরে এরাই আউল, বাউল, বৈষ্ণব, সাঁই, দারবেশ, লালন ফকির, সাহেবধনী, কর্তাভজা, খুশী, সহজিয়া ইত্যাদি সম্প্রদায় হল, অনেকে মুসলিম ধর্ম নিল। এরা হিন্দু-মুসলমান বিরোধ নিয়ে মাথা ঘামাত না, জাতপাত মানত না। কোন ব্যয়বহুল ধর্মীয় বা সামাজিক অনুষ্ঠান করত না। সমাজে যন্ত্রণাময় শ্রেণীবিভাগ, কঠোর জাতিবিভাগ - সেসব কষ্টের কথা বেরিয়ে এসেছে তাদের প্রান্তিক সাধনায়, গানে, কবিতায়। তবে, একটা বৈশিষ্ট্য দেখা গেল এই সময়ের শাসনে - দিল্লীর তুর্কী আমলের প্রশাসনে মুসলমান-হিন্দুর মিলিত শাসন থেকে অনেকটা স্বাধীনভাবেই এখানে মুসলমান-হিন্দু প্রশাসনিক কর্তারা মিলে শাসন-শোষণ ব্যবস্থা চালাত। শাসকের সংস্কৃতিই সমাজে প্রাধান্য পায় সাধারণত - তাই বাংলার সাধারণের সংস্কৃতিতে একটা স্বাতন্ত্র্য তৈরী হল - যা উত্তর-পশ্চিম ভারতের থেকে বেশ কিছুটা আলাদা।

তবে, বৌদ্ধ বুদ্ধিজীবীদের হাতে নতুন চেহারার ভাষা, অর্থাৎ প্রাচীন বাঙলা ভাষায়, সাহিত্য, গান ইত্যাদি তৈরী হতে শুরু করেছিল। তারা ছিলেন মূলত ব্রজযানী বৌদ্ধ। বাঙ্গলা সাহিত্যের শুরু চর্যাপদ থেকে, যা সিই (খ্রীঃ) দশম শতাব্দী থেকে ধরা হয়। বাঙলা সাহিত্যের জন্মতে হিন্দু বা মুসলমান ধর্মের মানুষদের কারুরই ভূমিকা নেই - তা ঐতিহাসিক সত্য। পরে মুসলমান সুফী, দরবেশ, পীর, গাজীরা ধর্মপ্রচারের জন্য বাঙলায় আসে। তাদের, বিশেষত সুফী মতের ইসলাম সংস্কৄতি এবং হিন্দুধর্মের যে অংশ উদার, তাদের মধ্যে কোন বিরোধ হয়নি। বস্তুত, বৌদ্ধধর্ম এক হাজার বছর ধরে ভারতবর্ষের প্রধান ধর্ম ছিল, তারপর ক্রমে দেশ থেকে বৌদ্ধধর্ম প্রায় নির্বাসিত হয়ে গেল। তবুও, বাংলায় বৌদ্ধধর্ম তারপরও কয়েক শতাব্দী ধরে টিঁকে থেকেছে। বৌদ্ধ পাল রাজারা দ্বাদশ শতক অবধি রাজত্ব করছিলেন। বৌদ্ধধর্ম বাঙলার সংস্কৄতিতে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে এসেছিল। বৌদ্ধধর্মের জাতপাতহীনতা, মানুষের মধ্যে সাম্য ও মৈত্রীর কথা মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। বাণিজ্যকেন্দ্র হিসাবে সমুদ্রপথের ব্যবহার বাঙলা থেকে দীর্ঘদিন ধরে চালু ছিল। বিসি (খ্রীস্টপূর্ব) ৪০১-তে চিনা পর্যটক ফা হিয়েন ভারতে এসেছিলেন খোটান ও আফগানিস্তান হয়ে, ভারত ছেড়েছিলেন তাম্রলিপ্ত (এখন যাকে তমলুক বলা হয়) বন্দর থেকে। কলকাতার কাছে গঙ্গার মোহানা থেকে ইউরোপে সূতীবস্ত্র, দেশের অন্যান্য জায়গা থেকে পণ্য বাঙলাতে জড়ো হয়ে সমুদ্রপথে বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ত। ফলে বহির্দুনিয়ায় সংস্কৃতি, মননের সংস্পর্শ ঘটত এখানকার বণিকদের, সেইসূত্রে