আরেক রকম ● দশম বর্ষ ত্রয়োবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ ডিসেম্বর, ২০২২ ● ১৬-২৯ অগ্রহায়ণ, ১৪২৯

সমসাময়িক

আসাম-মেঘালয় সীমান্ত বিবাদ


মুকরো একটি গ্রামের নাম। মেঘালয়ের ওয়েস্ট জয়ন্তিয়া হিলস্ জেলার লাসকেইন ব্লকের এক প্রান্তিক গ্রাম মুকরো। কমবেশি হাজার চারেক মানুষের বসবাস। পরিবারের সংখ্যা সাড়ে পাঁচশো ছুঁইছুঁই। গ্রামের বাইরে চাষের ক্ষেত। ক্ষেতের কোনো নির্দিষ্ট মালিক নেই। গ্রামের সকলেই মালিক এবং সকলের সমবেত পরিশ্রমের ফলে উৎপাদিত শস্যের ভাগ গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়।

মুকরো গ্রামের ক্ষেতের সীমানা পেরিয়ে গেলেই শুরু হয় আসামের ওয়েস্ট কার্বি আঙলঙ জেলা। সীমান্তে অনেক দিন আগে থেকেই বনরক্ষীদের একটা ছোট্ট ক্যাম্প আসাম সরকার স্থাপন করেছে। মেঘালয়ের তরফে কয়েকজন পুলিশ মাঝেমধ্যে ওই এলাকায় টহল দেয়। আসাম ভেঙে ১৯৭২-এ মেঘালয় জন্ম নেওয়ার সময় থেকেই এমনটাই চলছে।

আসাম আর মেঘালয়ের মধ্যেকার সীমান্ত দৈর্ঘ্য প্রায় ৮৮৪ কিলোমিটার। সীমান্ত অঞ্চলের ১২টি জায়গা নিয়ে মেঘালয়ের জন্মলগ্ন থেকেই বিবাদ-বিতর্ক চলছে দুই রাজ্যের মধ্যে। কখনো কখনো সেই বিবাদ হয়ে ওঠে সহিংস। যেমনটা হয়েছে গত ২২শে নভেম্বর, ২০২২। বিবাদগুলো শুরু হয় একেবারেই স্থানীয় স্তরে। মূলত বনজ সামগ্রীর ওপরে কার অধিকার তা নিয়েই দু‘রাজ্যের সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোর মধ্যে সংঘাত বাধে, আর তার পরে সেখানে পুলিশ প্রশাসনও হস্তক্ষেপ করে। যার ফলে বিষয়টা সরকারি স্তরে চলে যায়। কিন্তু শেষমেশ প্রাণ যায় বা আহত হন স্থানীয় মানুষরাই। সময়বিশেষে বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়। প্রান্তিক গ্রামের দরিদ্র মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে সর্বহারায় পরিণত হয়ে যান।

প্রকৃতপক্ষে আসামের সঙ্গে প্রতিবেশী মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড আর অরুণাচল প্রদেশের মধ্যে সীমানা নিয়ে বিবাদ আগেও ছিল এবং এখনও রয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে বিবাদের ঘটনা ক্রমশঃ বেড়ে চলেছে এবং সেগুলো সহিংস হয়ে উঠছে। যার জেরে গত চার দশকে ১৫০-এর বেশি মানুষের প্রাণ গেছে আহত হয়েছে সাড়ে ৩০০-এর বেশি মানুষ। আর ভিটেহারা হয়েছেন ৬৫ হাজার জন। সরকারি তথ্য সঙ্কলন করে ২০২১-এ এই পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয়। নিহতদের এই তালিকায় গত ২২ নভেম্বর যুক্ত হয়েছে আরও ছয়টি নাম। মেঘালয়ের মুকরোয় আসাম পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন পাঁচ জন কৃষক। আর আসাম বনরক্ষী বাহিনীর এক জন। ঘটনার পরে অপসারিত আসামের ওয়েস্ট কার্বি আঙলঙ জেলার পুলিশ সুপারিন্টেনডেন্ট। অপসারণের আগে তিনি বিবৃতি দিয়েছিলেন, আসামের অন্তর্ভুক্ত বনাঞ্চল থেকে কাঠ পাচার করা হচ্ছে এই সন্দেহে একটি ট্রাককে বনরক্ষীরা আটক করে। ধরা হয় চালক ও খালাসীকে। তারপরে মেঘালয়ের বাসিন্দারা এসে আসাম পুলিশের কাছ থেকে আটক করা গ্রামবাসীদের ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য হামলা চালায় বলেই পুলিশ গুলি চালাতে বাধ্য হয়। চিরকালীন প্রশাসনিক বিবৃতি। আর মেঘালয় বলছে, তাদের রাজ্যের অন্তত পাঁচ কিলোমিটার ভেতরে ঢুকে এসে ওয়েস্ট জয়ন্তিয়া হিলস জেলার মুকরোয় গুলি চালিয়েছে আসাম পুলিশ।

