আরেক রকম ● দশম বর্ষ একবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ নভেম্বর, ২০২২ ● ১৬-৩০ কার্তিক, ১৪২৯

প্রবন্ধ

ভারতে ফেডারেলিজম কি বিপন্ন?

রজত রায়


ফেডারেলিজম (federalism), কোঅপারেটিভ ফেডারেলিজম (cooperative federalism), কমপিটিটিভ ফেডারেলিজম (competitive federalism) এবং সাব-ফেডারেলিজম (sub-federalism) কথাগুলি অনেকটা মন্ত্রের মতো করে দেশের রাষ্ট্রের কর্ণধাররা নিয়মিত আউড়ে থাকেন। দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে নীতি আয়োগের কর্তারা সবাই এই ফেডারেলিজমের কথা দেশবাসীকে শুনিয়ে থাকেন। কিন্তু সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাবলী দেখে মনে হয়, ফেডারেলিজমের ধারণাটিকে ধীরে ধীরে কিন্তু সচেতনভাবেই দেশের রাজনৈতিক দলগুলি ক্রমশ বিকৃত করতে শুরু করেছে, যা অদূর ভবিষ্যতে ফেডারেলিজমের ধারণাটিকে একেবারেই বদলে দেওয়ার আশঙ্কাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে।

এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা অনুযায়ী ফেডারেলিজমের সংজ্ঞা এই রকমঃ
It is a mode of political organization that unites separate states or other polities within a overarching political system in a way that allows each to maintain its own integrity. Federal system do this by requiring that the basic policies be made and implemented through negotiations in some form, so that all the members can share in making and executing decisions.

ভারতে নীতি আয়োগ একধরণের কমপিটিটিভ ফেডারেলিজম-এর চর্চা শুরু করতে উৎসাহ দিয়ে চলেছে, যা কিনা রাজ্যগুলি এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলি নিজেদের মধ্যে উন্নয়নের বিভিন্ন খাতে যাতে একটা স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব নিয়ে কাজ করে, সেদিকে জোর দিচ্ছে। বিশেষ করে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও এমন সব উন্নয়ন প্রকল্প যা দীর্ঘস্থায়ী হবে, সেইসব ক্ষেত্রে এই প্রতিযোগিতার ফল নির্ধারণের জন্য নির্দিষ্ট মাপকাঠিও তৈরি করে দিয়েছে। একই সঙ্গে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক, এবং আন্তঃরাজ্য সম্পর্ক যাতে বৈরীতামূলক না হয়, সে জন্য কোঅপারেটিভ ফেডারেলিজমের নীতি, অর্থাৎ সহযোগিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে চলার কথা বলা হয়ে থাকে।

ভারতীয় সংবিধানে যদিও ‘ফেডারেলিজম’ কথাটা নেই, তবুও সংবিধানের প্রথম ধারা শুরুই হয়েছে এই কথা দিয়ে - “India, that is Bharat, shall be a Union of states.” তাই সরাসরি ফেডারেলিজম বা যুক্তরাষ্ট্রীয় কথাটা লেখা না থাকলেও “Union of states” কথাটি থেকেই নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে এই ফেডারেলিজমের ধারণাটি সংবিধানের ভিত্তিতে বিধৃত। কিন্তু তা সত্ত্বেও সংবিধান কার্যকর হওয়ার পর থেকেই ভারতের শাসনব্যবস্থায় বেশির ভাগ ক্ষমতাই কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ন্যস্ত হয়ে এসেছে। ফলে, কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য নষ্ট হয়ে একটা অসম সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, যেখানে কেন্দ্রের উপর রাজ্যগুলি অনেকাংশেই নির্ভর করতে বাধ্য হয়ে পড়ে। এই অসম সম্পর্কের ফলে উদ্ভূত টানাপোড়েন এতটাই বেড়ে চলে যে ১৯৮৩ সালে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী অকংগ্রেসি বিরোধী দল শাসিত রাজ্যগুলির সম্মিলিত চাপের কাছে মাথা নত করে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক খতিয়ে দেখতে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি আর. এস. সারকারিয়াকে মাথায় রেখে একটা কমিশন করেন। ওই সারকারিয়া কমিশনের সুপারিশগুলির মধ্যে একাধিক প্রস্তাবেই ক্ষমতার বন্টনের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার একটা ক্ষীণ চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়।

