আরেক রকম ● দশম বর্ষ দ্বাবিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ নভেম্বর, ২০২২ ● ১-১৫ অগ্রহায়ণ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

সাহিত্যে নোবেলঃ অ্যানি আর্নাক্স

গৌতম সরকার


চলতি বছরে সাহিত্যে নোবেল পেলেন ফরাসি ঔপন্যাসিক অ্যানি আর্নাক্স। আর্নাক্সকে পুরস্কৃত করার কারণ হিসেবে সুইডিশ অ্যাকাডেমির বক্তব্য, "সৎসাহস ও পর্যবেক্ষণ তীক্ষ্ণতা অবলম্বনে ব্যক্তিগত স্মৃতি, সমষ্টিগত সংযম, বিচ্ছিন্নতা বোধ এবং শিকড় অনাবৃত করার জীবনভোর প্রয়াস তাঁকে এই সম্মানে সম্মানিত করেছে।" অ্যাকাডেমির পক্ষ থেকে আরও বলা হয়েছে, "লিঙ্গ, ভাষা এবং শ্রেণীগত শক্তিশালী বৈষম্য দিয়ে পাক খাওয়া, মানবিক বোধের ঘুন ধরা, মাকড়সার জালে আটকানো শুদ্ধ চেতনা, লোভ, ক্রোধ, অশান্তি, দাঙ্গা, খুন, বলাৎকারে ভরা নিম্নশ্রেণীর মানুষের জীবন ধারাবাহিকভাবে এবং বিভিন্ন আঙ্গিকে আর্নাক্স দেখেছেন, এবং সেই অভিজ্ঞতা বিশ্বস্ততার সাথে তাঁর সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়েছে।" এ বছরের সম্ভাব্য প্রতিযোগীদের মধ্যে বিশ্বসাহিত্যের অনেক দিকপাল, মহীপাল ছিলেন। তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখক সলমন রুশদি, কেনিয়ার লেখক নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গ, জাপানের ঔপন্যাসিক হারুকি মুরাকামি, নরওয়ের জন ফোস, আরও অনেকে। তাঁদের মধ্যে আনি আর্নাক্স-কে বেছে নেওয়া প্রসঙ্গে অ্যাকাডেমির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, "the courage and clinical acuity with which she uncovers the roots, estrangement and collective restraints of personal memory helped her to win the coveted prize." নোবেল সাহিত্য কমিটির চেয়ারম্যান, আন্ডার্স অলসনের মতে, "আর্নাক্স একজন অত্যন্ত সৎ লেখক, তিনি তাঁর দীর্ঘ সাহিত্য জীবনে কঠিন সত্যের মুখোমুখি হতে ভয় পাননি। তাঁর সাহিত্যে তিনি এমন কিছু বিষয় উপস্থাপন করেছেন যা আগে কেউ করেননি, বা করলেও, দিনের আলোর মত এত স্পষ্ট করে কেউ বলেননি।" উদাহরণস্বরুপ মি. অলসন গর্ভপাত, ঈর্ষা, পরিত্যক্ত প্রেমিকের যন্ত্রনা, বাবার প্রতি ক্ষোভ, মায়ের প্রতি করুণা ইত্যাদির উল্লেখ করেছেন। নোবেল বিজয়ীর লেখা প্রসঙ্গে আন্ডার্স অলসন আরও বলেছেন, "uncompromising and written in plain language, scraped clean."

