আরেক রকম ● দশম বর্ষ একবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ নভেম্বর, ২০২২ ● ১৬-৩০ কার্তিক, ১৪২৯

প্রবন্ধ

‘বিদ্রোহ আর চুমুর দিব্যি’: বাংলা গানে প্রেম ও চুম্বন

প্রবুদ্ধ বাগচী


বড়ু চন্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এর বড়াই-এর মুখে রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার যে গ্রাম্য ও আদিরসাত্মক বর্ণনার কথা পণ্ডিতেরা পুঁথি হিসেবে বাঁকুড়া থেকে উদ্ধার করেছিলেন, প্রাথমিকভাবে সেগুলোকে ঠিক সাহিত্যপদবাচ্য বলতে তাঁদের কিছু আপত্তি ছিল। কারণটা স্বাভাবিক। যে সময়কালে ওইসব সাহিত্য সমালোচক ও গবেষকরা ওই সাহিত্য দৃষ্টান্তটা বিচার করতে বসেছিলেন ততদিনে ‘প্রেম’ বিষয়টা সম্বন্ধে তাঁদের একটা ধারণা বা পারসেপশন তৈরি হয়ে গিয়েছে যার মধ্যে যুক্ত ছিল একটা নান্দনিক মাত্রা। ফলে মূলত মধ্যযুগের গ্রাম জীবনের যে লোকায়ত প্রেম-কাহিনি বড়াই বুড়ির বয়ানে লোকের মুখে মুখে ফিরত তার মধ্যে আদিরস, শারীরিক ঘনিষ্ঠতার রসালো বর্ণনা অবধারিতভাবেই গ্রামীন সংস্কৃতির অশীলিত আধারে পরিবেশিত হত। ওই পুঁথিতে রাধার শরীরের স্তন, উরু বা নিতম্বের যেসব বর্ণনা আছে তা আজ আমাদের চোখে পড়লে বেশ অস্বস্তিকর মনে হবে। বড়ু চন্ডীদাস সেগুলোকেই একজায়গায় গ্রন্থিত করেছিলেন। এমনকি বড়ু চন্ডীদাস একজন ছিলেন নাকি একাধিক ব্যক্তি ওই একই নামে গ্রাম্য কাহিনির সম্মেলন করেছিলেন তা নিয়েও কিছু গবেষকদের কিছু সংশয় আছে। এই সংকলনের মধ্যে নান্দনিকতার প্রশ্ন গৌণ ছিল, থাকাটাই স্বাভাবিক। একইভাবে যদিও কবি জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দম’ বাংলায় লেখা নয় তবু সেখানেও কামোন্মত্ত কৃষ্ণ রাধার স্তনযুগল মর্দন করছেন এই বর্ণনা আছে - পরিশীলিত সমাজ চেতনা এটাকে ঠিক প্রেমের প্রকাশ বলে সহজে মেনে নিতে রাজি হবেন বলে মনে হয় না। যদিও কাব্য হিসেবে ‘গীতগোবিন্দ’কে উচ্চস্তরে বসাতে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। ঠিক যেমন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের ছাত্র ছাত্রীদের বড়ু চন্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’কে আদি মধ্যযুগের সাহিত্যের অন্যতম উপাদান হিসেবে মেনে নিতে হয়। ইতিহাস মানতে গেলে তো কোনো কিছুকে বাতিল করা সম্ভব নয়। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ মূলত গান ও তা রাগ রাগিনীর আধারেই গীত হত। বাংলার সাহিত্য একটা সময় অবধি তো কাব্য আর গানের যুগল সম্মিলনেই বহমান থেকেছে, শতকের পর শতক।

কিন্তু বৈষ্ণব পদসাহিত্যে রাধাকৃষ্ণের প্রেমকে এক স্বর্গীয় মহিমায় ও নান্দনিকতার নিরিখে যেভাবে স্থাপনা করা হল তাতে প্রেম পেয়ে গেল একটা আধুনিকতার মাত্রা। যা শুধুমাত্র দৈহিক আবেদনের উষ্ণতা নয় তাঁর মধ্যে তৈরি হল একটা সেরিব্রাল ও নান্দনিক বোধ - রবীন্দ্রনাথে এসে যার উচ্চারণ দাঁড়াবে ‘‘প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস/ তোমার চোখে দেখেছিলেম আমার সর্বনাশ’’। বিদ্যাপতি, চন্ডীদাসের মতন খ্যাত পদকর্তাদের লেখায় এই দেহাতীত ভালবাসার ছবি ধরা পড়ে, যার মধ্যে মিশে যায় রাধা-কৃষ্ণের প্রেমকে ভক্ত ও দেবতার প্রেমের মতো করে ইন্টারপ্রিটেশনের একটা স্পষ্ট বার্তা। ভরা ভাদ্র মাসে বৃষ্টি মুখর রাত্রে রাধা পা টিপে টিপে অভিসারে চলেছেন কৃষ্ণ-সমীপে এই বর্ণনায় প্রেমের দেহগত আর্তি ঠিক ততটা নেই যতটা আছে একটা মানসিক আশ্লেষের ছবি। ‘কামগন্ধহীন’ এই প্রেমকে আধ্যাত্মিকতার আলোয় অলঙ্কৃত করাই ছিল বৈষ্ণব পদকর্তাদের মূল বিবেচ্য। সন্দেহ নেই, বাংলার ঐতিহ্যগত পদাবলী কীর্তনে এই পদগুলিই গান হিসেবে গীত হয়ে এসেছে কাল থেকে কালান্তরে। মধ্যযুগের বাংলায় মূল সংস্কৃতিটাই ছিল গ্রামীন, গ্রামের মানুষ আসরে পালা কীর্তন শুনতে গেছেন কোনও কেচ্ছা রসের আবেদনে নয়, বিশুদ্ধ ভক্তি ও দৈব প্রেমরসের অতিমানবিক আখ্যানের খোঁজে। সেদিক দিয়ে ভাবলে বাংলার গানে প্রেমের পদসঞ্চার ঘটেছে বৈষ্ণব সাহিত্যের হাত ধরেই।

