আরেক রকম ● দশম বর্ষ দ্বাবিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ নভেম্বর, ২০২২ ● ১-১৫ অগ্রহায়ণ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

সঞ্জয় উবাচ


লীলা প্রসঙ্গ

মহারাজ, আমি আপনাকে বিশ্বরূপ দর্শনের অঙ্গ হিসেবে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের সংবাদ শুনিয়েছি। সে প্রসঙ্গে একথাও বলেছি যে, সেই আক্রমণের ফলে আমাদের ধর্মরাষ্ট্রের এই অঙ্গরাজ্যে পর্যন্ত কী ফল ফলেছে। এই রাজ্যের ডাক্তারি পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের দুর্দশার কথা আপনার অবিদিত নেই। কাতারে কাতারে আমাদের যেসব হবু ডাক্তারেরা ইউক্রেনে গিয়েছিলেন তাঁদের এখানে পড়াশোনার ব্যবস্থা করা কি চাট্টিখানি কথা। তাঁরা নাকি ওখানকার নির্ধারিত পাঠক্রম শেষ না করেই আপৎকালীন পরিস্থিতিতে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাই তাঁদের পূর্ণ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব এখন এদেশকেই পালন করতে হবে। আমাদের নাগরিক, তাঁদের শিক্ষাদীক্ষার ভার এখন এদেশকেই পালন করতে হবে, বইকি। সেও না হয় একরকম করে বোঝা গেল। কিন্তু প্রশ্ন, কয়েক হাজার ছাত্রের শিক্ষার ভার কে বহন করবে। এমনিতেই আমাদের নিজেদের যেসব ডাক্তারি ছাত্রছাত্রী রয়েছে তাদের পড়াশোনার যা দশা তাতে আমাদের সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়।

কেন? আমাদের দেশের সব মানুষই কি ডাক্তার হবার জন্যে হন্যে হয়ে আছে নাকি? এরকম হলে একদিক থেকে দেশের পক্ষে তা বড়ো সুখবর সন্দেহ নেই, কিন্তু তাহলে অন্যান্য বিদ্যাচর্চার কী হবে?

মহারাজ, আপনি দেশের সর্বাঙ্গীণ কুশল চিন্তা করেন তাই আপনার মনে এইরকম দুশ্চিন্তা দেখা দিচ্ছে। কিন্তু দেশের মানুষ বিদ্যাচর্চার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত বলে এসব দুশ্চিন্তা তাদের মাথায় হানা দিচ্ছে তাও ঠিক না।

তাহলে ইউক্রেন ফেরত ডাক্তারি পড়ুয়ার ভবিষ্যতের সঙ্গে তাদের দুশ্চিন্তার কারণ কী?

কারণ খুব সহজ মহারাজ। আমাদের এই অঙ্গরাজ্যের প্রাথমিক শিক্ষার নিয়োগ বিপর্যয় নিয়ে আমি আপনাকে আগেই অবহিত করেছি। তার সঙ্গে এখন যদি দেখা যায় এরাজ্যে ডাক্তারি শিক্ষার হালও প্রাথমিক শিক্ষার অনুরূপ তাহলে মহারাজ, তাদের দুর্ভাবনা ওই প্রচলিত প্রবচনটিকে ঘিরে।

তুমি কোন প্রবচনের কথা বলছ সঞ্জয়?

কথায় বলেনা মহারাজ, চাচা, আগে আপন প্রাণ বাঁচা। এদের ভাবনা এখন আপন প্রাণ নিয়ে। আজকে যাঁরা ডাক্তারি পড়ুয়া, কাল তাঁরা কোনোরকমে জোড়াতালি দিয়ে পাশ করে ডাক্তারবাবু হয়ে দেশের মানুষের চিকিৎসা করবেন। তখন কী হবে। তাঁরা তো শল্যচিকিৎসাও করবেন। সেতো একেবারে ছুরি কাঁচি নিয়ে আক্ষরিক অর্থে মারমার কাটকাট ব্যাপার।

দেখ সঞ্জয়, কথাটা ভাবতে গেলে দুশ্চিন্তার কারণ আছে বইকি। এরা কবে ডাক্তার হবে, তখন কি আর আমরা থাকব, এসব বলে পাশ কাটালে তো চলবে না। সে তো যে-কোনো সমস্যার বেলাতেই আমরা বলতে পারি, এতো এখনি আমাদের গায়ে এসে পড়ছে না, এতে আমাদের কী।

এই তো মহারাজের উপযুক্ত কথা। এসব ভাবনা দেশের মানুষ অনেক সময় ভাবে নিজেদের গা বাঁচানোর জন্য। কিন্তু মহারাজকে সেরকম চোখ-ঠারা ভাবনা মানায় না। তাঁকে ইতিউতি বিচার করে পথ চলতে হয় এবং কথাও বলতে হয় সেভাবে। মনে রাখতে হবে ধর্মরাজ্যের সবটাই তাঁর হাতে ধৃত।