ফরাসি এবং বিশ্ব সাহিত্যের অনেক লেখকের লেখা পড়ে বড় হয়ে উঠেছেন অ্যানি। তবে লেখার ক্ষেত্রে তিনি কোনও ঘরানাকে আশ্রয় করেননি। সমালোচক এবং পাঠকদের মতে তিনি সারাজীবন একটা 'ফ্ল্যাট স্টাইল' অবলম্বনে সাহিত্যচর্চা করে গেছেন, আর সেই কারণেই তিনি অনন্য ও একক হিসেবে সাহিত্য দুনিয়ায় জায়গা করে নিতে পেরেছেন। ১৯৭০ সাল থেকে সাহিত্যচর্চা করছেন, ফরাসি সাহিত্যে একটা বিশিষ্ট জায়গা করে নিতে সমর্থ হয়েছেন, তাঁর লেখা নিয়ে রেডিও, টিভি, সেমিনার, সিম্পোজিয়ামে বহু আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। ১৯৯১ সাল থেকে তাঁর লেখা ইংরেজি ভাষায় অনুদিত হতে শুরু হয়েছে। কিন্তু ইংরেজি সাহিত্য পড়া পাঠককুলের কাছে একজন বিশিষ্ট সাহিত্যিক হিসেবে নজর কেড়েছেন ২০১৯ সাল থেকে, যে বছর তাঁর বই 'দ্য ইয়ার্স' 'ইন্টারন্যাশনাল বুকার প্রাইজ'-এর জন্য চূড়ান্ত পর্যায়ে নির্বাচিত হয়। নোবেল পুরস্কার জয়ের পর লেখিকার স্বীকারোক্তি, "সাহিত্য হল রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রকাশের এক সুযোগ্য মাধ্যম। সাহিত্য সামাজিক বৈষম্য, অত্যাচার, দুর্নীতি, যন্ত্রনা, শোষণ, অস্পৃশ্যতা, বৈষম্য, আর্তি, দুর্ভোগ সবকিছুর প্রতি সাধারণ নির্বিরোধী মানুষেরও চোখ খুলে দেয়। আর সেটা সফলভাবে করার জন্য একজন লেখক হিসেবে ভাষাকে আমি ছুরির মত ব্যবহার করেছি। যে ছুরি সমাজের কল্পনার পর্দা ছিঁড়ে-খুঁড়ে দেয়।" তাঁর এই বক্তব্যকে পূর্ণ সমর্থন করেছেন 'টাইমস্' পত্রিকার সাহিত্য সমালোচক ডোয়াইট গার্নার, তিনি বলেছেন, "তাঁর কণ্ঠ আদিম প্রত্যক্ষতার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। তিনি সতত একটা ছুরি দিয়ে টেবিলের উপর প্রতিটি বাক্যকে খোদাই করে গেছেন।"

অ্যানি আর্নাক্স ১৯৪০ সালে নরম্যান্ডির ছোট্ট শহর ইভেটটে একটি শ্রমজীবী ক্যাথলিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা-মায়ের একটি মুদিখানা এবং কফি শপ ছিল। বাবা-মায়ের কোনও প্রথাগত শিক্ষা ছিল না, উল্টে বাবা ছিলেন মেজাজি এবং দুর্মুখ। মাত্র বারো বছর বয়সে ছোট্ট আর্নাক্স বাবাকে তার মা'কে হত্যার চেষ্টা করতে দেখেছিলেন। শৈশবের সেই ঘটনা তার মনে গভীর রেখাপাত করে, যেটি পরবর্তীকালের তাঁর গ্রন্থ 'শ্যেম'-এ উঠে এসেছে, যেখানে তিনি বলছেন, "আমার বাবা জুনের এক রোববার ভোরবেলা আমার মা'কে হত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন"। পড়াশোনার নিমিত্তে তিনি রাওয়েন এবং বোর্দো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে একজন স্কুল শিক্ষকের যোগ্যতার পরীক্ষায় পাশ করেন এবং পরবর্তীতে আধুনিক সাহিত্যে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। এই শিক্ষা পরবর্তী সাহিত্যজীবনে লেখার দিকধারা নির্ধারণে তাঁকে সাহায্য করেছিল।