বহু মানুষদের সঙ্গেও। বিশিষ্ট ঐতিহাসিক অ্যাডাম স্মিথ সে সময়ের বাঙলাকে অন্যতম সমৃদ্ধ অঞ্চল বলেছেন। হিন্দু ও মুসলিমদের পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতেই এই সমৃদ্ধি গড়ে উঠেছিল। রামায়ণ, মহাভারত সংস্কৃত থেকে বাঙলা ভাষায় অনুবাদের কাজটি প্রথম হয় মুসলমান শাসকদের আগ্রহে। বাঙলার মুসলমান রাজসভায় বিপুল পরিমাণে হিন্দুরা ছিলেন। এসব দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে যুক্ত সংস্কৃতি গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল। প্রকৃতপক্ষে, বাঙলার এই সংস্কৃতি শুধু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বা সহিষ্ণুতার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, তা পারস্পরিক সহযোগিতার আদান-প্রদানের স্তরে দৃঢ়ভাবে উন্নীত হয়েছিল। বাঙলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজৌদ্দোল্লার সময় পর্যন্ত বাংলার শাসনব্যবস্থার বিভিন্ন স্তরে হিন্দুদের উপস্থিতি যথেষ্টই ছিল এবং ধর্মনিরপেক্ষতার মুল্যবোধটি সাধারণভাবে বজায় ছিল। শাসকশ্রেণীর মধ্যে যেমন, শোষিতশ্রেণীর মধ্যেও তেমন ধর্মীয় বা জাতপাতের বিভাগের চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল সম্প্রীতির বিষয়গুলি - পরে যার ব্যতয় ঘটতে থাকে ব্রিটিশদের চতুর ‘ভাগ করো ও শাসন করো’ নীতির অনুসরণে।

ব্রিটিশদের বিভেদকারী শাসনব্যবস্থা সত্ত্বেও এই মিলন ও সহযোগিতার ঐতিহ্য বাঙলার সংস্কৃতি হিসাবে বজায় ছিল এবং বহু দিকে বিস্তৃত হয়েছিল। পূজা ও ঈদ, জন্মাষ্টমী ও মহরম, নানারকম নৃত্য, সঙ্গীত, ক্রীড়া দুই সম্প্রদায় পাশাপাশি চালিয়েছে। বাঙলা নববর্ষ উৎসব উদযাপন হিন্দু-মুসলমান একসঙ্গেই করেছে। কীর্তন, বাউল, ভাটিয়ালী, ঝুমুর, টপ্পা, কবিগান, তরজা, পাঁচালী, খেয়াল, ধ্রুপদী, পয়ার, সুফীগান, শাক্ত-শৈব-বৌদ্ধ মঙ্গলকাব্যের উপাখ্যান, বেহুলা-লখীন্দর কথা, কালকেতু-ফুল্লরা কথা প্রভৃতি সাংস্কৃতিক চর্চার বিভিন্নতা বাঙলার বহু শতাব্দীর বৈশিষ্ট্য হয়ে থেকেছে। হিন্দুধর্মের মধ্যেও বহুমুখী স্রোত বাঙলার সংস্কৃতিতে মূর্ত হয়ে উঠেছে। শ্রুতিপণ্ডিত-নৈয়ায়িক-স্মার্তদের ব্যাখ্যা, চৈতন্যকথা, বৈষ্ণবপদ, ব্রজবুলি প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। বাঙলার সংস্কৃতিতে সুফিবাদ ছাড়াও ব্রত ও বাউলের প্রভাব প্রচুর। ব্রত ও বাউলে মানবিকতার স্পর্শ মুখ্য হয়ে উঠেছে - তাতে নারীর কথাও যথেষ্ট। উত্তর বা পশ্চিম ভারতে পুরুষই প্রধান। বাঙলায় আদিতন্ত্রের প্রভাব ভালই ছিল, আদিতন্ত্রের দেহবাদ আজকের দৃষ্টিতে