এর পাশাপাশি মধ্যযুগে কিছু ইসলামী কবিও পদাবলি সাহিত্যের পাশাপাশি কিছু প্রেমকাব্যও রচনা করেছেন। সৈয়দ আলাওলের ‘পদুমাবতী’ বা লায়লা মজনুর প্রেম উপাখ্যান গীতিকা হিসেবে বাংলার (মূলত পুব বাংলায়) গীত হত। এক শ্রেণির শ্রোতা নিশ্চয়ই সেগুলি আগ্রহভরে শুনতেন। স্বভাবগতভাবে ইসলাম ধর্ম কিছুটা রক্ষণশীল, শারীরিকতার প্রতি তাঁদের প্রত্যক্ষ উদাসীনতা ধর্মীয় লক্ষন বলে তাঁদের আরাধ্যের কোনও প্রতিমা বা পট তারা অনুমোদন করেন না। তাঁদের প্রেম কাব্যেও এই দর্শনের ছাপ আছে যার প্রভাব পড়েছে ওইসব আখ্যান নির্ভর প্রাচীন বাংলার গানে।

সহজিয়া বৈষ্ণব সাধনার যে গৌণ স্রোত বাংলার গ্রামীন সংস্কৃতির প্রান্তীয় ধারা হিসেবে আবিষ্কৃত হয়েছে অনেক পরে সেখানে প্রেমের সঙ্গে দেহের যোগ অস্বীকার করা হয়নি ঠিকই কিন্তু বাংলা দেহতত্ত্বের গানে শারীরিক সাধনার দিক থেকে প্রেমের দিকে চলনের একটা নির্দিষ্ট দর্শন আছে। সেইসব গানের বাইরের চেহারা আর ভিতরের বার্তাকে মিলিয়ে নিয়ে দেখলে বোঝা যাবে সরাসরি নর নারীর প্রেমের শারীরিক রূপটাকে অস্বীকার না করে তারা তাঁরই মধ্যে একটা দেহাতীত প্রেমের দর্শন স্থাপন করেছেন। প্রচলিত বৈষ্ণবদের ধারণায় যেখানে অদ্বৈত মানে রাধা-কৃষ্ণের যুগল মিলন (মানসিক অর্থে), সহজিয়াদের কাছে সঙ্গমরত নারী পুরুষের রূপই হল অদ্বৈত। কিন্তু এটাকে যৌনতার সাধারণ চোখ দিয়ে তাঁরা দেখেন না, তাঁরা বলেন, ‘ঊর্ধরেত’ মানে সঙ্গম ও সংযম যার গূঢ়ার্থ হল দেহ থেকে দেহাতীতে যাওয়া। এইসব তাত্ত্বিকতার সপক্ষে গানও আছে প্রতিটি সহজিয়া গোষ্ঠীর। এটাকেও বাংলার গানের ধারায় আমাদের অন্তর্গত করা উচিত বলে আমার বিশ্বাস।

।। ২ ।।

ইউরোপীয় রেনেসাঁসের আগেই কিন্তু বাংলার গানে প্রেমের এইরকম একটা দেহাতীত ধরণ তৈরি হয়েছে এটা খেয়াল করা দরকার। অনেকে মনে করেন, ইংরিজি সাহিত্যের সম্রাট সেক্সপিয়ারের রচনাগুলি আদৌ মৌলিক নয়। সমকালীন নানা প্রেম, অসূয়া, হিংসা, বিদ্বেষের গ্রামীন আখ্যানগুলিকে ভিত্তি করে সেক্সপিয়ার তাঁর প্রতিভার ছোঁয়ায় উৎকৃষ্ট সাহিত্যে পরিণত করেছেন। ধারণাটা একদম অলীক, এটা গবেষকরাও অস্বীকার করতে পারেননি। এর পরেই ইউরোপীয় রেনেসাঁ সাধারণভাবে নরনারীর প্রেমকে সরাসরি শরীরের আওতা থেকে বার করে এনে অন্যরকম একটা অনুভূতিদেশের আলোয় এনে ফেলেন। ভালবাসার সঞ্চার, তার বিকাশ, পরিণতি এবং পাশাপাশি না পাওয়ার বেদনা, বিরহ এগুলো প্রেমের ধারণায় নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত হল। বৈষ্ণব সাহিত্যেও প্রেমের অনেক ধরনের স্তরের কথা আমরা পেয়েছিলাম এবং প্রতিটির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে পদ রচনাও হয়েছিল। কিন্তু বিজ্ঞানের জগতে ফ্রয়েডিয়ান মনস্তত্ব যখন যৌন শারীরবিদ্যার ক্ষেত্রে ‘ফোর প্লে’ থেকে ‘কপুলেশন’ হয়ে ‘অর্গাজম’-এর বৃত্তের কথা ব্যাখ্যা করে ফেলেছে তখনও সেগুলোর সঙ্গে কাব্যের ক্ষেত্রে এই বহুস্তরীয় প্রেমের সম্প্রসারকে আমাদের সরাসরি যুক্ত করার কথা না ভাবাটাই সংগত। বিশেষত প্রেমের যে সেরিব্রাল দিক (ফ্রয়েড অবশ্য এটাকেও বিজ্ঞানের ব্যাখ্যায় ধরে ফেলেছিলেন) সেটা মূলত নান্দনিকতার দিক, তার বিচার কাব্যমূল্যেই হওয়া বাঞ্ছনীয়।

