আরেক রকম ● দশম বর্ষ একবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ নভেম্বর, ২০২২ ● ১৬-৩০ কার্তিক, ১৪২৯

প্রবন্ধ

‘জাতীয়’ প্রয়োজনীয় ওষুধ তালিকা - অন্দরমহলের বিজ্ঞান-অবিজ্ঞান

ডা. স্বপন কুমার জানা


১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২। ভারত সরকার পঞ্চম ‘জাতীয়’ প্রয়োজনীয় ওষুধ তালিকা (NLEM-2022) প্রকাশ করল। উদ্দেশ্য, চিকিৎসকদের সব প্রেসক্রিপশনে ওষুধ ব্যবহার যুক্তিপূর্ণ ও বিজ্ঞানসম্মত করা। অমন তালিকা এর আগে ভারত সরকার ১৯৯৬, ২০০৩, ২০১১ ও ২০১৫ সালেও প্রকাশ করেছে।

নতুন তালিকায় রয়েছে ৩৮৪টি ওষুধের রাসায়নিক গঠন ও মিশ্রণ (ফর্মুলেশন)। ২০১৫ সালের তালিকা থেকে এইবার ৩৪টি ওষুধ বিভিন্ন কারণে বাদ পড়েছে। বাদ পড়া ওষুধের মধ্যে এরিথ্রোমাইসিন (Erythromycin), ক্লোরফেনির্যাগমাইন (Chlorpheniramine), রার্নিটিডিন (Ranitidine) ও এটেনোলল (Atenolol) ইত্যাদি ওষুধ উল্লেখযোগ্য। কারণ হিসেবে যা বলা হয়েছে, তা অবৈজ্ঞানিক, অযৌক্তিক ও বিভ্রান্তিকর! বিজ্ঞানের নামে চালিয়াতিও আছে। তাছাড়া প্রয়োজনীয় ওষুধ তালিকা থেকে বাদ মানে ওষুধগুলো নিষিদ্ধ নয়, তাই এই ওষুধগুলো এখন বাজারে থাকবে, কিন্তু বর্তমানের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হবে! (১) এই তালিকা তাই চিকিৎসক, ওষুধ বিজ্ঞানী, স্বাস্থ্যকর্মী, রাজনৈতিক দল ও জনমানুষের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে।

আমাদের দেশে যে ওষুধ-বাজার আশি শতাংশ (৮০%) অপ্রয়োজনীয়, নিষিদ্ধ, অকেজো ও অযৌক্তিক ফর্মুলেশনে ভরে রয়েছে, সেখানে এই ‘প্রয়োজনীয় ওষুধ তালিকা’র ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তা থেকে দেশের শাসকশ্রেণী ও জনগণের সামাজিক, অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ ও রাজনৈতিক ভাবনা বোঝা যায়। একটা বুনিয়াদি কথা খেয়াল করুন। সরকার বলেছে, এটা জাতীয় প্রয়োজনীয় ওষুধ তালিকা। এখানে ‘জাতীয়’ কথাটা যেমন গোলমেলে, ‘প্রয়োজনীয়’ কথাটিও তাই। দেশের রাজনৈতিক মহলের নিরন্তর পেজোমির ফলে একটা জাতি হিসেবে আমরা কতটা স্বাধীন বা পরাধীন তা নিয়েই সাধারণ মানুষজনের মধ্যে ধন্দের অবসান ঘটেনি। তাই তার কাছে কোন ওষুধ কতটা প্রয়োজনীয়, কেনই বা, তা নিয়েও সংশয় অনিবার্য হয়েছে।

সেদিক থেকে দেখে আমাদের মনে হয়, সত্যিই রোগীদের রোগের উপশম, প্রতিরোধ ও নিরাময়ের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য সরকার এই তালিকা প্রকাশ করেনি। তার মনোভূমিতে রোগীর স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার বাসনা যে আদৌ আছে তার প্রমাণও নেই। নইলে সরকারি ব্যবস্থাপনাতেই যে ওষুধ-বাজার সেখানে আশি শতাংশ অপ্রয়োজনীয় ওষুধ ফর্মুলেশন থেকে গেল কীভাবে? চিকিৎসকদের নব্বই শতাংশ প্রেসক্রিপশনে অপ্রয়োজনীয় ওষুধের ছড়াছড়ি কেন? কেনই বা সরকারকে ‘মেডিকেল এথিকস’-এ বলতে হচ্ছে -
‘‘Use of Generic names of drugs: Every physician should, as far as possible, prescribe drugs with generic names and he/she shall ensure that there is a rational prescription and use of drugs.’’ (২)

এইসব ভাল ভাল, মিষ্টি মিষ্টি কথা বলা হচ্ছে, অথচ সরকারি বা বেসরকারি কোনও ক্ষেত্রেই এসব নীতির প্রয়োগ ঘটছে না। বরং ‘সোসাইটি ফর সোসাল ফার্মাকোলজি’-এর গবেষণায় উঠে এসেছে, কমবেশী পঁচানব্বই শতাংশ (৯৫%) চিকিৎসক প্রেসক্রিপশনে বাণিজ্যিক (‘ব্র্যান্ড’) নামে ওষুধ লেখেন এবং ‘জাতীয়’ প্রয়োজনীয় ওষুধ তালিকাকে মান্যতা দেন না। প্রশ্ন করলে, না-মানার গা-জোয়ারি যুক্তি দেখান। তার মানে, নীতিবাক্যগুলো শুধু মুখের কথা, কাজের কথা নয়।

আর-এক দিক থেকে দেখলেও কেউ ভাবতে পারেন, এই ওষুধ তালিকায় সত্যই কি ভারত সরকারের জনস্বার্থবাহী স্বাধীন বৈজ্ঞানিক মতামত প্রতিফলিত হয়েছে? একটা পরমুখাপেক্ষী, আদর্শহীন, জনবিমুখ সরকারের পক্ষে স্বাধীন, বৈজ্ঞানিক মতামত দেওয়া কি আদৌ সম্ভব বা আদৌ কতটা সম্ভব? মাত্র ক’দিন আগে ডা. দিলীপ মহলানবিশ চিরবিদায় নিলেন। কলেরার চিকিৎসায় ‘ওআরএস’ ব্যবহার নিয়ে তাঁর স্বাধীন গবেষণার স্বীকৃতি পেতে তাঁকে কী পরিমাণ পরিশ্রম আর কালক্ষেপ করতে হয়েছিল তা অনেকেরই জানা। তাই আধিপত্যকামী পশ্চিম বিশ্বের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সর্বোপরি রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণাধীন হিসেবে ভারত সরকারের চরিত্র নিয়ে বুক ফুলিয়ে কিছু বলা অসম্ভব। একইসঙ্গে একথাও সত্যি যে, আধিপত্যকামীদের মধ্যে দ্বন্দ্বও অন্তহীন। সেই দ্বন্দ্বের বিচিত্র ফসল দেখতে আমরা অভ্যস্ত হয়েছি। তেমনই একটি ফসলের নাম যে ‘জাতীয় প্রয়োজনীয় ওষুধের তালিকা’ (NLEM), সেকথা হয়তো মিথ্যে নয়। একথায় যদি রাজনীতির গন্ধ ভেসে থাকে তাহলে তাও নিতান্ত বাস্তব।

প্রয়োজনীয় ওষুধ (ESSENTIAL DURGS) মানে কী?

