আরেক রকম ● দশম বর্ষ দ্বাবিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ নভেম্বর, ২০২২ ● ১-১৫ অগ্রহায়ণ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

অনুবাদপাঠ

অমিয় দেব


অনুবাদ পড়া সবসময়ই এক স্বচ্ছ কর্ম নাও হতে পারে। এমন হতেই পারে যে আমরা অনুবাদ পড়ছি, অথচ জানি না তা অনুবাদ। ধরা যাক আমরা কোন প্লেটো-র উক্তি পড়ছি ইংরেজিতে উদ্ধৃতিকার আমাদের বললেন না, বা বলার প্রয়োজনই মনে করলেন না, যে এটা অনুবাদ। তিনি সোজা ইংরেজি অনুবাদ উদ্ধৃত করলেন যেহেতু তাঁর পাঠকবর্গ ইংরেজি-পড়িয়ে। তারা ফরাসি-পড়িয়ে হলে তিনি হয়ত ফরাসি অনুবাদ উদ্ধৃত করতেন। কিন্তু সন্দেহ হয় বাংলায় লিখলে তিনি বাংলা অনুবাদ দিতেন কিনা। তাঁর উদ্ধৃতি হয়ত হতো ইংরেজি অনুবাদেই। আর এতে সাধারণ পাঠকের অনুবাদ বনাম মূল নিয়ে বিভ্রান্তি বাড়ত বই কমত না। আমাদের নিরবচ্ছিন্ন পাশ্চাত্যপ্রেক্ষণে আমরা সততই উদ্ধৃতিতে ভাসি। এবং তার সবটাই যদি ইংরেজির ঢেউয়ে আসে, তাহলে আমরা হয়ত একসময় ভাবতে বসব, যারা আমাদের ভাষা না লেখে তারা ইংরেজি লেখে। যামিনী রায় যে জগৎকে শুনেছি থালি ভারতীয় ও অভারতীয়তে ভাগ করতেন, তার এক কদর্থই তা হবে। যাই হোক, আমাদের আশু বিবেচনা আধিপত্য নিয়ে না, অনুবাদপাঠে স্বচ্ছতা থাকবে কিনা তা-ই নিয়ে। তবে স্বচ্ছতা মানে এই নয় যে আমরা মূল জানব; বস্তুত মূল যত কম জানব তার আস্বাদন বেশি হবে (আর বলা বাহুল্য বাংলাভাষীর এই আস্বাদন বাংলায় যত বেশি হবে তত ইংরেজিতে হবার নয়। আসলে, অনুবাদ নিয়েই তো এক প্রাথমিক অনাস্থা আছে আমাদের। সেই বিখ্যাত ইতালীয় উক্তি (ত্রাদুত্তোরে ভ্রাদিতোরে’ [অনুবাদক বিশাসহন্তা] ) আর একবার না করে বাংলা ‘দুধ না খেতে পেয়ে ঘোল খাওয়া’-র কথা বলছি। আমি নিজেকে এখন এক করুণাদ্রেকী ঘোল-থাইয়ে হিসেবেই উপস্থাপিত করছি। আর, হে নিবন্ধপাঠক, আমার ভ্রাতা, আমার দোসর, তোমাকেও এখন তাই হতে বলছি।

একবার শিশিরকুমার দাশ, যিনি ধ্রুপদী গ্রীক থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন, অনুবাদের নির্ভরতার প্রশ্ন তুলেছিলেন। অনুবাদকে পাঠকের কাছে নির্ভরযোগ্য হতে হবে। কিন্তু কী করে পাঠক জানবে তা নির্ভরযোগ্য? সে তো মূল জানে না - আর যদি জানত তাহলে তাকে অনুবাদ পড়তে হত না। তাই তাকে অনুবাদের উপরই আস্থা রাখতে হয়। এটাকে যদি উল্টো দিক থেকে দেখি তাহলে দাঁড়ায়, অনুবাদককেই নিজেকে পাঠকের আস্থাভাজন করে তুলতে হবে। তার মানে, সেই প্রাথমিক অনাস্থার (ত্রাদিতোরে) পরিবর্তে এক আস্থার আবহে আমরা গ্রহণ করব অনুবাদকে। আস্থা না থাকলে গ্রহণ নেই; গ্রহণ না হলে নেই আস্বাদন। তবু ব্যাপারটার ওখানেই ইতি হয়ে যায় না। প্রায়শই কোনো অনুবাদের অবিশ্বস্ততার কথা শোনা যায়, আবার অতীব সরলমতি পাঠকও একেবারে গুজবে কান না পেতে থাকতে পারে। সে হয়ত ভাবতে শুরু করে তাকে মূল থেকে অতিদূরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। কোনো উপায় কি আছে যাতে সে গোড়াতেই তার আস্থা বাজিয়ে নিতে পারে? শিশিরকুমার দাশ এক অপনয়নমূলক পদ্ধতি প্রস্তাব করেছেন। কিন্তু তাতে আমরা পরে আসব। আপাতত আমরা অনুবাদকে এক সাংস্কৃতিক সংঘটন হিসেবে দেখব।