বিশেষ করে ইউরোপীয় রেনেসাঁসের দর্শনে প্রেম অর্থে যে একটা মানসিক অনুভূতি, যাকে ঠিক জোর করে চাষের জমির মতো অধিগ্রহণ করা যায় না - বরং একজন পুরুষ অন্য এক নারীর প্রতি (বা বিপরীতে) একটা মানসিক স্বতঃস্ফূর্ত আশ্লেষ বোধ করছেন, যা না পেলে তাঁদের মধ্যে জেগে উঠছে বিষণ্ণতা, না-পাওয়ার বেদনা - এই দিকটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখা দরকার, আমাদের বহুল চর্চিত পুরাণ বা মহাকাব্যে প্রেমের এই মানসিক সঞ্চার ও সেরিব্রাল দিকটার কোনও অস্তিত্ব নেই। বরং নারীকে ভোগ ও দখল করার সামগ্রী হিসেবে বিবেচনা করেই সেখানে রাজ্য বিজয়ের সঙ্গে পরাজিত রাজার মহিষীকে দখল করে নেওয়া ছিল বীরত্বের সূচক ও বিজয়স্মারক। রাম ও সীতাকে আদর্শ দাম্পত্যের প্রতীক বলে প্রচার করা হলেও, আজকে আমরা দাম্পত্য প্রেম বলতে সচরাচর যেটা বুঝি তা আদৌ তাঁদের ভিতর ছিল কিনা সেটা নতুন গবেষণার বিষয় হতে পারে, নতুবা অগ্নিপরীক্ষার আখ্যানটুকু রামায়নে লেখা হত না। দ্রৌপদী অর্জুনকে যে অর্থে ভালবেসেছিলেন - অর্জুন, মহাকাব্যের মহানায়ক অর্জুন তার কণামাত্রও প্রতিদান দেননি। আর রাজসভার পাশা খেলায় ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির যখন দ্রৌপদীকে বাজি রেখেছিলেন তখন তার প্রগাঢ় ধর্মজ্ঞান তাঁকে একটুও শিক্ষা দেয়নি যে নারী কোনও বাজি রাখার পণ্য হতে পারে না। পিতামহ ভীষ্ম বলেছিলেন, ধর্মের গতি অতি সূক্ষ্ম! হবেও বা। আমাদের পুরাণেও দেবদেবীর এমন সব আখ্যান, মুনি-ঋষিদের এমন সব কামার্ত চেহারা আমরা পাই যেখানে সুন্দরী দেবীকে দেখে ধ্যানমগ্ন মুনির ধ্যানভঙ্গ হয়ে যায়, এমনকি কামনার আকস্মিক তাড়নায় বীর্যপাত অবধি ঘটে যেতে দেখি আমরা; মহাভারতের কাহিনির সূত্রপাত নৌকার ভিতর এক মৎস্যগন্ধা নারীর সঙ্গে কামার্ত রাজার প্রেমহীন যৌনমিলন, যেখানে বিধিনিষেধের কোনো তোয়াক্কাই নেই। এগুলি কি প্রেমের অভিজ্ঞান হতে পারে? ইউরোপের মহাকাব্যগুলিতেও নারীকে দখল করার অভিপ্রায়ে নানা যুদ্ধ বিগ্রহের উপাখ্যান তাঁদের অনিবার্য অঙ্গ যেখানে প্রেমের কোনও স্পর্শ নেই। কিন্তু প্রেমের সংজ্ঞা সত্যি অন্যরকম, ইউরোপীয় রেনেসাঁ এই কথা আমাদের শিখিয়েছে। যদিও তথাকথিত গৌরবান্বিত ও মহিমান্বিত সনাতন হিন্দুধর্মের বিবাহ অনুষ্ঠানে ‘কন্যা সম্প্রদান’-এর মতো একটি কুৎসিত ও কদর্য প্রথা আজও বহাল তবিয়তে চালু আছে যা সম্ভবত বিবাহ বিষয়টার সঙ্গে নারীকে ভোগ দখলের আর পাঁচটা সামগ্রী হিসেবে দেখার ‘প্রাচীন’ দর্শনের অসহ্য এক হ্যাংওভার, যাকে আরেকটু খারাপ ভাষায় ‘খোঁয়াড়ি’ বললেই ভাল হয়।

উনিশ শতকের বাংলায় যখন ইউরোপীয় নবজাগরণের ছোঁয়াচ লাগে তখন তার মধ্যে প্রেমের এই নতুনতর ব্যঞ্জনাও ঢুকে পড়ে তার সাহিত্যে ও গানে। বিশেষ করে এর আগে গান মানেই ছিল আধ্যাত্মিক - ধর্মাশ্রয়ী গানে যেখানে ঈশ্বর ও তার ভক্তের প্রেমের আকুলতা অথবা মঙ্গলকাব্যগুলিতে বিশেষ কোনও দেবদেবীর মাহাত্ম্য প্রচারের প্রয়াস (যার মধ্যে ক্ষমতার রক্তচোখ বিরল নয়) সেখানে বেড়া ভাঙা আধুনিকতার ছোঁয়াচ লেগে ব্যক্তির নিজস্ব প্রেমানুভূতির সুতীব্র প্রকাশ হয়ে উঠল এক ব্যতিক্রমী ঘটনা। যে বাংলা গানকে বলা হল কাব্যসংগীত। রামনিধি গুপ্ত (নিধুবাবু) যে টপ্পা গানের প্রচলন করেন তার আঙ্গিকটা বিহারের ছাপড়া অঞ্চল থেকে আনলেও বিষয়গত ভাবে সেখানে ব্যক্তি জীবনের প্রেমের প্রকাশই মুখ্য। এর আগে কবিগানের যে ধারা বাংলাদেশে ছিল তার মূল উপজীব্যই ছিল পদাবলী, নানা রাগ সংগীত ও দেশজ সুর মিশিয়ে একটা আধুনিক ধারা তৈরি করা। তার মধ্যে অনেকটা সমকালীন ছোঁয়াচ আছে যেটা প্রেমের ধারণার সঙ্গেও মিলে যায়। আখড়াই গান ভেঙে হাফ আখড়াই গান তৈরি করেন নিধুবাবুর শিষ্য মোহন চাঁদ বসু যাতে ব্যক্তি-প্রেমের আধুনিক প্রকাশ ধরা পড়ে। কীর্তন গান ছিল প্রধানত বৈষ্ণব পদাবলী নির্ভর আখ্যানের গীতিরূপ, তার থেকে পরিবর্তিত হয়ে যে 'ঢপ-কীর্তন' তাও ছিল একরকমের আধুনিক প্রেমের উচ্চারণে ভরপুর। ঢপ কীর্তনের প্রধান কারিগর মধূসূদন কিন্নরের একটি গানের অংশঃ