একটি দেশের প্রেক্ষাপটে যে সমস্ত ওষুধ ব্যাপক জনসংখ্যার স্বাস্থ্যরক্ষার প্রয়োজনে লাগে, সবসময় পর্যাপ্ত পরিমাণে এবং সঠিক মাত্রায় পাওয়া যায়, সেই সমস্ত ওষুধগুলিকে আমরা প্রয়োজনীয় ওষুধ বলি। তার তালিকা তৈরির জন্য যে মাপকাঠি ব্যবহার করা হয়, তা হ’ল -
(১) দেশের বেশি সংখ্যক মানুষ কোন ধরনের রোগে বেশি ভোগেন।
(২) দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় কী ধরনের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে।
(৩) দেশে কোন ধরনের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বর্তমান।
(৪) দেশের পরিবেশ, লোকসংখ্যা, বংশগতির ধারা ইত্যাদি কেমন।
(৫) এ ছাড়া যদি কখনও একাধিক প্রয়োজনীয় ওষুধ থেকে থাকে তাহলে সেগুলির মধ্যে কোনটি সবচেয়ে কার্যকরী, নিরাপদ, গুণগত ভাবে উন্নত, সহজেই পাওয়া যায় এবং কম খরচ পড়ে, সেই ওষুধটিকেই ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া হয়।

এই মাপকাঠির ভিত্তিতে হাতি কমিটি (১৯৭৪) আমাদের দেশে ১১৭টি ওষুধের তালিকা তৈরি করেছিল, যা দিয়ে আশি থেকে নব্বই শতাংশ রোগীর চিকিৎসা সুষ্ঠুভাবে করা যায়। অথচ বাজারে অপ্রয়োজনীয়, ভেজাল, নিষিদ্ধ ইত্যাদি মিলিয়ে চালু আছে ষাট হাজারের উপর ওষুধের ফর্মুলেশন। (৩)

১৯৭৭ সালে 'বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা' প্রথম ‘প্রয়োজনীয় ওষুধ তালিকা’ (Essential Drug List/EDL) প্রকাশ করে। মনে আছে, কোনও ওষুধ-বিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তকে তখন এসব বিষয়ের উল্লেখ ছিল না, শিক্ষক মহাশয়রাও এসব নিয়ে আলোচনা করতেন না। ১৯৭৭ থেকে ১৯৯৬, যখন ভারত সরকার প্রথম ‘জাতীয় প্রয়োজনীয় ওষুধ তালিকা’ প্রকাশ করল, এই সময়কালে ওষুধ-বিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তকে ‘প্রয়োজনীয় ওষুধ তালিকা’ বিশেষ অধ্যায় হিসেবে আসে। ইতোমধ্যে ‘ড্রাগ অ্যাকশন ফোরাম’ (DAF) তৈরি হয়েছে (১৯৮৬), আমরা অনেকেই সিলেবাসের বাইরে এসে এসব বিষয়ে অল্পস্বল্প জেনে নিয়েছি, প্রচার আন্দোলনও গড়ে তুলছি। তারপর ২০০০ সালে শুরু হল ওষুধ-বিজ্ঞানের নতুন অধ্যায়, নতুন আন্দোলন, ‘সোসাল ফার্মাকোলজি’।

প্রথমে বলা হত, ‘প্রয়োজনীয় ওষুধ তালিকা’, এখন বলা হয় ‘প্রয়োজনীয় মেডিসিন তালিকা’। ওষুধের মূল রাসায়নিক পদার্থকে বলা হয় 'ওষুধ' আর ফর্মুলেশনগুলো হল ‘মেডিসিন’। এই রাসায়নিকগুলির কোনটা, কেন, কতটা উপকারী অথবা ক্ষতিকর তা নিয়ে আলোচনা অতি জটিল হয়ে যাবে, তাই এখানে তা থেকে আমরা বিরত থাকছি।

অপ্রয়োজনীয় ওষুধ (NON-ESSENTIAL DRUGS) মানে কী?