একসময়ে মেঘালয় ছিল আসামেরই অংশ, আর শিলং শহর ছিল অবিভক্ত আসামের রাজধানী। ঘটনার পরের দিন ২৩শে নভেম্বর সেই শহরেই আসামের বিরুদ্ধে কালো পতাকা নিয়ে মিছিল হয়েছে। মেঘালয়ে এখন খাসি সম্প্রদায়ের একটা ধর্মীয় উৎসব চলছে। তাই রাস্তাঘাট মোটামুটি ফাঁকা। তবে প্রতিবাদ জানাতে বসতবাড়িগুলোতে আর গাড়িতে সবাই কালো পতাকা লাগিয়েছেন।

১৮৩৫-এর ব্রিটিশ আমলের মানচিত্রের ওপরে ভিত্তি করে আসাম ভেঙে মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম আর অরুণাচল প্রদেশ তৈরি করা হয়। স্থানীয় মানুষের ভাবাবেগ, ইতিহাস, জনজাতির স্বার্থ সেখানে প্রতিফলিত হয়নি বলেই মনে করা হয়। সীমান্ত বিবাদ মিটিয়ে ফেলতে একাধিক কমিটি হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টে মামলাও হয়েছে, এসেছে বহু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ। কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়ন করা যায়নি। দু’পক্ষই মেনে নেবে, এমন সমাধান আজও রয়ে গেছে অধরা। অথচ রাজনৈতিক ইচ্ছা থাকলে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে উপগ্রহ চিত্রের মাধ্যমে তো এখন সেই সংঘাতগুলো সহজেই প্রশাসনিক স্তরে মিটিয়ে ফেলা যায়। তা না করে কোনো এলাকায় সংঘাত হলেই সেখানে লাইন অফ কন্ট্রোল চিহ্নিত করে কেন্দ্রীয় আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করা হয়। প্রকারান্তরে এক দীর্ঘ এলাকাকে কেন্দ্রীয় শাসনের নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। গত বছর আসাম মিজোরাম সীমান্ত এলাকায় এমনটাই ঘটেছে।

বিতর্কিত সীমান্ত অঞ্চলের মানুষদের বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহ করে পরিচয়পত্র দেওয়া এবং সেখানে যাতে নতুন করে কোনো বসতি না গড়ে উঠতে পারে, সেটাও নিশ্চিত করা যায়। নানা ধরণের পরামর্শ, আদালতের রায় অনেকই তো এসেছে, কিন্তু প্রশ্নটা হল সেগুলো বাস্তবায়ন কে করবে? বিবাদ নিরসনে আসাম আর মেঘালয় সরকারও তো প্রশাসনিক আধিকারিকদের নিয়ে কমিটি গড়েছিল। তারা ঠিক করেছিল যে ১২টি অঞ্চল নিয়ে বিরোধ, তার মধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে ছয়টি অঞ্চলের সমস্যার সমাধান করা হবে। সেই মর্মে চলতি বছরেরই গোড়ার দিকে চুক্তিও হয়েছিল। কিন্তু তারপরেও এক রাজ্যের পুলিশ অন্য রাজ্যের সীমানায় ঢুকে গুলি চালায়, প্রাণ যায় নিরীহ গ্রামবাসীর।

উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে বিভিন্ন জনজাতির বসবাস। কয়েকটি বাদ দিয়ে বেশিরভাগ জনজাতির জনসংখ্যা অত্যন্ত কম। কিন্তু প্রতিটি জনজাতির ভাষা-ধর্ম, জীবনযাপন পদ্ধতি, সংস্কৃতি ভিন্ন এবং প্রতিটি জনগোষ্ঠীই নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। জনজাতির এই স্বতন্ত্র অস্মিতাকে নিয়ে বিভাজনের রাজনীতি করে আগ্রাসী আধিপত্যবাদ। এই বিভাজন জিইয়ে না রাখতে পারলে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ সম্ভব নয়। পিছিয়ে পড়া জনজাতির মানুষ নিজেদের সমস্যার মূল কারণ নির্ণয় করে নিতে সক্ষম হলে আগ্রাসী আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে সমস্যার সমাধানের পথ নিজেরাই খুঁজে নিতে পারবেন। তখনই যাবতীয় সীমান্ত সংঘর্ষ চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে।