আরেক রকম ● দশম বর্ষ একবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ নভেম্বর, ২০২২ ● ১৬-৩০ কার্তিক, ১৪২৯

প্রবন্ধ

সঞ্জয় উবাচ


বিশ্বরূপ দর্শন

মহারাজ, এর আগে আপনাকে আমাদের ধর্মরাজ্যের একটি অঙ্গরাজ্যের কিঞ্চিৎ খবর নিবেদন করেছিলাম। তার পরে ধর্মরাজ্যের রাজধানীতে 'কর্তব্য পথ' নির্মাণের সংবাদও আমি আপনাকে পরিবেশন করেছি। কিন্তু মহারাজ, বিশ্বরূপ দর্শনের কিছু উপাদান আমার সামান্য সাধ্যে আমি সংগ্রহ করেছি। আপনার অনুমতি নিয়ে আজ সেটাই আপনাকে জানাতে চাই।

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই জানাবে আর আমি তা মন দিয়ে শুনবও বটে। কিন্তু তার আগে আমার জিজ্ঞাসা আছে, তুমি আমাদের ধর্মরাজ্য থেকে হঠাৎ কী কারণে মনোযোগ সরিয়ে নিয়ে বিশ্বে তা নিবদ্ধ করছ?

আপনার কাছ থেকে এ প্রশ্ন আমার অপ্রত্যাশিত নয়। তবে বিশ্বব্যাপারের আমি আর কতটুকুই বা বুঝি তবু আমার খেয়ালে যা আসে তা আমি আপনার কাছে অকপটে নিবেদন করব। মহারাজ, আমি প্রথমেই বলব, আজ বিশ্বায়নের পরে প্রায় তিরিশ বছর সময় কেটে গেল। অর্থাৎ সেদিনের সেই বিশ্বায়নও আজ দেখতে দেখতে তিরিশ বছরের পূর্ণ যৌবনে অভিষিক্ত। আজ তার কথায় মনোযোগ না দিয়ে আমাদের কোনো প্রসঙ্গেরই আমরা কোনো হদিশ পাব না। আজ বিশ্বে সবাই এক নাছোড় জালে জড়ানো। প্রিয় হোক, অপ্রিয় হোক, এ কথা আজ আমাদের মেনে নিতে হবে যে, অন্যের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে আজ কারো কোনো মঙ্গলচিন্তার কোনো মানে নেই। অথচ এই বিশ্বেই জাতীয় স্বার্থের নামে মাঝে মাঝে হুঙ্কার ছেড়ে আমরা যেসব কথা ভাবতে চাই তার বিশেষ কোনো দাঁড়াবার জায়গা নেই।

দেখ সঞ্জয়, তোমার এ দৃষ্টিভঙ্গি অসার তা আমি কখনো মনে করি না। কিন্তু এ কথাও তো তুমি মানবে যে, ওই জাতীয় স্বার্থের জিগির সামনে না তুলে ধরলে কেউ কোনো কথার কোনো মানে বুঝতে পারে না।

আমি তা জানি মহারাজ, আর সে জন্যেই আজ সে সমস্যা সোজাসুজি আপনার গোচরে আনার জন্য আমি সামান্য প্রস্তুতি নিয়ে এসেছি। আমি সরাসরি আপনাকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কথায় মনোনিবেশ করতে বলি। ভালো হোক, মন্দ হোক, সেদিনের সোভিয়েত তন্ত্র আজ ভেঙে গেছে এ কথা সরল মনে সবাইকে মেনে নিতে হবে।

সোভিয়েত তন্ত্র বলে তুমি কি সোভিয়েত রাষ্ট্রের থেকে আলাদা একটা কিছু বোঝাতে চাইছ?