দ্বারী, কী দিব আর দান, প্রাণ দান দিয়েছি
সে দান ফিরায়ে নিতে হেথা এসেছি
মোদের দান ধ্যান পুরশ্চরণ, সকলই শ্রীরাধার চরণ
তাই ভেবে দাঁড়ায়ে সূদন যদি চরণ পায়।।

খেয়াল করলে দেখা যাবে পুরানো পদাবলী কীর্তনের থেকে এই গানের বক্তব্যে সমকালের আঁচ অনেক প্রত্যক্ষ। ঢপ-কীর্তন থেকে রবীন্দ্রনাথও তার কিছু গানের উপাদান গ্রহণ করেছিলেন। কবিয়ালদের মধ্যে অনেকের নাম ঐতিহাসিক ভাবেই জড়িয়ে গেছে, অ্যান্টনি কবিয়ালের নামে চলচ্চিত্র তার সূত্রে ভোলা ময়রা বা হরু ঠাকুরের নাম আমরা সকলেই জানি। এমনকি সেই সময় যখন মহিলাদের শিক্ষার ও সমাজের মূল সংস্কৃতিতে অংশগ্রহণের কোনও অধিকারই ছিল না সেই সময় কিছু মহিলা কবিয়ালের খবরও পাওয়া যায় যাদের মধ্যে আছেন যজ্ঞেশ্বরী মোহিনী দাসী, শশিমুখী প্রমুখ। কবিগানেও যে অন্যতর প্রেম ভাবনার প্রকাশ ঘটেছে তার একটা যোগ্য দৃষ্টান্ত হতে পারে হরু ঠাকুরের একটি গানেঃ

নাম প্রেম তার, সাকার নহে, বস্তুটি সে নিরাকার
জীবন যৌবন ধন কিংবা মন প্রাণ বশীভূত তার।
সুখে লোক বলয়ে পিরিতি সুখের সার;
প্রাণের বাহিরও হয় সে যখন জীবনে যেন মরে রই।

হরু ঠাকুরের আরেকটি গানে পাওয়া যাচ্ছেঃ

প্রেম কি যাচলে মিলে, খুজিলে মিলে?
সে আপনি উদয় হয় শুভযোগ পেলে।

এই উচ্চারণ কিন্তু আধুনিক প্রেমের দর্শনের সঙ্গে আশ্চর্যভাবে মিলে যায়, মনে পড়ে যায় রবীন্দ্রনাথের একটি গানের কথা ‘প্রেম এসেছিল নিঃশব্দ চরণে তাই স্বপ্ন মনে হল তারে’। কবিগানের ধারায় দাশরথি রায়, রাম বসু এরাও প্রচুর গান লিখেছেন যাদের মধ্যে ছড়িয়ে আছে নব্য শিক্ষিত চিন্তাধারার ভিন্ন গোত্রের এক প্রেমের বর্ণপরিচয়, যার সবটুকু এখানে বলার অবকাশ নেই।

।। ৩ ।।

ব্যক্তিপ্রেমের রোম্যান্স ও নবদীক্ষিত বাংলার মধ্যশ্রেণির সামনে প্রেমের বিচিত্র আলো আঁধারি, বিরহের প্রলম্বিত ছায়া, বেদনার আর্তি সব কিছু ফুটিয়ে তোলার জন্য দরকার ছিল একজন সুযোগ্য গানের কারিগর। সেই ভগীরথের কাজটি করলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। ভালবাসার যে বিচিত্র আলো ও অন্ধকার তার গানে যেভাবে ধরা পড়েছে সম্ভবত তার তুলনীয় দৃষ্টান্ত বাংলা গানে কেন গোটা পৃথিবীর কোনও কম্পোজারের গানে নেই। তার জীবিতকালে যে গানের সংকলন ‘গীতবিতান’ প্রকাশ পেয়েছিল তাতে তিনি নিজেই ‘প্রেম’ শিরোনামের একটি পর্যায় সংকলন করেছেন। এই নির্বাচনের মধ্যে ‘পূজা’ পর্যায়ের ভাবগত ঐশ্বর্য কোথাও সমাপতিত হয়েছে কিনা সেটা স্বতন্ত্র আলোচনার বিষয় হতে পারে, কিন্তু গীতিকার স্বয়ং যখন তার কিছু গানকে নির্দিষ্টভাবে প্রেমের গান বলেন তখন তা সন্দেহাতীত ভাবে বাংলা গানের স্থায়ী সম্পদ হয়ে ওঠে। এবং সেই প্রেম মূলত সেরিব্রাল প্রেম যা উনিশ শতকের আধুনিকতার সন্তান। যদিও রবীন্দ্রনাথের প্রেমের গানের তাপ ও চরিত্র এতটাই অনন্য যে তা পরের প্রজন্মকে অনেকদিন পর্যন্ত প্রভাবিত করেছে যার তালিকা করতে গেলে শেষ হবে না। প্রেমের অনুষঙ্গ হিসেবে ‘বাঁধিনু যে রাখি পরানে তোমার’ বা ‘তোমার মুখের কথা আমার নাম দিয়ে দাও ধুয়ে’ এইরকম উচ্চারণ প্রেমকে যে স্বপ্নিল তলে স্থাপন করে তার তুলনা আজ এতবছর পেরিয়েও বিরল।