সাংস্কৃতিক সংঘটন বলতে আমি অনুবাদ যে-সাংস্কৃতিক অন্তরণে অভীষ্ট তার কথা বলছি না, বলছি কোনো অনুবাদকর্ম তার উদ্দিষ্ট ভাষার সংস্কৃতিতে যে-ঢেউ তোলে তার কথা, তা যতই মৃদু হোক না কেন। কারণ পাঠকদের মধ্যে এমন কেউ কেউ থাকতেই পারেন যাঁরা মূলের ভাষা পড়তে পারেন, এবং তাঁদের দু-একজনে সেই ভাষায় তাঁদের জ্ঞানের সঙ্গে অনুবাদকের জ্ঞান মিলিয়ে দেখতে চাইতেই পারেন। ছিদ্রান্বেষণ হোক বা না হোক, এটা এক প্রকার সমালোচনা, হয়তা এই খেয়াল না করেই যে অনুবাদক কেবল ভাষান্তরণ বা সাংস্কৃতিক অন্তরণ করছিলেন না, লিখছিলেনও, যেভাবে একজন লেখক লেখে। যেমন, কোনো কবিতা অনুবাদে তাঁকে নিশ্চিত হতে হবে যে সেই অনুবাদ তার আপন মূল্যেই এক কবিতা। এবং অবশ্যই তার করা উপন্যাস বা গল্প অনুবাদ আপন মূল্যেই উপন্যাস বা গল্প।

কবিতা অনুবাদক হিসেবে কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত যে-কথাটার উপর জোর দিয়েছিলেন তা এই, যে মূল যেন-বা সেই বস্তু বা অভিজ্ঞতা যার রূপ দিচ্ছেন অনুবাদক। এবার, ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক অন্তরণের পর্যান্তি বা অ-পৰ্যাপ্তি যদি এক প্রকার সমালোচনা হয়, তবে এক অন্য প্রকার সমালোচনা আছে যাতে কোনো অনুবাদকর্মকে তার পরম্পরাগত প্রেক্ষিতে বসানো হয় - অর্থাৎ আগেকার অনুবাদগুলোর তুলনায় তার বিচার হয়। উভয় ক্ষেত্রেই সমালোচক এক অভিভাবকত্ব ধারণ করেন যাতে অনুবাদপাঠক তাঁর তত্বতালাশে কেবল চমৎকৃত বা আতঙ্কিত হতে পারে, কিন্তু অংশ নিতে পারে না। এমনও মনে হতে পারে যে অনুবাদক্রিয়াকে ঘিরে যে-আবর্ত ফেনিয়ে ওঠে তাতে তার মুখ্যগ্রহীতা অর্থাৎ পাঠকের কোনো জাযগাই নেই - সত্যিই এক থেদজনক পরিস্থিতি তা।

যদি এক মূল রচনার পাঠ-প্রতিক্রিয়া সন্ধান বৈধ হতে পারে, তাহলে কোনো কারণ নেই কেন এক অনুবাদের পাঠ-প্রতিক্রিয়া সন্ধান বৈধ হবে না। কন্সটান্সের বিখ্যাত পরিগ্রহণবাদীরা অনুবাদকে পাঠযোগ্য বিবেচনা করেছেন বলে জানি না - না ইয়াউস না ইজার। পাঠ-বিজ্ঞান কি এতে অসম্পূর্ণ থেকে যাচ্ছে না? যাই হোক, আমরা অন্তত আমাদের কী প্রতিক্রিয়া হয় অনুবাদ পড়ে তা লিপিবদ্ধ করতে পারি। নেওয়া যাক না এক উদাহরণঃ শিশিরকুমার দাশের ধ্রুপদী গ্রীক লিরিকের অনুবাদ। আমার প্রতিক্রিয়াই আমি লিপিবদ্ধ করি না কেন? ধ্রুপদী গ্রীক আমি জানি, অতএব আমি এর এক অভিপ্রেত পাঠক। আর, নিবন্ধপাঠক, ধরে নিচ্ছি তুমিও ধ্রুপদী গ্রীক জান না (গোস্তাকি মার্জনীয়) - অতএব তুমিও।

একহারা চেহারার এই বই বেরোয় ১৯৮৯-তে, নাম ‘বহু যুগের ওপার হতে’। এতে আছে ৯০টি নির্বাচিত কবিতা, বেশির ভাগই কবিতার ভাঙা টুকরো, যাতে সাত থেকে তিন পূর্বাব্দের মধ্যে গ্রীক কবিরা কী লিখেছিলেন তার এক আভাস মাত্র পাওয়া যায়। এর কোনো কোনোটি আগে ইংরেজিতে পড়েছি, তবে বাংলায় এই প্রথম (একটি ভাঙা সাফো ছাড়া, যা বিষ্ণু দে-র ‘চোরাবালি’-তে পেয়েছিলাম)। একটা কথা এখানে ওঠে, তারা তুলনায় ভালাে কি মন্দ তা নিয়ে নয়, তারা আমার চোখে যে আরাম দেয় তা নিয়ে। আমাদের ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারে আমরা এখনোইংরেজিকে একটু বেশি মূল্য দিই, এতটাই যে গ্রীক কবিতা যে বাংলায় অনুবাদ করা যায় তা নিয়েই যেন কেমন এক অচেতন সংশয় থাকে। শিশিরকুমার দাশ এর আগে তিনটে গ্রীক ট্র্যাজেডি অনুবাদ করেছেন, কিন্তু নাট্যের তাে এক বহিরঙ্গ টান আছে - তাই সংশয়ের অবকাশ কম। যখন আমি বাংলায় ওই গ্রীক কবিতাবলি পড়ি তখন আমার ইংরেজি অনুবাদ পাঠের স্মৃতি রোধ করে রেখেছিলাম যাতে পাঠে কোনো দাগ না লাগে। কিন্তু কী পাই বাংলা গ্রীক কবিতায়? নিশ্চয়ই খুব চেনা এক জগৎ নয় (এতদিনে আধচেনা ইংরেজ জগৎ থেকেও দূরে), তাই ভ্রমি বিস্ময়ে। এক জগৎ যেথানে সমকামিতা সিদ্ধ, যেখানে মৃত্যু অদূরেই দণ্ডায়মান, তাই বেঁচে থাকাটাই যেখানে আনন্দের। তবে দেবতাদের যে-নিত্য পদপাত সেখানে ঘটে তা আমাদের অচেনা ঠেকবার নয়। নরনারীর নাম অন্যতর, কিন্তু স্বরের শুদ্ধতায় উচ্চারণসুভগ। যে-ভূগোলে ভেসে ওঠে তা সুদূর হলেও কল্প-মানচিত্রে অলভ্য নয়। পাই পুরাণ ও ইতিহাসও। আর আবেগ? সমানুকম্পনে সাড়া জাগবেই। যেমন, সাফো বা আনাক্ৰেয়োনে প্রেমের আছড়ে পড়া; আনাক্তোরিয়া বা আথিসকে নিয়ে সাফোর উন্মাদনা, বা কাতর ঈর্ষা যখন প্রিয়সখী তার সদ্যলন্ধ বরের কণ্ঠলগ্ন; আনাক্ৰেয়োনের সুরাপ্রেম; থার্মোপাইলের যুদ্ধে নিহত সৈনিকদের দেশপ্রেম; সমরক্ষেত্র থেকে আরখিলোকিসের পলায়ন; ট্রয়ের সেই কালো রাত্রির স্মৃতি যখন ধ্বংস নেমে এল। ভিনদেশী পাঠকেরা তফাৎ থাকবে। আবার কোনো তথাকথিত বৈশ্বিক গোলে হরিবোল নয় এসব; তারা প্রাচীন গ্রীক জীবনের কিছু খুব ঘনিষ্ঠ ও নিভৃত মুহূর্ত। গ্রীক আওয়াজ আমরা অবশ্য শুনছি না এবং তা থেকে।যে-মানে উঠে আসে তা ঠিক পাচ্ছি না; কিন্তু যে-আওয়াজ আমরা শুনছি তাতে এক প্রতিফলন আমরা পাই গ্রীক জীবনের। প্রতিফলিত হলেও তাতে বাগর্থ মেলে। খানিকক্ষণের জন্য আমরা এক শিরাধমনীসুদ্ধ জীবনের কাছে হেঁটে যাই।

‘প্রতিফলন’ নিয়ে কারো সমস্যা হতে পারে, আমাদের তা হবার নয় যাদের কাছে অ-প্রতিফলিত মূলের কপাট বন্ধ। অনুবাদ ক্রিয়াটাই ঘটে আমাদের স্বার্থে। এবং আমরা যতক্ষণ জানি আমরা অনুবাদ পড়ছি, আর মূলের কোনোমোহ আমাদের নেই, ততক্ষণ আমাদের পায়ের তলায় মাটি আছে। বস্তুত, যদি আমরা বাংলার বদলে ইংরেজি পড়তাম, বা ধরা যাক উর্দুর বদলে ইংরেজি, তাহলে হয়ত আমাদের উত্তর-ঔপনিবেশিক লুকোচুরিতে সে-মোহ কিঞ্চিৎ হত। অদীক্ষিতদের মধ্যে কোনো হঠাৎ নেওয়া ‘কুইজে’ তার মাত্রা খুব কম মিলবে না। তা রোধ করার দায়িত্ব শিক্ষা’র, কিন্তু বাংলা লিপিতে ‘সাফোআলকাইঅস-আনাক্ৰেয়োন’ নামগুলি পড়ে কোনো ভ্রমের আশঙ্কা নেই। তাছাড়া, এক ধরণের স্বাধিকারও এতে আমাদের জোটে, কারণ তা আমাদের মূলের দিকে ঠেলে দেয় না যদিও মূলের অভাবই এর হেতু। আসলে আমি ইচ্ছে করেই এই দৃষ্টান্ত নিয়েছি, এই ধ্রুপদী গ্রীক লিরিকের বঙ্গানুবাদ, ওই [অধিকারহীন] স্বাধিকারের খাতিরেই, কারণ ধ্রুপদী গ্রীকের কোনো জ্ঞানই আমার নেই। হত যদি সাগরপারের ফরাসি বা জার্মান, তাহলে হয়ত মূল দেখে নেবার একটু লোভ আমার হত। ওই অপ্সরীরা, মন চায় ওদের চিরায়ু দিতে’ ঠেলে দিত মালার্মের ‘Ces mympfies, je tes veu perpetuer-এর দিকে। বা ‘কেননা আমরা আর-কিছু নই - শুধু পাতা, খোসা’ রিলকের ‘Denn wir sind nur die Schale und das Blatt’-এর দিকে। আমি অবশ্য আমার কথাই বলছি - এক্ষেত্রে এক দ্বিধাগ্রস্ত ভাঙাচোরা অনুবাদপাঠকের কথা - আর ঈর্ষা করি সেই অনুবাদপাঠককে যার এমন কোনো প্রলোভন হয় না; অর্থাৎ অনুবাদকের স্বাধিকার যে পুরোভোগ করতে পারে। সংস্কৃত মূল হলে বোধহয় আরো অনেকের অনুবাদপাঠ তত অব্যাহত থাকবে না, মূল মেলাবার প্রবণতা আমাদের বেশি হবে। কোনো ভালোমন্দের প্রশ্ন আমি তুলছি না, তবে অব্যাহত অনুবাদপাঠ নিশ্চয়ই ব্যাহত অনুবাদপাঠ অপেক্ষা সুখের।

একটা সংশয় তবু থেকে যায়। একই রচনার যদি দুটো অনুবাদ থাকে আর তাদের পাঠ হয় ঈষৎ ভিন্ন, তাহলে হয়ত আমরা জানতে চাইব, হয়ত, কোনটা মূলের বেশি কাছে, যদিও এই প্রশ্নটাই মূলজানা শুদ্ধ অনুবাদপাঠকের স্বাধিকারে একটু বিঘ্ন ঘটাবে। তাছাড়া অনুবাদপাঠক তো নিজে সমাধান করতে পারবে না, তাকে নির্ভর করতে হবে বিজ্ঞ সমালোচকের উপর, আর সেই জ্ঞানের ভার কি বইতে পারবে তার আস্বাদন? অন্য দিকে, একমাত্র একটা অনুবাদের ধারণাও বোঞধকরি ঠিক নয়, কারণ একই মূলের ভিন্ন ভিন্ন অনুবাদ হয়েই থাকে, আর তা শুধু ভিন্ন ভিন্ন সময়ে নয়, একই সময়েও। আবার বাস্তবিক অর্থে, পাঠকও হয়ত একই মূলের একাধিক অনুবাদে অনভ্যস্ত নাও হতে পারে এবং তাতে তার আস্বাদনের মাত্রায় খুব তারতম্য নাও ঘটতে পারে অনুবাদকর্ম ঠিক কী - উদ্ভাসন না পুনর্লিখন - তা পাঠকের জানবার কথা নয়; কিন্তু যদি পাঠক খেয়াল করে তাহলে হয়তা দেখবে, কোনো মূলের মত তার অনুবাদেরও এক নিজস্ব, অর্থাৎ মূলের ইতিহাসের সঙ্গে অসম্পৃক্ত, ইতিহাস আছে। এও দেখতে পারে যে সংস্কৃতিতে সংস্কৃতিতে তথা সভ্যতায় সভ্যতায় যে-সংলাপ চলে (খানিক ভুল বোঝাবুঝি ব্যতিরেকে যা নয়), অনুবাদ তারই অন্তর্গত। তদুপরি এই প্রতীতিও হতে পারে যে অনুবাদ কখনো কখনো সাংস্কৃতিক ‘অপর’-এর সঙ্গে সম্পর্কস্থাপন। আবার অনুবাদের যে এক রাজনীতি আছে, কী অনুবাদ হবে না হবে তা নিযে প্রভুত্বের হেরফের, তাও বুঝে ফেলতে পারে পাঠক। ইত্যাদি ইত্যাদি নানা উপলব্ধি নিয়েও অনুবাদপাঠক শেষ পর্যন্ত অনুবাদেরই পাঠক, মূলের নয়।