কিন্তু সারকারিয়া কমিশনের সুপারিশগুলি কার্যকর করার জন্য ১৯৯১ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। তার আগেই অবশ্য ১৯৯০ সালে সারকারিয়া কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী আন্তঃরাজ্য পর্ষদ (Inter-State Council) গঠন করা হয়। তার ফলে রাজ্যসমূহের মধ্যে এবং কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে বিবদমান বিষয়গুলির মীমাংসাকল্পে আলাপ আলোচনার মঞ্চ হিসাবে ব্যবহারের প্রক্রিয়া শুরু হয়। আরও অনেক আগে থেকেই জাতীয় উন্নয়ন পর্ষদ (National Development Council) গঠিত হয়েছিল যোজনা কমিশনের সহযোগী মঞ্চ হিসাবে দেশের উন্নয়ন প্রকল্পের পরিকল্পনায় রাজ্যগুলির মতামত প্রকাশের ও আলোচনার জন্য। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার এই পর্ষদের বৈঠক খুব কমই ডাকত। পরিস্থিতির কিছুটা বদল হয় ১৯৯১ সালে। নির্বাচনী প্রচার চলাকালীন রাজীব গান্ধীর হত্যার পরে কংগ্রেস সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রী হন পি. ভি. নরসিমা রাও। কিন্তু লোকসভায় প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় তাঁকে সরকার টিকিয়ে রাখতে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে একটা অলিখিত বোঝাপড়ায় আসতে হয়। এর ফলে ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬, এই পাঁচ বছর কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের যথেষ্ট উন্নতি হয়। একই সময়ে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। নরসিমা রাও সরকারের অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংহের উদ্যোগে কংগ্রেস সরকার দেশের অর্থনীতিকে মৌলিক সংস্কার করে উদারপন্থী এবং বাজার অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত করতে শুরু করেন। এর ফলে কেন্দ্রের উৎসাহে রাজ্যগুলির মধ্যে দেশি-বিদেশি পুঁজিকে বিনিয়োগের জন্য আকর্ষণ করার এক প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। এই প্রতিযোগিতায় রাজ্যগুলি পুঁজি আকর্ষণের জন্য নানান আকর্ষণীয় অর্থনৈতিক উৎসাহদায়ী ছাড়ের প্যাকেজ ঘোষণা করতে শুরু করে। শেষে এমন অবস্থা হয় যে রাজ্যগুলির মধ্যে কে কত বেশি আকর্ষণীয় প্যাকেজ দিয়ে অন্যদের ছাপিয়ে বিনিয়োগ আনতে পারে, তার একটা অন্ধ প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। অন্য দিক থেকে দেখলে ভারতে সহযোগিতামূলক (cooperative) ফেডারেলিজম দ্রুত দুর্বল হতে থাকে।

গত কয়েক বছরে এমন কিছু ঘটনা ঘটে চলেছে যা ফেডারেলিজমের ধারণার সঙ্গে একেবারেই খাপ খায় না। কোঅপারেটিভ ফেডারেলিজম বা কমপিটিটিভ ফেডারেলিজম - কোনওটার সঙ্গেই নয়। এক নজরে এই পরিস্থিতিটা এই রকমঃ

১. ২০১৯ সালের ১৯ জুন সিবিআই অফিসারদের একটা দল তদানীন্তন কলকাতা পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারের সরকারি বাসভবনে যান তাঁর সঙ্গে সারদা চিট ফান্ড মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে কথা বলে কিছু তথ্যের সন্ধান পেতে। সুপ্রিম কোর্ট পশ্চিমবঙ্গের চিট ফান্ড মামলার তদন্ত ২০১৪ সালে সিবিআইয়ের হাতে ন্যস্ত করার আগে রাজ্য পুলিশ তদন্ত করছিল। রাজীব কুমার তখন স্পেশ্যাল ইনভেস্টিগেশন টিমের কর্ণধার ছিলেন। কিন্ত বার বার চাওয়া সত্ত্বেও সিবিআই তাঁর কাছ থেকে কিছু জরুরী তথ্যের সন্ধান পাচ্ছিল না। এই অবস্থায় সিবিআই রাজীব কুমারের বাড়িতে ঢুকতে চাইলে কলকাতা পুলিশ বাধা দেয়। তারা সিবিআই-এর দলটিকে স্থানীয় থানায় আটকে রাখে। ইতিমধ্যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেখানে ছুটে আসেন এবং একটু পরে এসপ্লানেডে ধর্ণায় বসেন। মমতার অভিযোগ, সিবিআইয়ের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকারের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে, যা সংবিধানবিরোধী কাজ। অন্যদিকে রাজ্য পুলিশের একটা বড় দল সিবিআই-এর কলকাতা অফিসের সামনে জড়ো হয়, সম্ভবত, রাজীব কুমারকে যাতে সেখানে না নিয়ে যেতে পারে সেজন্য। এভাবে পরিস্থিতি যথেষ্ট উত্তপ্ত হয়ে উঠলে রাজ্যপালের নির্দেশে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী দিয়ে সিবিআই অফিসারদের, এবং তাঁদের কলকাতা অফিসের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। যেটা লক্ষ্যণীয়, রাহুল গান্ধী, চন্দ্রবাবু নাইডু, মায়াবতী, মেহবুবা মুফতি প্রমুখ বিরোধী নেতানেত্রীরা এই ঘটনায় মমতাকে সমর্থন করে বিবৃতি দেন।

