আরেক রকম ● দশম বর্ষ চতুর্বিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ ডিসেম্বর, ২০২২ ● ১-১৫ পৌষ, ১৪২৯

সম্পাদকীয়

‘‘...রাজ্যে রাজ্যে পরস্পরে দ্বন্দ্বে অমঙ্গল...’’


মহারাষ্ট্র-কর্নাটক সীমান্তে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে হঠাৎ করে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। মঙ্গলবার ৬ই ডিসেম্বর কর্ণাটকের বেলগাভি এবং মহারাষ্ট্রের পুনেতে সরকারি যানবাহন ভাঙচুর করার ঘটনা ঘটে। এবং অতিদ্রুত উত্তেজনা মহারাষ্ট্র-কর্ণাটক সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন জনপদে ছড়িয়ে পড়ে।

১৯৫৬-র ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠনের আইন প্রবর্তনের সময় থেকেই মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটক সীমানা বিরোধের সূত্রপাত। ১৯৬০-এর মে মাস থেকে মহারাষ্ট্র দাবি করে আসছে যে বেলগাভি (তখনকার বেলগাঁও), কারভার জেলার ৮৬৫টি গ্রাম মহারাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত করা উচিত। কারণ, এই এলাকার বাসিন্দাদের অধিকাংশের মাতৃভাষা মারাঠি। কর্ণাটক বরাবরই এই দাবি মেনে নিতে অস্বীকার করেছে।

মহারাষ্ট্রের ধারাবাহিক পীড়াপীড়িতে বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মেহের চাঁদ মহাজনের নেতৃত্বে ১৯৬৬-র ২৫শে অক্টোবর মহাজন কমিশন গঠন করে। মহারাষ্ট্রের দাবি প্রত্যাখ্যান করে মহাজন কমিশন বেলগাভি (তখনকার বেলগাঁও) জাট্ট, আক্কালকোট এবং শোলাপুর সহ ২৪৭টি গ্রাম/স্থানকে কর্ণাটকের অংশ করার সুপারিশ করেছিল। একই সঙ্গে নিপ্পানি, খানাপুর এবং নন্দাগড় সহ ২৬৪টি গ্রাম/স্থানকে মহারাষ্ট্রের অংশ হিসাবে কমিশন ঘোষণা করেছিল।

কমিশনের রিপোর্ট মহারাষ্ট্র সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছিল। মহারাষ্ট্র সরকার বরাবরই এই সুপারিশের বিরোধিতা করে চলেছে। মহারাষ্ট্র সরকারের মতে মহাজন কমিশন সমস্যার যথাযথ সমাধান না করে কর্ণাটকের পক্ষে রায় দিয়েছে।

বিরোধ মীমাংসার জন্য পরবর্তী সময়ে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করা হলেও তা ব্যর্থ হয়। ২০০৪-এ মহারাষ্ট্র সরকার কর্ণাটকের মারাঠি-ভাষী গ্রামগুলির উপর দাবি জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে একটি পিটিশন দাখিল করেছিল। পক্ষান্তরে জনসাধারণের অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে কর্ণাটক বেলগাঁও-র নাম পরিবর্তন করে বেলগাভি করে। এবং বেলগাভিকে রাজ্যের দ্বিতীয় রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করে। এমনকি সেখানে একটি বিধানসভা ভবন নির্মিত হয়।

কর্ণাটক এবং মহারাষ্ট্র দুই রাজ্য সরকারই মনে করে এই জটিল সমস্যাটি রাজনৈতিকভাবে সমাধান করা যাবে না এবং একটি আইনি সমাধান প্রয়োজন। ২০০৪ থেকে মহারাষ্ট্র-কর্নাটক সীমান্ত মামলা সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন। উভয় রাজ্যই তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে সরে যেতে অস্বীকার করেছে। কেন্দ্রের পরবর্তী সরকারগুলিও এমন একটি সংবেদনশীল বিষয়ে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করে চলেছে। ২০১০-এ কেন্দ্রীয় সরকারের হলফনামায় বলা হয়েছিল যে তৎকালীন মহীশূরে (বর্তমানে কর্ণাটক) নির্দিষ্ট এলাকা হস্তান্তর জোর করে চাপানো হয়নি এবং সিদ্ধান্তটি ভুল ছিল না। হলফনামায় বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা হয়েছিল যে সংসদ এবং কেন্দ্রীয় সরকার উভয়ই রাজ্য পুনর্গঠন বিল, ১৯৫৬ এবং বোম্বে পুনর্গঠন বিল, ১৯৬০ বিবেচনা করার সময় সমস্ত প্রাসঙ্গিক কারণগুলি বিবেচনা করেছিল।

