আরেক রকম ● দশম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা ● ১৬-৩১ জানুয়ারি, ২০২২ ● ১-১৫ মাঘ, ১৪২৮

প্রবন্ধ

ফিরে দেখাঃ কুরোসাওয়ার অবিস্মরণীয় ছবি রাশোমন

জিম ইসমাইল


আপনাদের অনেকেই 'রাশোমন এফেক্ট' শব্দবন্ধটির সঙ্গে পরিচিত। এটি এমন এক পরিস্থিতি যখন একই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা সেই ঘটনার পরস্পরবিরোধী কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য বিবরণ দেয়। একই ঘটনাকে, ঘটনার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন ব্যক্তিরা বিভিন্নভাবে ব্যক্ত করছে। এবার আসা যাক 'রাশোমন এফেক্ট' বা 'কুরোসাওয়া এফেক্ট' শব্দবন্ধটির গোড়ার কথায়।

রাশোমন (১৯৫০) আকিরা কুরোসাওয়ার দ্বাদশতম ছবি। এর আগে পর্যন্ত কুরোসাওয়া নিজ দেশে অসংবর্ধিত একজন পরিচালক। উন্নাসিক পশ্চিমি চলচ্চিত্র দুনিয়াতেও জাপান অসংবর্ধিত একটি দেশ। কিন্তু ১৯৫১ সালের ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে যখন 'রাশোমন' সেরা ছবির শিরোপা পেল তখন ছবিটা পাল্টে গেল। এর কিছুদিন পরে ১৯৫২ সালে সেরা বিদেশি ছবির জন্য অস্কারও পেল। আর কে না জানে পশ্চিমের গবাক্ষ দিয়ে প্রাচ্যের সূর্যোদয় না দেখলে আমাদের সূর্য দেখা সফল হয় না! রাশোমন ছবির সাফল্য জাপানি চলচ্চিত্র সম্পর্কে বহির্বিশ্বের দর্শক-সমালোচকদের আগ্রহী করে তোলে এবং একজন মহৎ পরিচালক হিসেবে কুরোসাওয়ার সঙ্গে সারা বিশ্বের পরিচয় হয়। ডোনাল্ড রিচি তাঁর 'The Films of Akira Kurosawa' বইতে রাশোমন সম্পর্কে এক জায়গায় বলছেন, "Actually, of course, what had happened is that in this film the confines of ‘Japaneese’ thought could not contain the director who thereby joined the world at large. Rashomon speaks to everyone, not just to the Japaneese."

ছবির সময়কাল একাদশ শতাব্দী। সংকটপূর্ণ সময়ের প্রেক্ষাপট। জাপানের কয়োটা শহরের সিংহদুয়ার রাশোমন দরজা। ভাঙা দরজা। বিশ্বাসহীন, সংযোগহীন এক অস্থির সময়ের প্রতীক রাশোমন দরজা। বাইরে প্রবল বর্ষণ। বৃষ্টিতে আটকে এই সিংহদুয়ারে জড়ো হয়েছেন তিন জন - এক কাঠুরে, এক বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং একজন সাধারণ মানুষ। সেই ভিক্ষু এবং কাঠুরে একটু আগেই আদালত থেকে সাক্ষ্য দিয়ে ফিরেছে। কাঠুরে চিন্তিত স্বরে বলে ওঠে,

"আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা!
আমি কিছুতেই কিছু বুঝে উঠতে পারছিনা!"

ভিক্ষুরও এক অবস্থা। তিনিও কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না। সাধারণ মানুষটি কৌতূহলী হয়ে তাদের কাছে জানতে চায় কী হয়েছে। কথা জমতে শুরু করে। কাঠুরে জানায়, এক সামুরাই ও তার স্ত্রী গভীর জঙ্গলে যাচ্ছিল। তাদের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় তাজোমারু (তোশিরো মিফুনে) নামে এক দস্যুর। তাজোমারু সামুরাইকে হত্যা করে ও তার স্ত্রীকে ধর্ষণ করে। এই পুরো ঘটনার সাক্ষী সেই কাঠুরে। একটি হত্যা এবং যৌন অপরাধ ঘটে, একটি গভীর জঙ্গলে। অসাধারণ ক্যামেরার কাজে আমরা দেখি আলো-ছায়ার মায়াজালে সেই গভীর জঙ্গল। এই জঙ্গল হল সেই জায়গার সিম্বল যেখানে এসে মনুষ্য হৃদয় পথ হারিয়ে ফেলতে পারে, বিচ্যুতি ঘটে যেতে পারে।