এ তুমি ঠিকই বলেছ সঞ্জয়। আর সেই কারণেই আমার সম্প্রতি অন্য ব্যাপার নিয়েও কিছু উদ্‌বেগ দেখা দিয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ আজ সাত মাস অতিক্রান্ত। গোড়ার দিকে যেমন মনে হয়েছিল পরাক্রান্ত রাশিয়ার কাছে সামান্য ওইটুকু ইউক্রেন আর কতদিন প্রতিরোধ চালাতে পারবে। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে ব্যাপার অত সহজে মেটবার নয়। একে তো আজকের আন্তর্জাতিক বিশ্বে দুনিয়ার কোনোকিছুই এক প্রান্তে নিশ্চিন্তে নির্বাসিত থাকে না। ঘন অরণ্যের ঠাস বুনোটের মতো সব কিছু সব কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে গিয়ে সৃষ্টি হয় এক অলৌকিক জটিলতার।

মহারাজ, আপনার মনের এই আধুনিকতার পরিচয় পেয়ে আজ আমি অকপটে আপনার কাছে নতজানু। আধুনিক বিশ্বের এই জট পাকানো চেহারাই যে আপনার উদ্‌বেগের কেন্দ্রেএ অতি যথার্থ প্রস্থান। আপনার বিবেচনার পক্ষে প্রাসঙ্গিক হতে পারে এই আশায় আমি আরোদু-একটা বিষয় আপনার গোচরে নিবেদন করতে চাই।

বলো, নিঃসংকোচে বলো সঞ্জয়। তুমি জান যে তোমার প্রতিবেদনকে আমি পরামর্শের মর্যাদায় গ্রহণ করে থাকি। তোমার ধীময় অনেক সময়ে আমার চিন্তার জট খুলতে সহায়ক হয়ে থাকে।

আমি মহারাজের কাছে চিরকৃতজ্ঞ। আমি বলব আসন্ন শীতকালের কথা। শীতার্ত ইউরোপের প্রকৃতি বিপর্যয়ের কথা মহারাজের অজানা নয়। নেপলিয়নের বাহিনীর দুর্দশার কাহিনি আজ লোককথার অঙ্গ। তা এই আসন্ন শীতে যুদ্ধের পরিস্থিতি কী হবে সে এক প্রশ্ন। তার সঙ্গে আছে পশ্চিমি শক্তির শক্তি সংকট। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমেত ন্যাটোর অন্তর্গত দেশসমূহের অনেকেই রাশিয়ার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। তার ফলে ইউরোপ শক্তি সঙ্কটে কাঁপছে। সদ্য নির্বাচিত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। তাঁর পূর্বসূরিকে বিদায় নিতে হয়েছে পঁয়তাল্লিশ দিনের মাথায়। তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের আয়ুষ্কাল কত তা নিয়ে দুষ্ট লোকেরা কেউ কেউ জল্পনা করছে, মহারাজ।

দুষ্ট লোকেদের কথা বাদ দাও। তাদের তো অভিসন্ধি থাকেই। রীতিমতো শান্ত শিষ্ট ভালো যারা, যারা আদৌ দুষ্ট নয় তারাওঅনেকে আয়ুষ্কাল নিয়ে অনিশ্চিত। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন যে ক্যারিবিয়ানের ছুটি কাটছাঁট করে দৌড়ে চলে এসেছিলেন নির্বাচনের আগে সে তো আর এমনি নয়। শিষ্ট লোকেরাও জানে তিনি অপেক্ষা করছেন অধীর আগ্রহে। কিন্তু এসব খুব বড়ো কথা নয়।

আমিও সেটাই বলতে চাই আপনাকে মহারাজ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বিশ্বমাত্রার দিকে আজ আমাদের নজর করতেই হবে। বুঝতে হবে তাই আজকের যুদ্ধের লীলাপ্রসঙ্গ। ২০২২-২৩-এর পৃথিবীর যে মন্দার কথা বিশেষজ্ঞরা ইতিমধ্যেই ঘোষণা শুরু করেছেন সেই প্রসঙ্গে ২০০৭-৮-এর বিশ্বমন্দার কথাও উঠে এসেছে। আর অর্থনৈতিক মন্দার কথায় বিশ-একুশ শতকের মানুষের মনে ১৯৩০-এর ভয়াবহ কথা মনে আসবেই। আমরা অনেকেই সে সময়ে হয়তো ছিলাম না। কিন্তু সে দুর্দিনের অভিঘাত এত ব্যাপক ছিল যে তার কথা বইয়ে পড়ে কিংবা লোকমুখে শুনে আমাদের অবস্থা হয়েছে ঘরপোড়া গোরুর মতো। সিঁদুরে মেঘ দেখলেই আমরা ভয়ে মরি। তারই মধ্যে সম্প্রতি বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের প্রতিবেদন বেরিয়েছে। সেখানে ভারতের স্থান দেখানো হয়েছে ১২১ টি দেশের মধ্যে ১০৭।

