আরেক রকম ● দশম বর্ষ চতুর্বিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ ডিসেম্বর, ২০২২ ● ১-১৫ পৌষ, ১৪২৯

সম্পাদকীয়

সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনগুলির বার্তা


হিমাচল প্রদেশ ও গুজরাটে বিধানসভা নির্বাচন সম্পন্ন হল। দিল্লি নগর কর্পোরেশন বা এমসিডি নির্বাচনও সম্পন্ন হল। একই সঙ্গে বিভিন্ন রাজ্যের ছয়টি বিধানসভা ও উত্তরপ্রদেশে একটি লোকসভা আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হল। এই নির্বাচনের ফলাফল কী রাজনৈতিক বার্তা দিচ্ছে?

প্রথমত, গুজরাট ব্যতিরেকে বিজেপি হিমাচল প্রদেশে পরাজিত হয়েছে, এমসিডি নির্বাচনে পরাজিত হয়েছে। ছয়টি বিধানসভা উপনির্বাচনে বিজেপি জিতেছে দুইটি আসনে এবং চারটি আসনে পরাজিত হয়েছে। অন্যদিকে, উত্তরপ্রদেশের একটি লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে সমাজবাদী পার্টি বিপুল ভোটে বিজেপিকে পরাজিত করেছে। অতএব বলা যেতে পারে যে গুজরাটে যেমন বিজেপি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সপ্তম বার সরকার গড়তে সক্ষম হয়েছে, তেমনি বাকি বিধানসভা এবং উপনির্বাচনের ফলাফল বিজেপির বিরুদ্ধে গিয়েছে।

হিমাচল প্রদেশের নির্বাচনে বিজেপি ভোট পেয়েছে ৪৩% এবং ২৫টি আসনে জয়ী হয়েছে, যেখানে কংগ্রেস ৪৩.৯% ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছে ৪০টি আসনে। ২০১৭ সালের নির্বাচনে বিজেপি প্রায় ৫০% ভোট পেয়ে ৪৪টি আসনে জয়ী হয়েছিল। অর্থাৎ বিগত পাঁচ বছরে বিজেপির ভোট কমেছে প্রায় ৬ শতাংশ। হিমাচল প্রদেশের নির্বাচনে বাড়তে থাকা বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি এবং কৃষকদের অসন্তোষ গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়। হিমাচলের মানুষ প্রত্যেক পাঁচ বছর পর পর সরকার বদলের রায় দিয়েছেন। বিজেপি ২০২২ সালের নির্বাচনে এই প্রবণতাকে উলটে দেওয়ার জন্য সবরকম প্রচেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয়। এর প্রধান কারণ হল গরীব মানুষ বিজেপি-র বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে। সিএসডিএস-এর নির্বাচন পরবর্তী সমীক্ষা অনুযায়ী ২০১৭ সালে গরীবদের ৪৮% বিজেপিকে এবং ৪০% কংগ্রেসকে ভোট দিয়েছিল। কিন্তু ২০২২ সালে গরীব মানুষের ৫১ শতাংশ কংগ্রেসকে ভোট দিয়েছে এবং ৩৮ শতাংশ ভোট দিয়েছে বিজেপিকে। মনে রাখতে হবে নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি নেতৃত্ব বারবার ডবল ইঞ্জিনের সরকার গড়ার ডাক দিয়ে এই নির্বাচনী লড়াইতে সামিল হয়েছিল। কিন্তু অর্থনৈতিক যে সংকট বিজেপি তৈরি করেছে দেশজুড়ে তার আঁচ থেকে হিমাচলের গরীব মানুষ বাঁচতে পারেননি। তাই তাঁরা বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন।