হ্যাঁ, তন্ত্র বললে তাই বোঝায় বটে। আর তা না বোঝাতে চাইলে ওই কথাটা প্রয়োগ করার বিশেষ কোনো মানে হয় না তাও ঠিক। আচ্ছা, ঠিক আছে আমি আপাতত যে কথাটা বলতে চাই তার জন্যে এখনি তন্ত্র না বললেও হয়তো চলবে। তন্ত্র হল গোটা পূর্ব ইউরোপের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। ব্যবস্থা হিসেবেই যা পশ্চিম ইউরোপের সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতির কাঠামো থেকে ভিন্ন এবং সেই ভিন্নতাকে মনে করা হয় পশ্চিমি ব্যবস্থার বিকল্প। আর এই বিকল্প ব্যবস্থার মধ্যে নানারকমের ভেদাভেদ ও অন্তর্বিরোধ সত্ত্বেও সোভিয়েতের একটা নেতৃত্বের অবস্থান অবশ্যস্বীকার্য ছিল। এই নেতৃত্বের সুবাদেই গোটা বিকল্প ব্যবস্থাটাকে বলা যেতে পারে সোভিয়েত তন্ত্র আর যে-রাষ্ট্রীয় স্বরূপে ওই নেতৃত্বের অবস্থান সেটাই হল সোভিয়েত রাষ্ট্র। সেই সোভিয়েত রাষ্ট্রটাই ভেঙে গেল ১৯৯১-তে। অর্থাৎ, যতগুলি প্রজাতন্ত্র মিলে একদিন (হয়তো এক দিনে নয়) এই রাষ্ট্রটি গড়ে উঠেছিল তারা আর একসঙ্গে এক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় থাকতে চাইল না। আস্তে আস্তে আবার একদিন সেই প্রজাতন্ত্রগুলি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত হল। বুঝতেই পারছেন মহারাজ, এতবড়ো একটা বদল, সে ধাক্কার কাঁপুনি নানাভাবে নানা দিকে ছড়িয়ে পড়বে। হলও তাই।

একে তো আমি দৃষ্টিশক্তিহীন, তায় আমাদের এই ধর্মরাজ্যের গতিপ্রকৃতিতে এতই ব্যতিব্যস্ত থাকি যে আমি অকপটে স্বীকার করছি বিশ্বব্যাপারের খবরাখবরে আমি আর তেমন ওয়াকিবহাল নই। তুমি বিশ্বাস কর সঞ্জয়, এই বয়সে আমাদের ধর্মরাজ্যের এই কুটিল সংগ্রামে আমি আজ ঈষৎ ক্লান্ত, তোমাকেও যে আমি সংবাদের স্বার্থে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছি, এও আমার নিজেরই কাছে এক বিড়ম্বনা। নির্জন অবসরে নিজেরই অগোচরে নিজেকে আমি এই কর্মকোলাহলে মত্ততার জন্য ধিক্কার দিয়ে থাকি, সঞ্জয়।

আমি দুঃখিত, মহারাজ। যুদ্ধক্ষেত্রে আপনার চিত্তদৌর্বল্য উদ্রেককারী বর্ণনার জন্য আপনি আমাকে মার্জনা করুন।

তোমার কোনো অপরাধ নেই, সঞ্জয়। আমার চিত্তই আজ এই যুদ্ধের ন্যায়-অন্যায়ে বিধ্বস্ত। তুমি নিতান্ত এক উপলক্ষ মাত্র। বলো, অসংকোচে তোমার বিশ্ববৃত্তান্ত জানাও আমাকে।

