আরেক রকম ● দশম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা ● ১৬-৩১ জানুয়ারি, ২০২২ ● ১-১৫ মাঘ, ১৪২৮

সমসাময়িক

তাহাদের তুলনা কেবল তেনারা!


সংসদীয় পথকে ব্যবহার করে সংবিধান আনুষ্ঠানিকভাবে না বদলেও কীভাবে ফ্যাসিবাদ কায়েম করতে হয় তার আধুনিকতম নিদর্শন সঙ্ঘ পরিবারের সরকার পরিচালনা।

চিরকাল বাম ডান সবাই গান্ধী পরিবারের বদনাম করে এসেছে। সঙ্ঘ পরিবার শব্দটি আড়ালে চলে গেছে। থাকলেও আদর্শ একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন রূপে দেখে আসছে।

অথচ পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম একটি সংগঠন।

আমেরিকার ক্লু ক্ল্যাক্স ক্লানের মতো গণশিকার বা লিঞ্চিংয়ে বিশ্বাসী, জার্মানির হিটলারের মতো জাতি ও ধর্মবিদ্বেষী, শিশুদের মনকেও বিষিয়ে তুলেছে।

'দ্য টেলিগ্রাফ' পত্রিকা প্রথম পাতায় ছবি দিয়ে দেখিয়েছে, কোট টাই পরা আধুনিক স্কুলের ছাত্ররা শপথ নিচ্ছে, মুসলিমদের গণহত্যা করার। বহুদিন ধরেই শিশুদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। অথচ কোনো সরকার ব্যবস্থা নেয়নি সঙ্ঘ পরিবারের বিরুদ্ধে।‌ ব্যতিক্রম কেবল কেরলের বামফ্রন্ট সরকার। সেখানে বামপন্থীদের সঙ্গে সঙ্ঘ পরিবারের নিয়মিত সংঘর্ষ।

গান্ধী হত্যাকারী বলে জওহরলাল নেহেরুর আমলে বল্লভভাই প্যাটেল চাপে পড়ে সঙ্ঘ পরিবারকে নিষিদ্ধ করেছিলেন। সঙ্ঘ পরিবার তখন মুচলেকা দিয়েছিল, আমরা রাজনীতিতে জড়াব না। অথচ জনসংঘ তৈরি হয়েছে সঙ্ঘের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। পরে বিজেপি। এবং বেদনার বিষয়, ইন্দিরা গান্ধীর আধা ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান ঘটাতে মতাদর্শগত সম্পূর্ণ ফ্যাসিস্ট জনসংঘ ও বকলমে স্ত্রী পরিবারের হাত ধরেছেন জয়প্রকাশ নারায়ণ তো বটেই এমনকী বামপন্থীদের একটা বড় অংশ।

ফ্যাসিবাদের বিপদকে খাটো করে দেখানো হয়েছে স্বৈরতন্ত্র ও সাম্প্রদায়িকতার 'ফ্যাসিবাদ'কে সমান বিপদ ভেবে। কিছুদিন আগেই বড় মার্কসীয় তাত্ত্বিক বলে পরিচিত ব্যক্তিও দেশে ফ্যাসিবাদ আসন্ন বলে মানতে চাননি।

১৯৯৬-এ এই বিপদ বুঝতে না পেরেই জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী হতে দেওয়া হয়নি।

ভারতীয় রাজনীতিতে এটাই টার্নিং পয়েন্ট। শাসন ক্ষমতায় গেলে রাষ্ট্রযন্ত্র, সামরিক বাহিনী, বিচার ব্যবস্থা, সংবাদ মাধ্যম, রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে ব্যবহার করে কী দুর্বিপাক মানুষের জীবনে ডেকে আনা যায় তার বহু নিদর্শন দেখেছে দেশ ও দুনিয়া।

বেসরকারিকরণ, সরকারি সম্পত্তি বেচা, দাঙ্গা লাগানো, দেশে পাকিস্তানি সৈন্য ঢুকতে দিয়ে কার্গিল যুদ্ধ, কফিন কেলেঙ্কারি, গুজরাট গণহত্যা, কাশ্মীরে গণতন্ত্র হত্যা, দিল্লি গণহত্যা, জামিয়া মিলিয়া ও জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রছাত্রীদের ওপর অত্যাচার, এনআরসি ও ডিটেনশন ক্যাম্পের মারফৎ ভাষিক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন, সিএএ আইন এনে দেশ বিভাজন চেষ্টা, মিথ্যা মামলা দায়ের, বুদ্ধিজীবী লেখক শিল্পী শিক্ষকদের মিথ্যা মামলায় আটক করে রাখা, কতজন কাশ্মীরে বন্দি তার তথ্য না দেওয়া - অবিশ্বাস্য পরিস্থিতি।

করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলা করেনি। শুধু ভাষণবাজি করেছে।

'মন কি বাত' বলেছেন, মানুষের মনের কথা শোনেননি। গঙ্গায় ভেসে গেছে অগণিত লাশ, গণচিতা জ্বলেছে দেশজুড়ে, অক্সিজেন ও ওষুধ সঙ্কটে জেরবার মানুষ।

প্রতিবাদ করলেই মিথ্যা মামলা ও হামলা।

গণপিটুনিতে মেরে ফেলা হয়েছে শতখানেক মানুষকে। গোরু চোর বলে দিলেই হলো।

সবাই নীরব হয়ে যাবেন।

বেশিরভাগ বিরোধী দলকে চুপ করিয়ে রেখেছে সিবিআই, ইডি, আয়কর অভিযানের ভয় দেখিয়ে।

প্রকৃত গণআন্দোলন গড়ে তোলেনি কোনো দল। না হলে কোটি খানেক মানুষ যখন শত শত কিলোমিটার পথ হেঁটে অন্যায় লকডাউনে বাড়ি ফিরলেন, পথেই মরলেন বহুজন, দেশে আগুন জ্বলে যেতো।

শ্রমিকরা উল্টে একটা তকমা পেলেন 'পরিযায়ী'।

মোদি অমিত শাহের দ্বন্দ্ব বেধেছে, অমিত শাহ বলেছেন, মোদির মাথা খারাপ, এই নিয়ে আত্মতুষ্ট থাকা অপরাধ।

জরুরি রাস্তায় নামা।

গণবিক্ষোভে দেশ উত্তাল করে দেওয়া।

শিক্ষার সর্বনাশ। চাকরি নেই। বিপুল বাজার দর। স্বাস্থ্য পরিকাঠামো বেহাল।

এই সময় দেশে পাঁচটি নির্বাচন।

বিরোধী ঐক্য নেই।

দেশের সবচেয়ে বড় রাজ্য উত্তরপ্রদেশ, সেখানে বিজেপি বিরোধী ভোট পাঁচ ভাগে হবে। কংগ্রেস এখানে ছোটো দল। বড় বিরোধী অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টি, মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি। মায়াবতী যেকোনো কারণেই হোক, বোধহয় কেন্দ্রীয় এজেন্সির চাপে আড়ালে। এছাড়া ওয়াইসিকে এখানে নামানো হয়েছে মুসলিম ভোট ভাগ করতে। দলিত ভোট ভাগ করতেও কিছু পক্ষকে নামানো হবে।

কিন্তু ভোটের চিঁড়ে পুরো ভিজছে না। যোগী মোদির সভায় তেমন ভিড় নেই। লক্ষ্ণৌ বিমানবন্দরের যাত্রী পরিষেবা ফি বাড়িয়ে উন্নয়ন করে তা বেচে দেওয়া হয়েছে আদানির কাছে।

আবার নাকি উড়ানক্ষেত্র গড়া হবে। সেও যাবে আদানির পেটে। বড় রাস্তা তৈরির কথা বলেছেন ভোটের মুখে। কিন্তু এতদিন কী করছিলেন? পশ্চিমবঙ্গের মা উড়ালপুলের ছবি দেখিয়ে বিজ্ঞাপন দিতে হয়েছে। গোরুর বিক্রি নেই বলে চাষিরা ক্ষুব্ধ। ফসলের দাম নেই। যে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে ২০১৩ পরবর্তী সময়ে দাঙ্গা বাধিয়ে ভোট ভাগ করেছিল, সাম্প্রতিক কৃষক আন্দোলনের জেরে সেখানে ভিন্ন সুর। বিজেপির বিধায়কদের কৃষকরা আটকে রাখছেন। চড় মারছেন। গত বছর পঞ্চায়েত নির্বাচনে জেলা পরিষদগুলোতে ব্যাপকভাবে হেরেছে বিজেপি। মথুরা, বারাণসী, অযোধ্যা - সব জায়গায় হার।

বারাণসীর বিধান পরিষদ নির্বাচনে দুটোতেই হেরেছে বিজেপি। সেখানে ঐতিহাসিক ৩৬০টি মন্দির ভেঙে দোকানপাট ভাঙচুর করে বিরাট চওড়া ঝাঁ চকচকে রাস্তা হয়েছে। হাঁটু জলে মোদিকে সাঁতারের অভিনয় করতে হয়েছে। সেখানে মোদি ও যোগীকে লোকে তাড়া করেছে। টিভিতে দেখায়নি। কিন্তু সমাজমাধ্যমে ভিডিও ক্লিপ এসেছে।

বারাণসীর মন জয়ে হিন্দু তাস খেলা শুরু হয়েছে। পোস্টার দেওয়া হয়েছে, হিন্দু ছাড়া কেউ বারাণসী আসতে পারবে না। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। বাণিজ্য ও পর্যটন মার খাবে। যে কাশী বিশ্বনাথ ধামের পূজা শুরু হতো বিসমিল্লাহের সানাই দিয়ে সেখানে এই বিধান চলবে কি?

