আরেক রকম ● দশম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা ● ১৬-৩১ জানুয়ারি, ২০২২ ● ১-১৫ মাঘ, ১৪২৮

সম্পাদকীয়

প্রশাসক না ধর্ম প্রচারক?


বিজ্ঞপ্তি -
সম্পাদকমণ্ডলীর একাধিক সদস্য করোনা আক্রান্ত হওয়ায় পত্রিকার দৈর্ঘ্য এবার কম হচ্ছে।

 

প্রশাসক না ধর্ম প্রচারক?

আগেকার দিনে রাজা-বাদশাহরা মন্দির-মসজিদ-গির্জা স্থাপনের উদ্যোগ নিতেন। উপাসনাগৃহর দেওয়ালে বা সদরে খচিত হত রাজা-বাদশাহের নাম, উদ্বোধনের দিনক্ষণ ইত্যাদি। এটাই ছিল তখনকার দস্তুর।

রাজা-বাদশাহের দিন অনেককাল আগেই সমাপ্ত। দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত। তবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত প্রশাসকদের অনেকেই বোধ হয় রাজা-বাদশাহের মেজাজ-মর্জি আয়ত্ত্ব করে ফেলেছেন। সুযোগ পেলেই সেই মানসিকতা প্রকাশ পায়। কেউ নতুন মন্দির নির্মাণে উদ্যোগী। কেউ আবার প্রকাশ্যে ধর্মীয় আচার-আচরণ পালন করতে পছন্দ করেন। এবং সময় সুযোগ পেলেই প্রকাশ্যে ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপে জড়িয়ে পড়েন। ধর্মীয় অনুষ্ঠানে প্রশাসকের সক্রিয় অংশগ্রহণ আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে মুহূর্তের মধ্যেই সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। প্রচারের মাত্রা বাড়িয়ে তোলার জন্য প্রশাসনের সাহায্য নিতে গণতান্ত্রিক প্রশাসক বিন্দুমাত্র দ্বিধা বোধ করেন না। তাঁর খেয়াল থাকে না যে ভারতের সংবিধানের চরিত্র ধর্মনিরপেক্ষ। এবং সেই সংবিধানকে স্বীকার করেই তিনি প্রশাসকের শপথ নিয়েছিলেন।

কাশী-র বিশ্বনাথ মন্দির ঢেলে সাজানো ছিল দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের প্রকল্প। সেই স্বপ্ন পূরণের জন্য গঙ্গার ঘাট থেকে মন্দির পর্যন্ত যাতায়াতের রাস্তা সুগম করা হয়েছে। নতুন রাস্তা নির্মাণের জন্য ঠিক কতগুলি প্রাচীন বাড়ি, মন্দির ইত্যাদি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তার হিসেব নেই। হারিয়ে যাওয়া বাড়িগুলির বাসিন্দাদের কোথায় পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হয়েছে তারও খবর পাওয়া যায়নি।

গঙ্গা স্নানের পর নবনির্মিত প্রশস্ত রাজপথ ধরে প্রধানমন্ত্রী সরাসরি সংস্কার হওয়া বিশ্বনাথ মন্দিরে গিয়ে পূজা-অর্চনা সেরে প্রকল্পের উদ্বোধন করেছেন। গঙ্গা স্নান থেকে শুরু করে শিবলিঙ্গের উপর কলস ভরা দুধ ঢেলে দেওয়ার প্রতিটি মুহূর্তের ছবি বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে নিয়মিত প্রচারিত হয়েছে। ফলে মন্দিরের দরজায় অথবা গঙ্গার ঘাটে উদ্বোধক হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর নাম খচিত হয়েছে কিনা তা প্রত্যক্ষ ভাবে জানার অবকাশ না থাকলেও পুরো ঘটনাটি সরকারি নথিভুক্ত হয়ে গেছে।

গঙ্গার ঘাট ও মন্দিরের সংস্কার এবং নতুন রাজপথ নির্মাণ বাবদ এখনও পর্যন্ত ৪০০ কোটি টাকা খরচের খবর প্রচারিত। এখনও অনেক কাজ বাকি। কাজেই আরও খরচ হবে। সরকারের অর্থানুকূল্যে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কাজটি সম্পন্ন করা হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের নামে শপথ নেওয়া প্রশাসক কোন যুক্তিতে এমন একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সরকারি কোষাগারের অর্থ মঞ্জুর করেন সেই প্রশ্ন কেউ তোলেননি। আর তুললেও একটাই উত্তর - সংসদে এবং বিধানসভায় সংখ্যাধিক্য রয়েছে। ভাবখানা এমন যেন সংসদে সংখ্যাধিক্য থাকলেই যা খুশি করার অধিকার জন্মে যায়। গণতন্ত্রের জন্য এই ধারণা বিপজ্জনক।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীও পিছিয়ে নেই। ১৬ই ডিসেম্বর, ২০২১ প্রকাশ্য জনসভায় তিনি জানান যে এবার দিঘাতেও জগন্নাথ মন্দির নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। বেহালা চৌরাস্তায় কলকাতা পুরসভার নির্বাচনী প্রচারে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেন যে, জগন্নাথ মন্দির দর্শন করতে সবাই পুরী যায়। দিঘায় কেন এরকম মন্দির হবে না প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, সমুদ্রের ধারে একটা মন্দির থাকা ভালো। এর মধ্যেই ৮ কোটি টাকা দিয়ে মন্দিরের জন্য জমি কিনে নেওয়া হয়েছে বলে তিনি ঘোষণা করেন যে, নতুন মন্দির তৈরির জন্য রাজ্য সরকার ১২৮ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের মতো অত বড়ো হয়তো হবে না, কিন্তু ওই মন্দিরের আদলেই দিঘায় জগন্নাথ মন্দির হবে।

