আরেক রকম ● দশম বর্ষ একবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ নভেম্বর, ২০২২ ● ১৬-৩০ কার্তিক, ১৪২৯

সমসাময়িক

হিন্দি আগ্রাসন বন্ধ হোক


সম্প্রতি ভারতীয় সংসদের সরকারি ভাষা সংক্রান্ত কমিটি, যার মাথায় আছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, রাষ্ট্রপতির কাছে একটি রিপোর্ট জমা দিয়েছেন যেখানে সুপারিশ করা হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্ত প্রযুক্তি ও অপ্রযুক্তি শিক্ষাকেন্দ্র, যেমন আইআইটি থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, সর্বত্র হিন্দি ভাষায় শিক্ষাদান করতে হবে, সমস্ত নির্দেশের মাধ্যম হবে হিন্দি ভাষা এবং ইংরেজি ভাষার ব্যবহার হবে ঐচ্ছিক। এই কমিটি এটিও সুপারিশ করেছে যে সমস্ত প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও আর বাধ্যতামূলকভাবে ইংরেজিতে করা যাবে না। সেখানে হিন্দি ভাষায় প্রশ্নের অবকাশ রাখতে হবে যাতে প্রতিযোগী চাইলে হিন্দি ভাষাতেই পরীক্ষা দিতে পারেন। কমিটি তাদের এই সিদ্ধান্তের যুক্তি হিসাবে টেনে এনেছেন ১৯৬৩ সালের সরকারি ভাষা আইনটিকে এবং পাশাপাশি নয়া শিক্ষানীতি ২০২০-কে।

এই আইনে বলা আছে, বলবত হওয়ার ১৫ বছর অবধি দেশের সরকারি কাজকর্মে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার চলবে। সংসদের কাজকর্ম থেকে শুরু করে সুপ্রিম কোর্টের কাজ অবধি ইংরেজি ভাষাতেই হবে। আইন বলবত হওয়ার ১০ বছরের ভেতর একটি সরকারি ভাষা সংক্রান্ত কমিটি সংসদে গঠন করতে হবে ৩০ জন সদস্যকে নিয়ে যারা সরকারি কাজকর্মের সর্বজনীন ভাষা হিসাবে হিন্দির ব্যবহারের ওপর একটি রিপোর্ট বানিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে জমা করবে। রাষ্ট্রপতি, সমস্ত রাজ্য সরকারগুলির মতামত শোনার পর সেই রিপোর্টের কতটা প্রযোজ্য হবে তার নির্দেশ দেবেন। এই আইন বিভিন্ন সরকারি কাজে হিন্দির প্রসার ঘটানোর এবং সমস্ত সরকারি নির্দেশনামায় ইংরেজির সাথে তার হিন্দি তর্জমাও যুক্ত করার কথা বলে। সমস্ত রাজ্য সরকারি কাজেও হিন্দি ভাষাকে যুক্ত করার সুপারিশ এই আইনে করা হয়। অর্থাৎ ভারতবাসীর কাছে হিন্দিকে সরকারি ভাষায় পরিণত করার প্রয়াসেই এই ১৯৬৩ সালের আইনটি রচিত হয়।

যদিও ১৯৬৩-র আইনে হিন্দি ও ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি রাজ্যের স্থানীয় ভাষাতেও সরকারি কাজকর্ম চালানোর সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এখান থেকেই ভারতে ত্রিভাষায় সরকারি কাজ করার প্রচলন। ইংরেজি, হিন্দি ও রাজ্যের নিজস্ব ভাষা, এই তিন ভাষাকেই সমগুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা করা হয় ১৯৬৩-র আইনে। ফলে আজকের আইন প্রণেতারা ১৯৬৩-র আইনের সাথে নয়া শিক্ষানীতিকে জুড়ে একটি মায়াজাল তৈরি করতে চাইছেন যাতে মনে হয় তাঁরা মাতৃভাষায় শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন। এই জন্যই তারা সর্বাগ্রে সুপারিশ করেছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাজকর্মে হিন্দি ভাষার প্রচলনের। যাতে গোড়াতেই একে হিন্দি আগ্রাসন বলে মনে না হয়, তাই তারা বলেছেন কেবল মাত্র ১৯৬৩-র আইন অনুযায়ী 'A' তালিকাভুক্ত রাজ্যের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য হিন্দি ভাষা হবে মুখ্য মাধ্যম। হিন্দির বাধ্যতামূলক ব্যবহার তারা 'B' বা 'C' তালিকাভুক্ত রাজ্যের জন্য নয় বলে দাবী করেছেন। এই রিপোর্ট প্রকাশ করতে গিয়ে তারা বলছেন, "আইআইটি গুয়াহাটিতে যেমন অসমিয়া বা হিন্দিতে পড়াশোনা হবে, তেমনই আইআইএম জোকাতে বাংলা বা হিন্দিতে পড়াশোনা হবে"। ভালো করে শুনলে বোঝা যায়, যে কোনো রাজ্যের জন্যই হিন্দি ভাষায় পড়াশোনা করানোর কথাটা বলে যাওয়া হচ্ছে। ফলে সংসদীয় কমিটি যতই মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের মত মহৎ উদ্দেশের কথা মুখে আওড়ে যান, লক্ষ্য তাদের হিন্দি ভাষাকে 'রাষ্ট্রভাষা' হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার। এমনকি রাষ্টপুঞ্জেও বর্তমান ভারত সরকার হিন্দিকে যুক্ত করার আবেদন নিবেদন চালিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ দুনিয়ার কাছেও ভারতবর্ষের মানুষের ভাষা হিসাবে হিন্দিকে প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ চলছে সমানে।

