আরেক রকম ● দশম বর্ষ ত্রয়োবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ ডিসেম্বর, ২০২২ ● ১৬-২৯ অগ্রহায়ণ, ১৪২৯

চিঠির বাক্সো

চিঠি

ভাস্কর দাশগুপ্ত, কলকাতা-৭০০০২৬


সম্পাদক সমীপেষু,
আরেক রকম,
কলকাতা

মহাশয়,

প্রথম সংখ্যা থেকে ‘আরেক রকম’-এর একনিষ্ঠ পাঠক হিসেবে, প্রায় গায়ে পড়ে এই বিতর্কের অবতারণা। প্রসঙ্গ - দশম বর্ষ দ্বাবিংশ সংখ্যায় প্রকাশিত গৌতম সরকার মহাশয়ের - “সাহিত্যে নোবেলঃ অ্যানি আর্নাক্স”। নিবন্ধটির বিষয়ে প্রাথমিক এবং সবিশেষ আপত্তি - শিরোনাম সহ নিবন্ধ জুড়ে অবিরত নোবেলজয়ী লেখিকার নামের ভুল বঙ্গীকরণ। ওঁর নামের সঠিক উচ্চারণ - আনি এয়ার্‌নো। প্রাবন্ধিকের বয়ানে - এয়ার্‌নো-র জন্মস্থান ইভ্‌তো হয়ে দাঁড়ায় ‘ইভেটট’! মার্সেল প্রুস্ত্‌ হয়ে যান ‘মার্সেস প্রাউস্ট’; সিমোন্‌ দ্য ব্যোভোয়া হয়ে যান - বুভোয়। এমন কি বিখ্যাত ভূতপূর্ব ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি লেখকের বয়ানে - ‘ফ্রঙ্কোয়েস্‌ মিটেরান্ড’। ফরাসি ভাষায় সামান্যতম ব্যুৎপত্তি না থাকা সত্ত্বেও ফরাসি সাহিত্যে নোবেল প্রাপ্তি নিয়ে আলোচনা এক অনধিকার চর্চা হিসেবে প্রতিপন্ন হয়। নিবন্ধে লেখক গুগল থেকে যাবতীয় তথ্য আহরণ করেছেন; আমাদের সবারই উৎস তো তাই। কিন্তু ফরাসি সাংস্কৃতিক ধারা এবং বঙ্গদেশে ফরাসী-অনুরাগের ঐতিহ্যের অনুষঙ্গ ব্যতিরেকে পুরো নিবন্ধটি একাধারে হয়েছে দায়সারা এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন। অন্তর্জালবাহিত প্রচুর তথ্য সন্নিবিষ্ট করেছেন নিবন্ধকার। কিন্তু যাচাই করেননি, উদ্ধৃত বক্তব্যের আপেক্ষিক গুরুত্ব, তাই দীর্ঘ নিবন্ধ পাঠে মনে পড়ে হ্যামলেটের স্বগতোক্তি - My words fly up, my thoughts remain below।

উল্লেখ করা প্রয়োজন ছিল নোবেল-প্রাপ্তির পরে তাঁর প্রকাশক গালিমার-এ এক সাংবাদিক সম্মেলনে এয়ার্‌নো-র প্রণিধানযোগ্য উক্তি - ‘আমার জন্য এ এক বিশাল ব্যাপার; বিশেষত আমি যাদের প্রতিনিধিত্ব করি’। স্পষ্টতই তিনি মনে করিয়ে দিচ্ছেন তাঁর শ্রমজীবী প্রেক্ষাপটের কথা।

নিবন্ধে নোবেল কমিটির মন্তব্য উদ্ধৃত হয়েছে। তাতে আনি এয়ার্‌নো-কে আংশিক চেনা যায় মাত্র। স্মরণ করা যেতে পারে রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে সুইডিশ একাডেমীর বিবৃতি। ফরাসী সাহিত্যে সামান্য অধিকার ভর করে আমাদের মত সাধারণ জনও বিস্মিত না হয়ে পারে না, এয়ার্‌নোর আবারো পুরস্কার প্রাপ্তিতে কারণ এতাবৎ কালে আনিকে বাদ দিলে, ফ্রান্সে সাহিত্যে নোবেলজয়ী লেখকের সংখ্যা পনেরো। এঁদের মধ্যে আছেন বাঙালির অতি পরিচিত রোঁমা রোঁলাঁ, ফ্রঁসোয়া মোরিয়াক্‌, অঁদ্রে জিদ, আলবেয়ার কামু এবং জঁ পল সার্ত্র্‌ও; যিনি পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন।

ফরাসী সংস্কৃতির জলবায়ুতে এত ঘনঘন প্রতিভার বিদ্যুৎ-চমক পরিলক্ষিত হয় যে এয়ার্‌নোর নিছক নারীবাদী বা শ্রমজীবী পরিবেশ থেকে উঠে আসার কথাই সব নয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ফ্রান্সে ১৬৭৮-এ প্রথম মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসের রচয়িতা একজন নারী - মাদাম দ্য লাফাইয়েত্‌।

কয়েক দশক আগে ফ্রঁসোয়াজ সাগঁ তাঁর একাধিক আত্মজীবনভিত্তিক উপন্যাসে বাঙালি পাঠকের মন জয় করে নিয়েছিলেন। তাঁরই উপন্যাসের শিরোনাম ‘বঁজুর্‌ ত্রিস্তেস্‌’ অনুপ্রাণিত জনপ্রিয় আধুনিক বাংলা গান তৈরি হয়েছে - 'সুপ্রভাত বিষণ্ণতা, তোমার আমি তোমার'। বর্তমান সময়কালে মাত্র তিরিশ বছর বয়েসে স্বনামধন্য লেখক এদুয়ার্‌ লুই-ও শ্রমজীবী পরিবারের সন্তান। এতদসত্ত্বেও এয়ার্‌নো-র বিশেষত্ব কোথায় যে এদুয়ার্‌ লুই স্বীকার করেন যে... যখন কিভাবে কথা সাজাবো খুঁজে পাই না, তখন এয়ার্‌নো খুলে পড়ি,... আমি যে কথা এক পাতা জুড়েও গুছিয়ে বলতে পারি না, উনি সেটা একটি বাক্যে সেরে ফেলেন।...

আনি এয়ার্‌নো-র বৈশিষ্ট্য তাঁর শ্রমিক-শ্রেণির দৃষ্টিভঙ্গি; যা সংসার-সমাজ-জগৎকে, এক নিয়ত পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়ায় হিসেবে দেখে। নির্যাতিত শ্রেণির পক্ষ নিয়ে তিনি তাঁর চারপাশকে নজর করে এক ভিন্নতর ভাষা নির্মাণ করে, যাকে কোন ট্যাগ-এর নিগড়ে বাঁধা মুস্কিল।