তাঁর সাহিত্যকর্ম শুরু হয় ১৯৭৪ সালে প্রথম বই 'ক্লিনড আউট' প্রকাশনার মধ্য দিয়ে। যদিও এই কৃতিত্ব তাঁর পারিবারিক জীবনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলে। তাঁর স্বামী সাহিত্যচর্চা ভালো চোখে দেখতেন না। তাই আর্নাক্স 'পি.এইচ.ডি.' থিসিস করার নাম করে নিভৃতে বইটি লিখেছিলেন। পরবর্তীতে যখন বইটির স্বত্ব প্রকাশনা সংস্থা গ্যালিম্যার্ডের কাছে বিক্রি করেন তখন বাড়িতে জানাজানি হয়ে যায়। এই ঘটনায় তাঁর স্বামী ভয়ানক ক্ষুব্ধ হন। বইটির সাফল্য আর্নাক্সকে আরও গভীর সাহিত্যচর্চায় অনুপ্রাণিত করে, যার ফলশ্রুতিতে কয়েক বছর পর তাঁর বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। বিবাহসূত্রে তাঁদের দুটি পুত্রসন্তান ছিল। লেখিকা পরবর্তীতে আর বিয়ে করেননি। এরপর তিনি লিখলেন, 'হোয়াট দে সে গোস' এবং 'দ্য ফ্রোজেন উওম্যান'। বইগুলো কারোর কারোর মতে আত্মজীবনীমূলক, আবার কেউ কেউ দেখেছেন 'সমাজের দর্পণ' হিসাবে। আসলে বিষয়দুটি প্রবলভাবে পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত। একজন লেখক নিজের গল্প বলতে গিয়ে সমাজের গল্পই বলতে থাকেন, কারণ সমাজ ছাড়া কারোর অস্তিত্ব প্রকাশ সম্ভব নয়, মহাশূন্যে সমস্ত জিনিসই একটা 'বিগ জিরো' ছাড়া আর কিছুই নয়। লেখিকার নিজস্ব ওয়েবসাইটে উল্লেখ আছে, "her writing has continued to explore not only her own life experience but also that of her generation, her parents, women, anonymously others encountered in public space, the forgotten."

একটি শ্রমজীবী, আপাত অন্ধকার পরিবারে বেড়ে ওঠার কারণে শৈশব থেকেই ঘরে-বাইরে বিভিন্ন প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে অ্যানিকে। বাবার অশিক্ষা এবং বদমেজাজ কখনোই বাবা-মেয়ের সম্পর্কের স্বাভাবিক রসায়ন তৈরি করেনি, মায়েরও রুচি ও সংস্কৃতি তথাকথিত শ্রমিক পরিবারের মহিলাদের মতোই ছিল। ক্যাফেতে সারাদিন উচ্চৈঃস্বরে সস্তা, বাজার চলতি গান বাজত, ঘরে তাঁর মা অতি সাধারণ রোম্যান্টিক নভেল পড়তেন। এইরকম আবহে বইয়ের প্রতি নেশায় কিছুদিন মায়ের নভেল নাড়াচাড়া করে বুঝতে পারলেন, প্রকৃত সাহিত্য এইসব সস্তা, বস্তাপচা প্রেমের একঘেয়ে কাহিনী নয়, তাই শৈশব থেকেই তিনি ফরাসি ক্লাসিক গোগ্রাসে গিলতে শুরু করলেন। আস্তে আস্তে বালজ্যাক, মার্সেস প্রাউস্ট, সিমোন দু বুভোয় পড়ে শেষ করেছিলেন।