হ্যাঁ, এ প্রতিবেদনের কথা আমিও শুনেছি। কিন্তু আমি এও শুনেছি যে এই প্রতিবেদনের পদ্ধতিগত ত্রুটি নিয়ে নাকি ভারতের তরফে আপত্তি জানানো হয়েছে।

ঠিকই শুনেছেন, মহারাজ। তবে সে ত্রুটি যদি থেকে থাকেও তবে তা তো সব কটি দেশের বেলাতেই প্রযোজ্য। তাতে কি আর আপেক্ষিকের হেরফের খুব বেশি হবে। কী জানি।

শুধু আমার ধর্মরাজ্য নয়, আজ দেখছি গ্রহটির সংকট নিয়ে মাথা ঘামানো একান্ত জরুরি।

ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে বিশ্ব পরিবেশ, সবই আজ বিশ্বের উদ্বেগ। কোনো নিস্তার নেই মহারাজ। ইহকালের এই লীলা আজ যেন সবার মাথার উপরে ভেঙে পড়ছে।

সঞ্জয়, তোমার কথা শুনতে শুনতে আরো একটা ভয় আমাকে গ্রাস করছে। এমনিতেই আমি তোমাকে বলেছি আমার ধর্মরাজ্যের অনেক কিছুর নীতি নৈতিকতা নিয়ে আজ আমার মনে সংশয় দেখা দিয়েছে। তার সঙ্গে মিলিয়ে তোমার মন্দার পৃথিবীর আগাম আভাস আমাকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে।

আপনার ভয়ের কথা, যদি আপত্তি না থাকে, তাহলে আমাকে বলুন মহারাজ।

তুমি স্বয়ং ব্যাসদেবের দৈবাদিষ্ট, আমার কোনো কথাই তোমার কাছে অগোচর রাখা আমার পক্ষে বিধেয় নয়, আমি জানি। তবে কি জান সঞ্জয়, সেসব কথা মুখে উচ্চারণ করতেও ভয় হয়।

তাও আমি মিনতি করছি, আমার কৌতূহল নিবৃত্ত করুন মহারাজ।

দ্যাখ, ১৯৩০-এর পৃথিবীর দিকে ফিরে তাকাতে আমার সত্যিই ভয় হয়। আমি একটা কথা অনেক দিন থেকে নিজের মনের মধ্যে পুষে রেখেছি। খানিক ভয়ে আর খানিক বিতৃষ্ণায় আমি সে কথা আজ পর্যন্ত কারো কাছে প্রকাশ্যে উচ্চারণ করিনি। ১৯২২-এর পৃথিবীতে মুসোলিনির উত্থান। এ বছর তার শতবর্ষ চলছে। আর ১৯৩৩-এ হিটলার। তুমি লীলার কথা বলছিলে না সঞ্জয়। অর্থনৈতিক মন্দা আর ওই দুর্জয় ফাশিবাদের বিকাশ, এই সংযোগ আর দ্বিতীয় বারের জন্য যেন আমাদের দেখতে না হয়। এই আমার আতঙ্ক।

মহারাজ, কথাটা যখন তুললেনই তখন এ কথাও খেয়াল করতে হয় যে, মুসোলিনির উত্থানও এক মহাযুদ্ধের প্রলয়কালীন ঘূর্ণিপাকের মধ্যে থেকেই ঘটেছিল। বিশ্বযুদ্ধের রেশ তখনো ঠিক কাটেনি। আর দ্বিতীয় যুদ্ধ যে প্রথম যুদ্ধেরই সন্তান সে কথাও অনেকবার নানাভাবে উচ্চারিত হয়েছে। তাই যুদ্ধ, অনটন, বিপর্যস্ত দৈনন্দিনের জীবন আর কঠোর হাতের শাসনের ত্রাস, এসব যেন বেশ দিব্যি আঁটিবাঁধা একটা গুচ্ছ। এই যে ২০০৭-৮-এর মন্দার কথা হল একটু আগে আর আবার এবারের মন্দার শঙ্কা, এও যেন একেবারে পাঠ্য কেতাবের দিক নির্দেশ। মাঝখানের সময়ের বহর ঠিক তের-চোদ্দ বছর হল না মহারাজ।

তা হল বইকি। কিন্তু তাতে কি?

এই তো সেই ক্লাস ঘরের মধ্যমেয়াদি বাণিজ্য চক্র। যা নাকি বারো তের চোদ্দ বছর অন্তর ঘুরে ঘুরে আসে। পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনীতির এ নাকি এক দুরারোগ্য ব্যাধি। গত শতকের ষাটের দশকের একটা সময়ে ভাবা হচ্ছিল এসব সমস্যা নাকি দুনিয়া কাটিয়ে উঠেছে। তবে ভিয়েতনাম যুদ্ধের পরবর্তী পৃথিবী আরব-ইজরায়েল যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে যে সংকটের মধ্যে ঢুকেছে তার আর নিরাময় নেই। এক ধাক্কা থেকে আর এক ধাক্কায় মাথা ঠুকে ঠুকে চলেছে মনে হয়।


[সৌরীন ভট্টাচার্য]