এই মন্তব্যকে পুরসভা নির্বাচনের জন্য ফাঁকা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট কুড়োনোর বিষয় হিসেবে ভাবলে বোধ হয় ভুল হবে। এর আগেও তিনি দিঘায় মন্দির নির্মাণের কথা বলেছেন। ২০১৯-এর ২১শে আগস্ট দিঘায় সরকারি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে ঘোষণা করেন দিঘায় নতুন জগন্নাথ মন্দির গড়ে পুরীর ধাঁচেই ধর্মীয় পর্যটন ক্ষেত্র গড়ে তোলা হবে। প্রস্তাবিত জগন্নাথ মন্দিরের নকশা, প্রকল্প রিপোর্ট হাতে নিয়ে সাংবাদিকদের সামনে দাঁড়িয়েই তাঁর দৃপ্ত ঘোষণা, ‘‘জগন্নাথ মন্দির তৈরির জন্য আমাদের প্ল্যানিং হয়ে গিয়েছে। এটা একটা বড় কাজ। দু’বছরের মধ্যে করার চেষ্টা হবে।’’

প্রস্তাবিত মন্দিরের ছবি সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সামনে তুলে ধরে তিনি বলেছিলেন পুরীর মন্দিরের আদলে দিঘায় জগন্নাথ মন্দির হবে। পুরীর মন্দিরের সমানই উচ্চতা হবে। সমুদ্রের পাশে অনেকটা জায়গা আছ। সরকার এটা করবে। কারণ এই মন্দির পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত। দিঘায় গড়ে উঠবে একটা ধর্মীয় তীর্থ এবং সংস্কৃতি কেন্দ্র।

সাংবাদিকদের হাতে প্রকল্পের নকশা বিতরণ করে মন্দিরের খুঁটিনাটি বিবরণ সম্পর্কে আলোচনার সময় তাঁর পাশে ছিলেন মন্ত্রিসভার বেশ কয়েকজন সদস্য এবং একাধিক প্রশাসনিক কর্মকর্তা। তাঁদের মধ্যে একজন আবার এখন বিধানসভায় বিরোধী দলের নেতা। মুখ্যমন্ত্রীর প্রস্তাবে সায় দিয়ে জেলাশাসক সেদিন জানিয়েছিলেন প্রায় দু’একর জমিতে ওই মন্দির গড়ে উঠবে। মন্দির তৈরির জন্য জায়গা চিহ্নিত হয়েছে। পর্যটন বিভাগ থেকে প্রকল্পের অনুমোদনও পাওয়া গেছে। অর্থাৎ পূর্বপরিকল্পিত ছক বাঁধা প্রকল্প। এ যেন 'মন্দির ওঁহি বনায়েঙ্গে' স্লোগানের আনুষ্ঠানিক অনুরণন।

এখানেই শুরু নয়। তারও আট মাস আগে ২০১৮-র ডিসেম্বরে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সফরে এসে দিঘাতেই প্রশাসনিক বৈঠকের সময় মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, দিঘায় জগন্নাথ মন্দির বড়ো করে তৈরি করা হবে, যাতে পুরীর মতো এখানেও পর্যটকেরা এসে সমুদ্র ভ্রমণের সঙ্গে জগন্নাথ মন্দির দর্শনের সুযোগ পান। মাত্র আট মাস পরে ফের দিঘায় এসেই তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, এই প্রকল্প রূপায়ণে তাঁর সরকার কতটা তৎপর।

ঘটনাক্রম বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে কেন্দ্র ও রাজ্যের বর্তমান প্রশাসকরা বিধিবদ্ধ প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের বদলে সরকারি অর্থে ধর্মীয় প্রচারে বেশি আগ্রহী। এর প্রতিবাদ তো দূরের কথা এ বিষয়ে প্রশ্ন তুললেই একটাই উত্তর - সংখ্যাধিক্য। একজন লোকসভায় তো অন্যজন বিধানসভায়। তাঁদের খেয়াল থাকে না যুক্তি, সংবিধান ইত্যাদি এড়িয়ে ইচ্ছেমাফিক কাজ করার মধ্যে জড়িয়ে রয়েছে স্বৈরাচারী প্রবণতা। তাঁদের আরও খেয়াল থাকে না যে কোনো রকমের স্বৈরাচারই দীর্ঘস্থায়ী নয়। কেন্দ্র ও রাজ্যের প্রশাসকরা কট্টর ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে দেওয়ার প্রতিযোগিতা বন্ধ করে সংবিধান অনুযায়ী প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনে উদ্যোগ নিলেই প্রকৃত অর্থে দেশের 'বিকাশ' বা রাজ্যের 'উন্নয়ন' হতে পারে। প্রশাসক দায়িত্ব অস্বীকার করে ধর্ম প্রচারক হয়ে গেলে তা সুষ্ঠু জনজীবনের জন্য হিতকর হতে পারে না। সমাজ-সভ্যতার মঙ্গলের জন্যও বিপজ্জনক।