আগেই বলেছি, ভারতের ওষুধ বাজারে আশি শতাংশ (৮০%) অপ্রয়োজনীয় ওষুধ ফর্মুলেশন রয়েছে। তার বিচারের মানদণ্ড হচ্ছে -
(১) ওষুধ-বিজ্ঞানের প্রামাণ্য বইতে যে সমস্ত রাসায়নিক পদার্থের স্বীকৃতি নেই।
(২) যে সমস্ত পদার্থের কার্যকারিতা সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা একমত নন।
(৩) যে সমস্ত পদার্থের কার্যকারিতা সম্পর্কে সন্দেহ রয়েছে এবং মানুষের শরীরে পদার্থগুলির গতিবিধি পরীক্ষিত নয়।
(৪) যে সমস্ত গাছ-গাছড়ার ওষুধের কার্যকরী পদার্থের নির্দ্দিষ্ট রাসায়নিক গঠন ও সঠিক মাত্রা নির্ধারিত হয়নি। (যেমন লিভ-৫২, জিনসেং, ডায়সর্টেস, ভিটামিন ও বিভিন্ন মিনারেল মিশ্রণ ইত্যাদি)।

নিষিদ্ধ ওষুধ (BANNED DRUGS) মানে কী?

এর মানে, যে সমস্ত ওষুধ বা ওষুধ ফর্মুলেশনগুলোকে রোগ-ব্যাধিতে লাভের চেয়ে বিভিন্ন ক্ষতিকারক দিক বেশি হওয়ার ফলে ওষুধ-বিজ্ঞানের পাঠ্য পুস্তকে এগুলো ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়েছে এবং ওষুধটিকে ‘ফার্মাকোপিয়া’ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। অনেক সময় নির্দেশ জারি করে সরকার বাজার থেকে এমন ধরনের ওষুধ তুলে নেয়। যেমন, থ্যালিডোমাইড (Thalidomide), সিমেটিডিন (Cimetidine), ডাইহাইড্রোস্ট্রেপটোমাইসিন (Dihydrostreptomycin), অ্যানালজিন (Analgin), কুইনোডোক্লোর (Quinodochlor), সাইপ্রোহেপ্টাডিন (Cyproheptadine), সিজাপ্রাইড (Cisapride), ফিলাইলপ্রোপ্যানোল্যামাইন (Phenylpropanolamine), সিবুট্র্যামাইন (Sibutramine), রোফেকক্সিব (Rofecoxib), ভ্যালেডোকক্সিব (Valdecoxib), ফেনাসেটিন (Phenacetin), অ্যাস্টেমিজোল (Astemizole), টারফেনাডিন (Terfenadine) ইত্যাদি। কোনও কোনও দেশে এমন কিছু ওষুধকে নিষিদ্ধ করা হয়। যেমন, নিমেসুলাইড (Nimesulide) ইসরাইল ও পর্তুগালে নিষিদ্ধ ৷

ইতিহাসের পাতা থেকে

সাতের দশক থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ওষুধ বাজারের প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় ওষুধের ফর্মুলেশন নিয়ে ওষুধ বিজ্ঞানে চর্চা শুরু হয়।

(১) ১৯৬৫ সালে ব্রিটিশ সরকার লক্ষ্য করে যে, ২২৪১টি ওষুধ ফর্মুলেশনের মধ্যে পঁয়ত্রিশ শতাংশই (৩৫%) অকেজো, অযৌক্তিক।

(২) ১৯৬৬ সালে আমেরিকার ‘খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন’ (FDA) অকেজো ওষুধের বাছাইপর্ব শুরু করে, রোগ সারানোর ক্ষমতার নিরিখে ওষুধগুলিকে পাঁচ ভাগে ভাগ করল -
(ক) কার্যকরী (Effective), (খ) শর্ত সাপেক্ষে কার্যকরী (Effective with reservation) (গ) আপাতভাবে কার্যকরী (probably effective) (ঘ) সম্ভবত কার্যকরী (Possibly effective), (ঙ) অকেজো (Ineffective)।