উপরিউক্ত নির্ভরতার প্রশ্নে এবার আমরা ফিরে যেতে পারি। অনুবাদপাঠকের অবশ্য তার উত্তর জানা নেই; কিন্তু, শিশিরকুমার দাশ যেমন বলেছেন, অনুবাদ পড়বার আগে সে একটু বিচক্ষণতার চেষ্টা করতে পারে। গোড়াতেই সে জানতে চাইতে পারে অনুবাদটি কি মূল থেকেই হয়েছে, নাকি অন্য কোনো অনুবাদ থেকে হয়েছে, নাকি হয়েছে কোনো মধ্যস্থের সাহায্যে। পরেক্ষ অনুবাদ নিয়ে একটা মুশকিল থেকেই যায়, বিশেষ করে যখন সেই ইংরেজিরই আমাদের আশ্রয় নিতে হয়। (ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, ইন্ডিয়া কিছুদিন আগেও কোনো ভারতীয় ভাষার মূল রচনার প্রথমে এক ইংরেজি অনুবাদ করিয়ে নিত, যা থেকে অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় অনুবাদ হত; এখন ‘আদান-প্রদান প্রচলিত হয়ে সেই ব্যবস্থা রদ হযেছে।) অনুবাদপাঠকের দ্বিতীয় জিজ্ঞাসা হতে পারে, অনুবাদের ভাষা অনুবাদকের মাতৃভাষা বা ‘প্রথম’ ভাষা কিনা। তৃতীয়ত, তার মনে হতে পারে কবিতার পদ্যানুবাদে গদ্যানুবাদ অপেক্ষা বেশি আপোশ থাকবে। তাছাড়া, ছন্দের ক্ষেত্রে এক অন্য ধ্বনিসামগ্রীতে কতটা যথাযথ অনুসরণ সম্ভব, এ-প্রশ্নও সে করতে পারে। অন্যদিকে, দূরের ভাষার চেয়ে কাছের ভাষা থেকে অনুবাদ নিশ্চয়ই সহজতর। তাছাড়া যে-অনুবাদকেরা আগে আরো অনুবাদ করেছেন তাঁদের উপর হয়ত বেশি ভরসা করা যায়। তবে বিখ্যাত অনুবাদকের বিখ্যাত রচনার অনুবাদ হলেই তা মাথায় তুলে নেবার মত নাও হতে পারে। স্টাইল বা রীতির প্রশ্নে পাঠক হয়ত চাইবে নৈর্ব্যক্তিকতা, অর্থাৎ লেখক যেখানে অনুবাদক সেখানে যেন তিনি তাঁর নিজের রীতি অনুবাদের ঘাড়ে না চাপান। এইরকম নানাবিধ প্রসঙ্গের এক তালিকা তাঁর 'Dependability' নামের প্রবন্ধে প্রস্তাব করেছেন শিশিরকুমার দাশ (বেরিয়েছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাপা Papers in Comparative Literature, ২য় খণ্ড - The Aesthetics of Translation- এ, ১৯৯২-তে)। তিনি হয়ত এতে এসে পৌঁছেছিলেন তাঁর সারাজীবনের অনুবাদপাঠ ও অনুবাদকর্মের মধ্য দিয়ে। তবে, মূল-না-জানা অনুবাদপাঠকের অনুবাদে আস্থা অর্জনের জন্য তাঁর প্রস্তাবিত নির্ণায়কদের নিয়ে কোনো বাধ্যতার দাবি তাঁর ছিল না। কিন্তু আস্থার উপর তিনি জোর দিয়েছিলেন।

আমি আগে ইঙ্গিত করেছি যে আস্থার একটা উল্টোপিঠও আছে। কোনো অনুবাদ পড়তে গেলে তা নিয়ে এক প্রাথমিক আস্থা থাকা চাই পাঠকের। যদি আস্থা না থেকে থাকে সংশয়? যেমন আস্থাবান পাঠক আছে, তেমনি সংশয়ী পাঠকও থাকতে পারে। কিন্তু অনুবাদ পড়ে যেহেতু যা লাভ হবার তা তারই হচ্ছে, তাই প্রাথমিক সংশয় বর্জনই বোধকরি অভিপ্রেত। তবে ওতেই তার দায়িত্ব ফুরোচ্ছে, বাকি কাজ অনুবাদের। তা কি ওই আস্থার যোগ্য হতে পারছে, সেই গুণ কি সত্যিই তার আছে? কোনোক্রমেই যেন অনুবাদের কর্মে খামতি না থাকে, কোনোভাবেই যেন তা কোনো পাঠকের অনাস্থার ঘুম না ভাঙিয়ে দেয়। আর এখানেই হয়ত শিশিরকুমার দাশের ‘নির্ভরতা তত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতা। শুধু নির্ভরযোগ্য অনুবাদই পাঠকের ভোগ্য। তা বিচারের ভার পাঠকের নয়; অনুবাদই আসবে যথাযথ হয়ে, সংশয়াতীত হয়ে। দায়িত্ব অনুবাদের, তা যেন মূলের উপযুক্ত হয়। পাঠক যেমন তার দিকে এগোবে, সেও যেন পাঠকের দিকে এগোয়। অতএব, অনুবাদপাঠ যেমন পাঠকের গল্প তেমনি অনুবাদেরও গল্প। অনুবাদকে মনে রাখতে হবে তার অস্তিত্ব পাঠকহেতু। আর পাঠককে মনে রাখতে হবে সে সক্রিয় অনুবাদহেতু। কাফকার সেই কাক ও আকাশের গল্প, অস্তিত্বের অনস্তিত্বের, যেন এক্ষেত্রে না বর্তায়।


(২০০৩-এ 'Sandhan' পত্রিকায় ছাপা লেখকের ইংরেজি প্রবন্ধ ‘Reading Translation’-এর বাংলা।)