রাশোমন এর প্রধান অংশটি একটি অ্যানেকডট যেটি চারবার চারভাবে আমাদের সামনে ফিরে ফিরে আসে। আদালতে বিচারকের সামনে হাজির হয় ধর্ষিতা মহিলা এবং দস্যু তাজোমারু। কিন্তু দেখা যায় তাদের দুজনের ঘটনার সংস্করণ ভিন্ন। বিচারালয়ে নিজের বয়ান দিতে এসে দস্যু জানায়, সামুরাই-এর স্ত্রীকে যৌন অত্যাচার করে সে চলে যাচ্ছিল কিন্তু মহিলা তাকে ও তার স্বামীকে তরবারি যুদ্ধে আহ্বান জানায়। যুদ্ধে যে বেঁচে থাকবে, মহিলা তার সঙ্গেই থাকতে চায়। দস্যু যুদ্ধে সামুরাইকে পরাজিত করে ও তার তরবারি দিয়ে হত্যা করে।

মহিলা তার বয়ানে বলে, তাকে ধর্ষণ করে দস্যু সেখান থেকে চলে যায়। কিন্তু মহিলা দেখে তার স্বামীর চোখেমুখে তার প্রতি ঘৃণা। এরপর সে রাগে-দুঃখে তার ছোরাটি দিয়ে স্বামীকে হত্যা করে। এবারে সাক্ষ্য দিতে আসে মৃত সামুরাই-এর আত্মা। আত্মা তার বয়ানে জানায়, ধর্ষণের পর তার স্ত্রী তাজোমারুর সঙ্গে চলে যাবার উপক্রম করে। চলে যাবার আগে সে দস্যুকে বলে স্বামীকে হত্যা করতে। তাজোমারু রাজি হয়না। মহিলা সেখান থেকে পালিয়ে যায়। তাজোমারু সামুরাইকে বন্ধনমুক্ত করে তারপর চলে যায়। তীব্র মনোকষ্টে সামুরাই ভেঙ্গে পড়ে। বেদনাহত হয়ে সে তার স্ত্রীর মুক্তোখচিত ছোরা দিয়ে আত্মহত্যা করে। সবশেষে কাঠুরের একটি ভাষ্য পাওয়া যায়, সেটি আবার বাকি তিনজনের থেকে আলাদা!

দেখা যাচ্ছে কারও বয়ানের সঙ্গে কারও বয়ানের মিল নেই। সাক্ষীদের নিজেদের প্রেক্ষিতে বলা ঘটনার বিবরণ পরস্পরবিরোধী। তাহলে প্রকৃত সত্য কি? হত্যা নাকি আত্মহত্যা? হত্যা হলে, কে হত্যাকারী? মহিলাকে ধর্ষণ করা হয়েছিল নাকি মহিলা নিজেই দস্যুকে প্রলুব্ধ করেছিল? চরিত্রগুলির পরস্পরবিরোধী ন্যারেটিভে 'প্রকৃত সত্য' মূর্ত হয়ে ওঠেনা। পরিচালক প্রশ্ন তুলে দেন, 'অ্যাবসোলিউট ট্রুথ' বলে আদৌ কিছু হয় নাকি সত্য আপেক্ষিক? এই ছবি সত্য, ন্যায়বিচার ইত্যাদি সম্পর্কে আমাদের নতুন করে ভাবায়। ছবি মুক্তির পরে কিছু সমালোচক জানতে চেয়েছিলেন প্রকৃত হত্যাকারী কে? এই প্রশ্নের উত্তর যে অত প্রয়োজনীয় কিছু নয় সেটা তারা বোঝেননি। পুরো ছবিতে আদালত প্রাঙ্গণে বিচারককে একবারের জন্যও দেখানো হয়না। দেখানো হবে কেন, পর্দার এপারে দর্শকই হল বিচারক। দর্শকই বিচার করবে 'সত্য' আসলে কী!

কুরোসাওয়ার অধিকাংশ চলচ্চিত্রের ভরকেন্দ্র হল কনট্রাস্ট বা কনফ্লিক্ট। এই দ্বন্দ্ব হল তাঁর ছবিগুলির চালিকা শক্তি। রিয়েলিটি এবং ইল্যুশন-এর দ্বন্দ্ব ছবিটিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এই ছবিতে হত্যা এবং যৌন অপরাধ হল রিয়েলিটি। চরিত্রদের ভাষ্যগুলি হল ইল্যুশন। রাশোমনে, রিয়েলিটি এবং ইল্যুশন-এর দ্বন্দ্বে সাবজেক্টিভ ট্রুথ, অবজেক্টিভ ট্রুথকে ছাপিয়ে যায়।

ভুলে গেলে চলবে না যে, চিরায়ত সৃষ্টি কেবলমাত্র বক্তব্য দিয়ে হয়না, একইসঙ্গে প্রয়োজন শৈলী। বিশ, তিরিশ অথবা চল্লিশের দশকের জাপানি ছবিগুলো দীর্ঘ ও ধীর গতির। ক্যামেরার নড়াচড়া কম। ঘটনার ঘনঘটাও কম। রাশোমন এ ক্যামেরা ব্যবহারে বিপ্লব আনলেন কুরোসাওয়া। ক্যামেরা এই ছবির অন্যতম পারফর্মার। পশ্চিমি দর্শকেরা কল্পনা করতে পারেননি যে জাপানি ফিল্ম, প্রযুক্তিকে এত ব্রিলিয়ান্টলি ব্যবহার করতে পারে! কুরোসাওয়া অল্প সময়ের মধ্যে ছবির মেজাজ তৈরি করে দেখালেন। তাঁর কম্পোজিশন শৈলী দিয়ে ভিজুয়াল টেনশন তৈরি করলেন। শুধু ক্যামেরা মুভমেন্ট নয়, অভিনেতাদের মুভমেন্টও রাশোমন-এর ফ্রেমিংকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে। কুরোসাওয়া গল্প বলাতে বিশ্বাস করলেও কখনোই একটি নিটোল গল্প বলেননি। কোনও সময়েই ঘটনার পারম্পর্য রক্ষা করেন না। বারবার ফিরে যান ফ্ল্যাশব্যাকে। ইচ্ছেমত দৃশ্যগুলো নিয়ে শাফল্ করতে থাকেন। রাশোমন-এর শুরু হয় সিংহদুয়ার দৃশ্য দিয়ে, ছবিটি সমাপ্তিতে সেখানেই ফেরে। রীতিবৈচিত্র্যের দিক থেকে এও এক বৃত্তরচনা।

জাপানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্পকার রাইউনসুকে আকুতাগাওয়া-র লেখা 'ইন আ গ্রোভ' এবং 'রাশোমন' নামে দুটি গল্পকে জুড়ে দিয়ে শিনোবু হাসিমাতো এই রাশোমন ছবির মূল চিত্রনাট্য লিখেছিলেন। শিনোবুর চিত্রনাট্য মূল সাহিত্য থেকে সরে আসেনি। কুরোসাওয়া কিন্তু মূল গল্পকে অক্ষুন্ন রেখে কিছু জিনিস জুড়ে দেন। এর ফলে চলচ্চিত্রটি অন্য মাত্রা পেয়ে যায়।

দস্তয়ভস্কির সাহিত্যের প্রতি কুরোসাওয়ার প্রবল অনুরাগের কথা জানা যায়। দস্তয়ভস্কির মত কুরোসাওয়া নিজেও মানবিকতায় আস্থা হারাননি (অন্তত প্রথম দিকের ছবিগুলিতে)। সবরকম মানুষের মধ্যে তিনি মানবিক গুণের সন্ধান পেতেন। ছবির শেষে, সিংহদুয়ারের উল্টোদিক থেকে একটি পরিত্যক্ত শিশুর কান্না শোনা যায়। মিথ্যুক কাঠুরে যত্ন করে নবজাতকটিকে কোলে তুলে নেয়। জীবন আর ভালবাসার প্রতি কুরোসাওয়ার আস্থা এই ছবিতে অনুভব করতে পারি।

''কোথাও মানুষ ভাল রয়ে গেছে ব'লে
আজও তার নিঃশ্বাসের বাতাস নির্মল;
যদিও উজীর, কাজী, শহর-কোটাল
ছড়ায় বিষাক্ত ধুলো, ঘোলা করে জল
তথাপি মানুষ আজো শিশুকে দেখলে
নম্র হয়...''

প্রবল বর্ষণ থেমে যায়।

মেঘ সরে যায়।

আকাশে আলো ফুটে ওঠে।

কাঠুরে নবজাতকটিকে নিয়ে বাড়ি চলে যায়।

রাশোমন হয়ে ওঠে এক মানবিক দলিল। এবং সর্বকালীন।


তথ্যসূত্রঃ

১। The Films of Akira Kurosawa; Donald Richie.
২। Something Like an Autobiography; Akira Kurosawa; Translated by Audie E. Bock.