মহারাষ্ট্র এবং কর্ণাটক দুই রাজ্যেই নির্বাচনের সময় আঞ্চলিক অনুভূতি জাগিয়ে তুলতে সীমান্ত বিরোধকে ব্যবহার করা হয়। সীমানা বিরোধ মহারাষ্ট্রের প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারের অংশ। এমনকি রাজ্য বিধানসভা এবং কাউন্সিলের যৌথ অধিবেশনে রাজ্যপালের বার্ষিক ভাষণেও বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। মতাদর্শগত পার্থক্য সত্ত্বেও মহারাষ্ট্রের রাজনৈতিক দলগুলি মহারাষ্ট্র-কর্ণাটক সীমানা বিরোধের বিষয়ে সহমত পোষণ করে। ক্ষমতাসীন বিজেপি হোক বা মুখ্যমন্ত্রী একনাথ শিন্ডের নেতৃত্বাধীন শিবসেনা কিংবা শিবসেনা (উদ্ধব বালাসাহেব ঠাকরে) থেকে শুরু করে কংগ্রেস, এনসিপি এবং এমএনএস - সবাই মনে করে কর্ণাটক সীমান্তে মারাঠি-ভাষী এলাকাগুলি মহারাষ্ট্রের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়া উচিত।

মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী একনাথ শিন্ডে সীমান্ত বিরোধের অবস্থা পর্যালোচনা করতে নভেম্বর মাসে মুম্বাইয়ে একটি বৈঠক ডেকেছিলেন। বৈঠকের পর দুই মন্ত্রী চন্দ্রকান্ত পাতিল এবং শম্ভুরাজ দেশাইকে দায়িত্ব দেওয়া হয় যাতে অতিদ্রুত সমস্যার আইনি এবং রাজনৈতিক সমাধান করা যায়। একই সঙ্গে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন যে বেলগাভি এবং কর্ণাটকের অন্যান্য মারাঠি-ভাষী অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধারা পেনশনের জন্য যোগ্য হবেন এবং জ্যোতিবা ফুলে জন আরোগ্য প্রকল্পের অধীনে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা পাবেন।

পরের দিনই বেঙ্গালুরুতে, কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী বাসবরাজ বোমাই মহারাষ্ট্রের সমস্ত কন্নড় স্কুলের জন্য অনুদান ঘোষণা করলেন। বোমাই আরও বলেছিলেন যে কর্ণাটক সরকার মহারাষ্ট্রের সাংলি জেলার জাট্ট তালুকের ৪০টি গ্রামের কর্ণাটকের সঙ্গে যুক্ত করার কথা ভাবছে। বোমাই আরও বলেছিলেন যে কর্ণাটক সরকার মহারাষ্ট্রের শোলাপুর জেলার সীমান্ত গ্রামগুলির উপর অধিকার দাবি করবে।

পক্ষান্তরে মহারাষ্ট্রের উপ-মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নভিস জোর দিয়ে বলেছিলেন যে মহারাষ্ট্র সরকার একটি গ্রামও কর্ণাটকে যেতে দেবে না। বরং মহারাষ্ট্র বেলগাভি, নিপানি এবং কারভার ৮৬৫টি গ্রাম পুনরুদ্ধার করবে। মহারাষ্ট্র সরকার মন্ত্রী চন্দ্রকান্ত পাতিল এবং শম্ভুরাজ দেশাইকে ৬ই ডিসেম্বর বিভিন্ন সংস্থা এবং স্থানীয়মানুষের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য বেলাগাভিতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কর্ণাটক সরকারের অনুরোধে প্রতিনিধিদলের প্রস্তাবিত সফর স্থগিত করা হয়ে।

মহারাষ্ট্রের মন্ত্রীরা বেলগাভি সফর স্থগিত করলেও, নারায়ণ গৌড়ার নেতৃত্বে কর্ণাটক রক্ষণ বেদিকা কর্মীরা বেলগাভিতে গিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটকে এখন রাজত্ব করছে বহুল প্রচারিত ডাবল ইঞ্জিনের সরকার। অর্থাৎ কেন্দ্রে এবং দুই রাজ্যেই গেরুয়া শিবিরের রাজত্ব। সাধারণ বুদ্ধিতে বলে দীর্ঘকালীন সমস্যার সমাধানের জন্য এটাই প্রকৃষ্ট সময়। কিন্তু সমাধানের বদলে দুই ডাবল ইঞ্জিনের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়েছে। একইরকম ভাবে গত বছর দেড়েক ধরে আসাম-অরুণাচল, আসাম-নাগাল্যান্ড, আসাম-মিজোরাম, আসাম-মেঘালয়ের মধ্যে একই ধরনের সমস্যা ঘটে চলেছে। এবং উত্তর-পূর্বের সবকটি রাজ্যেই ডাবল ইঞ্জিনের সরকার ক্ষমতাসীন।