২. ২০২২ সালের ৭ মে হরিয়ানায় সে রাজ্যের পুলিশ একটা রোড ব্লক তৈরি করে পঞ্জাব পুলিশের একটা দলকে আটকায়। তারা দিল্লি থেকে বিজেপির যুব নেতা তেজিন্দার সিংহ পাল বাগ্গাকে তাঁর বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে মোহালি নিয়ে যাচ্ছিল। বাগ্গার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে হুমকি দিচ্ছিলেন। এই মর্মে তাঁর বিরুদ্ধে পঞ্জাবে একটা অভিযোগ দায়ের হওয়ার পর তাঁকে পঞ্জাব পুলিশ গ্রেফতার নিয়ে যাচ্ছিল। দিল্লিতে আপ দলের সরকার থাকলেও সে রাজ্যে পুলিশ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের অধীন। তাই পঞ্জাবে সদ্য সদ্য আপ সরকার ক্ষমতায় আসায় সেখানে অভিযোগ নথিভুক্ত হয়েছিল। যাই হোক, হরিয়ানা দিয়ে পঞ্জাব যাওয়ার সময় হরিয়না পুলিশ পঞ্জাব পুলিশের হাত থেকে বাগ্গাকে মুক্ত করে ছেড়ে দেয়।

৩. ২০২২ সালের ৩ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গ থেকে সিআইডি অফিসারদের একটা দল দিল্লি যায়। তারা দিল্লিতে সিদ্ধার্থ মজুমদার নামে এক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে গিয়েছিল। সম্প্রতি ঝাড়খণ্ডের তিন কংগ্রেস বিধায়ক পশ্চিমবঙ্গে প্রচুর নগদ টাকা সহ পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পরে আদালতের নির্দেশে ওই বিধায়কদের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিকে জেরা করতেই সিআইডি দলটি দিল্লি যায়। কিন্তু দিল্লি পুলিশ তাদের ওই ব্যক্তিকে জেরা করতে না দিয়ে থানায় নিয়ে আসে। দিল্লি পুলিশের দাবি, কলকাতার পুলিশ এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নিয়ম মেনে চলেনি।

৪. তবে এটি সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পশ্চিমবঙ্গ থেকে কয়লার চোরাচালান সংক্রান্ত তদন্তের স্বার্থে সিবিআই রাজ্যে কর্মরত নয় জন আইপিএস অফিসার এবং এক বা দুজন আইএএস অফিসারকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে দিল্লিতে ডেকে পাঠায়। এঁদের ডেকে পাঠানোর কারণ, বিভিন্ন সময়ে এঁরা পশ্চিমবঙ্গের কয়লাখনি এলাকায় প্রশাসনিক দায়িত্বে ছিলেন। এর পরই ২০২২ সালের ২৯ আগস্ট মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক জনসভায় হুমকি দিয়ে বলেন, দিল্লিতে পশ্চিমবঙ্গের ওই আইএএস এবং আইপিএস অফিসারদের প্রতি দুর্ব্যবহার করা হলে এ রাজ্যে কর্মরত কেন্দ্রীয় এজেন্সির অফিসারদের বিরুদ্ধে তিনি পাল্টা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে দ্বিধা করবেন না।

এরকম আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। যেমন -

৫. কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর কথা বিকৃত করে প্রচার করার জন্য একটা টিভি চ্যানেলের নিউজ অ্যাঙ্করের বিরুদ্ধে ছত্তীশগঢ় পুলিশ ও রাজস্থান পুলিশ মামলা দায়ের করে। ওই টিভি সাংবাদিক উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদের বাসিন্দা। ২০২২ সালের জুলাইয়ের গোড়ার দিকে ছত্তীশগঢ় পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করতে গাজিয়াবাদের বাড়িতেহাজির হলে সাংবাদিকটি উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথকে টুইট করে সে কথা জানানোর পরেই উত্তরপ্রদেশ পুলিশ ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে ছত্তীশগঢ় পুলিশকে বাধা দেয়, এবং তাঁকে যাতে কংগ্রেস শাসিত রাজ্যের পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে যেতে না পারে, তাই নিজেরাই আটক করে নেয়।

স্বাধীনতারও আগে থেকে কাবেরি নদীর জলবন্টনকে ইস্যু করে কর্নাটক ও তামিলনাড়ুর মধ্যে বিবাদ এখনও ধিকি ধিকি জ্বলছে। অতীতে এ নিয়ে বহু রক্তপাত, প্রাণহানিকর দাঙ্গা হয়ে গেছে। একইভাবে শতদ্রু, যমুনা সংযোগকারী খালের জলবন্টন নিয়ে পঞ্জাব ও হরিয়ানার মধ্যে বিবাদ চলছে।