রাষ্ট্র সোভিয়েতের বিলুপ্তির পরে সোভিয়েত তন্ত্রের যে-সামরিক জোটের নাম 'ওয়ারস চুক্তি', তারও অবসান হল। ওই সময়ে পশ্চিমি শক্তির যে-সামরিক জোটের নাম ন্যাটো (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অরগানাইজেশন), তারও অবসান সূচিত হওয়া হয়তো স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু তা হয়নি, মহারাজ। খুব ক্ষীণকণ্ঠে একটু আধটু কথাবার্তা না উঠেছিল এমন নয়। ন্যাটো এখন গুটিয়ে ফেললেই হয়। তা হয়নি। বরঞ্চ ন্যাটোর গায়ে তখন পুবো হাওয়া লাগল। ভেঙে-যাওয়া সোভিয়েত তন্ত্রের অনেকগুলো দেশ তখন ন্যাটোর সদস্য হয়ে গেল। আর সোভিয়েত রাষ্ট্রেরও অনেকগুলো প্রজাতন্ত্র ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত হল। ফলে রাশিয়ার চারপাশে ন্যাটোর মালা-গাঁথা ‘বৈরী’ রাষ্ট্রের সুসজ্জিত সমারোহ। পূর্বতন সোভিয়েত রাষ্ট্রের অন্তর্গত ইউক্রেন প্রজাতন্ত্র তার সমস্ত বিশিষ্টতা নিয়ে এখন আর রাশিয়ার বন্ধুরাষ্ট্র নয়। উপরন্তু সে আজ ন্যাটোর সদস্যপদ মর্যাদার অভিলাষী। পশ্চিমি শক্তি সে অভিলাষ পূরণে উদ্‌গ্রীব।

দেখ সঞ্জয়, আমি আজ বৃদ্ধ কুরুপিতা। আমি এই ধর্মরাজ্যের রাজনীতির ন্যায়-অন্যায় নিয়ে আজ বিব্রত। এই মহাযুদ্ধের প্রাঙ্মুহূর্তে মামকাঃ পাণ্ডবাশ্চৈব, যুযুধান দুই পক্ষের অবস্থান নিয়েই আমার নানা সংশয় দেখা দিচ্ছে। আমি চাই না যুদ্ধকালে সেইসব সংশয়ী প্রশ্ন কাউকে হতোদ্যম করে দিক। আমার পুত্রেরা আজ বিবদমান তা আমি জানি। কিন্তু তারা ক্ষাত্রধর্ম থেকে বিচ্যুত হোক তা আমি চাই না।

জানি মহারাজ, আপনার মনের অবস্থা আমার অননুমেয় নয় জানবেন।

থাক এসব কথা। তুমি ইউক্রেন যুদ্ধের যে-কথা আমাকে শোনাতে চেয়েছিলে তাই বলো।

আমার একটা বলার কথা ছিল এই যে, আজকের আধুনিক পৃথিবীতে সব যুদ্ধের ছায়াপাত সর্বত্র দেখা যাবে। এবং তা অতি সত্বর। তাই আজকের কোনো যুদ্ধ নিয়েই কেউ এই অবস্থান নিতে পারে না যে এটা আমার বা আমাদের ব্যাপার নয়। আজকের সব যুদ্ধই এক অর্থে বিশ্বযুদ্ধ।

তুমি শুধু আধুনিক কালের উপরে জোর দিচ্ছ কেন?

আধুনিক কালের পৃথিবীতে বড়ো বেশি করে সবাই সবার সঙ্গে জড়িয়ে আছি আমরা। বার্তা বিনিময় থেকে ভাইরাস বিনিময় পর্যন্ত এ কথা আজ প্রায় সমানভাবে প্রযোজ্য। এই যে আমাদের সাম্প্রতিক অতিমারির অভিজ্ঞতা। নাকি চীনদেশের উহান প্রদেশ থেকে শুরু। দেখলেন তো মহারাজ, কেমন করে দেখতে দেখতে হু হু করে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে দাপট করে চলেছে। নতুন কোনো স্ট্রেন আজ এখানে পাওয়া যাচ্ছে তো কাল ওখানে ছড়িয়ে যাচ্ছে। আজকের যাতায়াত, যোগাযোগ এবং বিশ্বের দেশগুলি যেভাবে কাঠামোগত দিক দিয়ে পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাতে একের সমস্যা অন্যের সমস্যায় রূপান্তরিত হতে সময় লাগে না। আজকের জীবনে বাণিজ্য থেকে শিক্ষাদীক্ষা সব এমন জড়িয়ে গেছে।

(মহারাজ কিঞ্চিৎ গম্ভীর। সঞ্জয় কিছুক্ষণের জন্য নীরব।)