ঘটনাবলীর ধারাবাহিকতায় নজর দিলেই বোঝা যায় যে এই সমস্যা সমাধানের বদলে জিইয়ে রাখার চেষ্টা চলছে। রাজ্যগুলি নিজেদের স্থানীয় সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত থাকলে অন্য সব সমস্যা ধামাচাপা দেওয়া সহজ হয়ে যায়। বেকারত্ব, দ্রব্যমূল্য, দুর্নীতি ইত্যাদি বিষয়ে নজর দেওয়ার অবসর মেলে না। বহুল প্রচারিত নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনার সময় কোথায়?

সেই সুযোগে এমন সমস্ত বিষয়ে ঢাক পিটিয়ে আত্মপ্রচার করা হচ্ছে যার সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কোনও ধারণা নেই এবং তার প্ৰয়োজনীয়তা নিয়েও প্রশ্ন করা যায়। যেমন জি২০। কুড়িটি দেশের একটি আন্তর্জাতিক মঞ্চ। প্রতি বছর কোনও একটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান জি২০-র পরিচালনার দায়িত্ব পালনের সুযোগ পায়। ঘুরেফিরে সব সদস্য দেশই এই দায়িত্ব পালন করে। এর মধ্যে কোনো বিশেষ বাহাদুরি আছে কি? ২০২২-এর ডিসেম্বর থেকে ২০২৩-এর নভেম্বর পর্যন্ত ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে জি২০-র কুড়িটি সদস্য দেশের প্রতিনিধিরা বৈঠক করবেন। এইসব বৈঠকের ফলে দেশের কোন সমস্যার সমাধান হবে অথবা সাধারণ মানুষের কোন উপকার হবে সে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশিত হয়নি। আসলে বলার মতো কিছুই নেই। কিন্তু আত্মপ্রচারের সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না বলে উচ্চগ্রামে প্রচার চলছে।

জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন বা নন অ্যালাইন্ড মুভমেন্ট সংক্ষেপে ন্যাম-এর সদস্য দেশের সংখ্যা ১২০। ১৯৫৫-য় গঠিত এই আন্তর্জাতিক মঞ্চ আজও সক্রিয়। ২০১৯-এর অক্টোবরে আজারবাইজানের রাজধানী বাকু শহরে আয়োজিত হয় ন্যাম-এর সাম্প্রতিক অধিবেশন। ন্যাম-এর সভাপতিত্বের মেয়াদ তিন বছর। ১৯৫৫-র বান্দুঙ সম্মেলন থেকে শুরু করে ২০১৯-এর বাকু সম্মেলন পর্যন্ত এর অন্যথা হয়নি। দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে এই বিষয়ে কোনোদিন সোচ্চার হতে দেখা যায়নি। এমনকি ১৯৮৩-র ৬ই মার্চ কিউবার রাষ্ট্রপ্রধান ফিদেল কাস্ত্রো দিল্লির বিজ্ঞান ভবনে ন্যাম-এর পরবর্তী পরিচালক হিসেবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হাতে দায়িত্ব তুলে দিলেন তখনও এই বিষয়ে কোনো আত্মপ্রচার দেখা যায়নি। কুড়িটি দেশের জি২০-র তুলনায় ১২০টি দেশের ন্যাম নিঃসন্দেহে অনেক বড়ো আন্তর্জাতিক মঞ্চ।

তবুও এমনটাই চলবে। আজাদী কা অমৃত মহোৎসব, জি২০ ইত্যাদি নিয়ে প্রচার-বিজ্ঞাপন চলতেই থাকবে। পাশাপাশি রাজ্যে রাজ্যে স্থানীয় সমস্যায় মানুষকে জর্জরিত করে রাখার কাজও চলবে। মানুষের প্রশ্ন শাসকের পছন্দ নয়। কিন্তু মানুষের সোচ্চার প্রতিবাদ জনরোষে পরিণত হলে শাসকের তা পছন্দ হবে তো?