প্রেমের গানের মধ্যে উচ্ছলতা নজরুলের গানের মূল ধরতাই, আবেগের চাপও বেশি। ‘চাঁদ হেরিছে চাঁদ মুখ তার সরসীর আরশিতে’ এইরকম উচ্চারণের পাশাপাশি প্রেমের উল্টো পথে বিরহের আকুলতাও জনপ্রিয়তা পেয়েছে কাজী সাহেবের গানে - ‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাব তবু আমারে দেব না ভুলিতে’ বা ‘যেদিন লব বিদায় ধরা ছাড়ি দিয়ে’ এইসব গান মানুষের মন স্পর্শ করেছে, ব্যবহৃত হয়েছে চলচ্চিত্রে। নজরুল-পর্বের কিছু আগে রবীন্দ্রনাথের সমকালে অতুলপ্রসাদ সেনের গানেও বিরহের ছবি খুব আলঙ্কারিক অর্থে ধরা পড়েছে। তাঁর বহু খ্যাত গান ‘বঁধুয়া, নিদ নাহি আঁখি পাতে’ শেষ পর্যন্ত দুই প্রেমার্ত অথচ শারীরিকভাবে বিচ্ছিন্ন মানবসত্ত্বার ব্যথার বর্ণমালা বলেই চিনে নেওয়া যায়। তথ্য বলে সত্যিই তো দাম্পত্য সম্পর্কে ফাটল ধরা সেন দম্পতি তখন লখনঊ শহরের দুই প্রান্তে বাস করতেন, অথচ ব্যক্তির সম্পর্কের উত্তাপ থাকলেও এই গান সকলের। সেদিক দিয়ে বহুমুখী প্রতিভা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গানেও আছে প্রেম বিরহের আলো আধারি। তাঁর খুব চেনা গানে একদিকে যেমন সারা সকালটি ধরে প্রণয়ীর জন্য মালা গাঁথার উচ্চারণ, অন্যদিকে আর্ত আক্ষেপঃ ‘কেন মোর গানের ভেলায়/এলে না প্রভাত বেলায়/ হলে না সুখের সাথী/ জীবনের প্রথম দোলায়’।

কাজী নজরুলের পর বাংলা গানের যে তথাকথিত আধুনিক পর্ব সেখানে প্রেম ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়াল বড় এক বগগা। রোম্যান্টিক প্রেম, আঁতুড় বিরহ এবং তার অনুষঙ্গে চাঁদ ফুল তারা সমাধি এইসবের সপ্রশস্ত পুনরুচ্চারণই নির্মাণ করল বাংলা গানের একমাত্র ভুবন - একমাত্রিক সেই জীবনে আর কোনও অনুভূতির স্পন্দমান কল্লোল নেই, নেই জীবন নামক কোনও বৃহত্তর সীমানার ব্যঞ্জনা। বিষয় হিসেবে এইরকম একটা নির্বিকল্পে ঘুরপাক খেলে স্বাভাবিকভাবে তাতে গুণগত অপুষ্টির ছোঁয়া লাগে, তৈরি হয় একঘেয়েমির ক্লিশে। অথচ প্রেম শব্দটার যে অন্য আরও নানা মাত্রা থাকতে পারে এটা ওই তথাকথিত স্বর্ণ যুগের গীতিকাররা বোঝেননি।

প্রায় সমকালে প্রাক স্বাধীনতা আমলে প্রচুর দেশপ্রেমের গান লেখা হয়েছিল সেগুলি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে গীত হত, কিন্তু এই প্রেমটাও যে একটা ভালবাসার প্রকাশ হতে পারে এমনটা আধুনিক বাংলা গানের কথাকাররা ভেবেই উঠতে পারেননি। দু'য়েকটা ব্যতিক্রমী গান যে ছিল না তা নয়। ‘পৃথিবী আমারে চায়/ রেখোনা বেঁধে আমায়’ এমনই এক ব্যতিক্রম যার গীতিকার ছিলেন মোহিনী চৌধুরী - যেখানে প্রিয়ার বাহুডোর ছেড়ে বৃহত্তর জীবনে ফিরে যাওয়ার ডাক। এও কি একরকম প্রেম নয়? এমনকি পরের দিকে গণসংগীত বিষয়টাকেও প্রেমের গানের সম্প্রসারিত সংজ্ঞায় ধরা যাবে না কেন? সামাজিক ও আর্থিক শ্রেণি বৈষম্যের পটভূমিতে সাম্যবাদের আকাঙ্ক্ষা ও ভাবাদর্শের মধ্যে মানবপ্রেমের ইশারা একদম অস্বীকার করা যায় কি? যদিও এই ভাবাদর্শের একটা স্পষ্ট রাজনৈতিক সীমারেখা আছে সাধারণভাবে প্রেমের গান বলতে যে আমি-তুমির কম্বিনেশন আমরা বুঝি গণসংগীতে নিশ্চিত ভাবেই তা নেই। তবু বাংলা গানের ধারায় গণসংগীত একটা স্বীকৃত শাখা এবং তার মধ্যে অন্যরকম প্রেমের ফলন আছে বলে আমার বিশ্বাস। ওই সময়কালে কিংবদন্তী হয়ে ওঠা ‘রানার’ গানটির কথা ভাবলে দেখা যায়, ‘ঘরে তার প্রিয়া একা শয্যায় বিনিদ্র রাত জাগে’ লাইনের মধ্যে কেমন নিবিড়ভাবে বুনে দেওয়া হল রাত্রের একলা পথের পথিক ওই রানারের সাধারণ দাম্পত্যের সঙ্গে পেশাগত জীবনের সংগ্রামের একটা নিটোল বিরোধাভাস! ‘গাঁয়ের বধূ’ র আশা স্বপনের সমাধি ঘটে মহামারী দুর্ভিক্ষের করাল ছায়ায় - খুব সংকীর্ণ অর্থে নিশ্চয়ই এগুলো প্রেমের গান নয়, কিন্তু এর মধ্যে সাধারণ মানুষের শমিত জীবনের ভেঙে পড়ার আভাস আছে, সেই সাধারণ জীবন শুধুই সংগ্রামের নয়; প্রতিদিনের ভালবাসার, শান্ত দাম্পত্যের, সুস্থ জীবনের দাবিতে ঘুঘু ডাকা গ্রামের জলাশয়ের মতোই সুনিবিড় ও গভীর।