এই সুপারিশের পক্ষে কেন্দ্রের শাসকদলের লোকজন এই কথা বলতেই পারেন যে, এই সুপারিশ মোটেই হিন্দি ভাষাকে অন্য ভাষাভাষী মানুষের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে না, বরং তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষার জন্য উৎসাহ দিচ্ছে। আর প্রকাশ্যে না হলেও আস্তে আস্তে এরকম একটি প্রচার তারা চালাচ্ছেন যে, স্বাধীনতার এত বছর পরেও কেন আমরা একটি বিদেশী ভাষাকে দেশের বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করে যাব। কার্যক্ষেত্রে এই প্রচারের সামনে এমনকি প্রগতিশীল শিবিরও খানিক চুপ করে যান। কিন্তু প্রশ্ন হল এই যুক্তিগুলি ঠিক নাকি এক ধরণের ভাঁওতাবাজি। প্রথমত যদি ধরে নেওয়া যায় যে, কেন্দ্রের সরকার মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের জন্য উৎসর্গীকৃত প্রাণ, তাহলে প্রশ্ন আসে ক্ষমতায় আসার ৮ বছর পর ওনাদের বোধোদয় হল কেন? দ্বিতীয়ত যদি সত্যিই মাতৃভাষায় শিক্ষাদান করতে হয়, এমনকি উচ্চশিক্ষা স্তর অবধি তাহলে তার জন্য প্রয়োজন পাঠ্যপুস্তক নির্মাণ। সে কাজ মোটেও এক দিনের তো নয়ই বরং তার জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও নিরন্তর পরীক্ষা নিরীক্ষা প্রয়োজন। ভারতের সংবিধানে ২২টি ভাষাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এই প্রত্যেকটি ভাষাই আইনত ভারতের রাষ্ট্রীয় ভাষা যার মধ্যে কোনো একটি বিশেষ ভাষা (হিন্দি)-কে অগ্রাধীকার দেওয়া হয়নি। এ ব্যতীত আরো একাধিক প্ৰচলিত ভাষা রয়েছে যা কোনো না কোনো অংশের মানুষের মাতৃভাষা। তাহলে এতগুলি ভাষায় পাঠ্যপুস্তক নির্মাণের সামগ্রিক কোন পরিকল্পনা, ভাষা সংক্রান্ত কমিটি তাদের রিপোর্টে দিলেন না কেন?