দেখ সঞ্জয়, তুমি যা বলছ তাতে আমার পক্ষে এই মুহূর্তে হয়তো শুধু কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে মনোনিবেশ করাও শক্ত। কিন্তু ন্যায়-অন্যায়ের সংশয় নিয়ে যে-কথা আমি তোমাকে ইঙ্গিতে বলছিলাম তোমার কথায় তা আরো জোর পাচ্ছে। পশ্চিমি শক্তির পূর্ব দিগন্তের দিকে অভিযান বিষয়ে যা তুমি শোনালে তাতে তাদের দিক থেকে এটাকে বলতে হবে জয়োল্লাসের শামিল।

শুধু জয়োল্লাস নয় মহারাজ। এর মধ্যে স্পষ্ট রয়েছে জয়োদ্ধত ভূমিবাসনা।

তুমি কি বলতে চাও পশ্চিমি শক্তির তরফে ওই পূর্ব সুদূরে গিয়ে অন্যের রাজ্য দখলের বাসনা রয়েছে?

মহারাজ, আধুনিক কালের ভূমিবাসনায় অন্যের রাজ্যদখলই একমাত্র, অনেক সময়ে এমনকি প্রধান লক্ষ্যও, থাকে না।

তাহলে সে ভূমিবাসনার প্রকাশ হয় কিভাবে?

আধুনিক কালের পরিভাষায় তাকে বলা যেতে পারে 'স্ফিয়ার অব্‌ ইন্‌ফ্লুয়েন্স'। সে থাকবে আমার প্রভাবাধীন। তার স্বাধীনতা আমি অবশ্যই স্বীকার করি। কিন্তু তার থাকবে এক অদৃশ্য নীতিনিয়ামক। তার সার্বভৌমত্বেও আমার কোনো সমস্যা নেই। তার সব সিদ্ধান্ত তারই হবে। কিন্তু সেও জানে, আর অন্য সবাইও জানে, আর আমিও জানি কার সিদ্ধান্তের বসতি কোথায়।

তুমি যাকে আধুনিক পৃথিবী বলছ সঞ্জয়, সেখানে কি তাহলে প্রকৃত সার্বভৌমত্বের হানি হচ্ছে না?

হচ্ছে, সবাই তা জানে, মেনেও নিচ্ছে বা নিতে হচ্ছে। উচ্চাবচ পৃথিবীর বিশ্বায়নের এই অনিবার্য পরিণাম, মহারাজ। তাই জয়ী পক্ষের জয়োল্লাসে সংযম অবশ্য পালনীয়। সোভিয়েত তন্ত্রের বিলুপ্তির দিনে পুবের দিকে নতুন মৃগয়া ক্ষেত্রের সন্ধানে কোনো সংযমের পরিচয় ছিল না। তাই বলে ওইভাবে রাশিয়ার তরফে ইউক্রেন আক্রমণ করাও চলে না। সেও তো সার্বভৌমত্বেরই প্রশ্ন। স্বাধীন সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র ইউক্রেনের অধিকার আছে ন্যাটোর সদস্যপদ প্রার্থনার। অধিকার থাকলেই সে অধিকার সে প্রয়োগ করবে কিনা সেটা তাকেই ভাবতে হবে সংযত বোধবুদ্ধির বিচারে। মহারাজ, আপনার কুরুক্ষেত্রের মতো সব প্রশ্নই শেষ পর্যন্ত নীতি নৈতিকতার। আপনাকে বিষণ্ণ লাগছে, মহারাজ, আমি দুঃখিত। আপনার সংশয়ে কোনো সাহায্যের পরিবর্তে আমি হয়তো আপনার সংকট আরো বাড়িয়ে তুললাম।

না সঞ্জয়, তোমার মুখ থেকে সবকিছু শোনার জন্যেই আমি নিজেকে সাধ্যমতো প্রস্তুত করেছি।


(সৌরীন ভট্টাচার্য)