শুধুই কি রাজ্যে রাজ্যে বিরোধ? জিএসটি বাবদ কেন্দ্র রাজ্যগুলিকে কতটা করে আর্থিক ক্ষতিপূরণ বছর বছর দেবে, তা আগে ঠিক হয়ে থাকলেও কেন্দ্র বেঁকে বসায় এখনও বিরোধ চলছেই। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে মহারাষ্ট্রে প্রস্তাবিত ১.৫ লক্ষ কোটি টাকার বেদান্ত ফক্সকন (Vedanta Foxconn) প্রকল্পটি গুজরাতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত প্রকাশ্যে এসেছে। ফলে মহারাষ্ট্রের কংগ্রেস, এনসিপি জোট কেন্দ্রের বিরুদ্ধে রাজ্যকে বঞ্চনা করার ও রাজ্যের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে সোচ্চার।

গোয়া, মধ্যপ্রদেশ, কর্নাটক ও মহারাষ্ট্রে বিরোধী দলের বিধায়কদের ভাঙ্গিয়ে এনে সরকার ফেলা ও ওইসব দলত্যাগীদের এনে বিজেপি দলের সরকার গড়ার খেলা তো এখন রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেইসঙ্গে বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই বা অন্য সহযোগী সংস্থাকে লেলিয়ে দেওয়াও এখন কেন্দ্রের একটা আবশ্যিক কর্তব্য হয়ে উঠেছে। গত আট বছরে নরেন্দ্র মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ১২৪ জন রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে গ্রেফতার ইত্যাদি করা হয়েছে। তার মধ্যে ১১৮ জনই (অর্থাৎ, ৯৫ শতাংশ) বিরোধী নেতা। কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের ১০ বছরের শাসনকালেও বিরোধীদের মুখ বন্ধ করার জন্য এ ভাবে তাঁদের ভীতি প্রদর্শনের রেওয়াজ ছিল। ইউপিএ সরকারের ১০ বছরে ৭২ জন রাজনৈতিক নেতাকে সিবিআইয়ের জালে জড়ানো হয়েছিল। তার মধ্যে ৪৩ জন (৬০ শতাংশ) ছিলেন বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা। তবে শুধুই যে কেন্দ্রের বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার এবং বিরোধী দল পরিচালিত রাজ্য সরকার, এবং দুই পরষ্পরবিরোধী রাজ্য সরকারের মধ্যেই এই সংঘর্ষের রাজনীতি এবং বৈরী মনোভাবের প্রকাশ পাচ্ছে, তা নয়। রাজ্যে ক্ষমতাসীন দল (তা বিজেপি, কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস বা অন্য বামপন্থীরা) সেই সেই রাজ্যে বিরোধী দলগুলিকে যেন তেন প্রকারেণ কোনঠাসা করতে যতটা সক্রিয়, সংসদীয় গণতন্ত্রের রীতি মেনে তাদের প্রাপ্য মর্যাদা ও পরিসর দিতে ততটা আগ্রহী নয়।

২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর স্লোগান দিয়েছিলঃ কংগ্রেস মুক্ত ভারত গড়তে হবে। এখন মনে হয় সেই স্লোগান শুধু কংগ্রেসে সীমিত নেই, বিরোধীমুক্ত ভারত গড়ার আওয়াজ তুলছে। আবার বিরোধী দলগুলির অনেকেই যারা নিজ রাজ্যে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ভোগ করছে, তারাও বিরোধী মুক্ত রাজ্য নির্মাণে সচেষ্ট। পশ্চিমবঙ্গে গত ১১ বছর ধরে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসই তার একটা জ্বলন্ত নজীর।

এইসব ঘটনা ও প্রবণতার মধ্যে একটা প্যাটার্ন ধরা পড়ে। সেটা হল যুক্তরাষ্ট্রীয় (federalism) ধারণার বিপরীতে হাঁটার চেষ্টা। অর্থাৎ, সহযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা (cooperative federalism) বা প্রতিযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা (competitive federalism) - এ সবের কোনটাই নয়, এখন যা হচ্ছে তা ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে (federalism)-ই আঘাত হেনে চলেছে। এক কথায় এই প্রবণতাকে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার বিরোধী (anti-federalism) বলে চিহ্নিত করা যায়। কী কেন্দ্র, কী রাজ্য, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল যে যেখানে ক্ষমতায় রয়েছে, তারাই এই যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার বিরোধী (anti-federalism) কাজ করে সংবিধানকে ভিতর থেকে দুর্বল করে চলেছে।