হঠাৎ বলা হচ্ছে মধ্যপ্রদেশ সহ কিছু রাজ্যে হিন্দি ভাষায় ডাক্তারি পড়ানো হবে। তাহলে এই পাঠ্যপুস্তকগুলি তৈরী করা হল কবে? তাহলে কি আগাম লোকচক্ষুর অন্তরালে এই প্রক্রিয়া চলছিল? যদি তা হয়, তবে এই অযথা গোপনীয়তা কেন? নাকি তড়িঘড়ি রাজনৈতিক প্রচারের স্বার্থে এক অংশের ছাত্র-ছাত্রীকে গিনিপিগ বানিয়ে তাদের ভবিষ্যতের অন্তৰ্জলী যাত্রা করানো হবে? যদি কেন্দ্রের সরকারের এহেন সৎ মানসিকতা থেকেই থাকে তাহলে কেন্দ্রীয় বাজেটে এই খাতে বরাদ্দ কোথায়? শিক্ষা সংবিধান অনুযায়ী, রাজ্য ও কেন্দ্রের যৌথ তালিকাভুক্ত। তাহলে এই সংসদীয় কমিটি রাজ্যগুলির সাথে আগাম আলোচনা না চালিয়ে এরকম সুপারিশ করলেন কেন? আসলে না ওনাদের শিক্ষা নিয়ে মাথাব্যথা আছে, না আছে মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের সদিচ্ছা। ওনাদের মতলব, সংবিধানের অংশকে নিজেদের সুবিধার্থে ব্যবহার করে 'হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান'-এর রাজনৈতিক পরিকল্পনা সার্থক করা। তাই ইংরেজি বাতিল করে বিকল্প হিসেবে হিন্দিতে পড়ানোর সুপারিশ, এবং মাতৃভাষায় পড়ানোর জন্য পর্যাপ্ত সময় না দিয়েই এই সুপারিশকে আইনে পরিণত করে দেওয়া। আর যদি প্রশ্ন আসে, ভারতবর্ষের বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষের ভেতর যোগাযোগের সাধারণ ভাষা কোনো ভারতীয় ভাষা হবে, ইংরেজি নয়, তাহলে বলতেই হয়, বর্তমান দুনিয়াতে শিক্ষা কেবল একটি দেশের সীমানায় আটকে থাকে না। এখানকার ছাত্র-ছাত্রীরা যেমন অন্য দেশের থেকে শিক্ষা নেবে, তেমনই প্রয়োজনে নিজের অর্জিত জ্ঞান অন্যদেশের ছাত্রসমাজের জন্যও প্রকাশ করবে। ফলে আমরা চাই বা না চাই, একটা সময়ের পর বহির্বিশ্বের মানুষের সাথে তাকে যোগাযোগ করতেই হবে। ফলে একটি আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ভাষা এদেশের ছাত্র-ছাত্রীদের শিখতেই হবে। ঐতিহাসিক কারণে সেই ভাষা অনেকের পছন্দ না হলেও সেটা ইংরেজি ভাষাই। ফলে সেই ভাষাকে অচ্ছুৎ করার কিছু নেই। বরং একটি জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষাকে সবার ঘাড়ে জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার চাইতে একটি আন্তর্জাতিক ভাষাকে মেনে নেওয়া যুক্তিগ্রাহ্য।

বস্তুত আমাদের দেশ যে ইউরোপীয় দেশগুলির মত নয়, বরং এটা আসলেই একটা যুক্তরাজ্য, এবং স্বাধীনতার পর মূলত ভাষা ও সংস্কৃতিগত ঐক্য থেকেই রাজ্যগুলির আজকের রূপ একথা আমাদের দেশের বর্তমান শাসকদল ও তার সমর্থকরা যত দ্রুত বুঝতে শিখবেন ততই মঙ্গল। ফলে গায়ের জোরে এক দেশ, এক ভাষা, এক ধর্ম, এক জাতি এই জাতীয় চটকদারিত্বে না মেতে দেশটি মানুষের প্রকৃত সমস্যার দিকে মনোযোগ দিলেই কাজের কাজটি হয়। তবে ফ্যাসিস্টদের ঐতিহাসিক চরিত্র যে তারা ভ্রান্ত রাজনীতির জন্য, মানুষের মৌলিক সমস্যার কোন সমাধান হাজির করে না, বরং বিভিন্ন চটকদারী সিদ্ধান্ত নিয়ে একটা মনোহারি রাজনীতির বাতাবরণ তৈরী করে মানুষকে উত্তেজিত করে তোলেন। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরাই এত অপ্রস্তুত অবস্থায় যে তাঁরা এর বিরুদ্ধে কোনো অর্থবহ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছেন না। এমন অবস্থায় এ দেশের নাগরিক সমাজকেই দায়িত্ব নিতে হবে এই ধরণের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ গড়ে তোলার। ইতিমধ্যেই দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলিতে সাধারণ মানুষ ও রাজ্য সরকারগুলো এই সুপারিশের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছে। যদিও এটা খুবই দুঃখের বিষয়, যে জাতি মাতৃভাষার জন্য শহীদ হয়েছে, সেই বাঙালিদের মধ্যে এই বিষয় নিয়ে না রয়েছে কোন আলোচনা, না কোনো জনমত। আর এ রাজ্যের সরকার তো নিজের দুর্নীতি নিয়েই মশগুল। এ রাজ্যের শিক্ষিত সমাজ যদি অবিলম্বে এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত করতে না পারেন এবং রাজ্যের সরকারকে বাধ্য করতে না পারেন এই সুপারিশের বিরুদ্ধে বিধানসভায় প্রস্তাব পাশ করাতে তাহলে বাঙালি নিজের ঐতিহ্য ভুলে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানই জপবে।