হিমাচলের নির্বাচন পরবর্তী পরিস্থিতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত কংগ্রেস নেতৃত্ব নিয়েছেন যা প্রশংসনীয়। এই রাজ্যের কংগ্রেস রাজনীতি বহু দশক ধরে নিয়ন্ত্রণ করে এসেছেন বীরভদ্র সিংহ এবং তাঁর পরিবার, যারা আসলে হিমাচলের রাজপরিবারের সদস্য। এই নির্বাচনেও এই পরিবারের পক্ষ থেকে মুখ্যমন্ত্রীত্বের দাবি জানানো হয়েছিল। কিন্তু কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব বেছে নিয়েছেন সুখবিন্দর সিংহ সুখুকে। সুখবিন্দরজি একজন বাস ড্রাইভারের পুত্র যিনি বড়ো হয়েছেন দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে, দুধ বেচে সংসার চালিয়েছেন। রাজ পরিবারের সদস্যদের বঞ্চিত করে একজন সাধারণ মানুষকে মুখ্যমন্ত্রীত্বের দায়িত্ব দেওয়া কংগ্রেসের সাধারণ নীতি নয় বলেই মানুষ জানে। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী যেখানে বারবার পরিবারতন্ত্রের তিরে কংগ্রেসকে বিদ্ধ করেন, সেখানে এই পদক্ষেপটি অত্যন্ত ইতিবাচক।

দিল্লির এমসিডি নির্বাচনে বিজেপি পরাজিত হল দীর্ঘ ১৫ বছর পর। এমসিডি নির্বাচনে বিজেপিকে পরাজিত করে জয়ী হল আম আদমি পার্টি। আপ সরকারের বিভিন্ন গরীব দরদী পদক্ষেপ, এবং বিজেপির বিরুদ্ধে অসন্তোষ আপের জয়কে ত্বরাণ্বিত করে। এইক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য যে দলিত ভোটাররা আপের জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তফশিলী জাতিদের জন্য সংরক্ষিত আসনে আপ বিজেপির থেকে অনেক বেশি ভোট ও আসন লাভ করে। সাধারণ আসনের ক্ষেত্রে যেখানে আপ ও বিজেপি প্রায় সমান সমান, সেখানে সংরক্ষিত আসনে আপ বিজেপির থেকে অনেক দূর এগিয়ে। এই প্রবণতা একাধিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ। বিজেপি বিগত বেশ কিছু বছর ধরে হিন্দুত্বের স্লোগানের মধ্য দিয়ে দলিত ও আদিবাসী সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশকে নিজেদের সমর্থক বানিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু দিল্লির এমসিডি নির্বাচন দেখিয়ে দিল যে এই অংশের মানুষকে বিজেপি-র থেকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব। কিন্তু আপ বিগত কয়েক বছর ধরে নরম হিন্দুত্বের যেই লাইন নিয়েছে, তার ফলে মুসলমান মানুষের সমর্থন তারা হারিয়েছে। বিশেষ করে ২০২০ সালের দাঙ্গা যে সমস্ত অঞ্চলে হয়েছিল, সেখানে আপ সমর্থন হারিয়েছে এবং কংগ্রেস কিছুটা সমর্থন ফিরে পেতে সক্ষম হয়েছে। আপের নরম হিন্দুত্বের লাইন আগামীদিনে তাদের কতটা নির্বাচনী ফায়দা দেবে সেই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।