বাজারজাত ওষুধের এই শ্রেণী বিভাগকে জনগণের কাছে প্রচার করা হল। ১৯৬৮ সালের মধ্যে প্রায় চার হাজার ওষুধ ফর্মুলেশনকে পরীক্ষা নিরীক্ষার আওতায় আনা হল। ওষুধ কোম্পানিদের বলা হল, এক মাস থেকে ১২ মাসের মধ্যে ওষুধের কার্যকারিতা সম্পর্কে তথ্য দিতে হবে। এই সময় কিন্তু অভিযুক্ত ওষুধের বিক্রি বন্ধ থাকল না। সময় শেষ হয়ে গেল কিন্তু কোনও ওষুধ বাজার থেকে উঠল না। FDA-এর অকর্মণ্যতা জনগণের কাছে পরিস্কার হয়ে গেল। (৩)

এই সময়কালে ওষুধ কোম্পানিগুলো, একটার পর একটা ওষুধ তৈরি করে, ‘সর্বরোগের সঞ্জীবনী’ (Me too Drugs) বলে প্রচার চালায়। তার একমাত্র চালিকা শক্তি ছিল সীমাহীন মুনাফা আর বাজার দখলের লড়াই। তখনও ওষুধের ‘ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল’-এর বৈজ্ঞানিক, নৈতিক, আইনি, সাংস্কৃতিক দিকগুলি সঠিকভাবে গড়ে ওঠেনি।

(৩) ১৯৭৬ সালে দেখা যায় আমেরিকাতে ২৫টি বহুল ব্যবহৃত ওষুধের মধ্যে ৮টি ওষুধ বিজ্ঞানের নিরিখে যথাযথ নয় - তারা অপ্রচলিত, অকেজো ও ক্ষতিকর।

(৪) অস্ট্রেলিয়ার জনৈক অপরাধ বিজ্ঞানী (Prof. John Braithwaite) দেখান যে, ওষুধ কোম্পানিগুলো অন্যান্য শিল্পের চেয়ে বেশি ঘুষখোর ও মারাত্মক দুর্নীতিপরায়ণ। তাদের উৎপাদন ও নিরাপত্তার পরীক্ষায় সবচেয়ে মারাত্মক অনাচারের প্রমাণ রয়েছে।

(৫) ভারতের ওষুধ বাজারে খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য ১৯৭৪ সালে ভারত সরকারের নেতৃত্বে হাতি কমিটি (জয় সুখলাল হাতি) গঠিত হয়, এশিয়া-আফ্রিকা-ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে ভারতে প্রথম। এই সময় ভারত সরকারের নেতৃত্বে ইন্দিরা গান্ধী ও ইন্দিরা কংগ্রেস। সরকার তখন সোভিয়েত রাশিয়ার উপর একটু বেশি নির্ভরশীল। ইন্দিরা গান্ধী তখন ‘‘এশিয়ার মুক্তিসূর্য’’!

ওষুধ গবেষণা, উৎপাদন, বন্টন, প্রচার ও প্রেসক্রিপশন করা সহ বিভিন্ন দিক নিয়ে অনুসন্ধান চালানো হয়। তাতে এক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে আসে। দেখা যায়, চিকিৎসকরা সিলেবাসের পড়াশোনার বাইরে গিয়ে ওষুধ প্রেসক্রিপশন করছেন। ওষুধ কোম্পানিগুলো মেডিকেল রিপ্রেসেন্টটেটিভ মারফত প্রথম থেকেই ডাক্তারদের ‘ওষুধ বিক্রেতা‘ হিসেবে গড়ে তুলছে। এই কাজ অবশ্য এখনও চলমান। ভারত সরকার ওষুধ কোম্পানির অনাচারগুলোকে মদত দিয়েছে। তাতে জনস্বার্থই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, হয়ে চলেছে। লাভ হয়েছে, হয়েই চলেছে মুনাফাভোগীদের। শ্রেণিস্বার্থের অমনই মহিমা।