তবু লক্ষণীয় এই যে বাংলা গানে প্রেমের ওই একমাত্রিক চেহারাটাই চ্যাম্পিয়ন হয়ে এসেছে বহুকাল ধরে। সচরাচর প্রেমের গান বলতে আমাদের স্মৃতিতে ঘুরে ফিরে আসবেঃ ‘আমি এত যে তোমায় ভালবেসেছি’ বা ‘এই বালুকা বেলায় আমি লিখেছিনু/ একটি সে নাম আমি লিখেছিনু’ অথবা ‘কে প্রথম কাছে এসেছি? কে প্রথম ভালবেসেছি? তুমি না আমি?’ - যার প্রতিটিই একক ব্যক্তির রোম্যান্টিক ভালবাসার দ্যোতক। বাংলা গানের অভিধানে এইগুলোই ‘প্রেমের গান’। কিন্তু প্রেম মানে কি শুধু এই একরকম?

পুত্র বা কন্যার প্রতি বাবা-মায়ের যে ভালবাসা তা কি প্রেম নয়? বৃদ্ধ মা-বাবার প্রতি ছেলে-মেয়ের যে একরকম উদ্বেগময় ভালবাসা থাকে প্রেমের অভিধানে তা কি পরিত্যাজ্য? অথবা শুধু যুবক-যুবতী কেন প্রৌঢ়-প্রৌঢ়ার নিঃসঙ্গ দাম্পত্যের মধ্যে যে ভিন্ন চরিত্রের প্রেম ও আশ্রয় থাকে তাকে কি প্রেম বলা যাবে না? নব্বই দশকের গোড়ার দিকে বাংলা গানের যে নতুন ধারা সুমন চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে প্রাগ্রসর হয় তার সবথেকে উল্লেখযোগ্য দিক হল, ভালবাসার এই মাত্রাগুলো বাংলার গানের সংকীর্ণ মঞ্চে সাজিয়ে ধরে তাকে সম্পন্নতর করা। ‘তুই হেসে উঠলেই সূর্য লজ্জা পায়’ একেবারে আত্মজাকে নিয়ে লেখা সুমনের এই গান অথবা ‘গান তুমি হও’ গানের মধ্যে মিশে থাকা এই পঙক্তিঃ ‘গান তুমি হও আমার মেয়ের ঘুমিয়ে পড়া মুখ/ তাকিয়ে থাকি সেটাই আমার বেঁচে থাকার সুখ’ বাৎসল্য রসকে বাংলা গানের ভাঁড়ারে সশ্রদ্ধ জায়গা করে দিয়েছে। যা আগে কখনো এমনভাবে হয়নি। যদিও বাবা ও মেয়ের স্মৃতি যাপনের একটি গান ‘আয় খুকু আয়’-এর কথা কেউ কেউ বলবেন, বলতে পারেন দাদা ও হারিয়ে যাওয়া বোনের আখ্যানে নির্মিত ‘সে আমার ছোট বোন/ বড় আদরের ছোট বোন’ গানের কথা, কিন্তু ও গান দুটিতে বিষাদের ছাপ বেশি, ঠিক প্রেমের গান বলে চেনা মুশকিল। আবার নিজের বৃদ্ধ পিতাকে নিয়ে সুমন যখন লেখেন, ‘তিনি বৃদ্ধ হলেন, বনস্পতির ছায়া দিলেন’ তখন বাংলা গানের পরিসরে সেই গানও হয়ে ওঠে অন্য রকম এক ভালবাসার নিবেদনের গান যা ব্যতিক্রমী। পুরোনো দুই হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর মধ্যে হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়ার মধ্যে যে স্মৃতি মেদুর ভালবাসার সাময়িক স্ফূরণ ঘটে সুমন তাকেও জায়গা দিয়েছেন তার গানের খাতায় - ‘হঠাৎ রাস্তায় আপিস অঞ্চলে’ গানে, বাংলায় এমন গান এর আগে লেখা হয়নি। আবার সন্ধের আকস্মিক লোডশেডিং-এর মধ্যে আবদ্ধ ফ্ল্যাটে আটকে পড়া এক প্রৌঢ় দম্পতি, যখন মোমবাতি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, টর্চটা জ্বলছে না এমন এক পরিস্থিতিতে ‘কাজের কাজ নিপাত যাক’ বলে অন্ধকারে মুখোমুখি বসে পড়েন গল্পগাছায় সেও এক আশ্চর্য প্রেমের রঙিন বিনিময় (গানটির শিরোনামঃ 'মোমবাতিটা কোথায় গেল')! কেননা অন্য একটা গানে সুমন লিখছেন ‘জানি না বয়স হলে কেন প্রেমে পাক ধরে/ জানি না কেন যে হৃদয় রাত জেগে পায়চারি করে’ - এই পাক ধরা প্রেমের গান বাংলা গানের সারণীতে লিখতে হয়েছে তাঁকেই, কারণ এতদিনের গীতিকাররা এগুলো বরাবর এড়িয়েই গেছেন। আবার প্রেম মানে যদি নিবেদন হয় তার বিপরীত দিকে আছে প্রত্যাখ্যান - সেই কথাই বা থাকবে না কেন গানে? নিজের গানে এই প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন নচিকেতা। ‘এই... তুমি কি আমায় ভালবাসো? যদি না বাসো তবে পরোয়া করি না’ এমন সোজাসাপটা অথচ ভিন্ন মেজাজের গানের উৎসার বাংলার গানের ভুবনকেই সমৃদ্ধ করেছে বলা যেতে পারে।