বিকৃত লাগলেও, প্রাচীনকালের প্রেক্ষাপটে তা দেখেছেন বিশিষ্ট দার্শনিক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় - তিনি বলেছেন, প্রাচীন তন্ত্রে আদি বস্তুবাদের অনেক ধারণা ছিল। তন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল - নারীদের প্রাধান্য। যে কথা আগে বলেছি যে, বাঙলায় একটা স্বাতন্ত্র্য ছিল - তার প্রভাব আমরা দেখতে পাই এখানে হিন্দুধর্মের বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও। হিন্দুধর্মে বরাবরই বহু বিভিন্নতা, বহু বৈচিত্র্য। বাঙলায় বিভিন্ন উৎসব পালন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে এসব আরো যেন মূর্ত হয়ে উঠেছে। রথযাত্রা, ঝুলন, ভাদু, গোপোৎসব, দোল, দুর্গাপূজা, বিজয়া, ইতু, চড়ক, নীল, গম্ভীরা, ধর্মীয় যাগযজ্ঞ বা ভাবের চেয়ে অনেক বেশী সামাজিক আন্তরিকতা, মানবীয় ভাবে সম্পৃক্ত থেকেছে। ধর্মের চেয়ে দেশাচার, লোকাচার পালন বড় হয়েছে। কিন্তু হিন্দু-মুসলমানে, হিন্দুদের বিভিন্ন জাতপাতে ছোঁয়াছুঁয়ি, বাছবিচার এসবও বহু ক্ষেত্রে থেকেছে পারিবারিক প্রথার মত। হিন্দুধর্মের পুরুষরা - পুরোহিতরা পরিবারের নারীদের শিখিয়েছে, অন্য ধর্মের-জাতের নারী-পুরুষকে বাড়ির ভিতরে ঢুকতে না দেওয়া, তাদের রান্না করা খাবার না খাওয়া ইত্যাদি ধর্মের দিক থেকে অবশ্য পালনীয়। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে পরস্পর পরস্পরের প্রতি মঙ্গলকামনাই করে এসেছে।

মুর্শিদাবাদের খাগড়াতে কাঁসার বাসন, বিষ্ণুপুরের পিতল-কাঁসার বাসন, বনপাস (বর্ধমান) ও ঢাকার পিতলের বাসন, নবদ্বীপের মূর্তি ঢালাই, কুমিল্লাতে ইস্পাতের কাজ প্রভৃতি বিভিন্ন কারিগরী শিল্প গড়ে উঠেছিল। বাঙলার বস্ত্রের মধ্যে ঢাকার জামদানী-মিহি-মলমল, টাঙ্গাইল-শান্তিপুর-ফরাসডাঙ্গার তাঁতের শাড়ি ও ধুতি, কুমিল্লার ময়নামতী শাড়ি, মুর্শিদাবাদের রেশম-গরদ-তসর, রাজশাহীর মটকা, বীরভুম-বাঁকুড়া-বিষ্ণুপুরের রেশম, মেদিনীপুরের মাদুর, শ্রীহট্টের শীতলপাটি বিখ্যাত ছিল। বাঙলার খাদ্য ও রন্ধনের বিশেষ সুখ্যাতি বহুদিন - মাছ ও মাংসের রকমারী পদ, শাক, শুক্তানি, ঘন্ট, নিরামিষ ব্যঞ্জন, নারকেল, ক্ষীর, ছানার মিষ্টান্ন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বাঙলার সংস্কৃতিতে বহুত্ববাদ আজও অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হিসাবে সজীব রয়েছে।

কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সংকীর্ণ সুবিধাবাদী দক্ষিণপন্থী রাজনীতি বাঙলাকে আপাত দখল করেছে - ফলে জাতপাত, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ তৈরি হচ্ছে, বাড়ছে। ব্রিটিশরা যে ভেদাভেদের জমি তৈরী করেছিল তার পরিণতিতে দেশভাগের অব্যবহিত পূর্বে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটেছিল - যা ‘গ্রেটার ক্যলকাটা কিলিং’ নামে কুখ্যাত হয়ে আছে। ঢাকা শহরেও সেসময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটেছিল। তা পেরিয়ে বাঙলা মোটামুটিভাবে স্বাভাবিক সম্প্রীতির ছন্দে ফিরেছে - এপার বাঙলায় বামপন্থী রাজনীতির বিকাশ তার অন্যতম কারণ নিশ্চয়। মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি শ্রেণী, অর্থনীতির মৌলিক বিশ্লেষণ থেকে সমাজকে বিচার করে। তা ধর্মকেও সেভাবে দেখে। বাঙলায় বিগত ও এই শতাব্দীতে সাড়ে তিন দশকের বামপন্থী সরকারের সময় ধর্ম নিয়ে সরকার-পরিচালকদের সরাসরি অংশগ্রহণ ছিল না, ধর্মীয় উস্কানিমূলক কাজ থেকে নিজেদেরকে তারা দূরে রাখতে পেরেছিলেন। যদিও প্রত্যেক নাগরিকের ধর্মাচরণের সাংবিধানিক অধিকার তারা রক্ষা করেছেন সাধ্যমত। কিন্তু রাজনীতি সবসময় এক খাতে বয় না, ভোটের রাজনীতির ক্ষেত্রে একথা আরো প্রযোজ্য। ধর্ম আর সাম্প্রাদায়িকতার মধ্যে পার্থক্য আছে, কিন্ত মানুষের ধর্মীয় দুর্বলতাকে বাহন করে সুপ্ত ও প্রকাশ্যে সাম্প্রদায়িকতার পরিবেশ গড়ে তোলা হচ্ছে। রাজ্যে সাম্প্রদায়িক জাতপাতজনিত বিভেদকারী শক্তি আস্ফালন দেখাবার সাহস পাচ্ছে। দেশের পরিস্হিতিও এদিক থেকে আজ কঠিন। আজ নিজেদের সম্প্রীতির ঐতিহ্য-বনিয়াদকে যদি নিয়মিত চর্চা বা যত্ন না করা হয়, নানা প্ররোচনা কখনো কখনো বিপুল বিভ্রান্তি ছড়াতে পারে, যার পরিণতি ভয়ঙ্কর হয়ে যেতে পারে। বাঙলার চিন্তায় যে ধর্মনিরপেক্ষতার উজ্জ্বল বোধ, সাম্প্রদায়িক-জাতপাতগত সহিষ্ণুতা-সহযোগিতার সংস্কৃতির প্রবাহমান সুদূর অতীত থেকে আজ, নানা বাধা উস্কানি বিকৃত-মিথ্যা প্রচার সত্ত্বেও - তাকে স্রোতস্বিনী রাখতে হবে। এপার বাঙলার সঙ্গে ওপার বাঙলার হৃদয়ের যোগ আছে - তাকে আরো শক্তিশালী করতে হবে। বাঙলা ভাষা তার এক বড় বাহন - তা বিভিন্ন ধর্ম-সম্প্রদায়-জাত নির্বিশেষে ঐক্যের সুর রচনা করেছে। বাঙালীর সম্প্রীতির বন্ধনকে আরো দৃঢ় করতে হবে। ভোট আসবে, ভোট যাবে - সরকার আসবে, সরকার যাবে; কিন্তু মেহনতী-সাধারণ মানুষের সংগ্রামে ঐক্য খুবই মূল্যবান ও প্রয়োজনীয়। শ্রমজীবী মানুষের লড়াইতে যে ভয়ানক আক্রমণ ও চ্যালেঞ্জ আজ এসেছে তার বিরুদ্ধে জাতিগত বৈশিষ্ট্যের যে ইতিবাচক দিকগুলি আছে তার চর্চা করতে হবে, সেসবকে কাজে লাগাতে হবে, মানুষের কাছে নিয়ে যেতে হবে। আগামী প্রজন্মের জন্য এটা আমাদের অবশ্য কর্তব্য।