প্রথম তিনটি বইয়ের পর আর্নাক্স তাঁর লেখার স্টাইল একটু বদলে ফেললেন। তিনি তাঁর লেখা কখনই নন-ফিকশন বা কল্পকাহিনী হিসেবে উল্লিখিত হোক তা চাননি। ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত হল 'আ ম্যান'স প্লেস'। যেখানে তিনি বাবার সাথে নিজের সম্পর্ক দ্বর্থ্যহীন ভাষায় তুলে ধরেছেন। বলাবাহুল্য, আর্নাক্সের সাথে তাঁর বাবার সম্পর্ক আর পাঁচটা বাবা-মেয়ের সম্পর্কের মত ছিল না। আর্নাক্স যত বেশি শিক্ষার অঙ্গনে প্রবেশ করেছেন, ততই তাঁর সামনে নিজের পরিবার, পরিবেশ, বাবা-মায়ের শিক্ষার দৈন্যতা ধরা পড়েছে এবং তার ফলশ্রুতিতে রুচিগত ও সংস্কৃতিগত পার্থক্য ক্রমশ বেড়ে গেছে। কটুভাষী বাবা, সংস্কৃতিহীন মা, অসুস্থ পরিমণ্ডল শৈশবে যে অভাব তৈরি করেছিল সেটা তার মধ্যে একই সঙ্গে দৈন্যতা, ক্রোধ, ঈর্ষা, অপ্ৰাপ্তির যন্ত্রনাকে এক সমান্তরাল পথে চালিত করেছিল। এক ভঙ্গুর অথচ পিতা-পুত্রীর আত্মিক সম্পর্কের টানাপোড়েন সঠিকভাবে চিত্রিত হয়েছে 'আ ম্যান'স প্লেস' বইটিতে। এই বইটি প্রসঙ্গে নোবেল কমিটির ওয়েবসাইটে লেখা আছে, "this book was her literary breakthrough and in a scant hundred pages she produced a dispassionate portrait of her father and the entire social milieu that had fundamentally formed him." আর্নাক্স শিক্ষকতার পরীক্ষায় পাশ করার দু'মাসের মধ্যে তাঁর বাবা মারা যান। আর্নাক্স তাঁর এই উপন্যাস প্রসঙ্গে বলেছেন "a lived dimension of history, it is dispassionate about the life of a working class man of his time, a struggling grocer with minimal education." একই সঙ্গে একজন দায়িত্বশীল লেখক হিসেবে পাঠকদের এই উপন্যাস সম্বন্ধে সচেতন করার কথাও ভোলেননি। তাঁর সতর্কবাণী, "no lyrical reminiscenses, no triumphant displays of irony."

কয়েক বছর পর আর্নাক্স তাঁর মা-কে নিয়ে একটি উপন্যাস লিখলেন, নাম দিলেন, 'আ উওম্যান'স স্টোরি'। এই উপন্যাসে তিনি তাঁর মায়ের জীবনের অপ্রাপ্তি ও যন্ত্রণার কাহিনী চিত্রায়িত করেছেন। একজন শ্রমিক মহিলা সংসার চালানোর নিমিত্তে সারাজীবন শুধু পরিশ্রম করেই গেলেন, সুখ-শান্তি-আদর-সোহাগ কাকে বলে জানলেনই না, অতিরিক্ত পরিশ্রমে সময়ের অনেক আগে যৌবন হারিয়ে বৃদ্ধা হয়ে পড়লেন, আর শেষ জীবনে ডিমেনসিয়ায় আক্রান্ত হলেন। আর্নাক্সের উপন্যাসে সন্তানের চোখ দিয়ে এক মায়ের না পাওয়ার যন্ত্রনা শব্দহীন হাহাকার হয়ে ফুটে উঠেছে। প্রথম পর্যায়ে ছন্দহীন জীবন, যেখানে প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকার জন্য কঠোর-কঠিন পরিশ্রমই একমাত্র বিকল্প, সাংসারিক অশান্তি, দারিদ্র্য, দূষণীয় পরিবেশ ও সংস্কৃতি সঠিক এবং সম্যকভাবে প্রতীয়মান হয় এই উপন্যাসে এবং পরবর্তী পর্যায়ে ডিমেনসিয়া এবং মৃত্যুর পর্যায়ক্রমিক ছবি খুঁজে পাওয়া যায় তাঁর 'আই রিমেইন ইন ডার্কনেস' বইটিতে। মায়ের মৃত্যু আর্নাক্সের কাছে জীবন-মৃত্যুর সংজ্ঞাটাকেই এলোমেলো করে দিয়েছিল।