।। ৪ ।।

বাংলার গানে ‘চুম্বন’ নিয়ে বলার কথা অল্পই। কারণ সাংস্কৃতিকভাবে ‘চুম্বন’কে প্রেমের একরকম প্রকাশ্য যৌন প্রতীক বলেই বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজ চিহ্নিত করে এসেছে বারবার। তার একটা সহজবোধ্য কারণ হল প্রেমের সাধারণ অর্থ যদি সীমিত থাকে তারুণ্যের বা যৌবনের রোমান্টিকতার তাহলে ‘চুম্বন’ প্রেমিক-প্রেমিকার ভালবাসার প্রাথমিক শরীরী প্রকাশ। সাহিত্যে বা সিনেমায় বহুকাল পর্যন্ত এই নিয়ে একরকম ট্যাবু ছিল (যে কারণে বলা হত, বড়দের গল্প উপন্যাস পড়লে ছোটরা বখে যায়)। বাংলা গানে এই ট্যাবু ভাঙার চেষ্টা যে একদম হয়নি তা নয় তবে তার মধ্যে ছিল অতি সতর্কতার বুনন। আসলে প্রেম ব্যাপারটাকে আমরা কীভাবে দেখছি তার ওপরেই নির্ভর করে ‘চুম্বন’কে আমরা কোন নিক্তিতে বিচার করব। যেহেতু প্রাচীন বৈষ্ণব সাহিত্যে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমকে আমরা ‘লীলা’ নামের একটা নিরামিষ শব্দের আদলে বেঁধে ফেলেছি সেখানে দেহাতীত প্রেমের ধারণাটাই প্রধান হয়ে দেখা দিয়েছে। চন্ডীদাসের পদে আছে ‘রজকিনী প্রেম নিকষিত হেম/ কামগন্ধ নাহি তায়’ - এই 'কামগন্ধ'কে যদি সতর্কভাবে সরিয়ে রাখি তাহলে গানের ভাষায় ‘চুম্বন’ বা তারও বেশি কিছু আসবার পথ পাবে কোথা থেকে? সত্যি বলতে কি সেইভাবে পথ পায়ওনি। রবীন্দ্রনাথের একটা ‘প্রেম’ পর্যায়ের গানে বর্ণিত হয়েছে বর্ষা দিনের এমন এক পরিবেশঃ

নিভৃত নির্জন চারিধার
দুজনে মূখোমুখি
গভীর দুখে দুখি
আকাশে জল ঝরে অনিবার।

এমন চূড়ান্ত এক রোমাঞ্চসন্ধি, কিন্তু ‘চুম্বন’-এর এমন যোগ্য মুহূর্ত রবীন্দ্রনাথ শুধু ‘মুখোমুখি’ শব্দের আড়াল রেখে ছেড়ে দিয়েছেন। সবথেকে মজার ব্যাপার হল, প্রেম পর্যায়েরই অন্য একটা গানে ‘ঝড়ে যায় উড়ে যায় গো আমার মুখের আঁচলখানি’ যে কোনও কারণেই হোক গীতিকার আঁচলকে বুক থেকে মুখে তুলে এনেছেন। অথচ তর্কের খাতিরে যদি ধরে নিই মুখে আঁচলচাপা দেওয়া ছিল ওই উদ্দিষ্ট নারীর তাহলে কি পরের লাইনের অন্তরায় এই কথা লেখা যায় -

আমার রইল না লাজলজ্জা
আমার ঘুচল সকল সাজসজ্জা।

নারীর বুকের আঁচল সরে না গেলে তার লাজলজ্জা ঘুচে যাওয়ার কথা ওঠে কি? তাই ‘চুম্বন’কে একটা প্রতীক হিসেবে ভাবলে প্রেমের সঙ্গে শরীরের গভীর যোগাযোগ বাঙালি গীতিকাররা সতর্ক সামাজিকতার দোহাই দিয়ে এড়িয়ে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ এতটা আপোষপন্থী ছিলেন না ঠিকই কিন্তু তার ‘কেন যামিনী না যেতে জাগালে না বেলা গেল মরি লাজে’ গানকে একদল শুচিবায়ুগ্রস্ত সমালোচক ‘লাম্পট্যের গান’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন। ‘চিত্রাঙ্গদা’ নৃত্যনাট্যের কুৎসিত আক্রমণাত্মক সমালোচনা করেছিলেন স্বয়ং দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। এগুলো একটা সমাজের শিক্ষিত শ্রেণির মানসভঙ্গিকে চিহ্নিত করে।