সাহিত্য-আলোচনায় একটি ব্যঞ্জনা এখন বহুল-প্রচলিত - অটোফিকশন; কাছাকাছি বাঙলা তর্জমা - আত্মজীবন-কাহিনী। আনি এয়ার্‌নো এসব চিহ্ন-প্রদানের বিপ্রতীপে দাঁড় করান তাঁর রচনাকে। আটপৌরে ভাষায় তিনি তাঁর গদ্য দিয়ে প্রমিত ভাষাশৈলীর ধারনাকেই চ্যালেঞ্জ জানান। তাঁর উপন্যাসের মূল ফরাসী শিরোনাম ইংরেজি অনুবাদে তার রূপকল্প হারিয়ে ফেলে। যেমন ’৭৪ সালে রচিত তাঁর উপন্যাসের ফরাসি শিরোনাম - লেজ্‌ আর্‌মোয়ার্‌ ভিদ্‌; যা সহজ বাংলায় - শূন্য আলমারিগুলি। এই দ্যোতনা ইংরেজি অনুবাদ ‘ক্লিয়ার্‌ড আউট’-এ হারিয়ে যায়। লক্ষণীয়, তিনি নীরবে ফরাসী দেশ থেকেই উদ্ভূত নানা দার্শনিক ভাবনার প্রতিস্পর্ধী বয়ান তৈরি করেন। শুধুমাত্র আন্তর্জালের তথ্য সম্বল করেই নজর করা যায় তাঁর ১৯৯২-এর উপন্যাস ‘পাসিয়ঁ স্যাঁপ্‌ল’ বা ‘সোজা কথা - আসক্তি’র আখ্যানে আছে বিদেশী কূটনীতিকের সঙ্গে তাঁর অবৈধ প্রণয় কাহিনী। এখানে তিনি বিধৃত করেন সেই যৌনবাসনা যা নীতির তোয়াক্কা করে না; দু' মাসে এই উপন্যাসের বিক্রি দু' লক্ষ। ২০০০ সালে প্রকাশিত ‘লে’ভেনমঁ’ বা ‘সঙ্ঘটনকাল’-এ ফিরে আসে তাঁর কলেজ জীবনে গর্ভপাতের বিষয়টি; যা ছিল ‘শূন্য আলমারিগুলি’তেও। এরপর প্রকাশিত হয় তাঁর রোজনামচা যাতে কূটনীতিকের সঙ্গে সম্পর্কের সোজা-সাপটা দিনলিপি; সাহিত্য নয়। এখানে বিবেচ্য জাক্‌ দেরিদা প্রবর্তিত যে ‘ডিকন্সট্রাক্‌শন’ বা ‘অবিনির্মাণ’-এর কথা আমরা জানি; তার সহজ ব্যাখ্যা যদি হয় - একটি ‘পাঠ’কে এমন অভিমুখে বিচার করা যাতে সেই টেক্সট-এর আপাত নিখুঁত সঙ্গতির অভ্যন্তরে পাওয়া যায় স্ববিরোধ। অর্থাৎ প্রতীয়মান হয় যে অতীব সচেতন প্রয়োগ সত্ত্বেও ভাষার এমন ক্ষমতা যে তাকে কব্জা করা মুস্কিল। আনি এয়ার্‌নো, একই ঘটনাকে তাঁর সৃষ্টিতে বারবার ফিরিয়ে এনে এই তত্ত্বের বিপ্রতীপে নিজেকে সুস্থিত করেন। সময় এবং অভিজ্ঞতার অনুবর্তনে তাঁর একই আখ্যানের অন্য পরত খুলে যায়; ডিকন্সট্রাকশন-অনুসন্ধিৎসু পাঠকের নতুনতর পাঠের প্রয়াস ব্যতিরেকে। ভাষার ক্ষমতার প্রশ্নে তাই হয়ত এয়ার্‌নোর ভাষাশৈলী সমস্ত সংস্কারমুক্ত। তিনি সদর্পে ঘোষণা করেন তাঁর রচনা রাজনৈতিক এবং এলিট-বর্জিত আবহাওয়ায় গড়ে ওঠার কারণেই তাঁর রচনাভঙ্গি সুশীল সমাজে ছুরির মত বেঁধে। তিনি নিজেই নিজের ভঙ্গিকে মনে করেন - বর্বরোচিত ভাবে দ্ব্যর্থহীন, নিচুতলার অভব্য ভাষা। সাহিত্যে তাঁর অবস্থান প্রকাশিত হয় অন্য এক দিক থেকেও। কোন রাজনৈতিক দলের অনুগত না হয়েও সমাজের সকল প্রতিবাদ মিছিলে তিনি সামিল থাকেন। এই সব মিলিয়েই আনি এয়ার্‌নো সতত সৃষ্টিশীল ফরাসী সংস্কৃতিতে অনন্য; যেমন ছিলেন অধুনা প্রায় বিস্মৃত বিপ্লবোত্তর সোভিয়েত ইউনিয়ানের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আলেকজন্দ্রা কোলন্‌তাই, শ্রেণী-দৃষ্টিভঙ্গিতে যাঁর নারীবাদী চিন্তা লেনিন, ট্রট্‌স্কির সহধর্মিণীদেরও বিরূপ করে তুলেছিল।

উল্লিখিত সব কথাই অন্তর্জালে উপলব্ধ, প্রয়োজন ছিল সাহিত্যের প্রতি অনুরাগে এই বিষয়ে আরেকটু অভিনিবেশ।

বিনীত,

ভাস্কর দাশগুপ্ত
কলকাতা-৭০০০২৬