আর্নাক্সের লেখায় সমাজ এবং মানব ধর্মের বিবর্তন একটা বড় জায়গা নিয়েছে। তিনি বিশ্বাস করেন উপন্যাস লিখতে গেলে কোনও ঘরানা অনুসরণ করতে হয় না, প্রতিটি উপন্যাস তার চলন ও গমনের ধারায় নিজস্ব ধারা তৈরি করে নেয়। তাই অতি সহজেই তাঁর লেখায় জায়গা করে নেয় ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগত অনুভবগুলো। সেই কারণে পাঠককুল তাঁর লেখায় দেখতে পান অবাঞ্ছিত গর্ভসঞ্চার, প্রেম, ঈর্ষা, যন্ত্রনা, গর্ভপাত, মোহ, মোক্ষ, মাতৃত্ব, মাতৃত্ব সম্পর্কে দ্বিমত, প্রেম, প্রেম ও যৌনাচার নিয়ে বিতর্ক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য, ঔপনিবেশিকতা এবং রক্ষণশীলতার দ্বন্দ্ব ইত্যাদি। অ্যানি আর্নাক্স-এর লেখা বারংবার প্রশংসিত হয়েছে তাঁর দ্বর্থ্যহীন ভাষায় অকপট স্বীকারোক্তির জন্য। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ তাঁর বয়ঃসন্ধির অনভিপ্রেত গর্ভপাত যেটি বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত, 'হ্যাপেনিং ইন ফ্রান্স' বইটিতে। তখন তিনি রাওয়েন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। একই ঘটনা আবার বর্ণিত হয়েছে 'ক্লিনড আউট' এবং 'শ্যেম' গ্রন্থে। অ্যানি তাঁর লেখায় একইসাথে অযুত সাহস এবং তীব্র নির্লিপ্ততার সুচতুর সমাবেশ ঘটিয়েছেন। ভাষা তাঁর একেবারেই নিজস্ব। তবে সাহিত্য সৃষ্টির প্রথম থেকেই ফরাসি সাহিত্যে গুরুত্ব পেতে শুরু করলেও, ইংরেজি পড়া পাঠ্যজগতে পরিচিত হলেন 'দ্য ইয়ার্স' ২০১৯ সালে 'বুকার' প্রাইজের জন্য চুড়ান্ত পর্যায়ের জন্য নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে। ‘দ্য ইয়ার্স’ হল ১৯৪০ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত ফ্রান্সের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বিবর্তনের ইতিহাস। এখানে আর্নাক্স খুব দক্ষতার সাথে নিজের গল্পকে সমাজের পরতে পরতে বুনে গিয়েছেন। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ের সেই গল্পে রাজনীতি, সাহিত্য, গান, শিক্ষা, দূরদর্শন, বিবাহ, বিচ্ছেদ, বিজ্ঞাপন, স্লোগান সবকিছুই নিজ নিজ জায়গায় সোচ্চার হয়ে আছে। সাত দশকের এই ইতিহাসে ১৯৪০ সালে জন্ম থেকে শুরু করে, ১৯৬৮ সালের ছাত্রসংগ্রাম অভ্যুদ্যয়, প্রাথমিকভাবে আশা এবং পরবর্তীতে হতাশায় জর্জরিত প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কোয়েস মিটেরান্ড-এর আশি এবং নব্বই দশকের শাসনকাল, সবকিছুই অতি বিশ্বস্ততার সাথে চিত্রায়িত হয়েছে। বইটির আরেকটি বিশেষত্ব হচ্ছে গোটা কাহিনীতে আর্নাক্স নিজের কথা 'তৃতীয় পুরুষে' বলে গেছেন। এই বইটিকে ফরাসি সাহিত্যে, 'modern in search of lost time' হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয়, যুদ্ধ, মহামারী, দুর্ভিক্ষ, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, কঠোর জীবনসংগ্রাম একজন লেখককে যন্ত্রনা দেয় আবার তাঁকে লেখ্য উপাদান সরবরাহ করে পরিপূর্ণ হতে সাহায্য করে। আর্নাক্স ফরাসি সংস্কৃতি এবং সমাজের প্রেক্ষাপটে নারী এবং শ্রমিক শ্রেণীর মানুষজনদের দৈনন্দিন সংগ্রামের কথা একের পর এক উপন্যাসে লিখে গেছেন। তিনি সাহিত্যিক সিমোন দু বুভোয়, সমাজ বিজ্ঞানী পিয়েরে বোর্দিউ এবং ১৯৬৮ সালের মে মাসের সামাজিক অভ্যুদয়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। সেইসময় ফ্রান্সে কয়েক সপ্তাহ গোটা দেশ জুড়ে বিক্ষোভ, ধর্মঘট আর নাগরিক অস্থিরতা চলেছিল। সেই সবকিছু তাঁর বিভিন্ন লেখায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। নারী এবং সার্বিকভাবে পিছিয়ে পড়া সমাজের বাস্তব চরিত্রকে চিত্রায়িত করতে তাঁর গদ্যকে 'নিষ্ঠুর' এবং সময়ে সময়ে 'অশ্লীল' করতেও দ্বিরুক্তি করেননি।

অ্যানি আর্নাক্স দীর্ঘদিন ধরে ডায়েরি লিখে চলেছেন। তার মধ্যে কিছু ডায়েরি ব্যক্তিগত আর কিছু সামাজিক দলিল। তাঁর সাহিত্য সৃষ্টির আর এক শক্তিশালী মাধ্যম হল এই ডায়েরি। সেই ডায়েরি নিঃসৃত উল্লেখযোগ্য সৃষ্টিগুলি হল, 'আই রিমেইন ইন ডার্কনেস, 'গেটিং লস্ট', 'এক্সটেরিয়রস', 'থিংগস সিন', 'লুক অ্যাট দি প্রিটি লাইটস ডার্লিং' ইত্যাদি। 'দ্য আদার ডটার' শিরোনামে তিনি তাঁর জন্মের আগে মারা যাওয়া বোনের উদ্দেশ্যে একটা চিঠি লিখেছেন। এছাড়া ডায়েরির আরেকটি লেখা, 'হোয়্যার আই বিলঙ'-এ তিনি তাঁর নিজের সাথে জন্মস্থান নরম্যান্ডির সম্পর্কের রসায়নের সন্ধান চালিয়েছেন।

১৯৯২ সালে 'সিম্পল প্যাশন' বইটি প্রকাশ করে পাঠককুলের কাছে আর্নাক্স একইসাথে সমাদৃত এবং সমালোচিত হন। এই বইয়ে তিনি একজন ব্রিটিশ রাজনীতিকের সাথে তাঁর বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছেন। তাঁর এই বর্ণনায় রক্ষণশীল নারীসমাজ ক্ষিপ্ত হয়েছিল, তাঁদের মতে 'সিম্পল প্যাশন' হল এক বিপথগামী নারীর 'যৌন আকাঙ্খার অকপট চিত্রায়ণ।' এর মধ্যে তাঁরা বিন্দুমাত্র সাহিত্যকলা খুঁজে পাননি। কিন্তু আরেক শ্রেণীর পাঠকের কাছে আর্নাক্সের এই অকপট স্বীকারোক্তি উপন্যাস বিন্যাসের ধারণাটাকেই পাল্টে দিয়েছিল। আর্নাক্সের পরিবার ছিল ক্যাথলিক, আর্নাক্সই পরিবারের প্রথম প্রজন্ম যিনি উচ্চশিক্ষার্থে নরম্যান্ডির বাইরে পা রেখেছিলেন। শুধু পা রাখেননি, শিক্ষা তাঁকে রক্ষণশীলতার বেড়া ভাঙতে শিখিয়েছিল যেটি তাঁর লেখার ছত্রে ছত্রে প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর কাজগুলো ফ্রান্সের প্রথাগত ক্যাথলিক মূল্যবোধ থেকে অনেক দূরে, তাঁর বেশিরভাগ লেখা ধর্মনিরপেক্ষ এবং যৌন-মুক্ততার প্রামাণ্য দলিল। আর্নাক্সের যৌনতা নিয়ে কোনও পিউরিটান ছিল না, তাই তিনি শুদ্ধ স্বাভাবিক কণ্ঠে বলতে পেরেছেন, "sex had caught up with me, and I saw the thing growing inside me as stigma of social failure."

আর্নাক্স একটি নির্দিষ্ট ঘটনা জীবনের বিভিন্ন পর্যায় থেকে দেখতে চেয়েছেন। ২০০০ সালে প্রকাশিত 'হ্যাপেনিং' বইটিতে ১৯৬৩ সালে কলেজ ছাত্রী থাকাকালীন ঘটে যাওয়া গর্ভপাতের বিবরণ দিয়েছেন। একই ঘটনার কথা আমরা আবার দেখতে পাই 'ক্লিনড আউট' বইটিতে। 'সিম্পল প্যাশন' বইটিতে এক কূটনীতিকের সাথে তাঁর দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্কের যে ইতিকথা বর্ণিত হয়েছে, তার আভাস আবার মেলে 'গেটিং লস্ট' শিরোনামের ডায়েরিতে। এই ডায়েরি বার্লিন ওয়াল ভাঙার আগে-পরের একটা সামাজিক দলিল হিসেবে ফরাসি সাহিত্যে সমাদৃত হয়।

আর্নাক্স বলেছেন, "আমার জন্য নোবেল পুরস্কার হল লেখা চালিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা। এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও সমাজে নারীরা যে বৈষম্য এবং অপমানের মুখোমুখি হন তার বিরুদ্ধে লড়াই করার অস্ত্র আমার কলম।" তিনি আরও বলেন, "আমার অবস্থান থেকে একজন নারী হিসেবে কথা বলতে গেলে মনে হয় না যে, আমরা স্বাধীনতার মাপাঙ্কে পুরুষের সমান হয়েছি।"

তাঁর সৃষ্টি বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। 'আ উওম্যান'স স্টোরি', 'আ ম্যান'স প্লেস' এবং 'সিম্পল প্যাশন' বই তিনটি 'দ্য নিউইয়র্ক টাইমস নোটেবল বুকস'-এর সম্মাননা অর্জন করেছে, 'আ উওম্যান'স স্টোরি' 'লস এঞ্জেলস টাইমস বুক প্রাইজ'-এর চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে, 'শ্যেম' গ্রন্থটি ১৯৯৮ সালে 'পাবলিশার্স উইকলি বেস্ট বুক'-এর শিরোপা অর্জন করেছে। 'আই রিমেইন ইন ডার্কনেস' ওয়াশিংটন পোস্ট-এর 'আ টপ মেমোয়ার অফ ১৯৯৯'-এর শিরোপা পেয়েছে। অন্যদিকে 'দ্য ইয়ার্স' ২০০৮ সালে ‘মার্গেরিট ডুরাস প্রাইজ’, ২০০৯ সালে ‘টেলিগ্রাম রিডার্স প্রাইজ’ এবং ২০১৬ সালে 'স্ট্রেগা ইউরোপিয়ান প্রাইজ' অর্জন করে। ইংরেজিতে অনুবাদের পর 'দ্য ইয়ার্স' ২০১৯ সালে ‘ইন্টারন্যাশনাল বুকার প্রাইজ’-এর জন্য 'শর্ট লিস্টেড' হয়, আর তারপরই আর্না আর্নাক্সকে নিয়ে ইংল্যান্ড এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে চর্চা শুরু হয়। সেইসব চর্চার ফলশ্রুতিই এই নোবেল পুরস্কার জয়। আর্নাক্সের এই পুরস্কার জয়ে তাঁর দেশের বর্তমান প্রেসিডেন্ট এম্মানুয়েল ম্যাক্রোঁর প্রতিক্রিয়া, "Annie Ernaux was the voice of the freedom of women and of the forgotten."