হিমাচল প্রদেশ ও এমসিডিতে বিজেপি পরাজিত হলেও গুজরাটে তারা রেকর্ড ভোট ও আসন লাভ করে লাগাতার সপ্তম বার সরকার গড়তে সক্ষম হয়েছে। গুজরাটে বিজেপি ৫২.৫ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৫৬ আসন লাভ করেছে। কংগ্রেস পেয়েছে ২৭.৩% এবং আম আদমি পার্টি পেয়েছে ১২.৯% ভোট। অর্থাৎ কংগ্রেস ও আপের ভোট যোগ করলেও তা বিজেপির থেকে অনেকটাই কম রয়েছে। কিন্তু ২০১৭ সালে কংগ্রেস ৪২.২% ভোট পেয়ে বিজেপির রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল বলা যায়। অথচ তারপর থেকে লাগাতার কংগ্রেসের যেইভাবে বিরোধী শক্তির ভূমিকা পালন করার দরকার ছিল তারা তা করেনি। হার্দিক পাটেলের মতন গুরুত্বপূর্ণ যুব নেতাকে তারা হারিয়েছে। ২০১৭ সালের নির্বাচনে বিজেপির বিরুদ্ধে বিভিন্ন জাতি ও শ্রেণির যে ঐক্য তারা গঠন করতে সক্ষম হয়েছিল, তারা তা হারিয়েছে। কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধী বর্তমানে গোটা ভারত জুড়ে যাত্রা করছেন। কিন্তু কী আশ্চর্য! নির্বাচনের আগে গুজরাটে তিনি সেই যাত্রা নিয়ে যাননি। কিছুটা যেন ওয়াকওভারই দিয়ে দিলেন বিজেপিকে। অন্যদিকে, কংগ্রেসের এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আম আদমি পার্টি গুজরাটে উল্লেখযোগ্য ভোট পেয়েছে। কিন্তু তারা কংগ্রেসকে বিরোধী পরিসর থেকে সরিয়ে দিতে পারেনি। কিন্তু দিল্লি এবং পাঞ্জাবের পরে গুজরাটেও উল্লেখযোগ্য ভোট পেয়ে আম আদমি পার্টি উত্তর ভারতে একটি গুরুত্বপূর্ণ দল হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে।

দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিজেপি স্বগর্বে ঘোষণা করে থাকে যে গুজরাট হল হিন্দুত্বের ল্যাবরেটরি। এই নি্র্বাচনেও তাই বিজেপির সর্বোচ্চ নেতৃত্বকে খুব স্পষ্টভাবে হিন্দুত্বের প্রচার করতে দেখা গিয়েছে। কিন্তু গুজরাটের মানুষের মনে বিজেপির হিন্দুত্ববাদ বর্তমানে আধিপত্যের চেহারা নিয়েছে। নির্বাচন পরবর্তী সমীক্ষা রিপোর্ট অনুযায়ী উচ্চবর্ণের হিন্দুদের ৬২% বিজেপিকে ভোট দিয়েছে, পাতিদার (পাটেল)-দের মধ্যে বিজেপি পেয়েছে ৬৪%, ওবিসিদের মধ্যে ৪৬%, দলিতদের মধ্যে ৪৪%, আদিবাসীদের মধ্যে ৫৩%, মুসলমানদের মধ্যে ১৪%। অর্থাৎ মুসলমান সমাজ ব্যতিরেকে বাকি সমস্ত জাতি-উপজাতির সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হিন্দুত্বের নামে একতাবদ্ধ হয়ে বিজেপিকে ভোট দিয়েছে। সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ তার সর্বোচ্চ চিত্রটি লাভ করেছে গুজরাটে। এই মেরুকরণ ভেঙে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি এবং ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে মানুষকে সংঘবদ্ধ করা গুজরাটে একটি অত্যন্ত দুরূহ কাজ। নির্বাচন পরবর্তী সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে যে মানুষ মূল্যবৃদ্ধি, দুর্নীতি ইত্যাদি ইস্যু নিয়ে নাজেহাল, কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা এবং মোদীর জনপ্রিয়তা বিজেপিকে বিপুল ভোট জয়ী করছে।

আশার কথা একটাই গোটা দেশে বিজেপি এখনও সাম্প্রদায়িক মেরুকরণকে গুজরাটের পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেনি, যদিও সেই চেষ্টাই তারা করে চলেছে। হিমাচল প্রদেশ এবং এমসিডি নির্বাচনের ফলাফল থেকে এই বার্তাই স্পষ্ট যে বিজেপি বর্তমানে দেশে প্রবল শক্তিশালী হলেও সর্বশক্তিমান নয়। বিজেপি-র নির্বাচনী রথকেও আটকে দেওয়া যায়, যদি বিরোধীরা মানুষের কাছে গিয়ে সঠিক কথাগুলি বলেন, লড়াই আন্দোলন করেন। এই বার্তা নিয়েই বিরোধীরা ২০২৪ সালের নির্বাচনের জন্য কোমর বাঁধবেন এই দাবি ভারতের সমস্ত প্রগতিশীল ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের।