আরেক রকম ● দশম বর্ষ একবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ নভেম্বর, ২০২২ ● ১৬-৩০ কার্তিক, ১৪২৯

সম্পাদকীয়

বিজয়া, ভাইফোঁটা ইত্যাদি


প্রতি বছরই দুর্গাপূজার পর কোনো এক সন্ধ্যায় পাড়ায় পাড়ায় বিজয়া সম্মিলনীর আয়োজন করা হয়। সর্বজনীন পুজোর উদ্যোক্তাদের উদ্যোগেই এই অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। এটাই দীর্ঘদিনের প্রচলিত রীতি। পশ্চিমবঙ্গের যে ৪৩ হাজার পুজোর উদ্যোক্তারা এই বছর রাজ্য সরকারের কাছ থেকে ৬০ হাজার টাকা অনুদান পেয়েছেন তাঁরাও নিশ্চয়ই বিজয়া সম্মিলনীর আয়োজন করেছিলেন।

সবাইকে অবিশ্যি ছাপিয়ে গেল একটি বিশেষ বিজয়া সম্মিলনী। শিলিগুড়ির কাওয়াখালির মাঠে ১৯শে অক্টোবর সন্ধ্যায় নয়, ভর দুপুরে উত্তরবঙ্গের আট জেলার ক্লাব, বিভিন্ন সংগঠন, বণিকসভা এবং আমন্ত্রিতদের নিয়ে রাজ্য সরকারের উদ্যোগে আয়োজিত হয়েছিল বিজয়া সম্মিলনী। প্রশাসনের সক্রিয়তায় সরকারি অর্থে জেলাগুলি থেকে আমন্ত্রিত অতিথিরা বিলাসবহুল বাস অথবা গাড়িতে অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হয়েছিলেন। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘গ্রেটার কোচবিহার পিপলস অ্যাসোসিয়েশন’ বা চলতি ভাষার ‘গ্রেটার’ নেতা স্বঘোষিত ‘মহারাজ’ অনন্ত রায় ও দার্জিলিং-এর বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন প্রজাতান্ত্রিক মোর্চার নেতা অনীত থাপা। বিমল গুরুং অবিশ্যি অনুপস্থিত। তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল কিনা তা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়নি।

মঞ্চের এক পাশে, অনন্ত ‘মহারাজ’, অন্য পাশে অনীত থাপা। মধ্যমণি অবশ্যই মুখ্যমন্ত্রী। বিজয়া সম্মিলনীর মঞ্চে তাঁদের সামনেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে দিলেন, বাংলা ভাগের প্রশ্ন নেই। বললেন, ‘‘...কোনও ভাগাভাগি নয়। কোনও বঙ্গভঙ্গ নয়। আমরা চাই সঙ্গ।...’’ তার পরেই মুখ্যমন্ত্রীর প্রশ্ন, ‘‘সবাই কি কিছু বুঝতে পারলেন? বঙ্গ চায় সঙ্গ।’’

এরপরই উচ্চারিত হয় গত এগারো বছরের সেরা অনৃত বাণী। ‘‘...কেউ কেউ বাজে কথা বলে বেড়াচ্ছে, আমি নাকি সিঙ্গুর থেকে টাটাকে তাড়িয়েছি। টাটাকে তাড়িয়েছে সিপিএম।...’’

মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণের পর অনন্ত প্রথমে বলেন, ‘‘আমরা এখনও আলাদা রাজ্য অথবা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল চাই। মুখ্যমন্ত্রীর এক্তিয়ারের বিষয় নয় সেটি। তাঁর দেওয়া, না দেওয়ার ব্যাপার নেই।’’ পরে আবার বলেন, ‘‘আমি বঙ্গভঙ্গ চাই না, চাই কোচবিহার রাজ্য পুনর্গঠন করা হোক।’’ পশ্চিমবঙ্গের অঙ্গহানি না করে কীভাবে কোচবিহার রাজ্য পুনর্গঠন করা হবে সে বিষয়ে অবিশ্যি অনন্ত কিছুই বলেননি। তবে অনীত থাপা নতুন করে এ নিয়ে কিছু বলতে চাননি।

কিছু দিন আগেই অনন্ত দাবি করেছিলেন, খুব শিগগিরই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হতে চলেছে কোচবিহার। জানিয়েছিলেন, তাঁর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথাও হয়েছে। অন্য দিকে, গত মে মাসে পাহাড়ে জিটিএ ভোটের পর প্রথম বোর্ড-সভায় অনীত থাপারা আলাদা গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের ব্যাপারে আলোচনা প্রক্রিয়া চালু করার সমর্থনে প্রস্তাব পাশ করেন। সেখানে পাহাড়ের তৃণমূল জিটিএ বোর্ড সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন। এবং তাঁরা প্রস্তাবের বিরোধিতা করেননি।

এই প্রথম নয়, গ্রেটারের নেতাদের সঙ্গে প্রকাশ্য মঞ্চে এর আগেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে দেখা গেছে। ২০২২-এর ফেব্রুয়ারিতে চিলা রায়ের ৫১২তম জন্মদিবস উদযাপনের জনসভায় কোচবিহারের সিদ্ধেশ্বরী গ্রামে অনন্ত সহ গ্রেটারের সমস্ত শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে একই মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। সেই জনসভায় মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেন, কোচবিহার ২ নম্বর ব্লকের বাবুরহাট ও ঝিনাইডাঙার মাঝে বসবে ১৫ ফুট উঁচু চিলা রায়ের মূর্তি। তাঁর নামে একটি 'কমিউনিটি হল'ও হবে। নিউ বাণেশ্বর রেলস্টেশন থেকে সিদ্ধেশ্বরী গ্রাম পর্যন্ত নবনির্মিত রাস্তার নাম হবে 'মহাবীর চিলা রায় রোড'।

সেদিনের অনুষ্ঠানস্থলে আসার পথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে অনন্তের অনুগামীরা মুখ্যমন্ত্রীকে স্বাগত জানায়। আর গুয়াপান ও গামছা দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে মঞ্চে বরণ করেন অনন্ত ‘মহারাজ’। অনুষ্ঠানের মধ্যেই মুখ্যমন্ত্রী অনন্তকে প্রস্তাব দেন, সাদা পোশাক পরিহিত স্বেচ্ছাসেবকদের তিনি রাজ্য পুলিশের 'নারায়ণী সেনা' ব্যাটালিয়নে অন্তর্ভুক্ত করতে চান।

মুখ্যমন্ত্রী অবিশ্যি অনন্তের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রত্যাহারের বিষয়ে সেদিন কোনো কথা বলেননি। এবারের বিজয়া সম্মিলনীর অনুষ্ঠানেও বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। পক্ষান্তরে অনন্ত ‘মহারাজ’ কিন্তু নিজের দাবিতে নিশ্চল। ফেব্রুয়ারিতে যেমন বলেছিলেন অক্টোবরেও সেই একই কথা বললেন, - পৃথক কোচবিহার রাজ্য, নিদেনপক্ষে কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল তৈরি করতেই হবে। তিনি আরও জানিয়েছেন পৃথক রাজ্য অথবা কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল তৈরির ক্ষমতা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নেই। যা করার ভারত সরকার করবে। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে নাকি তাঁর নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে।

কথাটা নিছক কথার কথা নয়। অনন্তকে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে এক মঞ্চে একাধিক বার দেখা গিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থেকে নিজেকে বাঁচাবার জন্য বছর কয়েক আগে আসামের এক প্রত্যন্ত গ্রামে অনন্ত প্রায় অজ্ঞাতবাসে চলে গেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সাম্প্রতিক নির্বাচনের আগে দেশের অমিত পরাক্রমশালী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দুর্গম পথ পেরিয়ে সেই প্রান্তিক গ্রামে অনন্তর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। দীর্ঘ আলোচনার পর অবিশ্যি সরকারি বিবৃতিতে বলা হয়েছিল যে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সেখানে প্রাতঃরাশ করতে গিয়েছিলেন। আর অনন্ত বলেছিলেন যে, পূর্ব নির্ধারিত দিনক্ষণ অনুযায়ী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এসেছিলেন। সত্যি সত্যিই কী আলোচনা হয়েছিল তা জানা যায়নি। তবে ‘গ্রেটার কোচবিহার পিপলস অ্যাসোসিয়েশন’ (জিসিপিএ)-এর ঢালাও সমর্থন গেরুয়া শিবির পেয়েছিল বলেই ধারণা করা হয়। কারণ কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার প্রভৃতি জেলাগুলিতে অধিক সংখ্যক গেরুয়া বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন।

এতকিছুর পরেও কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিচলিত নন। অনন্তকে তিনি ভাইফোঁটার উপহার পাঠান। অনন্তও পাল্টা উপহার পাঠান। সংবাদমাধ্যমে এইসব খবর যথেষ্ট যত্ন নিয়ে গুরুত্ব সহকারে প্রচারিত হয়। কিন্তু কেন এত তোয়াজ অথবা খাতিরদারি তার কোনো ব্যাখ্যা করা হয় না।

একই সঙ্গে আসামের মুখ্যমন্ত্রী দীর্ঘকাল ধরে অন্য বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘কামতাপুর লিবারেশন অর্গানাইজেশন’ (কেএলও) নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। পলাতক এবং দেশান্তরী কেএলও নেতার সঙ্গেও নাকি নিয়মিত টেলিফোন মারফত যোগাযোগ হয়। একটি রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান একজন পলাতক জঙ্গি প্রধানের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা সত্ত্বেও দেশদ্রোহিতার অভিযোগ ওঠে না।

সবমিলিয়ে এ এক আশ্চর্য সমীকরণ। কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসকদলগুলি বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গি সংগঠনগুলির সঙ্গে সবসময়ই সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। অথচ মূলধারার সংবাদমাধ্যম বিষয়টি নিয়ে সোচ্চার নয়। এমন একটি ভয়াবহ ও সুদূরপ্রসারী সমস্যা কোনো এক অজ্ঞাত কারণে সংবাদমাধ্যমের নজর এড়িয়ে যায়। বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গি সংগঠনগুলিকে নিরন্তর প্রশ্রয় দেওয়ার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানের কোনো প্রচেষ্টা নেই। অথচ ঘটনা পরম্পরার উপর নজর রাখলেই বোঝা যায় যে শাসকের জনবিরোধী নীতির প্রতিবাদে গণ আলোড়ন শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গি গোষ্ঠীগুলি প্রকাশ্যে সক্রিয় হয়ে পড়ে। শুরু হয় হানাহানি। বিধ্বস্ত হয় সমাজ-সভ্যতা।

কাজেই বিজয়া সম্মিলনী ভাইফোঁটা সব নিয়ম মেনেই চলবে। সুকুমার রায়কে স্মরণ করে তিনি এবং তাঁরা ভাবতেই পারেন -
‘...ছুটলে কথা থামায় কে?
আজকে ঠেকায় আমায় কে?...
’’

তবে তাঁর খেয়াল রাখা দরকার যে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ কিন্তু বুঝতে পারে কে তাদের ঠকাচ্ছে। তখন কিন্তু মানুষের আলোড়ন ঠেকানো যাবে না।