সাহিত্য সৃষ্টির শুরুতেই আর্নাক্স বুঝতে পেরেছিলেন, এতদিন স্কুল-কলেজের পাঠ্য বইয়ে যা পড়ে এসেছেন এবং শিক্ষিকা হিসেবে যা পড়িয়েছেন কিংবা একজন সাহিত্য অনুরাগী হিসেবে যে সমস্ত গল্প উপন্যাস গোগ্রাসে গিলেছেন কোথাও সেভাবে তাঁর নিজের গল্পকে খুঁজে পাননি। ছোটবেলায় স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষিকারা অন্যান্য মেয়েদের দৈনন্দিন জীবনকাহিনী শুনতে আগ্রহী থাকলেও আর্নাক্স নিজের পরিবারের কথা বলতে শুরু করলে তাঁকে থামিয়ে দেওয়া হত। এই ঘটনাগুলোই পরবর্তীতে তাঁকে শ্রমজীবী, খেটে-খাওয়া মানুষের জীবনের টানাপোড়েন, অশান্তি, দাঙ্গা, মানবিক অবক্ষয়, প্রেম, হিংসা, প্রতিশোধ, যন্ত্রণা ইত্যাদি বিষয়গুলি নিয়ে লিখতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। তাঁর পূর্বসূরি মহিলা নোবেল বিজয়ীদের (টনি মরিসন, অ্যালিস মুনরো, পার্ল এস বাক) মত আর্নাক্সও তাঁর লেখায় তাদের প্রাধান্য দিয়েছেন যারা তথাকথিত সাহিত্য দুনিয়ায় দিনের পর দিন অনুচ্চারিত এবং ব্রাত্য থেকে গেছে। তাঁর লেখার জাদুতে তিনি পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করেছেন। বাধাবন্ধনহীন লেখার সারল্যই তাঁর প্রধান শক্তি। নিজের লেখা সম্বন্ধে বলতে গিয়ে লেখিকা বলেছেন, "the neutral way of writing comes to me naturally, it is the very same style when I wrote home telling my parents the latest news." অন্যদিকে বিখ্যাত সাহিত্যিক ও সমালোচক মার্গারেট ড্র্যাবার তাঁর লেখা সম্বন্ধে মন্তব্য করেছেন, “Ernaux has inherited de Beauvoir's role of chronicler to a generation. Now the great chronicler been justly rewarded with the greatest of literature prize."

সাহিত্যিক হিসেবে দীর্ঘ কঠিন পথ পেরোতে হয়েছে বিরাশি বছর বয়স্কা লেখিকাকে। সেই দীর্ঘ জীবনের দর্শনকে সোজাসাপ্টা ভাষায় তুলে ধরেছেন অজস্র গল্প-উপন্যাস-ডায়েরির পাতায় পাতায়। লেখার সঙ্গে কখনও কোনোভাবেই সমঝোতা করেননি। পরিবার, সংসার থেকে বেরিয়ে এসে সাহিত্য সৃষ্টিকেই ধ্যান-জ্ঞান-তর্পণ হিসেবে জ্ঞান করেছেন। তাঁর এই সম্মান ইউরোপ, আমেরিকা, ইংল্যান্ড ছাড়িয়ে তৃতীয় বিশ্বের পাঠকদের কাছেও তাঁকে পরিচিত করে দিল, এটাই সাহিত্য রসিকদের কাছে সবথেকে বড় পাওনা।