(৬) ১৯৭৭ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রথম প্রয়োজনীয় ওষুধ তালিকা প্রকাশিত হওয়ার বেশ কিছুকাল পরে, মার্কিনি মদতে ওষুধ কোম্পানীদের যৌথ কণ্ঠস্বর কেমন হয় তা নিয়ে বাংলাদেশ গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রধান পরিচালক ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী তাঁর বইতে (Politics of Essential Drugs) লিখেছিলেন,
‘‘The little book was a bombshell for the drug industry. It was bitterly criticised by the US Pharmaceutical Manufacturers Association (PMA) which stated on 10 April 1978: ‘[The] medical and economic arguments presented by WHO as justification for an essential drugs list are fallacious and ...adoption of this recommendation could result in suboptimal medical care and might reduce health standards already attained’. True to form, it argued that an essential drugs list would discourage the pharmaceutical industry from investing in research.’’ (৪)

(৭) ইতিমধ্যে, ১৯৭২ সালে চীন কমিউনিস্ট পার্টির দশম কংগ্রেসে সমাজতান্ত্রিক চীনের রূপান্তর ঘটে যায়। সারা দুনিয়া জুড়ে আগের মতোই ঘটতে থাকে শোষণ, শাসন, বঞ্চনা, অমানবিকতা, গণহত্যা ও যুদ্ধ। এরই মধ্যে সদাজাগ্রত পুঁজিতন্ত্রের দ্বন্দ্ব-বিরোধ। সেই বিরোধ থেকেই রাশিয়ার আলমা-আটাতে (১৯৭৮) জন্ম নেয় সারা দুনিয়ায় বুনিয়াদি চিকিৎসা পরিষেবায় 'বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা' (১৯৭৭) প্রণীত ‘প্রয়োজনীয় ওষুধ তালিকা’ ব্যবহারের দিক নির্দেশ।

ওষুধ ও রাজনীতি

ওষুধের বিশ্ব রাজনীতি বুঝতে গেলে ইতিহাসের উপরোক্ত ঘটনাগুলোর তাৎপর্য আছে। অবশ্য এই আলোচনাটি দীর্ঘ বিশ্লেষণের দাবি রাখে। কিন্তু চুয়াল্লিশ বছর আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের যৌথ আলমা-আটা ঘোষণাটি যে মনোরম সাইনবোর্ডের আড়ালে রঙ-বেরঙের জনবিরোধী কীর্তির রিহার্সাল সেকথা বলাই যায়। এমনই আর-এক ঘোষণা ছিল, ‘‘২০০০ সালের মধ্যে সকলের জন্য স্বাস্থ্য চাই’’। সেদিনের এই শ্লোগানের মর্মবস্তু যে এশিয়া আফ্রিকা-ল্যাটিন আমেরিকার দেশে দেশে স্বাস্থ্যের বাজার তৈরী করা - তা আজ স্পষ্ট হয়েছে।

একথা আমরা বলছি, কেননা আলমা-আটা ঘোষণার মধ্য দিয়ে আমাদের মতো আধাদরিদ্র, প্রায়দরিদ্র, পরনির্ভরশীল দেশগুলিতে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে অল্প স্বল্প সংস্কারকাণ্ড ঘটিয়ে চিকিৎসার সামন্ত সংস্কৃতিতে কিছু পরিবর্তন আনা হয়। মানুষের চিন্তা চেতনাকে এমনভাবে প্রভাবিত করা হয় যাতে তাঁরা ক্রমশ নতুন প্রযুক্তি কেনার জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকেন। অথচ শিশুদের পোলিও, হাম, যক্ষা, ডিপথেরিয়া, ধনুস্টংকার ও হুপিং কাশির টিকা কর্মসূচী অনেকাংশে প্রচারের ঢক্কা নিনাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ৷ মূলত জন্ম নিয়ন্ত্রণের প্রচার ছাড়া ‘সকলের জন্য স্বাস্থ্য চাই’ শ্লোগানের আর কোনও বিষয়েই উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটেনি।

আলমা-আটা ঘোষণা

১৯৭৮ সালে সারা দুনিয়ার সরকারগুলো কি জনস্বার্থবাহী ও প্রগতিশীল ছিল? বিভিন্ন দেশের সরকারি প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত ও পরিচালিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কি রাষ্ট্র-নিরপেক্ষ স্বাধীন সত্তা রয়েছে? রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান কিন্তু উল্টো কথা বলে। বিভিন্ন দেশের সরকারি দৃষ্টিভঙ্গিই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাজের চালিকা শক্তি, কিন্তু এই সংস্থায় যে সবচেয়ে বেশী টাকা ঢালে সেই মার্কিন রাষ্ট্রের নীতি ও উদ্দেশ্যই মূলত সেখানে প্রতিফলিত হয়। অনেকে ভাবেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কি তাহলে কোনও ভাল কাজ করেনি?