এর পরের পর্বের রোম্যান্টিক গানের দু' একটা দৃষ্টান্ত নিলে দেখা যাবে এই সতর্কতার ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। ‘এই রাত তোমার আমার’-এর মতো খ্যাত গানে বলা হয়েছে ‘তুমি আছো/আমি আছি তাই/ অনুভবে তোমারে যে পাই/ শুধু দুজনে’-এর মধ্যে শারীরিক ছোঁয়ার একটা আভাস আছে কিন্তু তা পরিমিতি বোধকে ছাপিয়ে যায়নি। এই 'কথা বলতে চাইব না' গানের মধ্যে শারীরিক ঘনিষ্ঠতার অনুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়ে গানের নান্দনিকতাকে ব্যাহত করতে হবে কিন্তু ‘চুম্বন’-এর অনুষঙ্গ থাকলে বাংলা গানের তুলসীতলা বড় বেশি অশুদ্ধ হয়ে যেত এই উপপাদ্যেরও কোনো যুক্তি নেই। আরেকটা গান মনে করি। মান্না দের কণ্ঠে অতি জনপ্রিয় ‘ও কেন এত সুন্দরী হল’ গানে এমন এক নারীর রূপ বর্ণনা যাকে দেখে কথক মুগ্ধ এবং বলা হচ্ছে ‘আমি তো মানুষ’! অর্থাৎ যে সুন্দরীকে দেখে মুগ্ধ হল, যার মানবিক সত্ত্বা নতুন করে জেগে উঠল তার মধ্যে রক্ত মাংসের সেই মানুষটির কি একবারও ইচ্ছে করবে না তার প্রেমিকাকে একবার চুমু খেতে? কিন্তু বাংলার গানে তার অনুমোদন নেই। কারণ, গান সমাজের রীতিনীতির অনুবর্তী। সুন্দর শিশু কোলে এক রূপবতী নারী দেখে আমরা অনায়াসে ওই শিশুটিকে চুমু খেতে পারি, কিন্তু নিজের প্রণয়িনী (হয়তো বা তার ভবিষ্যৎ জীবনের সঙ্গিনীও) তাকে প্রকাশ্যে চুমু খাওয়া আমাদের সামাজিকতায় বেমানান। ইউরোপে এই বেড়া নেই, তাই তাঁদের সমাজে বন্ধুবান্ধবী প্রকাশ্যে আলিঙ্গন ও চুম্বন করে, এতে তাঁদের সমাজের মহাভারত তেমন পাল্টে যায়নি, তাই তাঁদের গানেও তার ছায়াপাত আছে। তবে সুখের কথা বিশ্বায়নের সুবাদে কিছু সুফল তো সাংস্কৃতিক বিশ্বেও ঢুকেছে, তাই কিছুকাল আগে লেখা একটা গানে নচিকেতা বিদ্রূপ করেছিলেনঃ প্রকাশ্যে চুমু খাওয়া এই দেশে অপরাধ/ প্রকাশ্যে ঘুষ খাওয়া নয়!

কিন্তু এ তো ব্যাঙ্গের কথা। বাংলা গানে সত্যি সত্যি যদি কেউ ‘চুম্বন’কে স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন তিনি কবীর সুমন। ছকভাঙ্গা প্রেমের ভাষায় লেখা তার ‘জাতিস্মর’ গানে তিনি লেখেনঃ

ঠোঁটে ঠোঁট রেখে ব্যারিকেড গড়ো
প্রেমের পদ্যটাই
বিদ্রোহ আর চুমুর দিব্যি
শুধু তোমাকেই চাই।

অবদমিত যৌবনকে ‘চুম্বন’-এর প্রান্তরে মুক্তি দিলেন সুমন। বাংলা গান তার কলমে আন্তর্জাতিক হল। দোয়েলের কোনও দেশ নেই, গানেরও কোনও দেশ থাকবে কেন? মনে পড়ে গেল, ২০১৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের আহ্বানে ক্যাম্পাসে পুলিশ ডেকে অন্ধকার করে পড়ুয়াদের নির্বিচার পেটানোর প্রতিবাদে যাদবপুরের পড়ুয়ারা পুলিশ থানার সামনে এই ঠোঁটে ঠোঁটে ব্যারিকেড করে অনেকের রক্তচাপ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আশা করব সুমন যেমন লিখেছিলেন ‘ইচ্ছে করে মরব দেখে যৌথ খামার’ তেমনই তার অঘোষিত উদ্দীপনার নেপথ্য প্ররোচনায় যাদবপুর এমন চমকে দেওয়া কান্ড করে বসেছিল সেই সময়। বাহবা, সাবাস! এখন যৌবন যার ‘চুম্বন’ তার অধিকার হোক। ওই যাদবপুর যদি আজও রাজ্যের শিক্ষা বিভাগে লাগামহীন দুর্নীতির প্রতিরোধে ‘চুম্বন’-এর রঙে শপথ নেন তাহলে তাঁদের বিদ্রোহ আর প্রেম দুই সার্থক হবে বলে আমার প্রতীতি। মনে পড়ে যায়, ‘চার অধ্যায়’-এর বিদায় পর্বে এলা আর অন্তুর সেই ‘চুম্বন’-এর ছবি, সে ছিল এক চিরসবুজ বৃদ্ধের নির্মাণ। প্রেম যদি পবিত্র হয় তবে ‘চুম্বন’ সেই পবিত্রতার শারীরিক প্রতীক। সংবেদনশীল স্নায়ু রক্তের মানুষই প্রেম করেন, তাঁরাই চুমু খান। বাংলা গান এসে তাঁদের হাত ধরুক। শুধু সমাজের অনুবর্তন নয় তাকে একটু একটু পাল্টে দেওয়াও যে কোনও শিল্প মাধ্যমের স্বধর্ম। বাংলা গানই বা তার ব্যতিক্রম হবে কেন? লেট আস চেঞ্জ এ লিটল বিট!