২০১৯-র লোকসভা নির্বাচনে বারাণসীর সাধু সমাজের প্রতিনিধি ভগবান দাস ভোটে লড়তে চেয়েছিলেন। মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন ১০ হাজার সাধুর মিছিল করে। অন্যায়ভাবে বাতিল করানো হয় মনোনয়নপত্র।

অযোধ্যার নাম বদলেছেন। ফৈজাবাদ এখন অযোধ্যা। সেই অযোধ্যায় বাড়ির রঙ জোর করে গেরুয়া করা হয়েছে। স্থানীয় মানুষ ক্ষুব্ধ। জমি নিয়ে কালোবাজারি চলছে। রামমন্দিরের টাকা ও বিদেশ থেকে আসা সোনার হিসেব নেই। সাধু সমাজের এক বড় অংশ ক্ষুব্ধ।

স্থানীয় মানুষও সম্প্রীতি চান, দাঙ্গা হাঙ্গামা নয়।

এর মাঝে দলে দলে বিধায়ক মন্ত্রীরা পদত্যাগ করতে শুরু করেছেন বিজেপি থেকে। এঁরা অধিকাংশই ওবিসি সমাজের প্রতিনিধি।

মন্ত্রী মৌর্য পদত্যাগ করার পরই তাঁর বিরুদ্ধে ধর্মদ্বেষী মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে।

কী বলেছিলেন? মুসলিমদের বিরুদ্ধে? না।

বলেছিলেন, দলিতদের তাঁবে রাখতে যজ্ঞ ও পূজায় ভুলিয়ে উচ্চবর্ণ তাঁদের কাজ হাসিল করতে চায়।

তাই এতদিনে মামলা খুঁজে বার। বলেছিলেন ২০১৪-য়। তারপর ২০১৭-য় মন্ত্রী হয়েছেন। মনে পড়েনি। এরপরও ১৩ জানুয়ারি এক মন্ত্রী মন্ত্রিসভা ছেড়েছেন। এর দু'বছর আগে ২৩০ জন বিধায়ক যোগীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। সিএএ বিরোধী আন্দোলন নির্মমভাবে দমন করে সঙ্ঘ পরিবারকে সন্তুষ্ট করে যোগী মুখ্যমন্ত্রী থেকে যান।

উল্টে তাঁকে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী রূপে ঠারে ঠোরে তুলে ধরা শুরু হয়।

যাই হোক, যোগী সুখে নেই। যতই কোটি কোটি টাকা নষ্ট করে দীপ জ্বালান।

বেকারত্ব বাড়ছে।‌ কেরানির চাকরিতে শত শত পিএইচডি। লাখ লাখ দরখাস্ত।

এর মাঝে অযোধ্যা থেকে একটু দূরে অন্যরকম ঘটনা ঘটছে।

অযোধ্যা থেকে দূরে ধন্নিপুরে নতুন মসজিদের জন্য পাঁচ একর জমি বরাদ্দ করা হয়। সেই জমিতে তৈরি হবে নতুন মসজিদ। বাবরের নামে নয়। সিপাহি অভ্যুত্থানের অন্যতম সংগ্রামী মৌলবী আহমাদুল্লা শাহ্ ফৈজাবাদী-র নামে পরিচিতি পাবে নতুন মসজিদ। নানা সাহেবদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়তে লড়তে মৃত্যুবরণ করেছিলেন মৌলবী আহমাদুল্লা শাহ্ ফৈজাবাদী। ভেঙে ফেলা বাবরি মসজিদের থেকে চার গুণ বড়ো হবে নতুন মসজিদ। তার থেকেও ছয় গুণ বেশি জায়গা জুড়ে তৈরি হবে হাসপাতাল। 'গঙ্গা-যামুনি তেহজিব' মেনে রোজ গরিব ভোজনের বন্দোবস্ত করা হবে। মসজিদ ও হাসপাতাল এবং দৈনিক গরিব ভোজনের জন্য সরকারের কাছ থেকে এক পয়সাও সাহায্য নেওয়া হবে না।

এটা ভালো প্রচেষ্টা। কারো মতে, বাবরের নাম বাদ দেওয়া আত্মসমর্পণ কারো মতে দ্বন্দ্ব এড়িয়ে যাওয়া।

ইতিহাস বলবে।

তেনারাই সব নাকি দেশ। দ্বেষ ভুলে নতুন পৃথিবী জুড়ে মিশ্রসংস্কৃতির জোয়ার আসবে।