প্রশ্নটি যতটা সরল উত্তরটি ততটা নয়। কারণ, ভাল-মন্দ নির্ধারিত হয় একটি সংগঠনের চরিত্র, তার সমস্ত কাজকর্মের মৌলিক উদ্দেশ্য দ্বারা। ‘সকলের জন্য স্বাস্থ্য’ কর্মসূচী থেকেই সংগঠনের মৌলিক চরিত্র বোঝা যায়, কেননা এই শ্লোগানের পেছনে স্বাস্থ্যবাজার গড়ে তোলাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। তাই তারা অপ্রয়োজনীয় ওষুধ ফর্মুলেশনগুলো বাজার থেকে তুলে নেয়নি, নেয় না। বরং ‘প্রয়োজনীয় ওষুধ তালিকা’র জন্মই হয়েছে বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিগুলোর দ্বন্দ্বের ফসল বা পরিণতি হিসেবে! সেখানে বৈজ্ঞানিক তথ্য, গণস্বাস্থ্য, রোগ নিরাময়, রোগ প্রতিরোধ ইত্যাদিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়নি। তাই ওই শ্লোগান অন্তরাত্মায় জন-মানুষ বিরোধী! আলগাভাবে দেখলে যা মনোহারিণী বলে মনে হয়, গভীর পর্যালোচনায় তা উলটো।

১৯৮৬ সালে ধুরন্ধর বিশ্ব বণিকদের নির্দেশে ভারত সরকার দেশের চিকিৎসা পরিষেবাকে আইনিভাবে ‘পরিষেবা পণ্যে’ রূপান্তরিত করে (ক্রেতা সুরক্ষা আইন, ১৯৮৬)। দেশের চিকিৎসা পরিষেবা হয় ‘চিকিৎসা বাজার’! তাই ওষুধ বাজারে প্রয়োজনীয় ওষুধ তালিকাটা থাকলেও অপ্রয়োজনীয় ওষুধ ফর্মুলেশনগুলোর ব্যবহার চলতেই থাকবে। আমরা জানি, মরণমুখী পুঁজিতন্ত্রের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব বাড়তেই থাকবে। ভারতের শাসকশ্রেণির মধ্যেও তার প্রতিফলন পড়বে - এমনকী, আঞ্চলিক স্তরেও। তাকিয়ে দেখুন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রতিনিধিদের সীমাহীন অনাচারের দিকে। এসব কোনও কাকতালীয় ঘটনা নয়।

একটা কৌতূহলের দিক হল, ভারত সরকারের ‘‘জাতীয় ওষুধ তালিকা’’ (NLEM) থেকে অবৈজ্ঞানিক কোভিড ভ্যাকসিন বাদ দেওয়া হয়েছে। এর পিছনে কিন্তু গণস্বার্থ, নৈতিকতা ও বিজ্ঞানকে অগ্রাধিকার বা গণ-মানুষের আন্দোলনের ফলশ্রুতি ইত্যাদি কিছুই নেই। সরকার ওগুলো বাদ দিতে বাধ্য হয়েছে ওষুধ কোম্পানি ও পুঁজিপতিদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব বা বিরোধ থেকে। এ এক চিরন্তন সামাজিক নিয়মের বহিঃপ্রকাশ।

শেষের কথা

জাতীয় প্রয়োজনীয় ওষুধ তালিকা (২০২২) প্রকাশের পর থেকে যাঁরা আমাদের কাছে বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন তাঁদের জন্য কমরেড লেনিনের শিক্ষামালাকে আগে সামনে আনতে চাই -
’’যে কোনো নৈতিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক বচন, ঘোষণা ও প্রতিশ্রুতির পেছনে কোনো না কোনো শ্রেণীর স্বার্থ আবিষ্কার করতে না শেখা পর্যন্ত, লোকে রাজনীতির ক্ষেত্রে চিরকাল প্রতারণা ও আত্মপ্রতারণার নির্বোধ বলি হয়েছিল এবং চিরকাল তা থাকবেই।’’ (লেনিন। ‘‘মার্ক্সবাদের তিনটি উৎস ও উপাদান’’) (৫)

শ্রেণিবিভক্ত সমাজে এ শিক্ষামালা চিরন্তন সত্য। তাই সামগ্রিক আধিপত্যবাদের রাজনৈতিক বিচার-বিশ্লেষণ না-করে কেবল বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির বিরোধিতা আসলে ‘গাছের গোড়া রেখে ডাল কাটা’র সামিল। আমাদের মনে রাখতে হবে, রাজনৈতিক কাজ হচ্ছে সমস্ত অর্থনৈতিক কাজের প্রাণসূত্র। পুঁজিবাদীদের হাতে রাষ্ট্র মালিকানা ছাড়া বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানি আকাশচুম্বী মুনাফার পাহাড় ও সীমাহীন অনাচার ও দুর্নীতি করতে পারে না।

এক ধরনের মানুষ বা সংগঠন (বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা, এনজিও ইত্যাদি) জনগণকে নিরপেক্ষ ও অরাজনৈতিক রাখার নামে শাসকশ্রেণীর সমর্থক হিসেবে গড়ে তোলে, যা এক ধরনের অবৈজ্ঞানিক, রাজনৈতিক চর্চা!

প্রয়োজনীয় ওষুধের নতুন তালিকা দেশের রোগীদের চিকিৎসায় কতখানি উপকারে লাগবে তা বলা মুশকিল, কেননা অতীতে অমন তালিকা নিয়ে ওষুধ কোম্পানি, সরকার ও চিকিৎসকদের ভূমিকা আদৌ রোগীদের পক্ষে ছিল না। উপরন্তু ওষুধ বাজারে অপ্রয়োজনীয় ওষুধ ফর্মূলেশন বিক্রি এবং তার তালিকা দিন দিন প্রবলতর ও দীর্ঘতর হচ্ছে! আজও জনগণের বৃহত্তর অংশ মনে করেন সব চিকিৎসকের ওষুধ প্রয়োগ সঠিক, যুক্তিপূর্ণ ও বিজ্ঞানসম্মত! এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল ও অবাস্তব।


লেখাসূত্রঃ

(১) Union Minister for Health and Family Welfare as he launched National Lists of Essential Medicines (NLEM) 2022. 384 drugs have been included in this list with the addition of 34 drugs, while 26 from the previous list have been dropped. The medicines have been categorized into 27 therapeutic categories. (Google)

(২) MCI notification of April 6, 2002, the Indian Medical Council (Professional Conduct, Etiquette and Ethics, Regulation, 2002).

(৩) সোসাল ফার্মাকোলজি। প্রথম বুলেটিন। সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর, ২০০২। প্রকাশনাঃ সোসাইটি ফর সোসাল ফার্মাকোলজি। পশ্চিমবঙ্গ।

(৪) Politics of Essential Drugs: The Makings of a Successful Health Strategy: Lessons from Bangladesh. Zafrullah Chowdhury. Vistaar Publications. New Delhi. 1996.

(৫) Vladimir Ilyich Lenin. The Three Sources and Three Component Parts of Marxism. https://www.marxists.org/archive/lenin/works/1913/mar/x01.htm


ঋণ স্বীকারঃ

Social Pharmacology-Approach to a New Chapter. First Edition. 24th May, 2018. Society for Social Phamacology. West Bengal.